আহমেদনগর সালতানাত

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আহমেদনগর সালতানাত
নিজাম শাহি রাজবংশ

১৪৯০–১৬৩৬
কুতুব শাহির জাতীয় পতাকা
নিজাম শাহি রাজবংশের পতাকা
আহমেদনগর সালতানাতের বিস্তার
আহমেদনগর সালতানাতের বিস্তার
রাজধানীআহমেদনগর
প্রচলিত ভাষাফার্সি (সরকারি)[১]
দক্ষিণী
উর্দু
মারাঠি
ধর্ম
ইসলাম
সরকাররাজতন্ত্র
নিজাম শাহ 
ইতিহাস 
• প্রতিষ্ঠা
১৪৯০
• বিলুপ্ত
১৬৩৬
মুদ্রামোহর
পূর্বসূরী
উত্তরসূরী
বাহমানি সালতানাত
মুঘল সাম্রাজ্য

আহমেদনগর সালতানাত ছিল মধ্যযুগে ভারতের একটি রাজ্য। দক্ষিণাত্যের উত্তরপশ্চিমে গুজরাত ও বিজাপুরের মধ্যে এই রাজ্যের অবস্থান ছিল। ১৪৯০ সালের ২৮ মে বাহমানি সেনাপতি জাহাঙ্গির খানের নেতৃত্বাধীন বাহমানি বাহিনীকে পরাজিত করার পর জুন্নারের বাহমানি গভর্নর মালিক আহমেদ স্বাধীনতা ঘোষণা করে আহমেদনগর সালতানাতে নিজাম শাহি রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।[২] প্রথমে তার রাজধানী ছিল জুন্নার শহর। পরে এর নাম শিভনেরি রাখা হয়। ১৪৯৪ সালে নতুন রাজধানী আহমেদনগরের ভিত্তি স্থাপিত হয়। ১৬৩৬ সালে তৎকালীন মুঘল গভর্নর আওরঙ্গজেব (পরবর্তীতে সম্রাট) সালতানাতকে মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে একীভূত করেন।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

মালিক আহমেদ ছিলেন নিজামুল মুলক মালিক হাসান বাহরির পুত্র। পিতার মৃত্যুর পর তিনি তার পিতার উপাধি ধারণ করেন। এ কারণে তার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের নাম নিজাম শাহি রাজবংশ হয়। সিনা নদীর তীরে তিনি নতুন রাজধানী হিসেবে আহমেদনগর স্থাপন করেন। কয়েক দফা প্রচেষ্টার পর ১৪৯৯ সালে তিনি দৌলতাবাদের দুর্গ আয়ত্ত্বে আনতে সক্ষম হন।

১৫১০ সালে মালিক আহমেদ মারা যাওয়ার পর তার পুত্র প্রথম বুরহান শাহ তার উত্তরসুরি হন। এসময় তার বয়স ছিল সাত বছর। তার শাসনামলের প্রথমদিকে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল কর্মকর্তা মুকাম্মাল খান ও তার পুত্রের হাতে। ১৫৫৩ সালে প্রথম বুরহান শাহ মারা যান। তার ছয় পুত্র ছিল। তন্মধ্যে হুসাইন তার উত্তরসুরি হন। প্রথম হুসাইন শাহ ১৫৬৫ সালে মারা যাওয়ার পর তার শিশু পুত্র মুরতাজা সুলতান হন। তার শৈশবাবস্থায় চান্দ বিবি নামে পরিচিত তার মা খানজাদা হুমায়ুন সুলতানা শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। মুরতাজা শাহ ১৫৭২ সালে বেরার জয় করেন। ১৫৮৮ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর তার পুত্র মিরন হুসাইন ক্ষমতালাভ করেন। তিনি দশ মাসের কিছু বেশি সময় শাসন করেছেন। এরপর তিনি বিষপ্রয়োগের ফলে মারা যান। ইসমাইল নামের মিরন হুসাইনের এক চাচাত ভাই ক্ষমতালাভ করেন। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা জামাল খানের হাতে ছিল। জামাল খান ছিলেন দরবারের দক্ষিণী/হাবশি গোষ্ঠীর প্রধান। ১৫৯১ সালে রোহানখেদের যুদ্ধে জামাল খান নিহত হন। শীঘ্রই ইসমাইল শাহ ধরা পড়েন এবং তার পিতা বুরহান কর্তৃক কারারুদ্ধ হন। বুরহান নিজে বুরহান শাহ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে বসেছিলেন। কিন্তু চান্দ বিবি তার সাথে লড়াই করেন। ১৬০০ সালে চান্দ বিবির মৃত্যুর পর আহমেদনগর মুঘলদের হস্তগত হয় এবং বাহাদুর শাহ কারারুদ্ধ হন।

আহমেদনগর শহর এবং সংলগ্ন অঞ্চল মুঘলদের হস্তগত হলেও রাজ্যের অনেক অংশ নিজাম শাহি কর্মকর্তাদের হাতে ছিল। মালিক আম্বার ও অন্যান্য কর্মকর্তারা ১৬০০ সালে মুঘলদের প্রত্যাখ্যান করে নতুন রাজধানী পারান্দায় দ্বিতীয় মুরতাজা শাহকে সুলতান ঘোষণা করেন। মালিক আম্বার প্রধানমন্ত্রী এবং আহমেদনগরের ওয়াকিল-উস-সুলতান হন।[৩] পরবর্তীতে রাজধানী প্রথমে জুন্নার এবং এরপর খাডকিতে স্থানান্তরিত হয়। মালিক আম্বার ১৬২৬ সালে মারা যান। শীঘ্রই সম্রাট শাহজাহান নিজাম শাহিদের উৎখাত করার জন্য দক্ষিণাত্যের সুবেদার মহবত খানকে নির্দেশ দেন। মহবত খান আহমেদনগর আক্রমণ করেন। ফতেহ খান এবং বালক যুবরাজ তৃতীয় হুসাইন নিজাম শাহ উভয়ে নিহত হন। শীঘ্রই ইতঃপূর্বে অনুপস্থিত সেনাপতি শাহাজি ভোসলে বিজাপুরের সহায়তায় নিজাম শাহি বংশধর শিশু মুরতাজাকে সিংহাসনে বসান এবং নিজে তার অভিভাবক হন। মুরতাজা ও শাহাজির পরিবার মাহুলি দুর্গে অবস্থান করছিল। শাহজাহান দ্রুত বিজাপুরের মুহাম্মদ আদিল শাহর সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। এরপর মুঘল সেনাপতি খান জামান (মহবত খানের পুত্র) এবং আদিল শাহি সেনাপতি রানাদুল্লা খান (রুস্তম-এ-জামানের পিতা) মাহুলি আক্রমণ করেন। শাহাজি কয়েকবার অবরোধ ভাঙতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। জিজাবাই এবং তরুণ শিবাজি ছদ্মবেশে মাহুলি থেকে পালিয়ে যান। তবে মুরতাজার মা সাজিদা তাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়েন। মুরতাজাকে শাহজাহান এবং মুহাম্মদ আদিল শাহর সামনে আনা হয়। শাহজাহান তাকে হত্যা করার প্রস্তাব দেন যাতে নিজাম শাহিরা সমূলে উৎখাত হয়। শাহাজি তাকে সিদ্ধান্ত বদল করতে অণুরোধ করেন। কিন্তু আদিল শাহ সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। শেষপর্যন্ত শাহজাহান মুরতাজাকে মুক্তির আদেশ দেন। তবে তিনি শর্ত দেন যে শাহাজিকে অনেক দূরে দক্ষিণে প্রেরণ করা হবে যাতে তিনি মুঘলদের জন্য ক্ষতির কারণ না হন। মুরতাজাকে শাহজাহান দিল্লি নিয়ে আসেন এবং তাকে সর্দার করা হয়।

সেনাবাহিনী[সম্পাদনা]

তালিকোটের যুদ্ধ

প্রথম হুসাইন নিজাম শাহ তালিকোটের যুদ্ধের সময় দক্ষিণাত্যের একজুন প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত। তার মৃত্যুর পর চান্দ বিবি বিজাপুরগোলকুন্ডা সালতানাতের সহায়তায় মুঘলদের আক্রমণ প্রতিহত করেন।

মালিক আম্বারের রাজস্ব ব্যবস্থা[সম্পাদনা]

উত্তর ভারত এবং গুজরাত ও খান্দেশ সুবায় রাজা টোডরমলের প্রণয়নকৃত রাজস্ব ব্যবস্থার আদলে মালিক আম্বার তার রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। উর্বরতার ভিত্তিতে জমি ভালো বা মন্দ হিসেবে চিহ্নিত হত। জমির গড় ফলন সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার জন্য তিনি কয়েক বছরের হিসাব নিয়েছিলেন। প্রথমে প্রকৃত উৎপাদনের দুই-পঞ্চমাংশ রাজস্ব নির্ধারিত হয়। পরে কৃষকরা উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশের সমতুল্য নগদ প্রদানের অনুমতি পান। প্রত্যেক জমির জন্য গড় হিসেবে কর ধার্য করা হয়েছিল তবে প্রকৃত কর আদায় ফসলের অবস্থার উপর নির্ভর করত এবং তা বিভিন্ন বছর বিভিন্ন রকম হত।[৩]

শাসকগণ[সম্পাদনা]

বিশ্বাসভঙ্গের কারণে দক্ষিণাত্যের মুঘল শাসক খান জাহান লোদি ১৬৩০ সালে মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত হন। শাহজাহানের বিরুদ্ধে তিনি গোপনে তৃতীয় বুরহান নিজাম শাহর সাথে মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন।।[৪]

নিম্নোক্ত শাসকগণ আহমেদনগর শাসন করেছেন।:[৫]

  1. প্রথম আহমেদ নিজাম শাহ ১৪৯০–১৫১০
  2. প্রথম বুরহান নিজাম শাহ ১৫১০–১৫৩৩
  3. প্রথম হুসাইন নিজাম শাহ ১৫৫৩–১৫৬৫
  4. প্রথম মুরতাজা নিজাম শাহ ১৫৬৫–১৫৮৮
  5. দ্বিতীয় হুসাইন নিজাম শাহ ১৫৮৮–১৫৮৯
  6. ইসমাইল নিজাম শাহ ১৫৮৯–১৫৯১
  7. দ্বিতীয় বুরহান নিজাম শাহ ১৫৯১–১৫৯৫
  8. ইবরাহিম নিজাম শাহ ১৫৯৫–১৫৯৬
  9. দ্বিতীয় আহমেদ নিজাম শাহ ১৫৯৬
  10. বাহাদুর নিজাম শাহ ১৫৯৬–১৬০০
  11. দ্বিতীয় মুরতাজা নিজাম শাহ ১৬০০–১৬১০
  12. তৃতীয় বুরহান নিজাম শাহ ১৬১০–১৬৩১
  13. তৃতীয় হুসাইন নিজাম শাহ ১৬৩১–১৬৩৩
  14. তৃতীয় মুরতাজা নিজাম শাহ ১৬৩৩–১৬৩৬
  • মুঘল সম্রাট ও ইতিহাসবিদরা তাদের নিজাম শাহ না বলে নিজামুল মুলক সম্বোধন করতেন।

শিল্প ও স্থাপত্য[সম্পাদনা]

কলম ও কালি দ্বারা অঙ্কিত আহমেদনগর দুর্গ, আনুমানিক ১৮৮৫
আহমেদনগর দুর্গ (বামে)

নিজাম শাহি শাসকরা শিল্প ও স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। দক্ষিণাত্য সালতানাতের প্রাপ্ত চিত্রকর্মের ধারার মধ্যে আহমেদনগরের ধারা সর্বপ্রাচীন।[৫] কয়েকটি প্রাসাদ, যেমন ফারাহ বখশ বাগ,[৬] হাশ্ত বিহিস্ত বাগ, লাক্কাদ মহল এসময় নির্মিত হয়। এছাড়া সমাধি, মসজিদ ও অন্যান্য দালান নির্মিত হয়।[৭] দক্ষিণাত্যের অনেক দুর্গ যেমন জুন্নার, পারান্দা, আওসা, ধাআরুর, লোহোগাদ প্রভৃতিতে তাদের শাসনামলে উন্নয়ন হয়।

গ্যালারি[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Brian Spooner and William L. Hanaway, Literacy in the Persianate World: Writing and the Social Order, (University of Pennsylvania Press, 2012), 317.
  2. Sen, Sailendra (২০১৩)। A Textbook of Medieval Indian History। Primus Books। পৃষ্ঠা 118। আইএসবিএন 978-9-38060-734-4 
  3. Majumdar, R. C., সম্পাদক (২০০৭) [first published 1969], The Mughal Empire, History and Culture of Indian People, Bombay: Bharatiya Vidya Bhavan, পৃষ্ঠা 415–45, আইএসবিএন 978-8172764074 
  4. Jayapalan, N. (২০০১)। History of India। Atlantic Publishers & Distributors (P) Limited। পৃষ্ঠা 167। আইএসবিএন 9788171569281। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৫-১৭ 
  5. Michell, George & Mark Zebrowski. Architecture and Art of the Deccan Sultanates (The New Cambridge History of India Vol. I:7), Cambridge University Press, Cambridge, 1999, আইএসবিএন ০-৫২১-৫৬৩২১-৬, p.274
  6. Sohoni, Pushkar. "Change and Memory in Farah Bagh, Ahmadnagar" in Journal of Deccan Studies, v. 5 no. 2 (Jul–Dec 2007), pp. 59-77.
  7. Sohoni, Pushkar. "Architecture of the Nizam Shahs" in Helen Philon (ed.), Silent Splendour: Palaces of the Deccan, 14th - 19th centuries (Mumbai: Marg Publications, 2010).

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]