আঁতুড়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(আঁতুড় ঘর থেকে পুনর্নির্দেশিত)
রাজা রবি বর্মার অঙ্কিত মা ও শিশু

আঁতুড় বা আঁতুড় ঘর মূলত হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত একটি সংস্কার বা আচার। তবে গ্রামাঞ্চলে অনেক মুসলিম পরিবারেও এই প্রথাটি প্রচলিত রয়েছে। তবে মুসলিম পরিবারে শুধুমাত্র আতুড় ঘরেই (আলাদা ঘরে) রাখা হয় কিন্তু হিন্দু সমাজে প্রচলিত অন্য কোন আচার পালিত হয়না। সন্তান জন্ম হওয়ার পর প্রসূতি মায়ের ক্ষেত্রে কয়েকদিন চলমান অস্পৃশ্যতা ও অশুচিকালীন অবস্থাই হচ্ছে আঁতুড়। আঁতুড় অবস্থায় নবজাতকের মাকে আঁতুড় ঘর নামক একটি পৃথক ঘরে বাস করতে হয়। এসময় সে কোন কাজকর্ম করতে পারে না। আবার পরিবারের অল্প কয়েকজন নির্দিষ্ট সদস্য ছাড়া অন্য কেউ ওই ঘরে প্রবেশ করতে পারে না। নবজাতকের মায়ের প্রয়োজনীয় সব কাজই ওই আঁতুড় ঘরেই সম্পন্ন হয়।[১]

হিন্দু রীতি অনুযায়ী এই অশুচি অবস্থার সময়কাল পুত্র সন্তান বা কন্যা সন্তান ভেদে অথবা বর্ণভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের জন্য পুত্র সন্তান হলে তার 'আঁতুড়'-এর মেয়াদ থাকে বিশ দিন। অন্যদিকে কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে এই সময়কাল ৩০ দিন। কিন্তু শূদ্র বর্ণের প্রসূতি মায়েদের ক্ষেত্রে পুত্র কিংবা কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য হয় না। তাদের বেলায় উভয় সন্তানের ক্ষেত্রেই 'আঁতুড়'-এর মেয়াদ ৩০ দিন। সন্তান জন্মের প্রথম কয়েকদিন সব ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকলেও দশদিন পরে নবজাতকের মাতা প্রয়োজনীয় ঘরের কাজ করতে পারে। কিন্তু তারা কোন ধর্ম-কর্ম করতে পারেনা। অন্যদিকে শূদ্রদের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মের ১৩ দিন পর এই নিয়ম প্রযোজ্য হয়।[১]

আচার-অনুষ্ঠান[সম্পাদনা]

'আতুড়'কালীন সময় বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। যেমন:

  • পাঁচ উঠানি: কোন কোন ক্ষেত্রে সন্তান জন্মের পঞ্চম দিনে প্রসূতি মাকে আতুর ঘর থেকে মূল বাসভবনে নেয়া হয়। এদিন নাপিত নবজাতক এবং প্রসূতি মায়ের নখ কেটে দেয়। অর্থ ধোপাবউ দুজনকে ক্ষার দিয়ে গোসল করিয়ে দেয়। এই অনুষ্ঠানকে পাঁচটি অনুষ্ঠানও বলা হয়।
  • সূতিকাষষ্ঠী: পাঁচ উঠানে অনুষ্ঠানের পরদিন অর্থাৎ সন্তান জন্মের ষষ্ঠ দিনে সন্ধ্যায় সূতিকাষষ্ঠী বা ষেটের পূজা হয়। এই অনুষ্ঠানে গান-বাজনার আয়োজন করা হয় এবং আমন্ত্রিত অতিথিদের মিষ্টিমুখ করা হয়। কোন কোন অঞ্চলে একে ছয়ষষ্ঠীও বলে। হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে এদিন নবজাতকের ভাগ্য লেখা হয়। তাই তার মাথার পাশে দোয়াত-কলম রাখা হয়।
  • আটকড়াই: কোন কোন অঞ্চলে সন্তান জন্মের অষ্টম দিন সন্ধ্যাবেলায় কুলা বাজিয়ে তালে তালে ছড়া গেয়ে নবজাতক শিশুর মঙ্গল কামনা করা হয়। এ সময় পাড়া-প্রতিবেশীদের আটকলাই বা আটকলাই খাওয়ানো হয়। ছোলা কলাই, মুগ, মটর, খেসারি ভাজা, এবং চিড়া মুড়ি খই – এই আট রকম ভাজা দিয়ে আটকড়াই বা আটকলাই প্রস্তুত হয়। এছাড়াও এ দিন সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। আট ধরনের ভাজা খাওয়ানোয় এই অনুষ্ঠানের নাম আটকলাই, আটকড়াই অথবা আটকৌড়ে
  • নন্তা: সন্তান জন্মের নবম দিনে কোনও কোনও অঞ্চলে এই অনুষ্ঠান পালিত হয়।

এছাড়াও ক্ষেত্রবিশেষে প্রসূতি মা পরিপূর্ণ সিদ্ধিলাভ করে একুশতম বা ত্রিশতম দিনে। এদিন পুনরায় নবজাতক এবং প্রসূতি মাতাকে গোসল করানো হয় এবং তাদের নখ কাটা হয়। কোন কোন অঞ্চলে এ দিন পুনরায় ষষ্ঠীপূজাও করা হয়।

অশুচিকালীন এসব আচার-অনুষ্ঠানের বিধি-বিধান কৃত্তিবাসের অনুদিত রামায়ণ, মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল, রঘুনন্দন ভট্টাচার্যের শুদ্ধিতত্ত্ব সহ বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়।[১]

উদ্দেশ্য[সম্পাদনা]

আঁতুড় ব্যবস্থার পিছনে রয়েছে সামাজিক এবং বৈজ্ঞানিক কারণ। নবজাতক এবং প্রসূতি মাতার স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়। সন্তান জন্মদানের পর নবজাতক এবং প্রসূতি মাতা উভয়ই দুর্বল থাকে। এসময় প্রসূতি পক্ষে স্বাভাবিক কাজকর্ম করা সম্ভব নয়।[১]

বর্তমান অবস্থা[সম্পাদনা]

বর্তমানে শহরাঞ্চলে এই ব্যবস্থার প্রচলন নেই। তবে এর উদ্দেশ্য গুলো আধুনিক পদ্ধতিতে বাস্তবায়িত হয়। বাংলাদেশে প্রসূতি মায়ের ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করে। তাছাড়া শহরাঞ্চলে প্রসূতি মা এবং নবজাত উভয়ই বিভিন্ন রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধে সন্তান প্রসবের আগে এবং পরে বিভিন্ন রকম আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। গ্রামাঞ্চলেও এখন আগের মত সব আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয় না।[১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ভৌমিক, দুলাল। "আঁতুড়"bn.banglapedia.orgবাংলাপিডিয়া। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-৩০