কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের ইতিহাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, খ্রী. ২০০০

কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের ইতিহাস হল তার নিজস্ব আদি সভ্যতা, ফরাসী এবং স্বাধীনতা-উত্তর সভ্যতার সংমিশ্রণ।

বান্টু ও পিগমী[সম্পাদনা]

বর্তমান কঙ্গোর আদি বাসিন্দা হল বাম্বুতি জনগোষ্ঠীর মানুষ। প্রস্তর যুগের উপজাতি পিগমী-দের সাথে এই বাম্বুতি জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক আছে। তারা প্রায় ২,০০০ বছর আগে কঙ্গোর (গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের) উত্তর অঞ্চল থেকে আসা বান্টু উপজাতিদের প্রভাবে ধীরে ধীরে লৌহ যুগে প্রবেশ করে। এই অঞ্চলের প্রধান বান্টু উপজাতিরাই হল কঙ্গো, যা বাকোঙ্গো নামেও পরিচিত। তারা কঙ্গো নদীর উত্তর ও দক্ষিণে উৎস বরাবর কিছুটা দুর্বল এবং ক্ষণস্থায়ী একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই কঙ্গোলীয় রাজ্যের রাজধানী ছিল ম্‌বাঞ্জা কঙ্গো। পরবর্তীকালে পর্তুগিজদের সময়ে সীমান্ত-শহর সাও সালভাদোর হিসাবে পরিচিত হয়।

রাজধানী থেকে তারা বর্তমান আঙ্গোলা, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের কঙ্গোকে নিয়ে গঠিত একটি সাম্রাজ্য শাসন করত। নিকটবর্তী উপনদী-বিধৌত রাজ্যগুলিতে শাসন করতে, প্রায়ই কঙ্গো রাজারা তাঁদের পুত্রদের সে রাজ্যগুলির প্রধান হিসাবে নিয়োগ করতেন। এমন ছয়টি প্রদেশ ছিল ম্‌বেম্বা, সোয়ো, ম্‌বাম্বা, ম্‌বাটা, ন্‍সুন্দি এবং ম্‌পাঙ্গু। সঙ্গে ছিল উপনদী-বিধৌত উত্তরে লোয়াঙ্গো রাজ্য এবং দক্ষিণে ম্‌বুন্দু রাজ্য। সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে ছিল কঙ্গো নদী-র উপনদী কাওঙ্গো নদী। জানা যায় ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ বাসিন্দার এই সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল ৩,০০,০০০ কিমি। জনশ্রুতি আছে, ১৪০০ খ্রীষ্টাব্দে এই সাম্রাজ্যের পত্তন হয় যখন রাজা লুকেনি লুয়া নিমি, কাবুঙ্গা রাজ্য দখল করে ম্‌বাঞ্জা কঙ্গো-তে রাজধানী স্থাপন করেন।

পর্তুগিজ অভিযান[সম্পাদনা]

প্রথম ইউরোপীয় সংস্পর্শে আসার সময় কঙ্গো অঞ্চল

ইউরোপীয়রা প্রথম পদার্পণের পরপরই লৌহ যুগ-এর আফ্রিকা এক প্রচন্ড চাপের সম্মুখীন হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথম ইউরোপীয় ছিল পর্তুগিজ অভিযাত্রীদল। প্রাচ্য বাণিজ্যে ভেনিশীয় এবং অটোমান নিয়ন্ত্রণ ভেঙে পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জন এশিয়ার সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে আফ্রিকা উপকূলের দক্ষিণে একাধিক অভিযানের আয়োজনের চেষ্টা করেন। ১৪৮২-১৪৮৩ সালে কঙ্গো নদী-র দক্ষিণে যাত্রা করে, ক্যাপ্টেন ডায়োগো কা, তখনো পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত ঐ নদীর উৎস মুখটি আবিষ্কার করেন। তিনিই ছিলেন কঙ্গো সাম্রাজ্য-র সাথে সংঘর্ষে প্রথম ইউরোপীয়।

প্রথম দিকে এই সম্পর্ক ছিল খুবই সীমিত স্তরে এবং বিবেচিত হয়েছিল উভয় পক্ষের উপকারী বলে। স্থানীয় আভিজাতরা খ্রিস্টধর্ম-কে সহজেই গ্রহণ করেছিল। ৩ মে ১৪৯১ সালে রাজা নাজিঙ্গা ন্‍কুয়া ছিলেন প্রথম খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণকারী কঙ্গো রাজা প্রথম জোও। ১৫০৭ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র ন্‌জিংগা ম্‌বেম্বা, রাজা প্রথম আফোনসো উপাধি নিয়ে ১৫৪৩ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। তাঁর শাসনাকালে সে দেশে খ্রিস্টধর্ম একটি দৃঢ় ভিত্তি লাভ করে। ম্‌বাঞ্জায় অনেক গীর্জা নির্মিত হয়, যার মধ্যে কুলুম্বিম্বি ক্যাথেড্রাল (১৪৯১ থেকে ১৫৩৪ সালের মধ্যে নির্মিত) ছিল সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক। তাত্ত্বিকভাবে পর্তুগাল এবং কঙ্গোর রাজা সমান ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে চিঠিপত্রের বিনিময় চলত। কঙ্গো এক সময়ে এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ভ্যাটিকান-এর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল এবং পোপ এই অঞ্চলের বিশপ হিসাবে স্থানীয় ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেছিলেন।

বিদ্রোহ[সম্পাদনা]

পর্তুগিজ শাসনের বিরুদ্ধে একের পর এক বিদ্রোহের মধ্যে ম্‌বয়াইলার যুদ্ধ এবং কিম্পা ভিটার নেতৃত্বে বিদ্রোহ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। খনির অধিকার নিয়ে পর্তুগিজ প্রশাসনের পক্ষে গভর্নর আন্দ্রে ভিদাল ডি নেগ্রিরোস এবং কঙ্গো রাজা প্রথম আন্তোনিয়ো-র দ্বন্দ্বের ফল ছিল ম্‌বয়াইলার যুদ্ধ (বা আম্বুইলার যুদ্ধ বা উলাঙ্গার যুদ্ধ)। কঙ্গো অধিপতি পর্তুগিজদের অতিরিক্ত আঞ্চলিক অধিকার দিতে অস্বীকৃত হওয়ায় এবং তার আগে ঐ অঞ্চলে কঙ্গো-রাজা ডাচদের আগ্রাসনে সমর্থন করায় পর্তুগিজরা ক্ষুণ্ণ ছিল। ১৬৬৫ সালের ২৫ অক্টোবর যুদ্ধের সময় আনুমানিক ২০,০০০ কঙ্গোসেনা পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, এবং ঘটনক্রমে যুদ্ধের প্রথম ভাগেই কঙ্গো-রাজা [[Afonso I|]প্রথম আফোনসো]-র মৃত্যু হয়।

কিম্পা ভিটা-র বিদ্রোহ ছিল পর্তুগিজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের আরেক প্রচেষ্টা। ১৬৮৪ সালের দিকে ডোনা ব্যাট্রেইস, হিসাবে ব্যাপটিস্ট গ্রহণের পর, কিম্পা ভিটা ক্যাথলিকভাবে বেড়ে উঠতে থাকেন। অত্যন্ত ধার্মিক কিম্পা সেন্ট অ্যান্টনির দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুপ্রাণিত হয়ে নান হন এবং কঙ্গোর হৃত গৌরব পুরুদ্ধার করতে বাকি জীবন উৎসর্গ করেন। সে সময় স্থানীয় কঙ্গো আভিজাতদের মধ্যে তিন জন, জোওও দ্বিতীয়, পেড্রো চতুর্থ এবং পেড্রো কিবেনগা প্রত্যেকে নিজেকে কঙ্গোলিজ সিংহাসনের দাবীদাররূপে তুলে ধরলে গৃহযুদ্ধ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। আন্তোনিয়োর দৈববাণী আন্দোলন সংগঠন করে কিম্পা সরাসরি গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। এতে তিনি পর্তুগিজদের প্রিয়পাত্র পেড্রো চতুর্থের বিপক্ষে অবস্থান নেন। বিদ্রোহ চলার সময় খুব স্বল্পকাল তিনি রাজধানী ম্‌বাঞ্জা কঙ্গো দখল করেন। চতুর্থের বাহিনীর হাতে তিনি বন্দী হলে, কাপুচিন ফ্রিয়ার্স বা কাপুচিন মিশনারিদের প্ররোচনায় কিম্পাকে জাদুকরী ও ধর্মবিরোধী বলে অপবাদ দিয়ে, নিন্দা করে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। তাই অনেকের কাছেই তিনি হলেন জোয়ান অফ আর্ক-এর আফ্রিকান সংস্করণ এবং উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আফ্রিকান প্রতিরোধের প্রথম মূর্ত প্রতীক। কারণ তাঁর স্পষ্টবাদীতার জন্য, তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। [১][২]

ছিন্ন-ভিন্ন কঙ্গো[সম্পাদনা]

কঙ্গো সাম্রা্জ্য, খ্রী. ১৭০০

এই সমস্ত যুদ্ধের ফলস্বরূপ উত্তরের লোয়াঙ্গো রাজ্যটি কঙ্গো থেকে বেরিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। এছাড়াও নতুন যে রাজ্যগুলির অস্তিত্ব ছিল তার মধ্যে টেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা বর্তমান ব্রাজাভিল এবং কিনশাসা-কে ঘিরে একটি বিশাল অঞ্চল শাসন করত। ১৫৮০ সালে যখন স্পেন ও পর্তুগালের রাজ্যগুলি কিং ফিলিপ-এর অধীনে একটি ব্যক্তিগত ইউনিয়ন-এ একত্রিত হয়ে ইবারিয়ান ইউনিয়ন গঠন করেছিল। ফলে সে সময় তার অবস্থান নিয়ে পর্তুগাল-কে ইউরোপ-এ এক বড় ধরনের পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে হয়। ঐ ইউনিয়ন ১৬৪০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। তাই সে সময় পর্তুগালের পক্ষে কঙ্গো নদীর উৎসমুখ সহ চারপাশের অঞ্চল খুব কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। ১৮৮৮ সালে পেড্রো পঞ্চম-এর সময় তার আকার হ্রাস পেতে পেতে অ্যাঙ্গোলা-র উত্তরে একটি ছোট ছিটমহলের আকার নেয়। অবশেষে ১৯১৪ সালের কঙ্গোলিজ বিদ্রোহের পরে ক্ষুদ্র পর্তুগিজ রাজ্যটির বিলোপ ঘটে।

ফরাসি শাসন[সম্পাদনা]

কাঁচামালের জন্য হুড়োহুড়ি[সম্পাদনা]

বার্লিন সম্মেলন অবধি আফ্রিকা মহাদেশের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে ও বাড়াতে ইউরোপীয় প্রধান শক্তিধর দেশগুলি সেখানে ভিড় বাড়াতে শুরু করেছিল। পশ্চিম ইউরোপের পুঁজিবাদী উথ্থান এবং তারই ফলে উদ্ভূত শিল্পায়ন বা শিল্প বিপ্লব-এর জন্য আফ্রিকান কাঁচামাল যেমন রাবার, পাম তেল এবং তুলো-র চাহিদা ক্রমেই বাড়তে থাকে। যাদের হাতে এই কাঁচামালের নিয়ন্ত্রণ থাকবে, তাদের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। এই কারণে নতুন করে আফ্রিকার কাঁচামালের জন্য হুড়োহুড়ি আরও তীব্র আকার ধারণ করে।

তাই কঙ্গো নদী অববাহিকা অঞ্চলটির দখল, ইউরোপীয় দেশগুলির কাছে মুখ্য লক্ষ্য হয়ে ওঠে। ফরাসী, বেলজিয়ান রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ড, পর্তুগিজ এবং ব্রিটিশদের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগে এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই চালাতে থাকে। এর ফলে, কঙ্গো নদীর উৎসমুখ থেকে আটলান্টিক উপকূল পর্যন্ত অঞ্চলের মধ্যে পর্তুগাল পায় নদীর উত্তরাংশের কাবিন্দ। ফরাসীরা দখলে রাখে নদীর উত্তরাংশের বাকি বিরাট অঞ্চল। বেলজিয়ান রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ড নদীর উৎসমুখের ছোট্ট একটি পাদদেশ পেলেও তিনি দখলে পেয়েছিলেন বর্তমান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো (পূর্বতন জাইর)-র বিশাল উপকূলের পশ্চাৎভূমি। এর মাধ্যমে দ্বিতীয় লিওপল্ড তাঁর আন্তর্জাতিক আফ্রিকান সমাজ এবং পরবর্তীকালের আন্তর্জাতিক কঙ্গোলী সমাজ প্রতিষ্ঠা করে নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছিলেন। এইসব তথাকথিত জনহিতকর সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ অভিযাত্রী হেনরি মর্টন স্ট্যানলি-কে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়োগ করেছিলেন। ফলে দ্বিতীয় লিওপল্ডের ব্যক্তিগত সাম্রাজ্য কঙ্গো ফ্রি স্টেট তৈরি হয়। ১৫ নভেম্বর, ১৯০৮ সালে, বেলজিয়ামের সংসদ উপনিবেশটিকে সংযুক্ত করে, কঙ্গোর উপর দ্বিতীয় লিওপল্ডের রাজত্বকে কুখ্যাত করে তোলে।

পিয়ের স্যাভোরগা দ ব্র্যাজা[সম্পাদনা]

ফরাসী অভিযাত্রী পিয়ের স্যাভোরগা দ ব্র্যাজা ১৮৫২ সালে ইতালির রোম শহরে জন্মে ছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক আফ্রিকান সোসাইটি-র পক্ষে ফরাসী নৌ অফিসার হিসাবে কাজ করতে রাজি না হয়ে, কঙ্গো নদীর উত্তরের অঞ্চলটি ফরাসীদের জয় করতে সহায়তা করেছিল। ১৮৮০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি বর্তমান গ্যাবন-এর আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল থেকে, ওগোউই এবং লেফিনি নদী দুটি অতিক্রম করে, টেকে (Téké ) রাজ্যে পৌঁছন এবং রাজা মাকোকো-র সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। ফলে ঐ অঞ্চলে ফরাসী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ম্‌ফোয়া(Mfoa) নামের একটি ছোট্ট গ্রামকে রাজধানী করা হয়। সেটি পরে ব্রাজাভিল নামে পরিচিত হয়।

ফরাসী উপনিবেশিকদের সাথে ব্রাজাভিল-এর মিছিলে টেকের রাজা মাকোকো, খ্রী. ১৯০৫

নিয়ন্ত্রণ স্থাপন[সম্পাদনা]

ফরাসী নিরক্ষীয় আফ্রিকা, খ্রী. ১৯১০। (ক্যামেরুন তখনও একটি জার্মান উপনিবেশ ছিল।)

কঙ্গোয় ফরাসি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা বেশ কঠিন ছিল। বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ড-ও কঙ্গো নদীর উত্তর তীরে পা রাখার চেষ্টা করছিলেন এবং স্ট্যানলিকে ব্রাজাভিলের আশেপাশের অঞ্চলে প্রেরণ করেছিলেন। এরপর ফরাসিদের বিরুদ্ধে একের পর এক বিদ্রোহ হয়েছিল, যার মধ্যে মাবিয়ালা মা নাগাঙ্গা-র নেতৃত্বে বাহাংলা বিদ্রোহই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই বিদ্রোহের শুরু ১৮৯২ সালে ফরাসি প্রশাসক লাভাল হত্যার মধ্য দিয়ে এবং শেষ হয় ১৮৯৬ সালে ফরাসি কর্তৃক বিদ্রোহের নেতাকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। স্থানীয় জনগণকে জোরজবরদস্তি শ্রমে বাধ্য করতে কঠোর ফরাসি নীতির প্রয়োগের ফলে, পরবর্তী বেশির ভাগ বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। চালু হয়েছিল স্থানীয়দের দমনমূলক কোড দ লিংডিগন্যাট আইন। এই আইনে, স্থানীয় জনগণকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে বাদ দিয়ে, বাধ্যতামূলক শ্রমের আওতায় আনা হয়, এবং তাদের অভিযোগগুলি প্রকাশ্যে প্রচার করা অবৈধ করা হয়।

ছাড়কারী ব্যবস্থা ও ছাড়কারী কোম্পানি[সম্পাদনা]

বার্লিন চুক্তির অর্থনৈতিক বিধানকে অনুসরণ করতে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন জনগোষ্ঠী ও অনুন্নত অঞ্চল থেকে পাওয়া রাজস্বকে অধিকতর করার জন্য, ফরাসী সরকার ১৮৯৮ সালে বেশ কিছু তথাকথিত ছাড়কারী কোম্পানি প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়। উপনিবেশের সম্পদ একচেটিয়া ভাবে কাজে লাগানোর জন্য প্রায় ৫৯.৫ মিলিয়ন ফ্র্যাঙ্কের মূলধনযুক্ত মোটামুটি চল্লিশটি এমন সংস্থা এই ছাড়ের সুযোগ পায়। কিছু কৌশলগত ব্যাপার বাদ দিয়ে, মূলত কঙ্গো নদীর আশেপাশের ৬,৫০,০০০ বর্গমাইল জমি ত্রিশ বছরের জন্য ছাড় দিয়ে ইজারা দেওয়া হয়। সস্তা হবে বিবেচনা করে, প্রায়ই অনুপযুক্ত মূলধনের কোম্পানিগুলি অদক্ষ কর্মী নিয়োগ করে সমস্ত সম্ভাব্য ধনের ছাড় গ্রহণ করত। ঐ সব এলাকায় কার্যত হাতির দাঁত ও রাবার অদৃশ্য হয়ে যায়; আদিবাসী জনগোষ্ঠী নির্মম জবরদস্তি শ্রম, রোগ এবং কুসংস্কারে ধ্বংস হয়ে যায় এবং কেউ কেউ প্রতিবেশী উপনিবেশে পালিয়ে যায়। [৩]

ফরাসি প্রশাসন ছিল নির্মম এবং তা হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২১ থেকে ১৯৩৪-এর মধ্যে ব্রাজাভিল থেকে পয়েন্টে-নয়োর পর্যন্ত ৫১১ কিমি দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণে প্রায় ২৩,০০০ স্থানীয় এবং 'শ কয়েক ইউরোপীয় নিযুক্ত হয়। ফরাসী উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যে কোন সামান্য প্রতিরোধকেও নির্মমভাবে দমন করা হত। পরিশেষে পূর্বোক্ত ছাড়কারী ব্যবস্থা, যার উপর সরকার নির্ভর করেছিল, দেখা গেল সেখান থেকে ভাড়া এবং কর বাবদ আদায়ে সরকারের ক্ষতির পরিমাণ বেশি এবং সে ব্যবস্থা রক্ষা করতে যে ব্যাপক বর্বরতা প্রকাশ পেয়েছিল তার খবরে ফরাসী জনমত একেবারে হতবাক হয়ে যায়। ১৯৩০ সালের মধ্যে বেশিরভাগ ছাড়কারী সংস্থা দেউলিয়া হয়ে যায় এবং ঐ ব্যবস্থাটির বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে যায়।

১৯১১ সালে ফ্রান্সের মরক্কো অধিকারের স্বীকৃতির বিনিময়ে, কঙ্গো উপনিবেশের কিছু অংশ (তথাকথিত নিউ ক্যামেরুন অঞ্চল) জার্মান সাম্রাজ্য-র হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এই অঞ্চলে জার্মান শাসন কেবল পাঁচ বছর স্থায়ী হয়েছিল এবং ক্যামেরুন-এ জার্মান বাহিনীর পতনের পর ১৯১৬ সালে নিউ ক্যামেরুন আবার ফ্রান্স দখল করে নেয়।

ফরাসি প্রশাসন[সম্পাদনা]

১ লা আগস্ট ১৮৮৬ সালে এই উপনিবেশের আনুষ্ঠানিক নাম ছিল কলোনী অফ গ্যাবোন এন্ড কঙ্গো। ৩০ শে এপ্রিল ১৮৯১ সালে নাম পাল্টে করা হয় কলোনী অফ ফ্রেঞ্চ কঙ্গো, যার মধ্যে যোগ করা হয় গ্যাবোন এবং মধ্য কঙ্গোকে। ১৫ জানুযারী ১৯১০ সালে উপনিবেশটির নাম পাল্টে করা হয় আফ্রিকি ইকুটোরিয়ালি ফ্রেঞ্চাইজি বা এ.ই.এফ.। তখন এর সাথে চাদ এবং ওবানগুই-চারি-কেও যুক্ত করা হয়েছিল। এখন সেটি পরিচিত, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র নামে। কঙ্গো-ব্রাজাভিল ২৮ শে নভেম্বর, ১৯৫৮ সালে স্বায়ত্তশাসন লাভ করে এবং ১৫ ই আগস্ট, ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এ.ই.এফ.-এর রাজধানী হয় ব্রাজাভিল এবং মধ্য কঙ্গোর রাজধানী পয়েন্ট নয়ের

ব্রাজাভিল-এ গভর্নর-জেনারেলের উপস্থিতির কারণে ফেডারেশন দ্রুত মধ্য কঙ্গোতে কেন্দ্রীভূত হয়ে ওঠে। কেন না, প্রতিটি উপনিবেশ তাত্ত্বিকভাবে মোটামুটি স্বায়ত্তশাসিত হলেও, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের অর্থ হয়ে দাঁড়ালো, গভর্নর-জেনারেল যে অঞ্চলে বাস করেন, সেই অঞ্চলটিকেই তিনি অগ্রাধিকার দিতে পছন্দ করতে লাগলেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, বিচার বিভাগ এবং পূর্ত বিভাগীয় সমস্ত কাজকর্মই ব্রাজাভিল-ভিত্তিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকায়, তারা আঞ্চলিক গভর্নরদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। মধ্য কঙ্গো-র ছিল পয়েন্ট নয়ের-এ অবস্থিত ফেডারেশনের একমাত্র গভীর জল-বন্দর আর রেলওয়ে। তাই ব্রাজাভিলের পাবলিক বিল্ডিং, স্কুল, আইন-আদালত, ট্রেডিং ফার্মস, টেলিযোগাযোগ এবং চিকিৎসা পরিষেবাগুলি শীঘ্রই ফেডারেশনের অপর সহযোগীদেরকে ছাড়িয়ে গেল। চাদের মতো এ.আই.এফ-এর অন্যান্য প্রান্তিক অঞ্চলের লোকেরা মধ্য কঙ্গোতে কাজ করতে বাধ্য হল, এবং প্রাথমিকভাবে যাবতীয় পুঁজি, চোঙের মতো এই অঞ্চলেই পুঞ্জিভূত হতে থাকে। ফলে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মধ্য কঙ্গোর সিভিল সার্ভিসের ব্যাপক প্রসারণে, জনসংখ্যার প্রবল স্রোত গ্রামাঞ্চল থেকে শহরমুখী হয়ে ওঠে। গড়ে ওঠে আমলাতন্ত্র এবং ট্রেড ইউনিয়নের একটি গভীর অন্তর্জাল, যা স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার পক্ষে বোঝা হিসাবে প্রমাণিত হয়। [৪]

একটি হাই কমিশনার প্রতিষ্ঠার করে, ১৯৫৭ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ফরাসী সরকার শাসন অব্যাহত রাখে গভর্নর জেনারেলের মাধ্যমে। ১৯৫০ সালে সমগ্র এ.ই.এফ.-এর মোট জনসংখ্যা ছিল ৪১,৪৩,৯২২, যার মধ্যে অ-আফ্রিকান ছিল প্রায় ১৫,০০০।

১৯৪০ এবং পুনঃর্গঠন[সম্পাদনা]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ[সম্পাদনা]

ইউরোপে পর্তুগিজদের নানা ঘটনাক্রমের সাথে সাথে আবার কঙ্গো-ব্রাজাভিল, মায় সাধারণভাবে আফ্রিকার বিষয়গুলি গভীরভাব প্রভাবিত হয়। ১৯৪০ সালের ২২ জুন জার্মানিতে মার্শাল ফিলিপ পেটেইন আত্মসমর্পণ করলে, তথাকথিত ভিচি ফ্রান্স প্রজাতন্ত্রের জন্ম হয়। এর আগে গ্রেট ব্রিটেনের পাশাপাশি আফ্রিকান অঞ্চল থেকে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পেটেইন অস্বীকার করেছিলেন। মুষ্টিমেয় স্থানীয় ফরাসী প্রশাসক ও আধিকারিকদের সহায়তায়, নির্বাসিত বেলজিয়াম সরকার চার্লস ডি গাউলি-র ফ্রি ফ্রেঞ্চ এবং ব্রিটিশরা, ফরাসী সাম্রাজ্যের বৃহত অংশে জয় লাভ করে। রেনে প্লেভেন-এর মতো রাজনীতিবিদ, যিনি পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী হন, এবং জেনারেল ফিলিপ লেকলার্ক ডি হাটক্লোক, লেফটেন্যান্ট রেনে অ্যামিয়ট, ক্যাপ্টেন রেমন্ড দেলাঞ্জ, কর্নেল এডগার ডি লারমিনেট আর অ্যাডল্ফ সিসে-র মতো আধিকারিকরা তাঁকে এ.ই.এফ. অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করেছিলেন। তিন দিনের মধ্যে ডি গাউলি-র সেনারা চাদ (২৬ আগস্ট ১৯৪০), ক্যামেরুন (২৭ আগস্ট) এবং মধ্য কঙ্গো (২৮ আগস্ট)-র নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। আফ্রিকায় তথাকথিত ফ্রি ফ্রেঞ্চ-দের রাজধানী হয়ে ওঠে ব্রাজাভিল, যার শাসক হয় ২৭ শে অক্টোবর ১৯৪০ সালে ডি গাউলি প্রতিষ্ঠিত কনসেল দ্য ডিফেন্স দ্য এল'অ্যাম্পায়ার। মধ্য কঙ্গোকে কেন্দ্র করে এফ.ই.এ. রাতারাতি ব্যাকওয়াটার থেকে একটি রাস্তা গড়ে ফেলে আফ্রিকার ফ্রি ফ্রেঞ্চ বাহিনীর লিঞ্চপিন পর্যন্ত। বিশেষ করে দেশের অভ্যন্তর থেকে উপকূলে সামগ্রী সরবরাহ, সৈন্য এবং শ্রমিক আদান-প্রদানের জন্য পয়েন্ট নয়ের হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল এবং মুখ্য ক্ষেত্র। রেলের নিবিড় ব্যবহারের কারণে একটি নতুন নগরকেন্দ্রিক শ্রমিক শ্রেণির উত্থান ঘটে এবং উপনিবেশেরও পরিকাঠামোগত উন্নতি হয়। [৩]

ফেলিক্স এবুউ (Felix Eboué)[সম্পাদনা]

এই বিদ্রোহে চাদের তৎকালীন গভর্নর ফেলিক্স এবুউ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই কারণে এবং পূর্বে ডি গাউলিকে তাঁর সমর্থনের কারণে তিনি ১৯৪০ সালে এ.ই.এফ.-এর গভর্নর জেনারেল হন। ফরাসী উপনিবেশিক ইতিহাসে এই পদে তিনি ছিলেন প্রথম অস্বেতাঙ্গ। ১৮৮৪ সালে তিনি ফরাসী গায়ানায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক আফ্রিকান দাস বংশে। ১৯৪৪ সালের ব্রাজাভিল কনফারেন্স সংগঠনে ডি গাউলি সরকারকে এই বংশ রেনে প্লেভেন-এর সাথে একযোগে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এ সব ঘটেছিল ১৯৪৪ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে ৮ ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফরাসি উপনিবেশিক নীতিতে নতুন দিক নির্দেশ করে এই কনফারেন্স। এর মধ্যে অনেকগুলি নীতিই এবুউ তাঁর ১৯৪১ সালে প্রকাশিত "লা নওভেল পলিটিক কোলোনিয়ালে ডি এল'এ.ই.এফ." শীর্ষক বইতে ইতিমধ্যে সন্নিবেশিত করে ছিলেন। এই সম্মেলন বলপূর্বক-শ্রম বিলোপ করে এবং আরোপ করে কোড দে লা'ইন্ডিজেনাত। এতে আদিবাসীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রম অবৈধ হয়ে যায়। চতুর্থ প্রজাতন্ত্রের নতুন ফরাসী সংবিধান অনুমোদিত হয় ১৯৪৬ সালের ২৭ অক্টোবরে। তাতে এই প্রথম প্যারিসের সংসদে নিরক্ষীয় আফ্রিকান সদস্যের নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ফলে এবুউ এবং এই উপনিবেশের জনগণ আনুষ্ঠানিকভাবে ফরাসী সাম্রাজ্যের অংশ হয়। তারা অংশগ্রহণের অধিকার, আইন-কানুনের একটি অভিন্ন কোড, তিনটি স্তরের নির্বাচনী সংস্থাসহ নতুন এক গুচ্ছ অধিকার লাভ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে মারাত্মকভাবে দুর্বল ফ্রান্সের পক্ষে তার উপনিবেশিক নীতিগুলি পরিবর্তন করা ছাড়া তখন আর কোন বিকল্প ছিল না।

জাতীয়তাবাদের উত্থান[সম্পাদনা]

গভর্নর জেনারেল ফেলিক্স এবুউ স্থানীয় কঙ্গোলীয় অভিযোগগুলির জন্য ক্যারট অ্যান্ড স্টিক বা গাজর ও কাঠি পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। কিছু স্বাধীনতা দেওয়ার সাথে সাথে তিনি ফরাসী উপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে বিপজ্জনক যে কোনও ক্রিয়াকলাপকে নির্মমভাবে দমন করেছিলেন। কঙ্গোলিজ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আন্দ্রে মাতসোয়া (মাতসোয়া) মামলাটি তাঁর রাজনৈতিক মতবিরোধের প্রতি কঠোর দৃষ্টিভঙ্গিই নির্দেশ করে।

আন্দ্রে মাতসোয়াকে আধুনিক কঙ্গোলিজ জাতীয়তাবাদের জনক হিসাবে দেখা যেতে পারে। তাঁর উত্থান দেখিয়ে দেয়, কীভাবে কোড দে লা'ইন্ডিজেনাত এবং অমানবিক দমন সত্ত্বেও ফরাসী উপনিবেশগুলিতে আফ্রিকানরা উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম। ফরাসী মিশনারিদের পরিচালিত স্থানীয় স্কুলগুলিতে বা অন্য কোথাও, এই আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ উত্থানের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। আন্দ্রে মাতসোয়া চার্চের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষা এবং ইউরোপীয় চিন্তাধারা অর্জন করেছিলেন। ১৮৯৯ সালে মান্দজাকালা-য় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালে ব্রাজাভিলের ফরাসী শুল্ক প্রশাসনে যোগদান করেন এবং এর পরেই ফ্রান্সে চলে যান। যেখানে তিনি মরক্কোতে লড়াইয়ের জন্য ফরাসী সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং নন-কমিশনড অফিসার হয়ে দেশে ফেরেন। ফ্রান্সে বসবাসকারী তাঁর অঞ্চলের লোকদের সহায়তা করার উদ্দেশ্য নিয়ে, ১৯২৬ সালে তিনি প্যারিসে গঠন করেন এসোসিয়েশন ডেস অরিজিনিয়ারিস ডি এল'এ.ই.এফ.। এ জন্য তিনি ফরাসী সমাজের কিছু অংশের সমর্থন পেয়েছিলেন, যেমন ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি এবং মুক্ত রাজমিস্ত্রি আন্দোলনের কিছু অংশ।

১৯২৯ সালে যখন তাঁর দলটি কঙ্গোতেও সক্রিয় হয়ে উঠল এবং কোড দে লা'ইন্ডিজেনাতকে বন্ধ করার দাবি উঠল, তখন পরিস্থিতি বদলে গেল। ১৯২৯ সালে ফরাসী সরকার মাতসুয়ার সমিতি ভেঙে দেয় এবং তাঁর কয়েকজন বন্ধুসহ তাঁকে কারাগারে বন্দী করে চাদে প্রেরণ করা হয়। ফলে দাঙ্গা শুরু হয় এবং ফরাসী প্রশাসনের বিরুদ্ধে বহু বছর স্থায়ী আইন অমান্য করার প্রচার চালানো হয়। তবে ১৯৩৫ তিনি সালে ফ্রান্সে পালিয়ে গিয়ে একটি নতুন পরিচয়ে আবার তাঁর রাজনৈতিক কাজ চালিয়ে যান। কঠোর দমন-পীড়ন সত্ত্বেও ফ্রান্সের প্রতি তাঁর আনুগত্য দেখিয়ে, তিনি ১৯৪০ সালে জার্মান আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। আহত অবস্থায় তাঁকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে ব্রাজাভিল পাঠানো হয় এবং ১৯৮১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ফেলিক্স এবুউ-র অধীনে সাজা দিয়ে সারা জীবনের জন্য শ্রম শিবিরে পাঠানো হয়। এক অস্পষ্ট পরিস্থিতিতে ১৯৪২ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি কারাগারে মারা যান। তাঁর সমর্থকরা বলেন যে তাঁকে খুন করা হয়েছিল এবং মাতসোয়াবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যা মূলত লারি-র মধ্যে সক্রিয় ছিল এবং স্বাধীনতার পরেও সে সক্রিয়তা বজায় ছিল।

স্বাধীনতার পথে[সম্পাদনা]

কঙ্গো চৌদ্দ বছর অতিক্রম করেও পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের মতো রাজনৈতিক-স্বাধীনতা না পেয়ে, পর্যাপ্ত পরিমাণ অন্তবর্তী জনগণের সম্মানে বৈধ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়া প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। মূল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের আদলের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হলেও, প্রতিষ্ঠিত একাধিক আফ্রিকান সংবিধানের বিষয়গুলি ১৯৬১, ১৯৬৩, ১৯৬৮, ১৯৭৩ এবং ১৯৯২ সালে যুক্ত করা হয়। একটি মিশ্র রাষ্ট্র হিসাবে রাজনৈতিক দলগুলি খুব দ্রুত পুরোপুরি জাতিগত এবং আঞ্চলিক দলবদ্ধকরণের দিকে মনোনিবেশ করতে শুরু করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ১৯৪৬ এবং ১৯৫৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, সে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রদায়, লারি। তাদের বিশ্বাস ছিল, তাদের মৃত মেসিয়ানিক নেতা আন্দ্রে মাতসোয়া ফিরে আসবেন। প্রাথমিক পর্বের রাজনীতি থেকে বাকোঙ্গোর অনুপস্থিতির কারণেও একটি শক্তিশালী শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। যার ফলে ভিলি এবং ম্‌বোচি স্বাধীনতা লাভ অবধি মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল। [৫]

১৯৫৬ সাল পর্যন্ত কঙ্গোর সবচেয়ে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ছিলেন জ্যাঁ-ফেলিক্স টি্‌চিকাইয়া। তিনি ১৯৯৩ সালের ৯ নভেম্বর লিব্রেভিলিতে জন্মে ছিলেন এবং লোয়াঙ্গো রাজ্যের রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন। আইভরিয়ান নেতা ফেলিক্স হোউফোয়েত-বইগনি এবং আরও অন্যান্যদের সাথে একত্রে তিনি গঠন করেন, ১৯৪৬ সালে রাসেমব্ল্যামেন্ট ডেমোক্র্যাটিক আফ্রিকেন (আর.ডি.এ) এবং ১৯৪৭ সালে পার্টি প্রগ্রেসিস্ট আফ্রিকেইন। ১৯৪৫ সালের ২১ শে নভেম্বর, টি্‌চিকাইয়া প্রথম আফ্রিকান নেতা হিসাবে ফরাসি সংসদে নির্বাচিত হয়ে তাঁর জন্মভূমিকে সম্মানিত করেছিলেন।

যদিও টি্‌চিকাইয়া ফরাসী রাজনৈতিক বর্ণে, বামপন্থী ছিলেন, তবুও তিনি ফরাসি উপনিবেশিক শাসনের বিষয়ে কখনও জোরালোভাবে প্রশ্ন তোলেন নি। এর ফলে উপনিবেশিক শাসন বিরোধী ঘানা-র জাতীয়তাবাদী নেতা কাওয়ামে ন্‌ক্রুমা এবং মিশরের রাষ্ট্রপতি গামেল আবদেল নাসের-এর মতো প্রভাবশালী না হতে পারায়, কঙ্গোর স্বাধীনতার প্রস্তুতিতে তাঁর প্রভাব হ্রাস পায়। কেবলমাত্র একদা তাঁর পূর্ব শত্রু আরও উগ্রবাদী জ্যাকস ওপাঙ্গাল্ট-এর সাথে জোট বেঁধে ১৯৫৭ সালের ৩১ শে মার্চ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাজির হলে, কঙ্গোলী রাজনীতিতে আরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারতেন।

স্বাধীনতা পাওয়ার আগে ওপাঙ্গাল্টের উগ্রবাদকে ফরাসী ও ক্যাথলিক চার্চ ভীতিজনক মনে করায়, প্রাক্তন পুরোহিত ফুলবার্ট ইউলোর উত্থানের সহায়ক হয়। ইউলোর ইউনিয়ন ডেমোক্র্যাটিক পোর লা ডিফেন্স ডি'ইন্টারেটস আফ্রিকানস (ইউ.ডি.ডি.আই.এ.), আফ্রিকার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন (এম.এস.এ.) থেকে জর্জেস ইয়ামবোটকে বিচ্ছিন্ন করে, ১৯৫৮ সালে ইউলোকে প্রধানমন্ত্রী হতে সাহায্য করেছিল। এর ফলে ১৯৫৮ সালের ২৮ নভেম্বর কঙ্গো প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় (সঙ্গে পয়েন্ট নয়েরের পরিবর্তে ব্রাজাভিলকে রাজধানী করা হয়)।

১৯৫৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ওপাঙ্গাল্ট এবং তাঁর এম.এস.এ.-এর আয়োজনে একটি বিদ্রোহ দক্ষিণ অঞ্চলের উপজাতিদের সাথে ইউলো-সমর্থক উপজাতি আর উত্তরের জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ফরাসি সেনাবাহিনী সে সব দাঙ্গা দমন করে এবং ওপাঙ্গাল্টকে গ্রেপ্তার করা হয়। মোট প্রায় ২০০ মানুষ মারা যায়। এরপরে প্রধানমন্ত্রী ইউলো নির্বাচন করেছিলেন, যে প্রস্তাব আগে থেকেই বার বার ওপাঙ্গাল্ট করে চলেছিলেন। ৯ ই মে, প্রচারিত কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্রের কারণে, প্রবীণ রাজনীতিবিদ সাইমন কিখৌঙ্গা ন্‌গোট সহ বেশ কয়েক জন রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তারের পর সংসদ নির্বাচনে ইউলো অতি আয়াসে জয়লাভ করেন। ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই ফ্রান্স, কঙ্গোকে সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র হওয়ার বিষয়ে সম্মতি জানায়। [৬] ১৯৬০ সালের ১৫ আগস্ট কঙ্গো প্রজাতন্ত্র একটি স্বাধীন দেশে পরিণত হয় এবং ফুলবার্ট ইউলো হন এর প্রথম রাষ্ট্রপতি।

ঐ বছরেই নভেম্বরে, ইউলো ক্ষমা প্রদর্শণের অঙ্গ হিসাবে ওপাঙ্গাল্ট, ন্‌গোট এবং অন্যান্য বিরোধীদের মুক্তি দেন। বিনিময়ে উভয় রাজনীতিবিদ, পাশাপাশি জার্মেইন বাইকুম্যাট, ইউলো সরকারে যোগ দিয়ে মন্ত্রী পদ লাভ করেন এবং কার্যকরভাবে যে কোনও রকমের সংগঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বের অবসান ঘটানো হয়।

তেল[সম্পাদনা]

স্বাধীনতা লাভের অল্প কিছু আগে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল যাতে আগত বছরগুলিতে দেশ এবং বর্হিবিশ্বের সাথে মূলত ফ্রান্সের সম্পর্কের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। ফরাসী ভূতাত্ত্বিকরা ইতিমধ্যে ১৯২৬ সালে দেশে তেল ও গ্যাসের উপস্থিতির নিশ্চয়তা পেয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে পয়েন্টে ইন্ডিয়েনের কাছে ফ্রেঞ্চ সোসিয়েট দেস পেট্রোলস ডি ল্যাফ্রিক ইকোয়েটরিয়াল ফ্রানসাইসেস (এস.পি.এ.ই.এফ.) ব্যবহারযোগ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস-এর মজুদ খুঁজে পায়। তারপরেই ফ্রান্স এই মজুদের ব্যবহার শুরু করে। এর কারণ হল, আলজেরিয়ায় যে স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়েছিল তাতে ফরাসিরা হেরে যায়। তখনও পর্যন্ত ফরাসী বাজারের জন্য আলজেরিয়ার তেল ও গ্যাস ছিল মূল উৎস। তেলের জন্য আমেরিকা এবং ব্রিটিশদের উপর নির্ভরশীল না থেকে ফ্রান্সকে তখন বিকল্প কোনও সরবরাহের দিকে নজর দিতে হয়েছিল। আর তাই কঙ্গো উপকূলের তেল আবিষ্কার ছিল একটি আশীর্বাদ। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার, তার বার্ষিক প্রতিবেদনে দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করে, স্থানীয় জনসংখ্যার গরিষ্ঠ অংশের কাছে তা অভিশাপ হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৭০ দশকের মধ্যে কঙ্গোর বৃহত্তম রফতানি ছিল তেল। তবে বিশ্বব্যাপী বাজারমূল্যের অস্থিতাবস্থার সাথে একটি বিশাল সিভিল সার্ভিস এবং অত্যন্ত অদক্ষ রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রকে টিকিয়ে রাখার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, ভবিষ্যতের রাজস্বের বিষয়ে অত্যধিক আশাবাদী অনুমানের উপর নির্ভর করার প্রবণতায়, এই ক্ষেত্রটিতে নিয়মিতভাবে মারাত্মক আর্থিক ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। প্রথাগত শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়নবাদী আন্দোলন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, যোগাযোগ ব্যাবস্থার দুর্বল পরিকাঠামোর জন্য অত্যধিক ব্যায়ের কারণে, এই ক্ষেত্রটির উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়। [৭]

লেস ট্রয়েস গ্লোরিয়াস এবং ১৯৬৮-এর অভ্যুত্থান[সম্পাদনা]

ব্রাজাভিল যেহেতু ফরাসি নিরক্ষীয় আফ্রিকার বৃহৎ ফেডারেশনের রাজধানী ছিল, তাই এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ কর্মশক্তি ও অনেক ট্রেড ইউনিয়ন ছিল। উপনিবেশ-বিরোধীতার কারণে আফ্রিকার কোথাও কোথাও ইউলোর একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হচ্ছিল। ইউলোর ১৯৬৩ সালের ৬ আগস্টে মাত্র একটি আইনি ট্রেড ইউনিয়ন সহ একদলীয় রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণার পরে, ট্রেড ইউনিয়নগুলি ১৩ ই আগস্ট তাদের বিদ্রোহ শুরু করে। ক্রোধান্বিত শ্রমিকরা আগস্টে ইউলোর রাজবাড়ি ঘেরাও করে এবং ফরাসিরা সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করায় তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এই বিদ্রোহটির ১৮৩০ সালের রাজা চার্লস দশম-এর বিরুদ্ধে ফরাসি জুলাই বিপ্লব-এর আদলে নামকরণ করা হয়েছিল লেস ট্রয়েস গ্লোরিয়াস (তিন গৌরবময় দিবস)। ফুলবার্ট ইউলু এবং তাঁর প্রধান সমর্থকরা সামরিক বাহিনী দ্বারা গ্রেপ্তার হন এবং তাঁর কঙ্গো-রাজনৈতিক জীবনে আরও ভূমিকা গ্রহণের পথ বন্ধ করে দেয়।

কঙ্গোলী সেনাবাহিনী সাময়িকভাবে দেশের দায়িত্বভর গ্রহণ করে এবং আলফোনসে মাস্বাবা-দেবাট-এর নেতৃত্বে একটি বেসামরিক অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৬৩ সালের সংবিধান-এর অধীনে, মাস্বাবা-দেবাট পাঁচ বছরের মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার জন্য পাস্কাল লিসৌবা-র নাম প্রস্তাব করা হয়।

রাষ্ট্রপতি মাস্বাবা-দেবাটের কার্যকালে সরকার জাতীয়করণ-সহ বাম রাজনৈতিক ভাবধারার দিকে ঝোঁকে এবং ইউ.এস.এস.আর. ও কমিউনিস্ট চীন-এর সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক বাড়িয়ে তোলে। ১৯৬৮ সালের আগস্টে, যখন ক্যাপ্টেন মারিয়েন ন্গৌবি‌ এবং অন্যান্য সেনা কর্তারা একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে সরকারের পতন ঘটায়, তার সাথেই মাস্বাবা-দেবাটের সরকারও শেষ হয়ে যায়। নবগঠিত জাতীয় বিপ্লবী কাউন্সিলের অধীনে একত্রীকরণের পরে, ন্গৌবি ৩১ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সালে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করেন। এক বছর পর, আফ্রিকার প্রথম গণপ্রজাতন্ত্র-রূপে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো-র আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং রাষ্ট্রপতি ন্গৌবি‌, জাতীয় বিপ্লব আন্দোলন-এর নাম পাল্টে কংগোলিজ পার্টি অফ লেবার (পি.সি.টি.) রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। [৮]

ন্‌গৌবি(Ngouabi) হত্যা এবং সাসো-ন্‌গুয়েসো-র (Sassou-Nguesso) নির্বাচন[সম্পাদনা]

১৮ মার্চ, ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি ন্‌গৌবি-কে হত্যা করা হয়। তাঁকে গুলি করার অভিযোগে বেশ কিছু ব্যক্তির বিচার হয়েছিল এবং কয়েকজনের মৃত্যুদন্ড হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আলফোনসে ম্যাসাম্বা-দেবাট এবং চ্যানরিথী মৌকোকো নামে এক জন জেলে ছিলেন। তবে তাঁদের জড়িত থাকার প্রমাণ তেমন একটা পাওয়া যায় নি, এবং হত্যার পিছনের উদ্দেশ্যটিও অস্পষ্ট রয়ে যায়।

প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্য কর্নেল (পরে জেনারেল) জোয়াকিম ইহোম্বি-ওপাঙ্গোর সাথে, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য, দলের ১১-সদস্যের সামরিক কমিটি (সি.এম.পি.) গঠন করা হয়েছিল। দু বছর ক্ষমতায় থাকার পরে, ইহোম্বি-ওপাঙ্গোর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও বিচ্যুতির অভিযোগ আনা হয়েছিল দলীয় পরিচালকদের পক্ষ থেকে এবং পি.সি.টি.-র কেন্দ্রীয় কমিটি ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯-এ তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়। একই সঙ্গে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কর্নেল ডেনিস সাসো ন্‌গুয়েসো-কে মনোনীত করা হয়, অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি হিসাবে।

কেন্দ্রীয় কমিটি সাসো ন্‌গুয়েসোকে, পি.সি.টি.-র তৃতীয় এক্সট্রাঅর্ডিনারি কংগ্রেস প্রস্তুতির দায়িত্ব নেওয়ার নির্দেশন দেয়, যা তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এবং প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে এগিয়ে দেয়। এক কংগ্রেসনাল রেজুলেশনের আওতায় ইহোম্বি-ওপাঙ্গোর সমস্ত ক্ষমতা, পদমর্যাদা এবং সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া হয় এবং বিশ্বাসঘাতকতার বিচারের জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৮৪ সালের শেষদিকে তাকে গৃহবন্দি থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং তার নিজের গ্রাম ওয়ানডো-য় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।[৯]

গণতন্ত্র ও গৃহযুদ্ধ[সম্পাদনা]

কয়েক দশকের অশান্ত রাজনীতি, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী উদ্দীপনার পর, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে, কঙ্গোলীয়রা ধীরে ধীরে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী পরিমার্জন করে ১৯৯২ সালে কঙ্গো বহু-দলীয় গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। একদলীয় মার্কসবাদী শাসনের দীর্ঘ ইতিহাসের অবসান ঘটিয়ে, এই পরিবর্তনের জন্য একটি নির্দিষ্ট এজেন্ডা ১৯৯১ সালের কঙ্গোর জাতীয় সম্মেলনে উত্থাপন করা হয় এবং ১৯৯২ সালের অগস্টে বহুদলীয় সংসদরাষ্ট্রপতি নির্বাচন সমাপ্ত করা হয়। সাসো ন্গুয়েসো পরাজয় স্বীকার করেন এবং ৩১ আগস্ট ১৯৯২ সালে কঙ্গোর নতুন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক পাস্কেল লিসৌবা, উদ্বোধন করেন নব কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের।

কঙ্গোলীয় গণতন্ত্র ১৯৯৩ এবং ১৯৯৪ সালের গোড়ার দিকে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। রাষ্ট্রপতি ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে, নতুন ১৯৯৩-এর মে নির্বাচন করার আহ্বান জানান। সেই নির্বাচনের ফলাফল ছিল বিতর্কিত। তার কারণে, জুন এবং নভেম্বর মাসে সহিংস নাগরিক অস্থিরতা মাথাচাড়া দেয়। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে, সালিসিদের একটি আন্তর্জাতিক বোর্ডের সিদ্ধান্তগুলি সমস্ত পক্ষই মেনে নেওয়ায়, বৃহত্তর বিদ্রোহের ঝুঁকি হ্রাস পায়।

আমেরিকান মালিকানার অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়াম সংস্থাকে ভবিষ্যতের তেল উৎপাদনের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তাঁর সরকারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা বলে, লিসৌবা তাঁর রাষ্ট্রপতি হওয়ার শুরুতেই ফরাসী সরকারের নেকনজর হারিয়েছিলেন। ফরাসী সংস্থা এলফ অ্যাকুইটাইন (যেটি কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের কাছ থেকে তার বেশিরভাগ মুনাফা অর্জন করে এসেছে) তখন সবে পয়েন্ট নয়রে-র উপকূলে বড় গভীর-জলের তৈলকূপ প্ল্যাটফর্ম খোলায়, লিসৌবার উপর অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়ামের সাথে সমস্ত চুক্তি বাতিল করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে ফ্রাস। [১০]

যাইহোক ১৯৯৭ সালে কঙ্গোর গণতান্ত্রিক অগ্রগতি লাইনচ্যুত হয়। ১৯৯৭ সালের জুলাইয়ে আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে লিসৌবা এবং সাসো-ন্‌গুয়েসো শিবিরের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। মে মাসে, জোয়াকিম ইহোম্বি-ওপাঙ্গো-র রাজনৈতিক দুর্গ ওয়ান্দো-তে সাসো-ন্‌গুয়েসোর সফরকালে তাঁদের সমর্থকদের মধ্যে হিংসার সূত্রপাত হয়। [১১] ৫ জুন ১৯৯৭, ব্রাজাভিলের এম্‌পিলা-য় সাসো-ন্‌গুয়েসোর বাড়ি সরকারী বাহিনী ঘিরে রাখে, এবং পিয়ের আবোয়া ও অ্যাঙ্গোবো বোনাভেনচার নামে দু'জনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হয়, যাঁরা পূর্বোক্ত হিংসায় জড়িত ছিলেন। সরকারী বাহিনী এবং সাসো-ন্‌গুয়েসোর অনুগামীদের মধ্যে লড়াই শুরু হয়, যা কোবরা (Cobras) নামে পরিচিত ছিল। ৪ মাসের সংঘর্ষে ব্রাজাভিলের বেশিরভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। [১০][১১]

সাসো-ন্‌গুয়েসোকে প্রায় এক হাজার অ্যাঙ্গোলান ট্যাঙ্ক, সেনা দিয়ে সমর্থন করেছিল অ্যাঙ্গোলা। সহানুভূতিশীল ফরাসি সরকার-এর সমর্থনপুষ্ট সাসো-ন্‌গুয়েসোর বিদ্রোহীরা আরও উৎসাহিত হয়েছিল।[১০]

১৬ অক্টোবর সকালে এই বাহিনী একসাথে ব্রাজাভিল এবংপয়েন্ট নয়রের দখল নিয়ে ফেলে। যখন তাঁর সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করছিল, তখন লিসৌবা রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যান, আর নাগরিকরা লুটপাট শুরু করে দেয়। ইহোম্বি-ওপাঙ্গো যুদ্ধের সময় লিসৌবাকে সমর্থন করেছিলেন,[১২] রাষ্ট্রপতি সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন,[১৩][পূর্ণ তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এবং সাসো-ন্‌গুয়েসোর জয়ের পরে তিনি আইভরি কোস্ট [১২] এবং ফ্রান্সে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর, সাসো-ন্‌গুয়েসো নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এবং ৩৩ সদস্যের সরকার গঠন করেন।[১৪]

১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে সাসো-ন্‌গুয়েসোর সময়ে অন্তরবর্তীকালিন সময়কাল(transition period) ও তার প্রকৃতি নিরূপণ বিষয়ে ধারণা করার জন্য একটি জাতীয় ফোরাম অনুষ্ঠিত হয়। কঠোরভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত এই ফোরাম সিদ্ধান্ত নেয়, প্রায় তিন বছরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, একটি অন্তরবর্তী উপদেষ্টা আইনসভা নির্বাচিত হবে। ঘোষণা করা হয়, একটি সাংবিধানিক সম্মেলন একটি খসড়া সংবিধান চূড়ান্ত করবে। তবুও ১৯৮৯ সালের শেষদিকে সাসো-ন্‌গুয়েসোর সরকারী বাহিনী এবং সশস্ত্র বিরোধী দলের মধ্যে লড়াইয়ের ফলে অন্তরবর্তীকাল থেকে গণতন্ত্রে ফিরে আসতে বিলম্ব ঘটে। এই নতুন হিংসার কারণে, অর্থনৈতিকভাবে জোরালো কঙ্গো-মহাসাগর রেলপথ বন্ধ হয়ে যায়। দক্ষিণ ব্রাজাভিল এবং পুল, বোয়েনজা এবং নীয়ারী অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংস এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটে এবং কয়েক হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

১৯৯৯ সালের নভেম্বর এবং ডিসেম্বরে সরকারের সাথে, বিদ্রোহী গোষ্ঠীর, যদিও সবার সঙ্গে নয়, তবুও অনেকেইর প্রতিনিধির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গ্যাবন-এর রাষ্ট্রপতি ওমর বোঙ্গো-র মধ্যস্থতায় এই ডিসেম্বর চুক্তিতে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক আলোচনা অনুসরণর করার আহ্বান জানানো হয়।

সাসো-র দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতিত্ব[সম্পাদনা]

২০০২ সালে সাসো ৯০% বা তার বেশি এক অনির্বচনীয় ভোটে নির্বাচন জিতেছিলেন। তাঁর প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, লিসৌবা এবং বার্নার্ড কোলাস-কে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রাখা হয়েছিল। একমাত্র অবশিষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বী, আন্দ্রে মিলঙ্গো, নির্বাচন বয়কট করেছিলেন এবং সাসোর ভোটার জালিয়াতি সহ আরও অন্যান্য কারণে এই নির্বাচন থেকে সরে এসেছিলেন। ২০০২ সালের জানুয়ারিতে একটি নতুন সংবিধান বিষয়ে একমত হয়ে, রাষ্ট্রপতিকে নতুন ক্ষমতা মঞ্জুর করা হয় এবং তাঁর মেয়াদ সাত বছর বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন বাইক্যামেরাল অ্যাসেম্বলি প্রবর্তন করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর, বিরোধী কুড়িটি রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র চিস্তোপ ন্‌গোকাকা-র মাধ্যমে একটি বিবৃতি জারি করে বলা হয়, "ব্রাজাভিলের কর্মকর্তা এবং বেইজিং সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় ... অস্ত্র ও সামরিক নৈপুণ্য কিনেছিল সাসো সরকার।" [১৫] জুলাই ২০০৯ সালে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সাসো আরও সাত বছরের মেয়াদে পুনর্নির্বাচিত হন।

২০১৬ নির্বাচন-এ অংশ নিতে সাসো, ২০১৫ সালে সংবিধান পরিবর্তন করেছিলেন। অনেকেরই বিশ্বাস তিনি প্রতারণা করে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। রাজধানীতে সহিংস বিক্ষোভের পরে, সাসো পুল অঞ্চলে আক্রমণ করেছিলেন, যেটি নিনজা বিদ্রোহী-দের গৃহযুদ্ধের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হত। এর ফলে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে নিনজা বিদ্রোহীরা পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সুযোগ পায়। ৮০,০০০ লোক তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ডিসেম্বর ২০১৭ সালে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।[১৬]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Thornton, John K. The Kongolese Saint Anthony: Dona Beatriz Kimpa Vita and the Antonian Movement, 1684–1706. New York: Cambridge University Press, 1998.
  2. "Archived copy"। ২০০৭-০৯-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৫-০৯-২৪ 
  3. Decalo, Thompson, Adloff, Samuel, Virginia, Richard (১৯৯৬)। The Historical Dictionary of Congo (English ভাষায়)। Scarecrow Press। পৃষ্ঠা 6। 
  4. Decalo, Thompson, Adloff, Samuel, Virginia, Richard (১৯৯৬)। The Historical Dictionary of Congo (English ভাষায়)। Scarecrow Press। পৃষ্ঠা 5। 
  5. Decalo, Thompson, Adloff, Samuel, Virginia, Richard (১৯৯৬)। The Historical Dictionary of Congo (English ভাষায়)। Scarecrow Press। পৃষ্ঠা 7। 
  6. Blair, W. Granger (১৩ জুলাই ১৯৬০)। "3 More Nations Gain Freedom Through Pacts Signed by France; Congo, Central African and Chad Republics Are Given Sovereignty in Paris"The New York Times 
  7. Decalo, Thompson, Adloff, Samuel, Virginia, Richard (১৯৯৬)। The Historical Dictionary of Congo (English ভাষায়)। Scarecrow Press। পৃষ্ঠা 2। 
  8. "Republic of Congo profile"BBC। ৮ জানুয়ারি ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ৯ জানুয়ারি ২০১৯ 
  9. https://2009-2017.state.gov/outofdate/bgn/congobrazzaville/120208.htm
  10. French, Howard W. (অক্টোবর ১৬, ১৯৯৭)। "Rebels, Backed by Angola, Take Brazzaville and Oil Port"The New York Times। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৩-১৮ 
  11. "ENTRE ARBITRAIRE ET IMPUNITE : LES DROITS DE L'HOMME AU CONGO-BRAZZAVILLE" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০০৭-১১-১৪ তারিখে, Congolese Human Rights Observatory and International Federation of Human Rights (fidh.org), April 1998 (ফরাসি ভাষায়).
  12. Political Parties of the World (6th edition, 2005), ed. Bogdan Szajkowski, pages 138–140.
  13. "Congo: Lissouba 'accepted' selection of prime minister from opposition", Africa No 1 radio (nl.newsbank.com), August 10, 1997.
  14. International Business Publications, Usa. (২০০৭)। Central african customs and economic union udeac business law handbook.। Intl Business Pubns Usa। আইএসবিএন 1-4330-0611-1ওসিএলসি 946748122 
  15. "Republic Of Congo Opposition: Government Buying Chinese Arms"। AFP via Dow Jones News। ২০০৮-১২-৩০। 
  16. "Congo-Brazzaville's hidden war"। New Humanitarian। ১৮ জুন ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ৭ এপ্রিল ২০১৯