বিষয়বস্তুতে চলুন

উসুলে তাফসির (তাফসিরশাস্ত্র)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

উসুলে তাফসির বা ইলমে উসুলে তাফসির (আরবি: علم أصول التفسير) হলো একটি ইসলাম ধর্মীয় শাস্ত্র, যা এমন কিছু মৌলিক নীতিমালা ও ভূমিকার সমন্বয়ের গঠিত, যার মাধ্যমে কুরআনের তাফসির বা ব্যাখ্যা জানা যায়। এছাড়া এই শাস্ত্রে কুরআন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মতপার্থক্য কিভাবে সৃষ্টি হয় এবং কীভাবে তা সমাধান করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা করা হয়। [] বিখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত ইমাম ইবনে তাইমিয়া শাস্ত্রটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে বলেন: "এটি হল একটি সামগ্রিক নিয়মাবলির সমষ্টি, যা কুরআন বোঝা, এর তাফসীর ও অর্থ অনুধাবন, বর্ণিত ও বুদ্ধিভিত্তিক তথ্যের মধ্যে সত্য ও অসত্য পার্থক্য করা এবং বিভিন্ন মতামতের মধ্যে সঠিক প্রমাণ নির্দেশ করতে সাহায্য করে। []

সংজ্ঞা ও মূলনীতি

[সম্পাদনা]

উসূল শব্দের ভাষাগত অর্থ হল, এটি আরবি "আসল" (আরবি: أصل) শব্দের বহুবচন। এর অর্থ হল, কোন বস্তু বা বিষয়ের ভিত্তি বা ভিত্তিস্থল। পরিভাষায় এটি এমন কিছু বোঝায়, যার উপর অন্য কিছু নির্ভর করে, কিন্তু সে নিজে অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। []

তাফসীর শব্দের ভাষাগত অর্থ হল প্রকাশ, উদঘাটন ও ব্যাখ্যা করা।

পারিভাষিক অর্থে উসুলে তাফসীর হলো এমন একটি বিদ্যা বা জ্ঞান, যেখানে কুরআন সঠিকভাবে বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় মূলনীতি ও আলোচনা উপস্থাপন করা হয়। অর্থাৎ এই বিদ্যার মাধ্যমে সেই সকল নিয়ম কানুন, ভিত্তি ও উপায় বিস্তারিতভাবে জানা যায়, যা একজন মুফাসসিরকে (ব্যাখ্যাকারী) কুরআনের সহিহ ব্যাখ্যা দিতে সহায়তা করে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:

  • আরবি ভাষা ও তার শৈলী ভালোভাবে জানা,
  • আয়াত নাযিল হওয়ার কারণসমূহ (আসবাবুন নুযূল) জানা,
  • কুরআনের নাসিখ ও মানসুখ (বাতিল ও কার্যকর আয়াত) চেনা,
  • সাহাবা ও তাবেয়ীনের তাফসির (ব্যাখ্যা) জানা,
  • বিভিন্ন ব্যাখ্যার মধ্যে তুলনামূলকভাবে বিচার করে সঠিকটি নির্ধারণের নিয়ম জানা,
  • কুরআনের বাণীর ধরন বুঝা (যেমন: আম ও খাস, সরাসরি ও রূপক ইত্যাদি)। []

ইলমে তাফসির ও কুরআনের মধ্যে সম্পর্ক

[সম্পাদনা]
  • উসুলে তাফসির হলো কুরআনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের (উলূমুল কুরআন) একটি শাখা।
  • উসুলে তাফসিরকাওয়ায়েদে তাফসীরের (তাফসিরের নিয়মাবলী) সম্পর্ক হল কাওয়ায়েদে তাফসির মূলত উসুলে তাফসিরের একটি শাখা। []

আলোচ্য বিষয়বস্তু

[সম্পাদনা]

এ বিদ্যার আলেচ্য বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট নয়। কারণ বিভিন্ন লেখক একে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন। তবে কিছু সাধারণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো:

  1. তাফসীরের বিধান ও তার প্রকারভেদ
  2. তাফসীরের পদ্ধতিসমূহ
  3. রায় (যুক্তি) ও বর্ণনাভিত্তিক তাফসীর
  4. তাফসীরের মৌলিক নীতিমালা
  5. সালাফদের (প্রথম যুগের মুসলিমদের) তাফসীর পদ্ধতি
  6. তাফসীরে মতভেদ হওয়ার কারণ
  7. তাফসীরের ভিন্নতার প্রকার
  8. তাফসীর ঐক্যমত্য বিষয়াবলী
  9. সালাফদের বক্তব্যের ব্যাখ্যা
  10. কুরআনের পাঠভেদে ব্যাখ্যা
  11. তাফসীরের বিভিন্ন রীতির আলোচনা
  12. কুরআনের সামগ্রিক নীতিমালা (কুল্লিয়াত)
  13. তাফসীরের সাধারণ নিয়মাবলি
  14. তাফসীরে প্রাধান্য নির্ধারণের নিয়মাবলি (কোন ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য) []

উসুলে তাফসিরের মৌলিক উৎস হল এই শাস্ত্রে রচিত গ্রন্থসমূহ। যেমন:

নমুনা

[সম্পাদনা]

ইমাম যারকাশি বলেন: ২৩তম প্রকার হল কেরাতের দিকনির্দেশনা জানা এবং প্রতিজন ক্বারি কর্তৃক গৃহীত মতামতের দিক স্পষ্ট করা।”

এটি (উসুলে তাফসির) একটি মহান শাস্ত্র, যার মাধ্যমে বিভিন্ন অর্থের মহত্ব ও গভীরতা বোঝা যায়। ইমামগণ এই বিষয়ে অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন এবং একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে:

  • আল-হুজ্জা–আবু আলী আল-ফারিসি
  • আল-কাশফ–মাক্কি ইবন আবি তালিব
  • আল-হিদায়াহ–আল-মাহদাবি

তারা কিরাআতের ব্যতিক্রম দিকগুলো সম্পর্কেও বই লিখেছেন। এদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হল:

  • আল-মুহতাসিব–ইবন জিন্নী
  • আবুল বাক্বার গ্রন্থ

তবে উসুলে তাফসিরে কেবল আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা হয়। কেরাতের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। আবু ‘আমর জাহিদ তার “আল-ইয়াকূত” গ্রন্থে সাল্লাব থেকে বর্ণনা করেছেন:

যখন কুরআনের ই‘রাব (আরবী ব্যাকরণগত গঠন) সাত কারির বর্ণনায় ভিন্ন হয়, তখন আমি কোনটিকেও প্রাধান্য দেই না। তবে সাধারণ কথাবার্তায় (কুরআনের বাইরে) আমি শক্তিশালী ই‘রাবকে প্রাধান্য দেই এবং এটি গ্রহণযোগ্য।”

আবু জাফর আন-নাহহাস {فَكُّ رَقَبَةٍ} আয়াতের অর্থ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মতপার্থক্য উদ্ধৃত করে বলেন:

“ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে কেরাত সাহাবারা পড়েছেন, তা নিয়ে কটূক্তি করা নিষিদ্ধ। কারণ এগুলো রাসূল থেকেই সংরক্ষিত হয়ে এসেছে। তিনি বলেছেন: ‘কুরআন সাত হরফে নাজিল হয়েছে’ (সহীহ বুখারী/ ৪৯৯২)। অতএব উভয় কিরআতই উত্তম এবং একটিকে অন্যটির উপর অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।" []

আরো দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. مساعد بن سليمان الطيار (1423هـ)। فصول في أصول التفسير (الثانية সংস্করণ)। دار ابن الجوزي। পৃষ্ঠা (21)।  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  2. أحمد بن عبد الحليم ابن تيمية (1400هـ-1980م)। [مقدمة في أصول التفسير। دار مكتبة الحياة। পৃষ্ঠা (7)]। 25 يوليو 2022 তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=, |আর্কাইভের-তারিখ= (সাহায্য)
  3. التعريفات، علي الجرجاني، دار الكتب العلمية، 1403هـ، (ص 28). وكشاف اصطلاحات الفنون، محمد التهانوي، مكتبة لبنان، 1996م م، (1/37).
  4. التمهير في أصول التفسير، محمد السريع، دار الحضارة، 1443هـ، (ص 7).
  5. المهذب في أصول التفسير، إبراهيم الحميضي، دار ابن الجوزي، 1442هـ، (ص 14).
  6. مساعد بن سليمان الطيار (1423هـ). [فصول في أصول التفسير (ط. الثانية). دار ابن الجوزي. ص. (24-25) 
  7. بدر الدين الزركشي (1376هـ-1957م). [البرهان في علوم القرآن. تحقيق : محمد أبو الفضل إبراهيم (ط. الأولى). دار إحياء الكتب العربية. ج. 1. ص. (339-340)]. مؤرشف من الأصل في 20 نوفمبر 2021.