বিষয়বস্তুতে চলুন

ইবনে কুতলুবুগা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আবুল-ফিদা যাইনুদ্দিন কাসিম ইবনে কুতলুবগা আস-সুদুনি আল-জামালি আল-হানাফি

ইবনে কুতলুবুগা
إبن قطلوبغا
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম৮০২ হি./ ১৩৯৯ খ্রি.
মৃত্যু৮৭৯ হি./১৪৭৪ খ্রি
ধর্মইসলাম
আদি নিবাসআলেকজান্দ্রিয়া
উল্লেখযোগ্য কাজতাজুত তারাজিম
মুসলিম নেতা
শিক্ষক

ইবনে কুতলুবুগা ( আরবি: إبن قطلوبغا; ৮০২–৮৭৯ হি./ ১৩৯৯-১৪৭৪ খ্রি.) [] ছিলেন একজন ইসলামি পণ্ডিত, মুফাসসির, ভাষাবিদ, ঐতিহাসিকহানাফী আইনজ্ঞ। তিনি ১৩৯৯ সালে কায়রোতে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৪৭৪ সালে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। []

জীবনী

[সম্পাদনা]

তাঁর পূর্ণনাম হল আবুল-ফিদা যাইনুদ্দিন কাসিম ইবনে কুতলুবগা আস-সুদুনি আল-জামালি আল-হানাফি। তবে তিনি ইবনে কুতলুবুগা নামেই অধিক পরিচিত। “সুদুনি” উপাধিটি এসেছে তাঁর পিতাকে আযাদকারী সুদুন আল-শাইখুনির নাম থেকে। কুতলুবগা (قُطْلُوبُغَا) দুইটি তুর্কি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত একটি শব্দ: “কুতলু” অর্থাৎ বরকতময় বা মঙ্গলময় এবং "বগা" অর্থ পুরুষ হরিণ বা বলশালী পুরুষ। তাই এই নামের অর্থ দাঁড়ায় “বরকতময় বীরপুরুষ”। [][]

তিনি ৮০২ হিজরির মুহররম মাসে মিশরের কায়রো শহরে জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়সেই পিতাকে হারিয়ে তিনি এতিম অবস্থায় বড় হন। জীবিকার জন্য কিছু সময় সেলাইয়ের কাজও করেন এবং এই কাজে তিনি যথেষ্ট দক্ষতাও অর্জন করেন। যৌবনে তিনি কুরআন মুখস্ত করেন এবং এরপর ইসলামি জ্ঞান অর্জনের প্রতি মনোনিবেশ করেন। এর জন্য তিনি তৎকালীন বিখ্যাত আলেমদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাদের নিকট ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করেন। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ইবনে হাজার আসক্বালানী, ইমাম ইযযুদ্দীন ইবনে জামায়া, সিরাজুদ্দীন (যিনি আল-হিদায়ার বর্ণনাকারী হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন) এবং শরাফুদ্দীন সাকির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, উসুলে ফিকহ ও অন্যান্য ধর্মীয় জ্ঞানে গভীর অনুরাগ নিয়ে শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি বিশেষভাবে ইবনে হুমামের গবেষণা ও তার ফিকহি মতাদর্শ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। [][]

তিনি জরোতিতি থেকে তাজবিদ, আলাউদ্দিন বুখারি থেকে তাফসির এবং তাজ আহমাদ ফারগানি, ইবনুল জাযারী, বুসাইরী ও ইবনে হাজার আসকালানী থেকে হাদিসের শিক্ষা গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি মাজদি রুম ও শরাফুদ্দীন সাকিসহ অনেক বিজ্ঞ আলেমদের নিকট ফিকহ অধ্যয়ন করেন। তাজ আহমাদ ফারগানি তাঁর অন্যতম প্রধান শিক্ষক ছিলেন, যাঁর থেকে তিনি জামেউ মাসানিদে আবু হানিফা (খাওয়ারিজমি কর্তৃক সংকলিত) ও ইবনুস সালাহর উলুমুল হাদীস শুনেছেন ও অধ্যয়ন করেছেন। এরপর আরো উচ্চতর জ্ঞানের সন্ধানে তিনি আলেক্সান্দ্রিয়া, বায়তুল মুকাদ্দাসশামে অবস্থিত তৎকালীন বিখ্যাত বিদ্যাপীঠগুলির উদ্দেশে সফর করেন। এছাড়াও তিনি জীবনে বহুবার হজ্জ পালন করেছেন। []

ছাত্রজীবন শেষে কিছু দিন তিনি মিশরের বাইবার্সিয়া ও জাদাভিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন এবং এই সময়ে তাঁর কাছে অনেক প্রসিদ্ধ আলিম শিক্ষাগ্রহণ করেন। তাঁর বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে সাহভি, ইবনে শিহনা ও ইবনে যাহির নাসিরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম ইবনে হুমামের তিরোধানের পর তিনিই মিশরে হানাফি মাযহাবের নেতৃত্ব দেন। []

বিখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ ও জীবনীকার শামসুদ্দিন সাখাবি তাঁর সম্পর্কে বলেন: “তিনি ছিলেন একজন ইমাম, একজন আল্লামা (গভীর জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি), বাকপটু ও যুক্তি-তর্কে পারদর্শী; এমনকি তিনি নিজের শিক্ষকদের (জ্ঞানের ক্ষেত্রে) দোষত্রুটি অনুসন্ধানের ব্যাপারেও প্রবল আগ্রহী ছিলেন। তবে তাঁর মধ্যে কিছুটা আত্মপ্রশংসা ও বিতর্কপ্রবণতা ছিল। []

রচনাবলী

[সম্পাদনা]

কিছু ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, ইমাম ইবনে কুতলুবুগা বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ১২০টি গ্রন্থ রচনা করেছেন, যার মধ্যে প্রায় ৪০টির মত গ্রন্থ বর্তমান পাওয়া যায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য ও মুদ্রিত রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে[][]:

  • তাজুত তারাজিম: এটি হানাফি ফকিহদের জীবনী ও ফিকহি যোগ্যতায় তাদের শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কিত রচিত। এখানে তিনি অধিকাংশ প্রসিদ্ধ হানাফি আলিমের জীবনী উল্লেখ করেছেন এবং ফিকহের যোগ্যতা বিবেচনায় তাদের শ্রেণীবিন্যাস করেছেন।
  • গারিবুল কুরআন: পবিত্র কুরআনের বিরল শব্দাবলীর বিশ্লেষণ।
  • তাকওয়িমুল লিসান (২ খণ্ড): এটি একটি ভাষাগত পর্যালোচনামূলক গ্রন্থ।
  • নুযহাতুর রাইয ফি আদিল্লাতিল ফারায়িয: ইসলামি উত্তরাধিকার আইন বা ফারায়িযের দলিলসমূহের বিশ্লেষণ।
  • তালখিসু দাওলাতিত তুর্ক: তুর্কি জাতির ইতিহাস।
  • তারাজিমু মাশায়িখিল মাশায়িখ ও তারাজিমু মাশায়িখি শুয়ূখিল আসর (অসম্পূর্ণ): পূর্বসূরি আলেমদের জীবনী।
  • মুআ'জামু শুয়ূখিহি: তাঁর শিক্ষকদের তালিকা ও তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী।
  • আল কিরাআতুল আশর: দশ কেরাত সম্পর্কিত রচনা।
  • আল ফাতাওয়া: বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর প্রদত্ত ফতোয়া।
  • শারহু মুখতাসারিল মানার: উসুলে ফিকহ বিষয়ে রচিত মুখতাসারুল মানার নামক গ্রন্থের ব্যাখ্যা।
  • বুগিয়াতুর রাশিদ ফি তাকরিজি আহাদিসি শারহিল আকায়িদ: ইমাম নাসাফী কর্তৃক রচিত “আকীদায়ে নাসাফিতে" উদ্ধৃত হাদীসসমূহের বিশ্লেষণ।
  • ইত্বাফুল আহইয়া বিমা ফাতা মিন তাকরিজি আহাদিসিল ইহইয়া: ইমাম গাজালীর “ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন” গ্রন্থের হাদিসসমূহের বিশ্লেষণ।
  • মীযানুন নজর: যুক্তিবিদ্যার উপর রচনা।
  • শারহু মাসাবীহিস সুন্নাহ লিলবাগাভী ও শারহু দুরারিল বিহার লিলমুহাম্মাদ কুনিয়াবী: ফিকহি মাসয়ালা বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা।
  • আল মুসামারাহ বিস শারহিল মুসায়ারাহ লিইবনে হুমাম: ইবনে হুমামের একটি গ্রন্থের ব্যাখ্যা।
  • মান রাওয়া আন আবিহি আন জাদ্দিহি: হাদিসের রাবি (বর্ণনাকারী) সম্পর্কিত গ্রন্থ।
  • মুনইয়াতুল আলমাঈ ফিমা ফাতা মিন তাকরিজি আহাদিসিল হিদায়া: “হিদায়া” কিতাবে উল্লিখিত হাদীসসমূহের পর্যালোচনা।
  • মুজীবাতুল আহকাম ওয়া ওয়াকিয়াতুল আইয়াম: শরীয়তী বিধান ও যুগ-জীবনের ঘটনাবলী। []

আরো দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Adel Nuwayhed (১৯৮৮), مُعجم المُفسِّرين (আরবি ভাষায়) (3rd সংস্করণ), বৈরুত: مؤسسة نويهض الثقافية للتأليف والترجمة والنشر, ওসিএলসি 235971276, Wikidata Q122197128 
  2. العلاونة، أحمد (آذار 2003 م). نظرات في كتاب الأعلام (ط. الأولى). بيروت: المكتب الإسلامي. ص. 102. مؤرشف من الأصل في 2019-12-10. 
  3. التاريخ, تراحم عبر। "الشرف أبو العدل السودوني قاسم (قاسم بن قطلوبغا الزين السودوني)"tarajm.com (আরবি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৪-১৯ 
  4. لشوكاني، محمد بن علي. البدر الطالع بمحاسن من بعد القرن السابع (نسخة المكتبة الشاملة) 2/40 
  5. شمس الدين السخاوي. الضوء اللامع لأهل القرن التاسع. دار الجيل. ج. السادس. ص. 184. 
  6. الزركلي، خير الدين (أيار 2002 م). الأعلام - ج (ط. الخامسة عشر). بيروت: دار العلم للملايين. ص. 180. مؤرشف من الأصل في 2019-12-10 
  7. الشوكاني، محمد بن علي. البدر الطالع بمحاسن من بعد القرن السابع (نسخة المكتبة الشاملة) 2/40
  8. "ابن قطلوبغا - المكتبة الشاملة"shamela.ws। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৪-১৯ 
  9. ابن قطلوبغا (1413 هـ). تاج التراجم (ط. الأولى). حققه وقدّم له محمد خير رمضان يوسف - دمشق: دار القلم. ص. 9. مؤرشف من الأصل في 30 مايو 2016 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]