আলোচ্যসূচী নির্ধারণ তত্ত্ব

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

আলোচ্যসূচী নির্ধারণ তত্ত্ব এই তত্ত্বে বলা হয়েছে যে মিডিয়া বা গণমাধ্যম মাধ্যমগুলি, সমস্যাগুলি সনাক্ত এবং প্রচার করার ক্ষমতার মাধ্যমে, সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির মনোযোগ আকর্ষণ করে এমন সমস্যাগুলি গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে,[১] এবং নির্দিষ্ট বিষয়ে জনমতকে নির্দেশ করে।[২]

গণমাধ্যমই ঠিক করে দেয় জনগণ কোন বিষয়ে ভাববে কিন্তু কি চিন্তা করবে সেটি কখনো ঠিক করে দেয় না। অর্থাৎ মিডিয়া বা গণমাধ্যমে প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা কি হবে তা নির্ধারণ করে গণমাধ্যমই, আবার সেই অনুষ্ঠান দেখানোর জন্য জনগণকে প্রভাবিত করেও গণমাধ্যম কিন্তু জনগণ মূলত কি চায় সেটি কখনোই গণমাধ্যমে তুলে ধরা হয় না।

১৯৬৮ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় ১০০ জন মানুষের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় ম্যাক্স ম্যাককম্বস এবং ডোনাল্ড শ একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে মিডিয়া বা গণমাধ্যমই মানুষকে প্রভাবিত করে যে সে কোন বিষয় নিয়ে ভাববে। সোজা কথায় যে ইস্যু গণমাধ্যমে প্রাধান্য পাবে তা সাধারণ মানুষের চিন্তা চেতনাতেও প্রাধান্য পাবে যেখানে গণমাধ্যমের প্রচারের বাইরেও নানান বড় ইস্যুসমূহ রয়েছে যা কিনা জনগণের সাথে সম্পৃক্ত। পরে এই গবেষণাটির জের ধরে ১৯৭২ সালে Public Quarterly Opinion এ ৪০০টিরও বেশি কেইস স্টাডি পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশিত হয় যেখানে দেখানো হয়েছে গণমাধ্যমগুলো কীভাবে তাদের আলোচ্যসূচী নির্ধারণ করে।

গণমাধ্যমের আলোচ্যসূচী নির্ধারণের ধাপঃ গণমাধ্যমের আলোচ্যসূচী নির্ধারণের কাজটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয় । প্রথমে, গণমাধ্যম কোনো বিষয় বেছে নেয়, পরে জনগণের সেই বিষয় নিয়ে ভাবা উচিত এই ধারণাকে বদ্ধমূল করতে গণমাধ্যম বিষয়টি আবার গুরুত্বসহকারে নিয়মিত খবর বা মতামত আকারে প্রকাশ করতে থাকে। এতে জনগণের মাঝে বিষয়টি সম্বন্ধে আগ্রহ জাগে অর্থাৎ প্রভাব বিস্তার হয়। পরে প্রভাব বিস্তারের ফলেই উক্ত বিষয়টি আলোচ্যসূচীতে পরিণত হয় এবং তা গণমাধ্যমের পাশাপাশি জনগণের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

গণমাধ্যমের আলোচ্যসূচী নির্ধারণের কৌশলঃ

দ্বার রক্ষণঃ দ্বার রক্ষণ বলতে বোঝায় আধেয় বা বিষয় নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াকে। প্রতিদিনই আমাদের চারপাশে নানান ঘটনা ঘটে, কিন্তু গণমাধ্যম সব সংবাদ প্রচার করে কী? দেখা যায় ভিন্ন ভিন্ন গণমাধ্যম তাদের হাউজ পলিসি অনুযায়ী সংবাদ প্রচার করে। হাউজ পলিসির মাঝে রাজনৈতিক আদর্শ, প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন সবকিছুই ন্যস্ত থাকে। মূলত প্রাতিষ্ঠানিক আদর্শ বা হাউজ পলিসির বাইরে যায় এমন কোনো কিছুই গণমাধ্যম করে না, যতই তা জনগণের সাথে সম্পৃক্ত হোক না কেনো। আর এই জিনিসগুলো হয় দ্বার রক্ষণের কারণে।

মূখ্যকরণঃ গণমাধ্যমে কিছু বিষয় খুব ফলাও করে প্রচার করা হয় আর কিছু বিষয় একেবারে সাদামাটা আকারে উপস্থাপন করা হয়। পত্রিকায় দেখা যায় যে লাল কালিতে বড় মোটা হরফে ব্যানার শিরোনাম ইত্যাদি আকারে সংবাদ উপস্থাপন করা হয়। মূলত এটি পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের জানিয়ে যে কোন বিষয়টা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কোনো সংবাদ একাধিকবার প্রচার করে বা ছেপে বা ভিন্ন ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে পাঠক-দর্শক-শ্রোতার সামনে হাজির করা হয়, আর বার্তা দিয়ে দেয়া হয় গণমাধ্যমের তরফ থেকে যে এই বিষয় নিয়েই ভাবতে হবে। আলোচ্যসূচী নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই ধরনের কাজকেই বলা হয় মূখ্যকরণ।

কাঠামোকরণঃ কোনো ঘটনা বা বিষয়কে বিশেষ আঙ্গিকে উপস্থাপন করাকেই বলে কাঠামোকরণ। দেখা যায় যে একই ঘটনা একেক গণমাধ্যম একেকভাবে প্রকাশ বা প্রচার করছে। কোনো বিষয় বা ইস্যুকে নিজস্ব আঙ্গিকে উপস্থাপন করার কৌশলই হলো কাঠামোকরণ। যেমন বাংলাদেশে ২০১১ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার কর্তৃক গৃহীত নারী উন্নয়ন নীতিমালাকে কিছু গণমাধ্যমে ‘ইসলাম বিরোধী’ হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও প্রগতিশীল গণমাধ্যমে তা নারীর সম-অধিকারের জন্য ইতিবাচক বলে উপস্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানের গণমাধ্যমগুলোয় প্রচারিত অনুষ্ঠানমালার মধ্যে টক শোর জনপ্রিয়তা অনেক। সেখানে প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন অতিথির মাঝে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বা যুক্তি তর্ক প্রদান করতে। মজার বিষয় হচ্ছে টক শো তে আলোচনার বিষয়টা কখনোই দর্শক-শ্রোতারা ঠিক করে দেন না, বিষয়টা ঠিক করে মিডিয়াই আর সেই বিষয়ের ওপর আলোচনাই দর্শক-শ্রোতারা শোনেন এবং বক্তাদের কথায় হ্যাঁ বা না মেলান। আরো পরিষ্কার উদাহরণ হিসেবে আনা যায় কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠানমালার কথা। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনও বেশিরভাগ মানুষই কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন যাদের বেশিরভাগই অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। বর্তমানে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠানাদি প্রচার হলেও সেখানে বিভিন্ন কৃষি উপাদানের নাম সহ ব্যবহারের যে পদ্ধতি সেটি অনেক কৃষকই বোঝেন না। আবার দেখা যায় বা বিভিন্ন এলাকায় সফল কৃষকদের গল্প তুলে ধরা হয় যেখানে একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সার বা কৃত্রিম বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে বেশি ফসল ফলিয়ে বেশি অর্থ আয়ের গল্প তুলে ধরা হয়, কিন্তু প্রান্তিক কৃষকদের আর্থিক সমস্যা, ন্যায্য দাম না পাওয়া সহ বিভিন্ন সমস্যার কথা কৃষকরা গণমাধ্যমের দ্বারা পৌঁছাতে পারেন না বা পৌঁছানো হয় না। আর নানান অনুষ্ঠান প্রচারিত হলেও সেখানে কৃষকদের সরাসরি মিথস্ক্রিয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।

আলোচ্যসূচী নির্ধারণ তত্ত্ব মূলত গণমাধ্যম কর্তৃক জনসাধারণকে প্রভাবিত করার এবং নিজেদের দিকে ধাবিত করার একটি কৌশলমাত্র। এতে প্রাতিষ্ঠানিক আদর্শ বা গণমাধ্যমের হাউজ পলিসিই বেশি প্রাধান্য পায় জনসাধারণের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের চাইতে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Blanton, Shannon Lindsey; Kegley, Charles William (২০১৭)। World Politics: Trend and Transformation (2016–2017 সংস্করণ)। Boston, MA: Cengage Learning। পৃষ্ঠা 507। আইএসবিএন 978-1-305-50487-5 
  2. "Agenda Setting"obo (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-৩১