আলাপ:কুমুদিনী হাজং

পাতাটির বিষয়বস্তু অন্যান্য ভাষায় নেই।
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

কপিরাইট সন্দেহের কারণে আলাপ পাতায় সরিয়ে নেওয়া হলো[সম্পাদনা]

এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য জমিদার ও বৃটিশ পুলিশ দমন নিপীড়ন চালাতে থাকে। ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সকাল ১০ টার দিকে বিরিশিরি থেকে ৪ মাইল উত্তর-পশ্চিমে বহেরাতলী গ্রামে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর একটি দল লংকেশ্বর হাজংএর বাড়িতে হানা দেয়। কিন্তু তাদের না পেয়ে অষ্টাদশী গৃহবধু কুমুদিনী হাজং কে বন্দী করে বিরিশিরতে নিয়ে যেতে থাকে। এদিকে এখবর ছড়িয়ে পরলে রাশিমনি হাজং এর নেতৃত্বে হাজার হাজার হাজং নারী পুরুষ বৃটিশ পুলিশ বাহিনীকে ঘিরে ফেলে ও কুমুদিনী হাজংকে ছেড়ে দিতে বলে।

ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর সেনারা হাজং গ্রামবাসীর কথা কর্ণপাত না করে বিরিশিরির দিকে যেতে থাকে। রাশিমনি হাজং কয়েকজন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে কুমুদিনী হাজংকে ছাড়িয়ে নিতে গেলে সশস্ত্র সেনারা নৃশংসভাবে তাঁদের ওপর গুলি চালায়। এতে রাশিমনি হাজং গুলি বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ নৃশংস হত্যাকান্ড দেখে পেছনের পুরুষ দলের নেতা সুরেন্দ্র হাজং রাশিমনিকে ধরতে গেলে তাঁকেও নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় অন্যান্য হাজং নারী পুরুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং সশস্ত্র সেনাদের উপর বল্লম ও রামদা দিয়ে হামলা চালায়। তাঁদের হামলায় ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর দু’সেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। বাকি সেনারা দৌঁড়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে।

রাশিমনি হাজং হাজং দের কাছে আজও হাজং মাতা হিসাবে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার পাত্র। নিঃসন্তান হয়েও হাজংদের অধিকার ও নারী সংগ্রামের প্রতীক রাশিমনি হাজং সম্প্রদায়ে হাজং মাতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন আর কুমুদিনী হাজং হয়ে ওঠেন টংক আন্দোলনের প্রেরণার উত্‍স। কুমুদিনী হাজং এরপর আন্দোনল প্রত্যক্ষ ভবে অংশ গ্রহন করেন। তিনি গ্রামগুলোতে সরকারের অন্যায় অত্যাচারের প্রতিরোধ আন্দোলন ও টংক প্রথার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সাংগঠনিক কর্ম তত্‍পরতা চালান। ১৯৫০ সালে জমিদার প্রথার বিলুপ্ত সাধন পর্যন্ত এ আন্দোলন অব্যাহত থাকে। “পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহন ও প্রজাস্বত আইন ১৯৫০” -বলে সকল টংক কৃষককে তার দখলীকৃত জমির স্বাভাবিক মালিক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

এই হলো ইতিহাস। এইবার বর্তমানে ফিরি। রাস্তা ছেড়ে কিছু দূর গিয়ে এক বাঙালির বাসায় জিজ্ঞাস করলে তারা উৎসাহের সাথে দেখিয়ে দেয় বাড়ি। সে বাড়ির ছোট একটা ছেলে সাথে করে পথ দেখি নিয়ে যায়। এই সেই কুমুদিনী হাজং এর বাড়ি। একটা টিলার উপর টিনের বাড়ি। মেঝে পাকা। উঠানে ফুলের গাছ। পুজার জায়গা। অনন্যা সম্পাদিকা ও প্রাক্তন সাংসদ তাসমিমা হোসেন এই টিনের ঘরটি তৈরি করে দিয়েছেন। বাড়ি পাওয়া গেল কিন্তু যার কাছে এসেছি তাঁকে পাওয়া গেলনা। মেয়ে মেঞ্জলী হাজং এর বাড়ি বেড়াতে গেছেন। সেটা বিজয়পুর সীমান্তের পাশে। কুমুদিনী হাজং এর ছেলের সাথে কথা বলে বিদায় নিলাম। এবার টার্গেট বিজয়পুর সীমান্তে মেঞ্জলী হাজং এর বাড়ি।

বিজয়পুর সীমান্তের কাছে বিডিআর ক্যাম্প। ক্যাম্পে জিজ্ঞাস করে জানা গেল কেউ চিনেনা তাকে। তবে পাশের হাজং পল্লীতে খোঁজ করে জানা গেল বিডিআর ক্যাম্প পার হয়ে যেতে হবে। সেজন্য অনুমতি নিতে হবে। কারণ জায়গাটা একদম সীমান্তের সাথে তার পরেই ভারত। পরিচয় নিয়ে এবং যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাস করে অনুমতি দেয়া হয়।

নদীর পাশে একেবারে শান্ত হাজং পল্লীতে সাধারণ হাজংদের মত দরিদ্র কুটির। বাসায় একাই ছিলেন এই অশীতিপর নেত্রী। আমরা তাকে দেখতে এসেছি শুনে শিশুর মত আনন্দ ঝলমল করে উঠে চোখমুখে। রিমঝিমকে খুব আদর করলেন। জড়িয়ে ধরে দোয়া করলেন অনেক। আমার শুনতে চাইলাম তার সেই সময়কার কথা। কিন্তু বয়স হয়ে গেছে কিছু মনে করতে পারলেন না। জানালেন মাঝে মাঝে লোকজন আসে তাঁকে দেখতে।

আমরা যখন কথা বলছিলাম একজন সর্বদা হাসিমুখের মহিলা ভেজা শরীর নিয়ে তাড়াতাড়ি নৌকা চালিয়ে আমাদের কাছে আসেন। তিনিই মেঞ্জলী হাজং। সাথে ছোট ছেলে। নদীতে গিয়েছিলেন লোকজন কিভাবে কয়লা তুলে দেখতে।

আমি মনে মনে ভাবছিলাম কুমুদিনী হাজং এর জন্য কোন উপহার নিয়ে আসা উচিৎ ছিল। এখন টাকা দিলে কিছু মনে করবেন কীনা। আমি ইকবাল ও মুকুল কিছু টাকা ওনার হাতে দিলে নিতে চাননা। ইকবাল বলে, ”আমরাতো কোনো উপহার নিয়ে আসিনি আপনার জন্য টাকাটা রাখুন, আপনার মেয়েকে ,নাতিকে জন্য কিছু কিনে দিয়েন।’

অদ্ভুত সারল্য ভরা মনুষটা, অপরিচিত আমারা যেন তার কত আপন। তবে একটা জিনিস মনে বিধে। সব কিছু ছাপিয়ে দারিদ্রের চেহারা ফুটে উঠে, মনটা খারাপ হয়ে যায়। প্রশ্ন করি সরকার থেকে কোনো ভাতা পান কীনা? উত্তর আসে কখনই পান নাই। খুব অবাক হই না। কোথাকার কোন আদিবাসি কৃষক আন্দোলনের নেত্রিকে নিয়ে রাষ্ট্রের মাথা ব্যাথা না থাকারই কথা। কিন্তু মুকুলের মাথাব্যাথা আছে।

মুকুল সম্পর্কে দুইটা কথা বলা দরকার। মুকুল পয়সাওলা না। মোটামুটি একটা চাকরি করে। তা দিয়ে পরিবার নিয়ে বাসা ভাড়া করে ঢাকাতে থাকে। এরমধ্যেও প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা আলাদা করে রাখে গ্রামের অসহায় দরিদ্র বৃদ্ধা মহিলাদের জন্য। চারশ টাকা করে পাঁচ জনকে প্রতি মাসে পাঠায় টারা যেন একটু ভালো ভাবে থাকতে পারে। তার স্বপ্ন টাকা হলে একটা ওল্ড হোম করা যেখানে এরকম অসহায় দরিদ্র বয়স্ক লোকজন, যাদের দেখার কেউ নাই তারা যেন জীবনের শেষ কয়টা দিন থাকা খাওয়ার কষ্ট না পায়।

মুকুল জানায় তার সাহায্য করা পাঁচ জনের একজন মারা গিয়েছে। সেই জায়গায় কুমুদিনী হাজং কে দিতে চায়। সেজন্য মেঞ্জলীর কাছ থেকে মানি অর্ডার করার ঠিকানা নেয়। বয়সে ছোট মুকুলের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।

ফিরে আসার সময় নিকটাত্মীয়কে বিদায় দেয়ার মত কুমুদিনী হাজং ও তার মেয়ে আমাদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। যতক্ষণ দেখা যায় হাসিমুখে দাড়িয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত তার সাথে দেখা করতে পেরে আমাদের মন গর্ব ভরা প্রশান্তিতে ছেয়ে থাকে।

এরমধ্যে আমার মাথায় একটা ভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকে। কত টাকাই তো আমারা কতভাবে খরচ করি। কিন্তু আমরা কি পারিনা কুমুদিনী হাজং এর জন্য এমন একটা কিছু ব্যাবস্থা করতে, হতে পারে একটা গাভী কিনে দিয়ে, যাতে করে এই জীবন্ত কিংবদন্তির শেষ কয়টা দিন আরেকটু ভালো ভাবে কাটতে পারে?