বিষয়বস্তুতে চলুন

আবদেল-হালিম মাহমুদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আবদেল-হালিম মাহমুদ
৪৬তম আল-আজহারের প্রধান ইমাম
কাজের মেয়াদ
মার্চ ১৯৭৩ – ডিসেম্বর ১৯৭৮
পূর্বসূরীমোহামেদ আল ফাহহাম
উত্তরসূরীআবদেল-রহমান বিসার
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম(১৯০১-০৫-১২)১২ মে ১৯০১
আবু আহমেদ, শারকিয়া, মিশরের ক্ষেদিভেট
(বর্তমানে আল সালাম, মিশর)
মৃত্যু১৭ অক্টোবর ১৯৭৮(1978-10-17) (বয়স ৭৭)
কায়রো, মিশর
জাতীয়তামিশরীয়

আবদেল-হালিম মাহমুদ ( আরবি: الإمام الأكبر عبدالحليم محمود ) (১২ মে ১৯০১ - ১৭ অক্টোবর ১৯৭৮; ২ জমাদিউল আউয়াল ১৩২৮ হি - ১৪ যিলকদ ১৩৯৮ হিজরি) ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত আল-আজহারের প্রধান ইমাম হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।[] তিনি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার আধুনিকীকরণ, মধ্যপন্থা প্রচার এবং আধুনিক বিজ্ঞানকে ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে গ্রহণের জন্য পরিচিত ছিলেন।

জীবনের প্রথমার্ধ

[সম্পাদনা]

আবদেল-হালিম মাহমুদ ১৯১০ সালের ১২ মে মিশরের কায়রো থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে শারকিয়া প্রদেশের আবু আহমেদ (বর্তমানে আল সালাম) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অল্প বয়সেই কুরআন মুখস্থ করেন এবং তারপর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সেখান থেকে ১৯৩২ সালে স্নাতক হন। এরপর তিনি ফ্রান্সে পড়তে যান এবং ১৯৪০ সালে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।

দর্শন এবং কার্যকলাপ

[সম্পাদনা]

গবেষক মোশে আলবো এবং ইয়োরাম মেইতালের মতে, মাহমুদের লেখায় বারবার উঠে আসা বিষয়গুলো ছিল:

  • জ্ঞান ও শিক্ষার গুরুত্ব।
  • ইসলামী নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠত্ব।
  • মুসলিম ইতিহাসের অনন্যতা।
  • ইসলামী আধ্যাত্মিকতা ও ফিকহের সমন্বয়।
  • "অন্য" মতবাদ (যেমন পশ্চিমা, জায়নবাদী, কমিউনিস্ট, ধর্মনিরপেক্ষ, ও বিধর্মী) চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যান।
  • ইসলামী ধর্মতত্ত্ব ও আইনের প্রাধান্য।
  • ইসলামের ভিত্তির ওপর মিশরীয় রাজনীতি ও সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা।[]

১৯৭১ সালে আনোয়ার সাদাতের রাষ্ট্রপতিত্বকালে তিনি সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।[] এই চুক্তির মূল্য ছিল ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড[]

ইসলামী আইন

[সম্পাদনা]

মাহমুদ সবসময়ই মিশরের বেসামরিক আইন ব্যবস্থার পরিবর্তে শরিয়াহ আইন চালুর পক্ষে ছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, হুদুদ (শরিয়া আইন অনুসারে চোরের হাত কেটে ফেলার শাস্তি) আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ছিল। ইবনে সউদ এটি প্রয়োগ করে সৌদি আরবে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যদিও এটি মাত্র সাতবার কার্যকর করা হয়েছিল।[]

তিনি মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর নির্ধারণের পক্ষে একটি ফতোয়া জারি করেন। তবে তিনি স্বীকার করেছিলেন যে শরিয়ায় বিয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট বয়স উল্লেখ নেই। তিনি যুক্তি দেন, "উন্নত সমাজ বিয়ের বয়স ১৬ নির্ধারণ করেছে, এবং এটি উপযুক্ত।"[]

বিজ্ঞান

[সম্পাদনা]

মাহমুদের মতে, "ব্যক্তিগত বা সামাজিক যে কোনো পরিবর্তন বিজ্ঞানের মাধ্যমে শুরু হয়, সেটা ধর্মীয় হোক বা বস্তুগত। পরিবর্তনের পথ তাত্ত্বিক বা প্রয়োগিক বিজ্ঞান দিয়ে শুরু হলেও এর একটি লক্ষ্য থাকা জরুরি। এই লক্ষ্য হলো ইসলামী দায়িত্ব কারণ বিজ্ঞান মানুষকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করে। জ্ঞান শুধু শেখার বিষয় নয়, এটি ইবাদত ও জিহাদের এক ধরনের রূপ।"

তিনি প্রধান ইমাম থাকাকালীন আল-আজহারে নতুন অনুষদ, শিক্ষাপদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অভূতপূর্ব সংস্কার ও পুনর্জাগরণ ঘটে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন][ তথ্যসূত্র প্রয়োজন ]

সুফিবাদ

[সম্পাদনা]

আবদেল-হালিম মাহমুদ তার প্রচুর লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে সুফিবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য স্মরণীয়। তিনি সুদানি সুফি শায়খ মুহাম্মদ ওসমান আবদু আল-বুরহানির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন।

তাকে "১৪শ শতাব্দী হিজরির গাজ্জালি" উপাধি দেওয়া হয়েছিল। কারণ তিনি ইসলামের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক (যা প্রথম দর্শনে বিরোধী মনে হয়) সমন্বয় করার অনন্য ক্ষমতা রাখতেন। ১৯৬০-১৯৭০-এর দশকে, সাদাতের সময়ে মিশরে ইসলামী পুনর্জাগরণ শুরু হয়। এ সময় তিনি প্রভাবশালী ব্যাক্তিত্ব হয়ে ওঠেন।

তিনি তাসাউফকে (সুফিবাদ) একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে উপস্থাপন করেন, যা মানুষকে চূড়ান্ত সত্য বোঝার ক্ষমতা দেয়। তাসাউফের সারমর্মকে অধিবিদ্যার জ্ঞানকে (মা`রিফা) বলা হয়। অধিবিদ্যা হলো ঈশ্বরের গোপন দিক ব্যাখ্যা ও তার ভবিষ্যদ্বাণী স্পষ্ট করার বিজ্ঞান। তিনি তাসাউফকে "রহস্যবাদ" থেকে আলাদা করেন। তিনি বলেন, তাসাউফ কুসংস্কার নয় বরং একটি বিজ্ঞান।

তিনি আব্বাস মাহমুদ আল-আক্কাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, মা‘রিফা এমন একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র, যেখানে বস্তুগত বিজ্ঞান, চিন্তা (ফিকর) বা মানসিক উপলব্ধি (বাসিরা) পৌঁছাতে পারে না। এগুলো মানুষের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকে। কিন্তু তাসাউফ সেই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে এবং একমাত্র তাসাউফই এই আধ্যাত্মিক জগতের গভীরে পৌঁছাতে সক্ষম।

"আবদুল হালিমের মতে সুফিবাদ তিনটি উপাদান নিয়ে গঠিত - ইলম, জিহাদ এবং উবুদিয়া। প্রথমটি ছিল ইলম, ইসলামী আইনের জ্ঞান। তিনি শরিয়া অনুযায়ী জীবনযাপনের তাৎপর্যের উপর জোর দেন এবং শর্ত দেন যে ইসলামী আইন বোঝা এবং সেই অনুযায়ী জীবনে এর প্রয়োগ করা উচিত। তিনি আবু হামিদ আল-গাজ্জালির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ঈশ্বর তাদের আশীর্বাদ করবেন যারা আইনের জ্ঞান অনুযায়ী কাজ করে, তাদের জ্ঞান যতই সীমিত হোক না কেন। কিন্তু যারা জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আইন অমান্য করে, তাদের শাস্তি দেবেন। দ্বিতীয়টি হল জিহাদ, এটি কেবল যুদ্ধ নয়, বরং ব্যক্তি ও সমাজের বাস্তবতায় নিজেকে উপস্থাপন করে সমসাময়িক সমস্যার সমাধানে কাজ করা। আব্দুল হালিমের মতে, প্রকৃত সুফি কেবল নির্জনবাসী সাধক নন, বরং যিনি সময়ের সমস্যা মোকাবিলায় নিয়োজিত থাকেন। তিনি উদাহরণ হিসেবে আব্দুল কাদির আল-জাজাইরির (মৃত্যু: ১৮৮৩) নাম উল্লেখ করেন। তিনি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন। তৃতীয়টি হল `উবুদিয়া—অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য। যখন কেউ প্রকৃত উবুদিয়া অর্জন করে, তখন সে মারিফার (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) অধিকারী হয় এবং আল্লাহর দয়া ও রহমত লাভ করে।[]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Brown, Jonathan A.C. (২০১৪)। Misquoting Muhammad: The Challenge and Choices of Interpreting the Prophet's LegacyOneworld Publications। পৃষ্ঠা 150–151আইএসবিএন 978-1780744209। সংগ্রহের তারিখ ৪ জুন ২০১৮ 
  2. Albo, Moshe; Meital, Yoram (২০১৪)। "The Independent Path of Shaykh al-Azhar ʿAbd al-Ḥalīm Maḥmūd": 163। ডিওআই:10.1163/15700607-00542p02 
  3. Yasser Mohamed Elwy Mohamed Mahmoud (২০০৯)। A political economy of Egyptian foreign policy: State, ideology, and modernisation since 1970 (গবেষণাপত্র)। London School of Economics and Political Science। পৃষ্ঠা 161। 
  4. Paper originally prepared by Hatsuki Aishima for an international conference "Sufism, Culture, Music" held from 12 to 15 November 2005 in Tlemcen, Algeria ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১১ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]