আন্ধা হাফিজ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

আন্ধা হাফিজ হল বাংলাদেশের চট্টগ্রামে বসবাসকারী বিংশ শতকের সত্তরের দশকের কথিত এক পীর। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মেজর ফারুককে পরোক্ষভাবে প্ররোচিত করার ব্যপারে তার যোগসূত্র রয়েছে বলে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ নামক বইয়ে উল্লেখ করেছেন।[১][২]

জীবন বৃত্তান্ত[সম্পাদনা]

আন্ধা হাফিজের নিজস্ব ভাষ্যমতে, ভারতের লখনৌতে তার জন্ম হয় এবং সেখানে তার পৈত্রিক বাড়ি অবস্থিত। ১৯৫৫ সাল থেকে সে চট্রগ্রামের হালিশহরে বসবাস শুরু করে এবং পীর পেশার সূচনা করে। তার বড় ভাই চট্রগ্রাম রেলওয়েতে চাকরি করতো। তার দাবিমতে, সে সময় বাংলাদেশে তার অসংখ্য মুরীদ ছিল।[৩]

শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা[সম্পাদনা]

অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বর্ণনানুযায়ী, চট্টগ্রামের হালিশহরে আন্ধা হাফিজের ভবিষ্যতবাণী করার নামডাক ছিল এবং অসংখ্য অনুসারী ছিল। তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার ভক্ত হওয়ার সুবাদে মেজর ফারুক তার খোঁজ পায়। সে শেখ মুজিব হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে আন্ধা হাফিজের পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৫ এর মার্চ-এপ্রিল নাগাদ ব্যেঙ্গল ল্যান্সারের জন্য চট্টগ্রামের হাটহাজারীর অদূরে দুদিনের জন্য তার রেঞ্জ ফায়ারিং-এর শিডিউল পড়ায় সে সময় সে হাফিজের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায় এবং ২রা এপ্রিল তার সাথে সাক্ষাৎ করে। সাক্ষাতের প্রথমে হাফিজ ফারুকের হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ভাবে। এরপর ফারুককে সে বলে, "আমি জানি তুমি ভয়ঙ্কর কিছু করতে যাচ্ছ। করতে চাও কর, তবে মনে রেখো, আমি তোমাকে যে নীতি অনুসরণ করতে বলছি, তা যদি তুমি পালন না কর, তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।" তিনি এরপর ফারুককে তিনটি নীতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে মেনে চলতে নির্দেশ দিলেনঃ ১) আল্লাহ আর ইসলামের জন্যে ছাড়া ব্যক্তিগত লাভের জন্যে কিছু করবে না। ২) শক্তি অর্জন কর। ৩) সঠিক সময় বেছে নাও। তিনি মেজরকে আরও তিনমাস অপেক্ষা করার পরামর্শ দিলেন।[৪] ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বিকেলে ফরিদা তার স্বামীর নির্দেশে হালিশহরে আন্ধা হাফিজের কাছে শেখ মুজিব হত্যা পরিকল্পনার জরুরি খবর পৌঁছানোর চেষ্টা করে। খবরটি ছিল, ১৫ আগস্ট ফারুকরা শেখ মুজিবকে হত্যা করতে যাচ্ছে। স্ত্রী ফরিদার প্রতি ফারুকের নির্দেশ ছিল: "আন্ধা হাফিজকে বলবে, আমি ১৫ তারিখেই কাজটা করতে যাচ্ছি। আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস রেখে দেশের জন্যই আমি এ কাজটি করতে যাচ্ছি। আমি যা করছি তা জনগণের মঙ্গলের জন্যই করছি। আমি চাই তিনি আমাকে বলুক আমি ঠিক পথে আছি নাকি ভুল করছি। তিনি যদি অন্য কিছু করতে বলেন-আমি তাই করবো।" ফারুক ফরিদাকে দুপুরের মধ্যেই আন্ধা হাফিজের মন্তব্য টেলিফোনে জানিয়ে দিতে বলে। ফরিদা গিয়ে দেখলেন আন্ধা হাফিজ লুঙ্গি ও সুতির গেনজি গায়ে পায়ের উপর পা তুলে একটি নীচু চৌকিতে বসে আছে। ফরিদা তার সামনে গিয়ে বসলে হাফিজ ফরিদার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নীরবে ফারুকের পাঠানো সংবাদ শুনে নেওয়ার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। এরপর একটি দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলে আবেগজড়িত কন্ঠে উর্দু ভাষায় বলে, "তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তোমাদের যা করার করে ফেলো। তবে অত্যন্ত গোপনে কাজটা করতে হবে।" আবারো এক লম্বা নীরবতার পর সে ফরিদাকে বলে, "ফারুককে বলো কাজটা শুরু করার আগে সে যেন আল্লাহর রহমতের জন্য দোয়া করে নেয়। তার সাথীরাও যেন একইভাবে দোয়া করে নেয়। দুটি সুরা দিলাম। সে যেন অনবরত তা পাঠ করতে থাকে। তাহলে তার মন পবিত্র থাকবে। পবিত্র চিন্তা ছাড়া সে আর অন্য চিন্তা করতে পারবে না।" ফরিদা বিদায় নেওয়ার পূর্ব মূহুর্তে তার স্বামী ও সাথীদের জন্য দোয়া করতে আন্ধা হাফিজকে অনুরোধ জানালে আন্ধা হাফিজ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “চিন্তা করো না। আমি তাদের আল্লাহর হাতে সপে দিয়েছি। এটা তার ইচ্ছা। তিনিই তাদের রক্ষা করবেন। ফরিদা আন্ধা হাফিজকে বার্তাটি পৌঁছে দিয়ে পাল্টা কিছু নির্দেশনামা জানাতে ফারুককে ফোন করতে গিয়ে তৎক্ষণাৎ ঢাকার টেলিফোন লাইন অচল পায়। পরবর্তীতে লাইন সচল হলে ফারুককে টেলিফোন করা হলেও ফারুক টেলিফোন ধরেনি, সে তখন ঘুমাচ্ছিল। পরে ফরিদা শ্বশুরের সহায়তায় তাকে সেই নির্দেশনামা পাঠিয়ে দেয়।[৪]

আন্ধা হাফিজের বক্তব্য[সম্পাদনা]

লেখক ও সাংবাদিক অম্লান দেওয়ানের নেওয়া সাপ্তাহিক বিচিন্তার এক সাক্ষাৎকারে আন্ধা হাফিজ উক্ত সম্পৃক্ততার দাবি অস্বীকার করে এবং মাস্কারেনহাসকে মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস্ত করে। তার বক্তব্যমতে, "অ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস আসলে আমার কাছে কোনদিন আসেননি। কোন রাজনৈতিক দলের লোকের কাছ থেকে সে হয়তো ইনফরমেশন নিয়েছে। আসলে, কর্নেল ফারুক-রশীদ ভায়রা ভাই। দু্ই বোনকে তারা বিয়ে করেছে। তাদের স্ত্রীরা শিল্পপতি এ, কে খানের ভাগ্নি। এরা বহু আগে থেকেই আমার কাছে আসতো। এরা সবসময় আমাকে বলতো, হুজুর আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমরা যেন একসাথে মিলেমিশে থাকতে পারি। তাড়াতাড়ি যেন আমাদের বিয়ে হয়। আমিও তাদের দোয়া করি। আর দোয়ার কারণেই তাদের দুজনের বিয়ে হয় কর্নেল ফারুক-রশীদের সাথে। এরাও বিয়ের আগে থেকেই আমার কাছে আসতো। আমিতো কাউকে মানা করতে পারি না। চোর হোক, গুন্ডা হোক..সবাই আমার কাছে আসবে। সবাইকে আমি দোয়া করি। এটা বানোয়াট একটা কাহিনীমাত্র। আমি শুনতে পাই আমার নাম উল্লেখ করে বইটায় লেখা হয়েছে। আমার ছবি ছাপা হয়েছে। কে আমার ছবি তুলে নিয়েছে আমি টের পাইনি। কিন্তু আমার কাছে কোন সাংবাদিক এসে প্রশ্ন করা, স্টেটম্যান নেওয়া.. এসব কেউ কোনদিন নেয়নি। কিন্তু কিছুদিন পর শুনলাম আমি নাকি কর্নেল ফারুককে দোয়া করেছি এবং আমার দোয়া পেয়েই ফারুক শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে। প্রকৃত সাধক যারা, তারা মানুষকে ভালোবাসে। তারা কখনো কোন মানুষকে হত্যার জন্য দোয়া দিতে পারে না। .. ছোটবেলা থেকেই আমি মানুষের উপকার করে আসছি, কিন্তু কেউ বলতে পারবে না.. আমি কারো ক্ষতি করেছি। ম্যাসকারেনহাসের বইতে যখন আমার নামটা আসছে, তখন বিদেশ থেকে ভক্তরা আমাকে ঘটনাটা জানায়। আমি এতে প্রচন্ড দু:খ পাই। গ্ল্যাকসো বাংলাদেশের তখনকার চেয়ারম্যান ছিলেন ব্যারিষ্টার রশীদুজ্জামান, আমার মুরিদ..উনি কি এক কাজে তখন লন্ডন ছিলেন। উনি খবর পেয়ে লন্ডন থেকে আমাকে ফোন করেন এবং বলেন: 'হুজুর আপনার বিরুদ্ধে এসব লেখা হয়েছে।' আমি বললাম, আমার কাছেতো কেউ আসেনি। এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং মিথ্যা। রশীদুজ্জামান ম্যাসকারেনহাসের সাথে দেখা করেন এবং ম্যসকারেনহাসকে বললেন, 'আপনি হুজুরের সর্ম্পকে যেসব কথা লিখেছেন সেগুলো কি আপনি কনফার্ম হয়ে বলেছেন? হুজুরের সাাক্ষাতকার নিয়ে বলেছেন? ম্যাসকারেনহাস এতে অনুতপ্ত হলেন। তিনি রশীদুজ্জামানকে বললেন, আমি বাংলাদেশে এসে হুজুরের কাছে মাফ চেয়ে যাব। ব্যারিষ্টার রশীদ ফোনে আমাকে সব কথা জানায়। আমি রশীদকে বললাম, সে হয়তো আমার কাছে মাফ চাওয়ার সুযোগ পাবে না। আসলেও সে সুযোগ পায়নি। এর কিছুদিন পরই ম্যাসকারেনহাস হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।" বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ফারুক-রশীদ তার কাছে এসেছিলেন কিনা, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "না, এরপর উনারা আর আমার কাছে আসেননি।"[৩] অম্লান দেওয়ানের মতে, সাপ্তাহিক বিচিন্তায় উক্ত সাক্ষাতকার প্রকাশিত হওয়ার পর আন্ধা হাফিজ খুব রাগ করে। সে চট্রগ্রামের পত্রিকা স্টল থেকে সবগুলো কপি কিনে নেয় যাতে আর কেউ পড়তে না পারে। পরবর্তীতে নতুন করে সেই সংখ্যাটি ছাপা হয় এবং চট্রগ্রামে পাঠানো হয়ে। ফলে তা লাখ লাখ মানুষের হাতে পৌছে যায় এবং এতে আন্ধা হাফিজ খুব রাগ করে। সে বিচিন্তার কাকরাইলের অফিসে মিনার মাহমুদকে ফোন করে। সেনাবাহিনীর জেনারেলরা তার মুরিদ এ তথ্য প্রকাশ করার কারণে আন্ধা হাফিজ ধমকের সুরে মিনার মাহমুদকে বলে: “তোর মতো সাংবাদিক আমি এক নিমেষেই গায়েব করে ফেলতে পারি। তোরা আমার সাথে বেঈমানি করেছিস।”[৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. হাফিজ, কাজী (২৮ জানুয়ারি ২০১০)। "বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কৃতকর্মের মাশুল গুনতে হচ্ছে তাদের পরিবার পরিজনকেও"কালের কণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২০ 
  2. SINGH, AJAY; Ali, Murtaza। "CLOSING A BLOODY CHAPTER: A landmark ruling convicts Mujib's assassins"CNN। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২০ 
  3. দেওয়ান, অম্লান। "আন্ধা হাফিজের সাক্ষাৎকার – অম্লান দেওয়ান"মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২০ 
  4. বাংলাদেশঃ রক্তের ঋণ, এন্থনি মাস্কারেনহাস, অনুবাদঃ মোহাম্মদ শাহজাহান, হাক্কানি পাবলিশার্স, ১৯৮৮ , পৃষ্ঠা নংঃ ৬২, ৬৩, ৭৮, ৭৯