ইছামতী (উপন্যাস)
ইছামতী কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) রচিত শেষ প্রকাশিত উপন্যাস। ১৯৫০ সালের ১৫ই জানুয়ারি এটি মিত্রালয় প্রকাশনা থেকে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। তাঁর মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই উপন্যাসের জন্য তাকে মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার প্রদান করেন (১৯৫০-৫১)।
পটভূমি
[সম্পাদনা]ইছামতি নদীকে কেন্দ্র করে রচিত এই উপন্যাসে বিভূতিভূষণের জন্মস্থান বারাকপুর তথা নিশ্চিন্দিপুরের মোল্লাহাটি নীলকুঠির কথা বিধৃত হয়েছে। উনিশ শতকের নীলবিদ্রোহের পটভূমিতে সাধারণ মানুষের উত্থান-পতনের মর্মন্তুদ ইতিহাস ধরা পড়েছে এই রচনায়। এই মোল্লাহাটি নীলকুঠির অত্যাচারকে অবলম্বন করেই উনিশ শতকের মধ্যভাগে নীলদর্পণ (১৮৬০) নাটকটি রচনা করেন দীনবন্ধু মিত্র।
চরিত্র
[সম্পাদনা]- ভবানী বাড়ুয্যে – প্রধান চরিত্র।
- তিলু – ভবানীর সেবাপরায়ণা স্ত্রী।
- খোকা – ভবানী ও তিলুর শিশু পুত্র।
- শিপ্টন সাহেব – অত্যাচারী নীলসাহেব।
- ভজামুচি – নীলকুঠির সহিস।
- রামকানাই কবিরাজ – গ্রামের বৃদ্ধ কবিরাজ।
Anglo Indian life in rural bengal গ্রন্থের রচয়িতা Colswardi grant এই উপন্যাসের একটি চরিত্র।
পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে প্রভাব
[সম্পাদনা]প্রমথনাথ বিশীর 'কেরী সাহেবের মুন্সী', বিমল মিত্রের 'সাহেব বিবি গোলাম', রমাপদ চৌধুরীর 'লালবাঈ' প্রভৃতি ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস রচনাক্ষেত্রে এই উপন্যাসটি দিশারীর কাজ করেছে।
দিনলিপিতে উপন্যাস রচনার উল্লেখ
[সম্পাদনা]১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে বারাকপুরে অবস্থানকালে 'হে অরণ্য কথা কও' দিনলিপিতে বিভূতিভূষণ লিখেছেন,
“ | ইচ্ছে আছে এবার একটা বইয়ে হাত দেবো — নাম দেবো তার ইছামতী। বড় উপন্যাস। তাতে থাকবে ইছামতীর ধারের গ্রামগুলির অপূর্ব জীবন প্রবাহের ইতিহাস — বন নিকুঞ্জের মরা-বাঁচার ইতিহাস।কত সূর্যোদয়, কত সূর্যাস্তের নিষ্কিঞ্চন, শান্ত ইতিহাস। | ” |
উপন্যাস রচনার প্রস্তুতি হিসাবে বিভূতিভূষণের বিভিন্ন সময়ে লিখিত বিভিন্ন ডায়েরীতে মোল্লাহাটি ভ্রমণ ও নীলকুঠি পরিদর্শনের কথা পাওয়া যায়,
“ | ওখান থেকে বেরিয়ে গাঙের ধার দিয়ে কুঠীর কাছে এলুম। ভাঙা কুঠী দেখালুম কাপ্তেন চৌধুরীকে, যেমন বাল্যকালে আমাদের গ্রামে যে কেউ আসুক, তাকে কুঠী দেখাবোই। রামপদকে দেখিয়ে ছিলুম, বামনদাস মুখুয্যেকে দেখিয়েছিলুম। আজও দেখাচ্ছি ১৩১০ সাল ১৩১১ সালের পরেও। কুঠী হয়ে গেলুম মোল্লাহাটি — বেলেডাঙা, নতিডাঙার পথ দিয়ে। অনেকদিন – প্রায় ৫/৬ বছর মোল্লাহাটি আসিনি। ডাকবাংলোটাতে গিয়ে বসলুম, মেম সাহেবের গোর দেখলুম – সাহেবদের নীলকুঠীর ধ্বংসস্তূপের ওপর প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যায় বেড়িয়ে বেড়ালুম – কোথায় আজ সেই লালমুরা, ফালমন সাহেবের দল, কোথায় তাদের দলদর্পিতা, গর্বিতা মেমের দল। মহাকাল সন্ধ্যার আকাশে বিষাণ বাজিয়ে সব অবসান করে দিয়েচে। | ” |
জীবনের গভীর উপলব্ধি
[সম্পাদনা]উপন্যাসের শেষাংশে কাহিনীর প্রধান চরিত্রের মুখ থেকে লেখক জীবনের গভীর সত্য ব্যক্ত করান,
“ | এইটুকু জেনেচি, বিলাসিতা যেখানে, বাড়তি যেখানে, সেখানেই পাপ, সেখানেই আবর্জনা। আত্মা সেখানে মলিন। চৈতন্যদেব কি সাধে রঘুনাথ দাসকে উপদেশ দিয়েছিলেন, 'ভালো নাহি খাবে আর ভালো নাহি পরিবে!' আমার খোকা যদি বাঁচে, সে অন্যভাবে জীবনযাপন করবে। নির্লোভ হবে। সরল, ধার্মিক, সত্যপরায়ণ হবে। যদি সে ভগবানকে জানতে চায়, তবে সরলতা ও দীনতার মধ্যে ওকে জীবনযাপন করতে হবে। মলিন বিষয়াসক্ত মনে ভগবদ্দর্শন হয় না। আমি ওকে সেইভাবে মানুষ করবো। |
” |
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- বিভূতি উপন্যাস সমগ্র (২য় খন্ড), উপন্যাস সমগ্র, পৃষ্ঠা ১১৭০