অ্যাড হোমিনেম
অ্যাড হোমিনেম (ইংরেজি: Ad hominem) একটি লাতিন শব্দগুচ্ছ, যার অর্থ "ব্যক্তির বিরুদ্ধে" বা "মানুষের প্রতি" বিশেষত মিথ্যারোপ সম্পর্কে।[১][২] যুক্তিবিদ্যায় এটি এমন একটি আক্রমণাত্মক কৌশলকে বোঝায়, যেখানে বিতর্ক বা আলোচনা চলাকালীন যুক্তির মূল বিষয়বস্তুতে আঘাত না করে ব্যক্তি আক্রমণ করা হয়। এটি একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি বা অযৌক্তিক ত্রুটি হিসেবে গণ্য হয়, যা যুক্তিকে দুর্বল বা ভ্রান্ত করে তোলে।[৩][৪][৫]
অ্যাড হোমিনেম ফ্যালাসি
[সম্পাদনা]যুক্তিবিদ্যায়, অ্যাড হোমিনেম ফ্যালাসি হলো এমন একটি যুক্তিকৌশল, যেখানে কোনো ব্যক্তির যুক্তি বা বক্তব্যকে খণ্ডানোর পরিবর্তে ব্যক্তির চরিত্র, উদ্দেশ্য, বা অতীত আচরণকে আক্রমণ করা হয়। এর মাধ্যমে মূল সমস্যার সমাধান হয় না, বরং বিতর্ককে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
উদাহরণস্বরূপ:
- যুক্তি: "এই সিদ্ধান্তটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।"
- অ্যাড হোমিনেম আক্রমণ: "তুমি তো নিজেই পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করো, তোমার কী অধিকার এই বিষয়ে কথা বলার?"
ধরন
[সম্পাদনা]- Ad Hominem Abusive: ব্যক্তিকে সরাসরি আক্রমণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন বক্তার যুক্তি খণ্ডানোর বদলে তাকে "অজ্ঞ" বা "অনৈতিক" বলে অপমান করা।
- Ad Hominem Circumstantial: ব্যক্তির পরিস্থিতি বা আগ্রহের দিকে আঙুল তোলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, "তুমি তো নিজেই লাভবান হবে এই সিদ্ধান্ত থেকে, তাই তোমার যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।"
- Tu Quoque (তুমি নিজেও): যেখানে ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে বলা হয় যে সে নিজেই তার বক্তব্যের বিপরীতে কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, "তুমি পরিবেশের কথা বলছো, অথচ তোমার নিজের গাড়ি থেকে কার্বন নির্গমন হচ্ছে।"
ইতিহাস
[সম্পাদনা]প্রাচীন ইতিহাস
[সম্পাদনা]অ্যাড হোমিনেম কৌশল প্রথম দেখা যায় প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে। সক্রেটিস এবং অ্যারিস্টটল-এর মতো দার্শনিকরা যুক্তির বিভিন্ন রূপ নিয়ে আলোচনা করেছেন, যার মধ্যে ব্যক্তিগত আক্রমণের ব্যবহারও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা এই ধরনের আক্রমণকে একটি যৌক্তিক ভুল বলে মনে করতেন, যা প্রকৃত যুক্তির বিকল্প নয়।[৬]
মধ্যযুগীয় ও রেনেসাঁ যুগ
[সম্পাদনা]মধ্যযুগে এবং রেনেসাঁ যুগে দর্শন এবং ধর্মীয় আলোচনায় অ্যাড হোমিনেম কৌশল প্রায়শই ব্যবহৃত হতো। বিশেষ করে ধর্মীয় বিতর্ক এবং রাজনীতিতে এটি প্রচলিত ছিল।[৭][৮] রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে বিপ্লবী মতবাদের প্রতিক্রিয়ায় অ্যাড হোমিনেম কৌশল ব্যবহার করে ব্যক্তি আক্রমণ করা হতো, যাতে তাদের বক্তব্য দুর্বল করে দেখানো যায়।[৯][১০]
আধুনিক যুগ
[সম্পাদনা]আধুনিক সময়ে, বিশেষ করে রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিতর্কে অ্যাড হোমিনেম কৌশলের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি প্রায়শই গণমাধ্যম এবং সামাজিক মিডিয়ায় ব্যবহৃত হয়, যেখানে ব্যক্তিগত আক্রমণ বা চরিত্র হরণ করা হয় যুক্তির বিকল্প হিসাবে। এর ফলে, এটি একটি বিশিষ্ট যৌক্তিক ভুল হিসেবে বিবেচিত হয় এবং শিক্ষার ক্ষেত্রেও এটি ব্যাপকভাবে সমালোচিত।
অ্যাড হোমিনেমের প্রভাব
[সম্পাদনা]এ ধরনের আক্রমণ বিতর্ককে যুক্তির মূল বিষয়বস্তু থেকে সরিয়ে দেয় এবং বিতর্ককে ব্যক্তিগত স্তরে নিয়ে যায়। ফলে সমস্যা সমাধানের পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং তা পারস্পরিক বিদ্বেষ বাড়াতে পারে। একে সফলভাবে ব্যবহার করার ফলে একটি শক্তিশালী যুক্তিও দুর্বল বলে প্রমাণিত হতে পারে, যদিও আসলে তা যুক্তিসঙ্গত।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার
[সম্পাদনা]- রাজনীতি: রাজনৈতিক বিতর্কে প্রায়শই প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়, যেখানে তাদের নীতি বা বক্তব্যের পরিবর্তে তাদের চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।[১১]
- আইন: আদালতেও অ্যাড হোমিনেম আক্রমণের উদাহরণ পাওয়া যায়, যেখানে একজন আইনজীবী প্রতিপক্ষের যুক্তির পরিবর্তে তার চরিত্রের ওপর আঘাত হানতে পারেন।
- গবেষণা: বিজ্ঞান ও গবেষণায়ও অ্যাড হোমিনেম আক্রমণ দেখা যায়, যেখানে কোনো বিজ্ঞানীর কাজের পরিবর্তে তার ব্যক্তি জীবনের বিষয়বস্তু নিয়ে আক্রমণ করা হয়। [১২][১৩]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Ad Hominem: Meaning and Examples"। Encyclopædia Britannica। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২৪।
- ↑ Walton, Douglas (১৯৯৮)। Ad Hominem Arguments। University of Alabama Press। আইএসবিএন 978-0817309224
|আইএসবিএন=
এর মান পরীক্ষা করুন: checksum (সাহায্য)। - ↑ "Ad Hominem Fallacy"। Stanford Encyclopedia of Philosophy। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২৪।
- ↑ "What is an Ad Hominem Attack?"। Logically Fallacious। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২৪।
- ↑ Woods, John (২০০৪)। The Death of Argument: Fallacies in Agent Based Reasoning। Springer। আইএসবিএন 978-1402024735
|আইএসবিএন=
এর মান পরীক্ষা করুন: checksum (সাহায্য)। - ↑ Hansen, Hans (২০২০)। "Fallacies"। Stanford Encyclopedia of Philosophy।
- ↑ Govier, Trudy (২০১০)। A Practical Study of Argument (7th সংস্করণ)। Wadsworth। আইএসবিএন 978-0495603405।
- ↑ "Ad Hominem"। Encyclopedia Britannica। সংগ্রহের তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ Finocchiaro, Maurice A. (১৯৮২)। "Fallacies and the Evaluation of Reasoning"। American Philosophical Quarterly। 19 (1): 13–26।
- ↑ Dowden, Bradley (২০২১)। "Fallacy: Ad Hominem"। Internet Encyclopedia of Philosophy।
- ↑ Wrisley 2019, পৃ. 86–87।
- ↑ Tindale 2007, পৃ. 92–93।
- ↑ Hansen 2019, 1. The core fallacies।