আলাপ:পরশুরাম

পাতাটির বিষয়বস্তু অন্যান্য ভাষায় নেই।
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

কপিরাইট লঙ্ঘন করা হয়েছে কিনা রিভিউ করা প্রয়োজন[সম্পাদনা]

লাঙ্গলবন্দ কেন পবিত্র তীর্থস্থান হলো, কেন এখানে স্নান করলে পাপমুক্ত হয়, তা নিয়ে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে। ত্রেতাযুগের সূচনাকালে মগধরাজ্যে ভাগীরথীর উপনদী কৌশিকীর তীর ঘেঁষে ছিল সমৃদ্ধ এক নগর, যার নাম ছিল ভোজকোট। এই নগরে গাধি নামে চন্দ্রবংশীয় একজন রাজা ছিলেন। গাধির ছিল এক ছেলে বিশ্বামিত্র ও এক মেয়ে সত্যবতী। সত্যবতী বয়োপ্রাপ্ত হলে ভৃগুবংশীয় এক ব্রাহ্মণ সন্তান রিচিকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এরপর সত্যবতীর গর্ভে ঋষি নামে এক ছেলের জন্ম হয়। এই জমদগ্নিই হলেন পরশুরামের পিতা। ঋষি জমদগ্নির পাঁচ পুত্রের মধ্যে পরশুরাম ছিলেন সবার ছোট। পরশুরামের জন্মের সময় পাপভারে আক্রান্ত পৃথিবী রসাতলে যাওয়ার উপক্রম হয়। এ দুর্যোগময় মুহূর্তে পৃথিবীকে কলুষমুক্ত করতে নারায়ণের অংশ হিসেবে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন পরশুরাম। তিনি ছিলেন বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। ছোটবেলায় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল রাম। পরে ক্ষত্রিয় নিধনকল্পে হাতে পরশু বা কুঠার তুলে নিয়েছিলেন বলে তিনি পরশুরাম নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত হন। একদিন পরশুরামের মা রেণুকাদেবী জল আনতে গঙ্গার তীরে যান। সেখানে পদ্মমালী (মতান্তরে চিত্ররথ) নামক গন্ধর্বরাজ স্ত্রীসহ জলবিহার করছিলেন (মতান্তরে অপ্সরীগণসহ)। পদ্মমালীর রূপ এবং তাঁদের সমবেত জলবিহারের দৃশ্য রেণুকাদেবীকে এমনভাবে মোহিত করে যে তিনি তন্ময় হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। অন্যদিকে ঋষি জমদগ্নির হোমবেলা পেরিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে তাঁর মোটেও খেয়াল নেই। সংবিত ফিরে রেণুকাদেবী কলস ভরে ঋষি জমদগ্নির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ান। তপোবলে ঋষি জমদগ্নি সবকিছু জানতে পেরে রেগে গিয়ে ছেলেদের মাতৃহত্যার আদেশ দেন। প্রথম চার ছেলে মাকে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু পরশুরাম পিতার আদেশে মা এবং আদেশ পালন না করায় ভাইদের কুঠার দিয়ে হত্যা করেন। পরে পিতা খুশি হয়ে বর দিতে চাইলে তিনি মা এবং ভাইয়ের প্রাণ ফিরে চান। তাতেই রাজি হন ঋষি জমদগ্নি। কিন্তু মাতৃহত্যার পাপে পরশুরামের হাতে কুঠার লেগেই রইল। শত চেষ্টা করেও কুঠার খসাতে পারলেন না। পিতার কাছে জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর পাপমুক্তির উপায়ের কথা। পিতা বললেন, ‘তুমি মাতৃহত্যা ও স্ত্রীলোক হত্যা এই দুই পাপে আক্রান্ত হয়েছ, তাই তোমাকে তীর্থে ঘুরতে হবে, যে তীর্থের জলের স্পর্শে তোমার হাতের কুঠার খসে যাবে; মনে রাখবে সেই তীর্থই হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান।’ পিতার কথামতো পরশুরাম তীর্থে তীর্থে ঘুরতে লাগলেন। শেষে ভারতবর্ষের সব তীর্থ ঘুরে ব্রহ্মকুণ্ডের পুণ্য জলে স্নান করার পর তাঁর হাতের কুঠার খসে গেল। পরশুরাম মনে মনে ভাবলেন, এই পুণ্য বারিধারা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে মানুষ খুব উপকৃত হবে। তাই তিনি হাতের খসে যাওয়া কুঠারকে লাঙলে রূপান্তর করে পাথর কেটে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে মর্ত্যলোকের সমভূমিতে সেই জলধারা নিয়ে আসেন। লাঙল দিয়ে সমভূমির বুক চিরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন তিনি। ক্রমাগত ভূমি কর্ষণজনিত শ্রমে পরশুরাম ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার অন্তর্গত সোনারগাঁয়ে এসে তিনি লাঙল চালানো বন্ধ করেন। এ জন্য এই স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্দ। এরপর এই জলধারা কোমল মাটির বুক চিরে ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিশেছে। পরবর্তী সময়ে এই মিলিত ধারা বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। ব্রহ্মার তেজজাত বলে এই নদের নাম হয়েছে ব্রহ্মপুত্র। বর্তমানে নদীটি কচুরিপানায় ভরে গেছে। বুক ভেদ করে জেগেছে ধু-ধু বালুর চর। অগভীর হলেও এককালে এটা ছিল পৃথিবীর বড় নদগুলোর মধ্যে অন্যতম। তিব্বতের মানস সরোবরের কাছাকাছি ব্রহ্মকুণ্ড থেকে এ নদের জন্ম। ব্রহ্মকুণ্ডের অবস্থানস্থল প্রাচীনকালে ব্রহ্মদেশের (বর্তমান মিয়ানমার) অংশ তিব্বতে এই নদী সম্পু নামে পরিচিত। সম্পু অর্থ পবিত্র। সম্পু ভারতের আসাম রাজ্যের উত্তর-পূর্ব কোণে এসে লোহিত, দিবং এবং দিহং নামের তিনটি নদীর সঙ্গে মিশেছে। এই মিলিত স্রোত ব্রহ্মপুত্র নাম নিয়ে আসাম ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়েছে। উৎপত্তিস্থল থেকে সাগর-সঙ্গম পর্যন্ত নদটির দৈর্ঘ্য প্রায় এক হাজার ৮০০ মাইল। চৈত্র মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে ব্রহ্মপুত্রে পুণ্যস্নান শাস্ত্রোক্ত মতে নির্ধারিত। হিন্দু ঐতিহ্য অনুসারে এ দিন ব্রহ্মার আদেশে পৃথিবীর সব তীর্থ এসে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়। ওই দিন ব্রহ্মপুত্র পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তীর্থে পরিণত হয়। পুণ্য তিথিতে স্নানমন্ত্র পাঠ করে নিজ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী ফুল, বেলপাতা, ধান, দূর্বা, হরীতকী, ডাব, আমের পল্লব প্রভৃতি দিয়ে তর্পণপূর্বক ব্রহ্মপুত্রে স্নান করলে পাপমুক্ত হয়ে আশাতীত পুণ্য অর্জন করা যায়। লাঙ্গলবন্দের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। আজ থেকে ৫০০ বছর আগে শ্রীশ্রী চৈতন্যদেব লাঙ্গলবন্দে স্নান করতে এসেছিলেন। তাঁর নামে এখানে একটি মন্দির আছে। ১৯০১ সালে এসেছিলেন সনাতন ধর্মের বরপুত্র স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি শিষ্য ও আত্মীয়সহ স্নান করেছিলেন রাজঘাটে। এই রাজঘাটে নেপালের রাজারা স্নান করতেন বলে লোকমুখে শোনা যায়। লাঙ্গলবন্দেই বিসর্জিত হয়েছে ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর চিতাভস্ম। ওই ঘাট এখন গান্ধীঘাট নামে পরিচিত। বর্তমানে এখানে আছে বহু পুরোনো প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ১১টি মন্দির, জরাজীর্ণ ১৩টি স্নানঘাট, অতিথিদের থাকার জন্য নামমাত্র ভাঙাচোরা সাতটি আশ্রম এবং একই রকমের তিনটি আশ্রয়শিবির। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটারব্যাপী এই তীর্থক্ষেত্রটি অস্তিত্ব রক্ষার অপারগতা প্রকাশ করছে প্রতিনিয়ত। গঠনমূলক কোনো ব্যবস্থা না থাকায় মন্দিরগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে লুপ্তপ্রায়। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকর্তা বিষ্ণু এবং প্রলয়ের অধীশ্বর মহেশ্বর শিব। সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের এই তিন দেবতা হচ্ছেন গুণাতীত পরমব্রহ্মের প্রথম গুণময় স্বরূপ। বর্তমান যুগে এই তিন দেবতার মধ্যে বিষ্ণু এবং শিবের পূজা বহুরূপে করা হলেও ব্রহ্মার আরাধনা সে তুলনায় খুবই কম। এই পটভূমিতে ব্রহ্মতেজের উৎস থেকে সৃষ্ট বাংলাদেশের মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দকে এক ব্যতিক্রমী আধ্যাত্মিক ক্ষেত্ররূপে স্বীকার করতে হবে। তাই দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, হিন্দু পুরাণ অনুসারে লাঙ্গলবন্দ তীর্থস্থান হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারাপদ আচার্য্য: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, নাগবাড়ী, নারায়ণগঞ্জ। --অর্ণব দত্ত (আলাপ) ০৭:১২, ৪ ডিসেম্বর ২০১০ (ইউটিসি)[উত্তর দিন]