আয়াতুল কুরসি
আয়াতুল কুরসি (আরবি: آية الكرسي) হচ্ছে মুসলমানদের ধর্মীয়গ্রন্থ কোরআনের দ্বিতীয় সুরা আল বাকারার ২৫৫তম আয়াত। এটি কোরআনের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ আয়াত এবং ইসলামি বিশ্বে ব্যাপকভাবে পঠিত ও মুখস্থ করা হয়। ইসলামি পণ্ডিতগণ একে কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ আয়াত বলে দাবি করে থাকেন।[১] এতে সমগ্র মহাবিশ্বের উপর আল্লাহর জোরালো ক্ষমতা ঘোষণা করা হয়েছে। মুসলমানগণ বিশ্বাস করেন যে, এটি পাঠ করলে অসংখ্য পুণ্য লাভ হয়। এছাড়া, দুষ্ট আত্মাকে দূর করতেও এই আয়াতটি ব্যবহৃত হয়।
মূল পাঠ, উচ্চারণ ও অর্থ[সম্পাদনা]
আরবি ভাষায় | উচ্চারণ | বাংলা অনুবাদ | ||
---|---|---|---|---|
اللّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لاَ تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلاَ نَوْمٌ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلاَّ بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلاَ يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلاَّ بِمَا شَاء وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ وَلاَ يَؤُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيم |
আল্লাহু লা--- ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল ক্কাইয়্যুম, লা- তা’খুজুহু সিনাত্যু ওয়ালা নাউম। লাহু মা ফিসসামা ওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্। মান যাল্লাযী ইয়াশ ফাযউ ইনদাহু--- ইল্লা বি ইজনিহ, ইয়া লামু মা বাইনা- আইদীহিম ওয়ামা খালফাহুম, ওয়ালা ইউ হিতুনা বিশাই ইম্ মিন ইল্ মিহি--- ইল্লা বিমা শা'----আ,ওয়াসিয়া কুরসি ইউহুস সামা ওয়াতি ওয়াল আরদ, ওয়ালা ইয়া উদুহু হিফজুহুমা ওয়াহুয়াল আলিয়্যূল আজী-ম। |
আল্লাহ (ঈশ্বর), তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই, তিনি জীবিত, সবকিছুর ধারক। তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না এবং নিদ্রাও নয়। আকাশ ও ভূমিতে যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁর। কে আছে এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তার অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে কিংবা পিছনে যা কিছু রয়েছে সে সবই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোনো কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। তাঁর আসন সমস্ত আকাশ ও পৃথিবীকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তার পক্ষে কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান।[২] |
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা[সম্পাদনা]
এই আয়াতের প্রথমেই বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ (উপাস্য, ইবাদাতের যোগ্য) নেই। এরপর আল্লাহর গুণাবলি বর্ণনা হয়েছে। اَلْـحَيُّ শব্দের মাধ্যমে জানানো হয়েছে যে, তিনি সর্বদা জীবিত। قَيُّوْمُ শব্দের অর্থ হচ্ছে, তিনি নিজে বিদ্যমান থেকে অন্যকেও বিদ্যমান রাখেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন। তারপর বলা হয়েছে, তাকে তন্দ্রা (নিদ্রার প্রাথমিক প্রভাব) ও নিদ্রা স্পর্শ করতে পারে না। অর্থাৎ মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রণ তাকে ক্লান্ত করে না। পরের অংশ থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ আকাশ এবং জমিনের সবকিছুর মালিক এবং তিনি যা কিছু করেন, তাতে কারো আপত্তি করার অধিকার নেই। তার অনুমতি ছাড়া তার কাছে সুপারিশ করার ক্ষমতাও কারো নেই। বলা হয়েছে, আল্লাহ অগ্র-পশ্চাৎ যাবতীয় অবস্থা ও ঘটনা সম্পর্কে অবগত। অগ্র-পশ্চাৎ বলতে এ অর্থ হতে পারে যে, তাদের জন্মের পূর্বের ও জন্মের পরের যাবতীয় অবস্থা ও ঘটনাবলি আল্লাহ জানেন। আবার এ অর্থও হতে পারে যে, অগ্র বলতে মানুষের কাছে প্রকাশ্য, আর পশ্চাত বলতে বোঝানো হয়েছে যা অপ্রকাশ্য বা গোপন। আল্লাহ যাকে যে পরিমাণ জ্ঞান দান করেন সে শুধু ততটুকুই পায়। পরের অংশে বলা হয়েছে তার আরশ ও কুরসি এত বড় যে, তা সমগ্র আকাশ ও জমিনকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। এ দুটি বৃহৎ সৃষ্টি এবং আসমান ও জমিনের রক্ষণাবেক্ষণ করা তার জন্য সহজ। শেষ অংশে আল্লাহকে “সুউচ্চ সুমহান” বলা হয়েছে।[৩]
গুরুত্ব[সম্পাদনা]
জান্নাতের দরজা[সম্পাদনা]
আবু উমামা থেকে বর্ণিত, রাসুল বলেছেন:
“ | যে ব্যক্তি প্রতি ফরজ নামাজ শেষে আয়াতুল কুরসি পড়ে, তাঁর জান্নাতে প্রবেশ করতে মৃত্যু ছাড়া কোনো কিছু বাধা হবে না।[৪] | ” |
মর্যাদাসম্পন্ন মহান আয়াত[সম্পাদনা]
আবু জর জুনদুব ইবনে জানাদাহ মুহাম্মাদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনার প্রতি সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন কোন আয়াতটি নাজিল হয়েছে? রাসূল বলেছিলেন, আয়াতুল কুরসি।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] উবাই বিন কাব থেকে বর্ণিত, মুহাম্মদ উবাই বিন কাবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তোমার কাছে কুরআন মজীদের কোন আয়াতটি সর্বমহান? তিনি বলেছিলেন, (আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুআল হাইয়্যুল কাইয়্যুম) তারপর রাসূলুল্লাহ নিজ হাত দ্বারা তার বক্ষে (হালকা) আঘাত করে বলেন: আবুল মুনযির! তোমার জ্ঞান আনন্দদায়ক হোক।[৫]
ফেরেশতা নিযুক্তকারী আয়াত[সম্পাদনা]
আবু হুরায়রা একদিন দেখতে পেলেন একজন আগন্তুক সদকার মাল চুরি করছে তখন তিনি আগন্তুকের হাত ধরে বললেন, “আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে আল্লাহর রাসূলের কাছে নিয়ে যাব।” তখন আগন্তুক বলল যে, সে খুব অভাবী আর তার অনেক প্রয়োজন। তাই দয়া করে আবু হুরায়রা তাকে ছেড়ে দিলেন। পরদিন সকালে মুহাম্মদেরর কাছে আসার পর তিনি আবু হুরায়রাকে জিজ্ঞাসা করলেন “গতকাল তোমার অপরাধী কী করেছে?” আবু হুরায়রা তখন তাকে ক্ষমা করার কথা বললেন। রাসুল বললেন, “অবশ্যই সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে আর সে আবার আসবে।” পরদিন আবু হুরায়রা চোরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন আর যখন সে আবারও চুরি করতে আসল তখন তিনি তাকে পাকড়াও করলেন আর বললেন “এবার অবশ্যই আমি তোমাকে আল্লাহর রাসুলের কাছে নিয়ে যাব।” এবারও সেই চোর বলে যে সে খুব অভাবী আর তার অনেক প্রয়োজন আর শপথ করে যে আর আসবে না। পরদিন আবার ও রাসূল তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি একই জবাব দেন আর তখন তিনি বলেন, “আসলেই সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে আর সে আবার আসবে।” পরদিনও আবার আবু হুরায়রা চোরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন আর যখন সে আবারও চুরি করতে আসল তখন তিনি তাকে পাকড়াঁও করলেন আর বললেন “এবার অবশ্যই, আমি তোমাকে আল্লাহর রাসুলের কাছে নিয়ে যাব। তুমি বারবার শপথ কর আর চুরি করতে আস।” চোর যখন দেখল এবার সে সত্যিই রাসুলের কাছে নিয়ে যাবে তখন অবস্থা বেগতিক দেখে সে বলে, “আমাকে মাফ কর। আমি তোমাকে এমন কিছু বলে দিব যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাকে কল্যাণ দান করবেন।” আবু হুরায়রা সেটা জানতে চাইলে চোর বলে, “যখন ঘুমাতে যাবে তখন আয়াতুল কুরসি (আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল……) পড়ে ঘুমাবে, তাহলে আল্লাহ তোমার জন্য একজন পাহারাদার নিযুক্ত করবেন যে তোমার সাথে থাকবে আর কোন শয়তান সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে আসতে পারবে না।” এটা শুনে আবু হুরায়রা তাকে ছেড়ে দিলেন। পরদিন রাসূল আবার অপরাধীর কথা জানতে চাইলে তিনি আগের রাতের কথা বললেন। তখন রাসূল বললেন; “যদিও সে চরম মিথ্যাবাদী, কিন্তু সে সত্য বলেছে।” রাসুল আবু হুরায়রা কে বললেন; “তুমি কি জান সে কে?” আবু হুরায়রা বললেন, “না।” রাসুল আবু হুরায়রা কে বললেন, “সে হচ্ছে শয়তান।” [সহীহ বুখারী নং ২৩১১][৬]
খারাপ জিন থেকে বেঁচে থাকার আয়াত[সম্পাদনা]
উবাই ইবনে কা‘ব হতে বর্ণিত, তার এক খেজুর রাখার থলি ছিল। সেটায় ক্রমশ তার খেজুর কমতে থাকত। একরাতে সে পাহারা দেয়। হঠাৎ যুবকের মত এক জন্তু দেখা গেলে, তিনি তাকে সালাম দেন। সে সালামের উত্তর দেয়। তিনি বলেন: তুমি কি? জিন না মানুষ? সে বলে: জিন। উবাই তার হাত দেখতে চান। সে তার হাত দেয়। তার হাত ছিল কুকুরের হাতের মত আর চুল ছিল কুকুরের চুলের মত। তিনি বলেন: এটা জিনের সুরত। সে (জন্তু) বলে: জিন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমি সবচেয়ে সাহসী। তিনি বলেন: তোমার আসার কারণ কি? সে বলে: আমরা শুনেছি আপনি সাদকা পছন্দ করেন, তাই কিছু সাদকার খাদ্যসামগ্রী নিতে এসেছি। সাহাবি বলেন: তোমাদের থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? সে বলে: সূরা বাকারার এই আয়াতটি (আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহ হুআল হাইয়্যুল কাইয়্যুম), যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় এটি পড়বে, সকাল পর্যন্ত আমাদের থেকে পরিত্রাণ পাবে। আর যে ব্যক্তি সকালে এটি পড়বে, সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের থেকে নিরাপদে থাকবে। সকাল হলে তিনি রাসুলের কাছে আসেন এবং ঘটনার খবর দেন। রাসুলুল্লাহ বলেন: সে সত্য বলেছে।” (সহিহুত তারগিব:১/৪১৮)[যাচাই প্রয়োজন]
আরও দেখুন[সম্পাদনা]
তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]
- ↑ "আপনার জিজ্ঞাসা আয়াতুল কুরসি দিয়ে কি নামাজ পড়া যাবে?"। এনটিভি। ৩ মে ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ২০ নভেম্বর ২০২০।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ আয়াতুল কুরসী ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে, সুরা আল বাকারার ২৫৫তম আয়াত, ourholyquran
- ↑ কুরআনুল কারীম (অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর) (PDF)। কুরআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। পৃষ্ঠা ২৩০–২৩৩।
- ↑ হাদিস সম্ভার ১৪৬৩, iHadis.com
- ↑ সুনানে আবু দাউদ ১৪৬০, iHadis.com
- ↑ হাদিস সম্ভার ১৪৬২, iHadis.com