বিষয়বস্তুতে চলুন

এভলিয়া চেলেবি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
এভলিয়া চেলেবি
হাঙ্গেরিতে এভলিয়া চেলেবির স্মরণে নির্মিত একটি মূর্তি
জন্ম
দারভিশ মেহমেদ জিল্লি

(১৬১১-০৩-২৫)২৫ মার্চ ১৬১১
মৃত্যু১৬৮২ (বয়স ৭০–৭১)
পরিচিতির কারণসেয়াহাতনামা ("ভ্রমণ পুস্তক")

দারভিশ মেহমেদ জিল্লি (২৫ মার্চ ১৬১১ – ১৬৮২), এভলিয়া চেলেবি (উসমানীয় তুর্কি: اوليا چلبى) নামে পরিচিত, একজন উসমানীয় পরিব্রাজক ছিলেন। তিনি নিজের দেশসহ আশেপাশের অঞ্চলসমূহে ভ্রমণ করেন সেই সময়, যখন উসমানীয় সাম্রাজ্য সাংস্কৃতিক উৎকর্ষে পৌঁছেছিল।[]

এভলিয়া চেলেবি ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভ্রমণ করেন এবং সেই অভিজ্ঞতার বিবরণ তিনি ভ্রমণসাহিত্যের একটি বিখ্যাত গ্রন্থে রূপ দেন, যার নাম ছিল সেয়াহাতনামা ("ভ্রমণ পুস্তক")।[]

চেলেবি নামটি একটি সম্মানসূচক উপাধি, যার অর্থ হলো "ভদ্রলোক" বা "ধার্মিক ব্যক্তি"।

কুতাহিয়ায় এভলিয়া চেলেবির বাড়ি, যা এখন একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়

এভলিয়া চেলেবি ১৬১১ সালে ইস্তানবুলে এক ধনাঢ্য পরিবারের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন, যাদের পূর্বপুরুষ কুতাহিয়া থেকে আগত ছিল।[] তাঁর পিতা দারভিশ মেহমেদ জিল্লি ছিলেন উসমানীয় দরবারের একজন রত্নকার এবং তাঁর মা ছিলেন মেহমেদ চতুর্থ-এর প্রধান মন্ত্রী মেলেক আহমেদ পাশার এক আবখাজীয় আত্মীয়।[]

এভলিয়া চেলেবি তাঁর বইতে নিজ পিতৃপুরুষের বংশপরিচয় তুলে ধরেছেন, যা আহমদ ইয়াসাভী-এর সঙ্গে সম্পর্কিত—তুর্কি ভাষার প্রাচীনতম কবি ও সূফি সাধকদের একজন।[] তিনি দরবারি উলামাদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন।[]

সম্ভবত তিনি গুলশেনি তরিকার অনুসারী ছিলেন, কারণ তিনি কায়রোর তাঁদের খানকাহ সম্বন্ধে বিস্তারিত জ্ঞান প্রকাশ করেছেন এবং একটি গ্রাফিতিতেও নিজেকে এভলিয়া-ই গুলশেনি ("গুলশেনির এভলিয়া") হিসেবে উল্লেখ করেছেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

তিনি ছিলেন এক ধর্মপ্রাণ মুসলমান, যিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতা করতেন। তিনি কুরআন মুখস্থ পাঠ করতে পারতেন এবং প্রায়শই ইসলাম নিয়ে হাস্যরস করতেন। সুলতান মুরাদ চতুর্থের দরবারে তিনি একাধারে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও বিনোদনকর্মী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন, কিন্তু এমন কোনো চাকরি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন যা তাঁকে ভ্রমণ থেকে বিরত রাখত।[][]

তিনি ছিলেন বিখ্যাত খালওয়াতি তরিকার দরবেশ উমার গুলশেনির শিষ্য। তাঁর কণ্ঠ ও বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শিতা তাঁকে দরবারে জনপ্রিয় করে তোলে এবং প্রধান সংগীতজ্ঞ আমির গুনাও তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হন। তিনি সংগীত বিষয়ক তত্ত্ব ইল্‌ম আল-মুসিকি-তেও প্রশিক্ষিত ছিলেন।[]

তাঁর ভ্রমণলিপি রচনার শুরু হয় ইস্তানবুলে, যেখানে তিনি বিভিন্ন ভবন, বাজার, রীতিনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে নোট গ্রহণ করতেন। ১৬৪০ সালে তিনি শহরের সীমানা পেরিয়ে ভ্রমণ শুরু করেন এবং তাঁর সেই অভিজ্ঞতাগুলি সেয়াহাতনামা ("ভ্রমণ পুস্তক") নামক দশ খণ্ডের একটি গ্রন্থে রূপ নেয়। এই রচনায় তিনি ঐ সময়কার উসমানীয় সাহিত্যের প্রচলিত রীতির ব্যতিক্রম করে কথ্য ও সাহিত্যিক তুর্কির মিশ্রণে লিখেছেন, যার ফলে সেয়াহাতনামা এখনো ১৭শ শতাব্দীর উসমানীয় সমাজজীবন সম্পর্কে এক জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।[] গ্রন্থটিতে উসমানীয় ধ্রুপদি সংগীতের বাদ্যযন্ত্র নিয়েও দুটি অধ্যায় রয়েছে।[]

এভলিয়া চেলেবি ১৬৮৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তবে, তাঁর মৃত্যু ইস্তানবুলে না কায়রোতে হয়েছিল তা স্পষ্টভাবে জানা যায় না।[]

সেয়াহাতনামা

[সম্পাদনা]

তিনি ইতিহাসের দীর্ঘতম ও অন্যতম উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভ্রমণবৃত্তান্ত সেয়াহাতনামা রচনা করেন।[১০] যদিও সেয়াহাতনামা-তে অনেক বিবরণ অতিরঞ্জিত, কল্পনাপ্রসূত বা তৃতীয় পক্ষ থেকে ভুলভাবে গ্রহণ করা হয়েছে, তথাপি এই বই ১৭শ শতাব্দীর উসমানীয় সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে মূল্যবান তথ্যসূত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।[১১] এর প্রথম খণ্ড শুধুমাত্র ইস্তানবুল নিয়ে এবং শেষ খণ্ডটি মিশর নিয়ে লেখা হয়েছে।

বর্তমানে সেয়াহাতনামা-র সম্পূর্ণ ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়নি, তবে বিভিন্ন অংশের অনুবাদ পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ ইংরেজি অনুবাদ করেন জোসেফ ফন হামার-পুরগস্টাল, একজন অস্ট্রিয় লেখক ও ওরিয়েন্টালিস্ট; এটি ১৮৩৪ সালে "Evliya Efendi" নামে প্রকাশিত হয়। এই অনুবাদে প্রথম দুই খণ্ড (ইস্তানবুল ও আনাতোলিয়া) অন্তর্ভুক্ত, যদিও এর ভাষা এখন অপ্রচলিত।[১২]

অন্যান্য অনুবাদের মধ্যে রয়েছে এরিখ প্রোকোশ-এর জার্মান ভাষায় দশম খণ্ডের প্রায় পূর্ণ অনুবাদ, রবার্ট ডানকফ-এর ২০০৪ সালের প্রস্তাবনামূলক গ্রন্থ The World of Evliya Çelebi: An Ottoman Mentality এবং ডানকফ ও সুয়ং কিম-এর ২০১০ সালের নির্বাচিত অংশের ইংরেজি অনুবাদ An Ottoman Traveller: Selections from the Book of Travels of Evliya Çelebi

এভলিয়া বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের সময় স্থানীয় ভাষার নমুনা সংগ্রহ করতেন। সেয়াহাতনামা-তে প্রায় ৩০টি তুর্কি উপভাষা ও ভাষার বিবরণ রয়েছে। তিনি জার্মানফারসি ভাষার কয়েকটি শব্দের মধ্যে সাদৃশ্য উল্লেখ করেন, যদিও তিনি তাদের কোনও সাধারণ ইন্দো-ইউরোপীয় মূল স্বীকার করেননি। এছাড়াও, তিনি অনেক ককেশীয় ভাষার এবং চাকোনীয় ভাষার প্রথম লিখিত রূপ সংরক্ষণ করেন এবং উবিখ ভাষার সাহিত্যের বাইরে একমাত্র লিখিত নমুনাও তাঁর বইতে পাওয়া যায়। তিনি আরব ঘোড়া ও তাদের বিভিন্ন প্রজাতি নিয়েও বিস্তারিত বিবরণ দেন।[১৩]

সেয়াহাতনামা-র দশটি খণ্ডে এভলিয়া চেলেবি নিম্নলিখিত ভ্রমণসমূহ বর্ণনা করেছেন:[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

  1. কনস্টান্টিনোপল ও আশপাশের এলাকা (১৬৩০)
  2. আনাতোলিয়া, ককেশাস, ক্রিটআজারবাইজান (১৬৪০)
  3. সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, আর্মেনিয়ারুমেলিয়া (১৬৪৮)
  4. কুর্দিস্তান, ইরাকইরান (১৬৫৫)
  5. রাশিয়াবলকান অঞ্চল (১৬৫৬)
  6. হাঙ্গেরি-তে অস্ট্রো-উসমানীয় যুদ্ধ (১৬৬৩–৬৪)-এর সময় সামরিক অভিযান (১৬৬৩/৬৪)
  7. অস্ট্রিয়া, ক্রিমিয়া ও দ্বিতীয়বার ককেশাস ভ্রমণ (১৬৬৪)
  8. গ্রিস এবং পুনরায় ক্রিমিয়া ও রুমেলিয়া (১৬৬৭–১৬৭০)
  9. হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা ভ্রমণ (১৬৭১)
  10. মিশরসুদান ভ্রমণ (১৬৭২)

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে

[সম্পাদনা]
আধুনিক স্কোপিয়ে, উত্তর মেসিডোনিয়া-তে এভলিয়া চেলেবির নামে একটি সড়ক
  • এভলিয়া চেলেবি ওরহান পানুকের ১৯৮৫ সালের উপন্যাস The White Castle-এ উপস্থিত হয়েছেন এবং স্লোভাক লেখক জুরাজ চেরভেনাক রচিত The Adventures of Captain Bathory (Dobrodružstvá kapitána Báthoryho) ধারাবাহিক উপন্যাসেও উঠে এসেছেন।
  • İstanbul Kanatlarımın Altında (আমার ডানার নিচে ইস্তানবুল, ১৯৯৬) একটি চলচ্চিত্র, যেখানে ১৭শ শতাব্দীর শুরুতে মুরাদ চতুর্থের শাসনকালে কিংবদন্তীতুল্য বিমানচারী দুই ভাই হেজারফেন আহমেদ চেলেবিলাগারী হাসান চেলেবি-র জীবন এবং উসমানীয় সমাজব্যবস্থা তুলে ধরা হয়েছে — যার প্রত্যক্ষদর্শী ও বর্ণনাকারী হিসেবে আছেন এভলিয়া চেলেবি।
  • Evliya Çelebi ve Ölümsüzlük Suyu (এভলিয়া চেলেবি ও অমরতার জল, ২০১৪, পরিচালনা: সেরকান জেলজেলে) একটি শিশুতোষ রূপান্তর, যা এভলিয়া চেলেবির অভিযানের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। এটি প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য তুর্কি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র।
  • ইউনেস্কো এভলিয়া চেলেবির জন্মের ৪০০ বছরপূর্তি উদ্‌যাপনের জন্য তার স্মারক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।[১৪]
  • ২০১৫ সালের টিভি ধারাবাহিক Muhteşem Yüzyıl: Kösem-এ এভলিয়া চেলেবির চরিত্রে অভিনয় করেন তুর্কি অভিনেতা নেজিপ মেমিলি।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Darke, Diana (২০২২)। The Ottomans: A Cultural Legacy (ইংরেজি ভাষায়)। Thames & Hudson। পৃষ্ঠা 51। আইএসবিএন 978-0-500-77753-4 
  2. "Saudi Aramco World : The Unread Masterpiece of Evliya Çelebi"। saudiaramcoworld.com। ২০১৪-১০-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-১০-২৭ 
  3. Bruinessen, Martin (১৯৮৮)। Evliya Çelebi's Book of Travels: Evliya Çelebi in Diyarbekir। Brill। পৃষ্ঠা 3। আইএসবিএন 9004081658 
  4. Robert Dankoff, An Ottoman Mentality: The World of Evliya Çelebi, BRILL, 2004, আইএসবিএন ৯৭৮-৯০-০৪-১৩৭১৫-৮, পৃ. xii
  5. Dankoff, Robert (২০০৪)। An Ottoman Mentality: The World of Evliya Çelebi। BRILL। আইএসবিএন 90-04-13715-7 , পৃ. ২১
  6. Jerusalem: The Biography, পৃ. ৩০৩–৩০৪, Simon Sebag Montefiore, Weidenfeld & Nicolson, 2011. আইএসবিএন ৯৭৮-০-২৯৭-৮৫২৬৫-০
  7. Farmer, Henry George (১৯৩৬)। "Turkish Instruments of Music in the Seventeenth Century"। Journal of the Royal Asiatic Society 
  8. HALASI-KUN, TIBOR (১৯৭৯)। "Evliya Çelebi as Linguist"। Harvard Ukrainian Studies 
  9. "Evliya Celebi | Turkish traveler and writer"Encyclopædia Britannica (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-১০-২১ 
  10. Darke, Diana (২০২২)। The Ottomans: A Cultural Legacy (ইংরেজি ভাষায়)। Thames & Hudson। পৃষ্ঠা 146। আইএসবিএন 978-0-500-77753-4 
  11. "Evliya Celebi | Turkish traveler and writer"Encyclopædia Britannica (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-১০-১৯ 
  12. Finkel, Caroline (২০১৫)। "Joseph von Hammer-Purgstall's English Translation of the First Books of Evliya Celebi's Seyahâtname (Book of Travels)"Journal of the Royal Asiatic Society25 (1): 41–55। এসটুসিআইডি 163025559ডিওআই:10.1017/S1356186314000108 
  13. "The Evliya Çelebi Ride And Way Project, Turkey" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-১৩ 
  14. "Anniversaries celebrated by Member States | United Nations Educational, Scientific and Cultural Organization"। portal.unesco.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-১০-২৭ 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]