বিষয়বস্তুতে চলুন

ইয়াকুব আল-মানসুর

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ইয়াকুব আল-মানসুর
আমিরুল মুমিনিন
রাবাতে ইয়াকুব আল-মানসুরের অসমাপ্ত মসজিদ
আলমোহাদ খিলাফতের শাসক
রাজত্ব১১৮৪–১১৯৯
পূর্বসূরিআবু ইয়াকুব ইউসুফ
উত্তরসূরিমুহাম্মাদ আন-নাসির
মৃত্যু২৩ জানুয়ারি ১১৯৯(1199-01-23) (বয়স ৩৮–৩৯)
মারাকেশ
সমাধি
দাম্পত্য সঙ্গীআম্মতুল্লাহ বিনত আবু ইসহাক[]
সাফিয়া বিনত আবু আবদাল্লাহ ইবন মারদিনিশ[]
বংশধরমুহাম্মাদ আন-নাসির
ইদ্রিস আল-মামুন
পূর্ণ নাম
আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবন ইউসুফ ইবন আব্দুল মু’মিন আল-মানসুর
রাজবংশআলমোহাদ রাজবংশ
পিতাআবু ইয়াকুব ইউসুফ
ধর্মইসলাম

আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইউসুফ ইবনে আবদ আল-মু'মিন আল-মানসুর ( আরবি: أبو يوسف يعقوب بن يوسف بن عبد المؤمن المنصور  ; জন্ম ২৩ জানুয়ারী ১১৯৯ তৃতীয় আলমোহাদ খলিফা ছিলেন।[] পিতার উত্তরসূরী হিসেবে আল-মনসুর ১১৮৪ থেকে ১১৯৯ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তার রাজত্বকালে তিনি বাণিজ্য, স্থাপত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটান এবং সামরিক অভিযানে একের পর এক বিজয় অর্জন করেন। তিনি আইবেরিয়ান উপদ্বীপে রিকনকোয়েস্টা প্রতিহত করতে সক্ষম হন।

সামরিক পদক্ষেপ

[সম্পাদনা]

আল-মনসুরের বাবাকে ২৯ জুলাই ১১৮৪ সালে পর্তুগালে হত্যা করা হয়। ১০ আগস্ট তার বাবার মৃতদেহ নিয়ে সেভিলে পৌঁছানোর পর, তাকে তৎক্ষণাৎ নতুন খলিফা ঘোষণা করা হয়।[] আল-মনসুর তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ করেছিলেন। কিন্তু আফ্রিকায় বানু গানিয়া গোত্রের বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে বিলম্ব হয়। বিদ্রোহ দমন শেষে তিনি তিনি তার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আইবেরিয়ান উপদ্বীপের দিকে যাত্রা করেন।

১১৯০ সালের ১৩ জুলাই তিনি পর্তুগিজ টেম্পলারদের(মধ্যযুগে একটি বিখ্যাত খ্রিস্টান সামরিক সংগঠন) দুর্গ তোমার অবরোধ করলেও সেটি দখল করতে ব্যর্থ হন। তবে ১১৯১ সালে তিনি আলগার্ভ অঞ্চলের প্রধান দুর্গ পাদেরনে ক্যাসল ও আশপাশের এলাকা দখল করেন। এ এলাকাগুলো ১১৮২ সাল থেকে পর্তুগিজ রাজা সানচো প্রথমের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিভিন্ন শহর দখল করে তিনি তিন হাজার খ্রিস্টান বন্দি নিয়ে আফ্রিকায় ফিরে যান।

কিন্তু তিনি আফ্রিকায় ফিরে গেলে আইবেরিয়ান উপদ্বীপের খ্রিস্টানরা পুনরায় আক্রমণ শুরু করে। খ্রিস্টানরা সিলভস, ভেরা এবং বেজা সহ অনেক মুরিশ শহর দখল করে।

আল-মনসুর এই খবর শুনে আইবেরিয়ান উপদ্বীপে ফিরে আসেন এবং আবার খ্রিস্টানদের পরাজিত করেন। এবারও অনেক বন্দিকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে আফ্রিকায় ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়।

পরবর্তীতে যখন আল-মানসুর আফ্রিকায় ছিলেন, তখন খ্রিস্টান বাহিনী ৩ লাখের বেশি সৈন্য নিয়ে তার বিরুদ্ধে বিশাল সেনাদল গঠন করে। এই সংবাদ পাওয়া মাত্র তিনি আবারও আইবেরিয়ায় ফিরে আসেন এবং ১১৯৫ সালের ১৮ জুলাই আলারকোসের যুদ্ধে ক্যাস্টিলিয়ান রাজা আলফোন্সো অষ্টমকে পরাজিত করে। এই যুদ্ধে আল-মানসুরের বাহিনী ১.৫ লাখ শত্রু সেনাকে হত্যা করে এবং অনেক সম্পদ লুট করে। এই বিজয়ের পরই তিনি আল-মানসুর বিল্লাহ ("আল্লাহর দ্বারা বিজয়ী") উপাধি গ্রহণ করেন।[]

অভ্যন্তরীণ নীতি

[সম্পাদনা]
আল-মনসুরের শাসনামলে বাব উদয়াকে কাসবাত আল-আওদায়ে যুক্ত করা হয়।

স্থাপত্য পৃষ্ঠপোষকতা

[সম্পাদনা]

আল-মানসুরের শাসনামলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ প্রকল্প সম্পন্ন হয়। তিনি রাবাতে উদয়দের কসবায় একটি স্মৃতিস্তম্ভের ফটক তৈরি করেছিলেন এবং মারাকেশের বর্তমান কুতুবিয়া মসজিদের নির্মাণকাজ তার আমলে শেষ হয়। তিনি মারাকেশে একটি বিশাল রাজপ্রাসাদ ও দুর্গ তৈরি করেন। দুর্গটি পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে শহরের শাসকদের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই রাজকীয় অঞ্চলের মধ্যে কাসবাহ মসজিদ (এল-মানসুরিয়া মসজিদ) এবং বাব আগনাউ নামে বিশাল দরজা ছিল, যা আল-মানসুরের সময়ে নির্মিত হয়। তিনি রাবাতে আরও বৃহত্তর সুরক্ষিত রাজধানী নির্মাণের কাজ শুরু করেন। সেখানে তিনি বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদ নির্মাণের চেষ্টা করেন। তবে তাঁর মৃত্যুর পর মসজিদ এবং এই নতুন দুর্গের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। মসজিদের কিছু অংশ নিয়ে বিশাল মিনারের ভিত্তি নির্মাণ করা হয়। এটি আজ হাসান টাওয়ার নামে পরিচিত।

রাবাতের ঐতিহাসিক প্রবেশদ্বারগুলোর মধ্যে বাব এর-রুয়াহ বিশেষভাবে আল-মানসুরের সময়ে নির্মিত হয়েছিল।[][][] আল-মনসুরের বিখ্যাত কাজগুলির মধ্যে একটি হল মারাকেশের বিমারিস্তান। এটি মরক্কোর প্রথম হাসপাতাল। তিনি এটিকে বিলাসবহুল অলংকরণ ও ভাস্কর্যে সাজিয়েছিলেন। সেখানে বাগান ও জলপথও সংযুক্ত ছিল। এই হাসপাতালের ব্যয় পুরোপুরি আলমোহাদ সরকার বহন করত। বলা হয় যে খ্যাতনামা দার্শনিক ইবনে রুশদ কিছু সময়ের জন্য এই হাসপাতালে কাজ করেছিলেন।

দর্শন এবং ধর্ম

[সম্পাদনা]
"আভেরোয়েসের অপমান": আল-মনসুর তার দরবার থেকে আভেরোয়েসকে বহিষ্কার করেন ( লুই ফিগুয়ের, ১৮৬৭ চিত্র)

আল-মানসুর দার্শনিক ইবনে রুশদকে রক্ষা করেছিলেন এবং তাকে দরবারে বিশেষ সম্মান দিয়েছিলেন। অন্যান্য আলমোহাদ খলিফাদের মতো তিনিও ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। তিনি আলমোহাদ মতবাদ অনুযায়ী জাহিরি (শাব্দিক) ফিকহ অনুসরণ করতেন এবং হাদিস বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখতেন। এমনকি তিনি নবী মুহাম্মদের কথা ও কাজ নিয়ে নিজেও একটি বই লিখেছিলেন।

তিনি শুধুমাত্র কুরআন, হাদিস এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের (ইজমা) ভিত্তিতে রায় দিতে বিচারকদের নির্দেশ দেন। তার বাবা আবু ইয়াকুব কর্ডোবার পণ্ডিত ইবনে মাদা’কে প্রধান বিচারক নিয়োগ করেন। তারা একসঙ্গে আলমোহাদ সংস্কারের সময় জাহিরি মতবাদ ছাড়া সব ইসলামি বই নিষিদ্ধ করেন। তবে আল-মানসুর এতেও সন্তুষ্ট হননি। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর এসব বই আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে ইবনে মাদা’কে নির্দেশ দেন।

মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার

[সম্পাদনা]

তিনি ২৩ জানুয়ারী ১১৯৯ সালে মারাকেশে মারা যান।[] প্রথমে তাকে রাজপ্রাসাদে অস্থায়ীভাবে দাফন করা হয়। পরে আলমোহাদ খলিফাদের মূল সমাধিস্থল তিনমালে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পূর্ববর্তী আলমোহাদ খলিফা এবং ইবনে তুমার্তকেও সমাহিত করা হয়েছিল।[] (p109)

তার আলারকোস বিজয় মুসলিম ইতিহাসে দীর্ঘদিন স্মরণীয় ছিল,যখন খ্রিস্টান বাহিনী মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয় লাভ করতে থাকে। ইতিহাসবিদ ইবনে আবি জার তার ১৩২৬ সালের রাউদ আল-কিরতাস ("মাগরেবের শাসকদের ইতিহাস") গ্রন্থে এই বিজয়ের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।

মরক্কোর ফেজের বাইরে আল-মনসুরের নামে মৌলে ইয়াকুব শহরের নামকরণ করা হয়েছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. al-Fāsī, ʻAlī ibn ʻAbd Allāh Ibn Abī Zarʻ; al-Gharnāṭī, Ṣāliḥ ibn ʻAbd al-Ḥalīm (১৮৬০)। Roudh el-Kartas: Histoire des souverains du Maghreb (Espagne et Maroc) et annales de la ville de Fès (ফরাসি ভাষায়)। Impr. impériale। পৃষ্ঠা 326। 
  2. al-Fāsī, ʻAlī ibn ʻAbd Allāh Ibn Abī Zarʻ; al-Gharnāṭī, Ṣāliḥ ibn ʻAbd al-Ḥalīm (১৮৬০)। Roudh el-Kartas: Histoire des souverains du Maghreb (Espagne et Maroc) et annales de la ville de Fès (ফরাসি ভাষায়)। Impr. impériale। পৃষ্ঠা 355। 
  3. Encyclopaedia of Islam 
  4. Encyclopaedia of Islam 
  5. Deverdun, Gaston (১৯৫৯)। Marrakech: Des origines à 1912। Éditions Techniques Nord-Africaines। 
  6. Salmon, Xavier (২০১৮)। Maroc Almoravide et Almohade: Architecture et décors au temps des conquérants, 1055-1269। LienArt। 
  7. Bennison, Amira K. (২০১৬)। The Almoravid and Almohad Empires। Edinburgh University Press।