ওঘবতী নদী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ভারতবর্ষের একটি  প্রাচীন এবং পবিত্র নদী।

সরস্বতী নদীর সাতটি রূপের মধ্যে একটি ওঘবতী। অপর নদী সমূহ হলো-সুপ্রভা, কাঞ্চনাক্ষী,বিশালা, মনোরমা, সুরেণু, বিমলোদকা।  

     সুপ্রভা কাঞ্চনাক্ষী চ বিশালা চ মনোরমা।

     সরস্বতী চৌঘবতী সুরেণুর্বিমলোদকা।।

এই সাতটি নদী সমস্ত জগৎ এ ছড়িয়ে রয়েছে।[১]

মহাঋষি বশিষ্ঠ কুরু রাজার যজ্ঞে কুরুক্ষেত্রে পূণ্যসলিলা স্রোতস্বিনী সরস্বতীকে আহ্বান করেন, তখন ওঘবতী নদী কুরুক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়।[২] .

মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের নিকট ভারতবর্ষের নদী সমূহের নাম জিজ্ঞাসা করলে সঞ্জয় অন্যান্য নদীর সঙ্গে এর নাম-ও উল্লেখ করেন।

      পূর্বাভিরামাং চীরাঞ্চ ভীমামোঘবতীং তথা।

      পলাশিনীং পাপহরা মহেন্দ্রং পাটলাবতীম্।।[৩]

ওঘবতী নদীর গল্প[সম্পাদনা]

মহাভারতে অনুশাসন পর্বে ''গৃহস্থ-ধর্ম যথাযথ পালন করে মৃত্যুকে-ও জয় করা যায়'' এই প্রস্তাবনায় পিতামহ ভীষ্ম ওঘবতীর গল্প বলেন।

  প্রাচীনকালে মহিষ্মতী নগরে ইক্ষ্বাকু বংশীয় দুর্যোধন নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর সুদর্শনা নামে এক সুন্দরী কন্যা ছিল। সেই কন্যাকে দুর্যোধন অগ্নিদেবের হাতে সমর্পন করেন।  সুদর্শনা ও অগ্নিদেবের মিলনে সুদর্শন নামে এক পুত্র জন্ম নেয়।

  প্রসিদ্ধ রাজা নৃগের পিতামহ ওঘবানের 'ওঘবতী' নামে এক পুত্র ও 'ওঘবথ' নামে এক পুত্র ছিল। রাজা ওঘবান সেই অগ্নিপুত্র সুদর্শনের সঙ্গে কন্যা ওঘবতীর বিয়ে দেন।সুদর্শন এবং ওঘবতী গৃহস্থাশ্রমে নিরত হয়ে কুরুক্ষেত্রে থেকে 'গৃহস্থ-ধর্ম পালন করতেন। জ্ঞানী ও তেজস্বী সুদর্শন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি গৃহস্থ হয়েই মৃত্যুকে জয় করবেন। তিনি ওঘবতীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন,'তুমি কোনোভাবেই অতিথিকে বিরূপ করবেনা;সর্বদা অতিথিকে সন্তুষ্ট রাখবে;যদি অতিথি সেবা করতে হলে শরীর দান ও করতে হয় ,তবে ক্ষণমাত্র বিবেচনা না করে অতিথিকে প্রসন্ন করবে।' ওঘবতী স্বামীর নির্দেশ মেনে নিলেন। এদিকে মৃত্যুর দেবতা সুদর্শন কে জয় করবার জন্য তাঁর দোষ ত্রুটি খোঁজার চেষ্টায়,তাঁর পেছন পেছন চলতে লাগল।

একদিন সুদর্শন কাঠের সন্ধানে বনে গেল। সেই সময় এক সুন্দরকান্তি ব্রাহ্মণ অতিথি হয়ে ওঘবতীর গৃহে এলেন। ওঘবতী তাঁকে প্রণাম করে হাত-পা ধোওয়ার জল এবং বসার আসন দিলেন। তারপর ওঘবতী ব্রাহ্মণের প্রয়োজন জানতে চাইলে ব্রাহ্মণ তাঁকে কামনা করেন। তখন ওঘবতী ব্রাহ্মণকে অন্য বস্তুর প্রলোভন দেখান, কিন্তু ব্রাহ্মণ তাতে ভোলে নি। তখন ওঘবতী স্বামীর নির্দেশ স্মরণ করে বললেন, 'আচ্ছা তাই হোক'। তারপর সেই ব্রাহ্মণ এবং ওঘবতী গৃহে প্রবেশ করলেন।

তারপর সুদর্শন আশ্রমে উপস্থিত হয়ে ওঘবতীর খোঁজে তাঁকে বার বার ডাকতে লাগলেন। কিন্তু সেই অতিথির বাহুদ্বারা আলিঙ্গিত হয়ে ছিলেন বলে ওঘবতী স্বামীর ডাকে সাড়া দিলেন না। অতঃপর বার বার ডাকার ফলে অতিথি ব্রাহ্মণ ঘরের ভেতর থেকেই বললেন, 'আমি তোমার অতিথি, আমার প্রার্থনাতেই তোমার স্ত্রী আমার কণ্ঠলগ্না হয়েছেন। এমতাবস্থায় তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার'। 'যদি  প্রতিজ্ঞা পালনে ব্যর্থ হয় তবে সুদর্শনকে বধ করব' এই মনে করে মৃত্যু সুদর্শনকে অনুসরণ করছিল।

কিন্তু অতিথি ব্রাহ্মণের কথায় বিস্মিত সুদর্শন বিন্দুমাত্র ঈর্ষান্বিত বা রাগান্বিত না হয়ে বললেন, 'আপনার ইচ্ছা পূর্ণ হোক।আমার স্ত্রী এবং সর্বস্ব দিয়ে আমি অতিথি সেবা করতে পারি। আমি নিঃশঙ্কচিত্তে এই সত্য বাক্য বললাম।এই সত্য বাক্যে দেবতারা আমায় পালন করুন কিংবা মিথ্যা হলে দগ্ধ করুন'।

এই কথা শুনে অতিথি দিব্য দেহ ধারণ করে গৃহ থেকে বের হয়ে উদাত্ত স্বরে তিন ভূবন অনুনাদিত করে বললেন, 'হে সুদর্শন,তোমার মঙ্গল হোক। আমি স্বয়ং ধর্মরাজ। তোমায় পরীক্ষা করবার জন্য এসেছিলাম। তোমায় সত্য জেনে তোমার প্রতি প্রীত হলাম। যে মৃত্যু তোমার সর্বদা ছিদ্রান্বেষণ করত, সেই মৃত্যু কে তুমি জয় করেছ। তোমার পত্নী ওঘবতী তোমার গুণে ও নিজের পতিব্রত্যে নিজেকে রক্ষা করেছেন। ইনি যা বলবেন,তাই হবে।এর অন্যথা হবে না। এই ব্রহ্মবাদিনী নিজের তপস্যার প্রভাবে অর্ধশরীরে ওঘবতী মর্ত্যধামে প্রবাহিত হবেন এবং বাকি অর্ধ শরীরে তোমার অনুগমন করবেন।ওঘবতী তোমার সঙ্গে শাশ্বত ও সনাতন সেই স্বর্গে যাবেন, যেখানে গেলে মানুষ আর ফিরে আসে না। এবং তুমি সশরীরে স্বর্গে যাবে। কারণ, তুমি মৃত্যুকে জয় করেছ'।এই বলে ধর্মরাজ চলে গেলেন।

এবং তারপর দেবরাজ ইন্দ্র শ্বেতবর্ণ সহস্র অশ্বযোজিত রথে সুদর্শন ও ওঘবতীকে তুলে নিয়ে স্বর্গের উদ্দেশ্য প্রস্থান করলেন।[৪]

অন্যান্য[সম্পাদনা]

কুরুকুলপিতামহ ভীষ্ম কুরুযুদ্ধে শরবিদ্ধ হয়ে ওঘবতী নদীর তীরে শরশয্যা গ্রহণ করেন।

     উপাস্যমানং মুনিভির্দেবৈরিব শতক্রতুম্।

     দেশে পরমধর্ম্মিষ্ঠে নদীমোঘবতীমনু।।[৫]

মৎস্য পুরাণে ওঘবতী নদীকে একটি পবিত্র তীর্থরূপে উল্লেখ করা হয়েছে । শ্রাদ্ধকার্যের জন্য এটি উপযুক্ত । তবে মৎস্য পুরাণের পাঠে ঔঘবতী নামটি পাওয়া যায় ।[৬]

পণ্ডিত N.L. Dey ধারণা করেছেন যে , আপগা নদীরই আরেক নাম ওঘবতী । আবার তিনি নিজেই এ ধারণা সম্পর্কে ভিন্নমতও পােষণ করেছেন । তিনি মনে করেছেন পৃথুদক ( বা আধুনিক পেহােয়া ) , যা ওঘবতী নদীর তীরে অবস্থিত বলে মনে করা হয় , সে ধারণা সঠিক হলে ওঘবতী ও আপগাকে একাত্মক করে দেখা সম্ভব নয় । সেক্ষেত্রে মার্কণ্ড নামের নদীটি প্রাচীন ওঘবতী হয়ে থাকতে পারে , কারণ এই মার্কণ্ড ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলের নিকটেই পৃথুদক বা পেহােয়া অবস্থিত ।[৭] প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে , যমুনার উপনদী মার্কণ্ডেরই প্রাচীন নাম ছিল অরুণা । অরুণার সঙ্গে সরস্বতীর মিলনস্থল অরুণা সরস্বতী সঙ্গম নামে খ্যাত ।[৬][৮]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। বৈশম্পায়ন বলিলেন, 'রাজা ! সরস্বতী নদী সাতটি-.....। শল্য পর্ব, অধ্যায় - ৩৬, শ্লোক_৩-৪ 
  2. হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। রাজাশ্রেষ্ঠ ! মহাত্মা বশিষ্ঠ কুরুক্ষেত্রে থাকিয়া.....।শল্য পর্ব, অধ্যায় - ৩৬, শ্লোক_২৬ 
  3. হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। রাজা ! আর্য্য ও ম্লেচ্ছ এবং তাদের সহিত মিলিত অনেক মানুষ এই নদী গুলোর জল পান করে যথা-........।ভীষ্মপর্ব, অধ্যায় - ৯, শ্লোক_২২ 
  4. হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। ক্ষত্রিয় প্রধান ! কোন গৃহস্থ, ধর্ম অবলম্বন করিয়া মৃত্যু কে জয় করিয়াছিলেন। এই সকল কথাই যথাযথ ভাবে বলুন।.....। অনুশাসন পর্ব, অধ্যায় - ২, শ্লোক_৩-৮৯ 
  5. হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। শান্তি পর্ব, অধ্যায় - ৪৯ , শ্লোক_৬-৭ 
  6. নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী সম্পাদিত, পুরাণকোষ। ওঘবতী 
  7. Nundolal Dey, The Geographical Dictionary of Anchient and Medieval India.। Oghabati-The river Apaga,a branch of the river Chitang;... The Oghabati cannot be identified with Apaga, it must be the river Markanda.। Oriental Books Reprint Corporation,New Delhi.। পৃষ্ঠা 142। 
  8. Nundolal Dey, The Geographical Dictionary of Anchient and Medieval India.। Aruna--A branch of the Sarasvati in Kurukshetra; It has been identified by General Cunningham with the Markanda. It junction with the Sarasvati three miles to the north-east of Prithudaka is called the Aruna-Sangama.। Oriental Books Reprint Corporation,New Delhi.। পৃষ্ঠা 11।