অসহযোগ আন্দোলন (ব্রিটিশ ভারত)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

অসহযোগ আন্দোলন মহাত্মা গান্ধীভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত ভারতব্যাপী অহিংস গণ-আইন অমান্য আন্দোলনগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা এই আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে “গান্ধী যুগ”-এর সূত্রপাত ঘটায়।[১][২]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রাওলাট আইন পাস হলে, ভারতের ভাইসরয় ও ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ১৯১৯ সালের ৬ এপ্রিল সেই আইন বলবৎ করে। এই আইনবলে ভারতবাসীর উপর দমনমূলক নানা বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হয়, ন্যূনতম প্রমাণ দাখিল ব্যতিরেকেই সেনা ও পুলিশকে সাধারণ ভারতীয়দের গ্রেফতার, কয়েদ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অনুমতি দেওয়া হয়।

অধিকন্তু, ভারতীয় জনসাধারণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের একতরফা ভারতীয় সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত অনেক ভারতবাসীকেই ক্ষুব্ধ করেছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, অ্যানি বেসান্ত, গোপালকৃষ্ণ গোখলেবাল গঙ্গাধর তিলকের মতো উদার মধ্যপন্থী নেতাদের আহ্বানে হোমরুল আন্দোলন শুধুমাত্র আবেদন-নিবেদন ও রাজনৈতিক সভাসমিতির মাধ্যমে চলছিল; তার এমন কোনও বিধ্বংসী চরিত্র ছিল না যা সরকারি কাজে বিপুল বাধার সৃষ্টি করতে পারে।

চম্পারণ, খেদা, খিলাফত ও অমৃতসর[সম্পাদনা]

১৯১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং বিহারের চম্পারণগুজরাটের খেদায় মহাত্মা গান্ধী দেখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে গণ-আইন অমান্য করে সরকারি কাজে বাধা দিয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সম্ভ্রম ও দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।

১৯১৮ সালে চম্পারণ ও খেদা সত্যাগ্রহের সময় অস্বাস্থ্যকর অবস্থা, গার্হস্থ্য হিংসা, কুসংস্কার, নারীনির্যাতন ও অস্পৃশ্যতার অন্ধকারে নিমজ্জিত গরিব কৃষকদের নেতৃত্ব দেন তিনি। এই সব দুর্দশার মধ্যেও তাদের বাধ্য করা হচ্ছিল খাদ্যশস্যের বদলে নীল, তামাকতুলা উৎপাদনে। বদলে দেওয়া হচ্ছিল অতি নগণ্য মজুরি। তার উপর, দুর্ভিক্ষ সত্ত্বেও তাদের করদানে বাধ্য করা হচ্ছিল। শেষপর্যন্ত সরকার এই মর্মে চুক্তিস্বাক্ষরে বাধ্য হন যে, দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে কর মকুব করা হবে, কৃষকদের নিজ ইচ্ছামতো ফসল চাষ করতে দেওয়া হবে, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে ও সমস্ত জমি ও সম্পত্তি যা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, তাও ফেরত দেওয়া হবে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এটিই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বৃহত্তম বিজয়।

মহাত্মা গান্ধীকে সাহায্য করেন রাজেন্দ্র প্রসাদজওহরলাল নেহেরুর মতো একদল তরুণ ভারতীয় বিপ্লবী। খেদা আন্দোলনটি সামগ্রিক পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তিনিও গান্ধীজির অন্যতম সহসৈনিকে পরিণত হন।

তুরস্কের মুস্তাফা কামাল ইসলামের খলিফা বলে পরিচিত তুরস্কের সুলতানকে সিংহাসনচ্যুত করলে ব্রিটিশ সরকার কামালকে সমর্থন করেন। তখন লক্ষ লক্ষ ভারতীয় মুসলমান সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হন। প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে মুসলমান নেতারা খিলাফত কমিটি গঠন করে তাঁদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের ঔদাসিন্যের অবসান ঘটাতে সচেষ্ট হন।

পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে একটি নীরস্ত্র জমায়েতে রেজিন্যাল্ড ডায়ারের নির্দেশে নির্বিচারে গুলি চালানো হলে শতাধিক মানুষ নিহত ও সহস্রাধিক আহত হন। মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধদেরও ছেড়ে দেওয়া হয় না। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বিক্ষোভ শুরু হলে ব্যাপক ধরপাকড়, লাঠিচার্জ ও হত্যালীলা চালায় পুলিশ। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ভারতের ব্রিটিশ শাসনের সর্বাপেক্ষা কুখ্যাত ঘটনা বলে বিবেচিত হয়। গান্ধীজি ও তাঁর সহযোগীদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে ব্রিটিশ শক্তির সঙ্গে এবার সংঘাত অনিবার্য।

সত্যাগ্রহ[সম্পাদনা]

গান্ধীজি রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় প্রতিবাদ আন্দোলনের সূচনা করেন। সকল অফিস ও কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ভারতীয়দের সরকারি স্কুল, পুলিশ বিভাগ, সেনাবাহিনী ও সরকারি চাকুরি ত্যাগে উৎসাহিত করা হতে থাকে। আইনজ্ঞরা সরকারি আদালত বর্জন করেন। গণ-পরিবহণ, ব্রিটিশ দ্রব্যসামগ্রী বিশেষত কাপড় বর্জিত হয়।

বাল গঙ্গাধর তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, অ্যানি বেসান্ত প্রমুখ বরিষ্ঠ নেতা এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। সারা ভারত মুসলিম লীগ এর সমালোচনাও করেন। কিন্তু দেশের তরুণ জাতীয়তাবাদীগণ এই আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে গান্ধীজিকে সমর্থন করেন। তাঁর পরিকল্পনা গ্রহণ করে কংগ্রেস এবং মৌলানা আজাদ, মুখতার আহমেদ আনসারি, হাকিম আজমল খান, আব্বাস তয়েবজি, মৌলানা মহম্মদ আলিমৌলানা শওকত আলি প্রমুখ মুসলিম নেতা তাঁকে সমর্থন করেন। ১৯১৯ ও ১৯২০ সালে গান্ধীজি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন – এমনকি সারা ভারত হোমরুল লিগ যেখানে একদা জিন্নাহ্, তিলক ও বেসান্তের মতো নেতানেত্রীর কর্তৃত্ব বজায় ছিল, সেখানেও তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন।

সাফল্য ও আন্দোলন প্রত্যাহার[সম্পাদনা]

অসহযোগ আন্দোলনের সাফল্য ও লক্ষ লক্ষ ভারতীয়ের এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। কিন্তু ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২ তারিখে চৌরি চৌরায় প্রতিবাদী জনতা ও স্থানীয় পুলিশের হিংসাত্মক সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে তিনজন আন্দোলনকারী নিহত হন। গান্ধীজি অনুভব করেন আন্দোলন বিপথে চালিত হচ্ছে। তিনি চাইতেন না আন্দোলনে জনতা ও পুলিশ মারমুখী হয়ে পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করুক ও সাধারণ নাগরিকগণ তাতে নিহত হন।

গান্ধীজি তিনদিন অনশন পালন করেন। ভারতীয় জনগণকে সংগ্রাম বন্ধ করার অনুরোধ জানান ও গণ-অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন।

প্রতিক্রিয়া[সম্পাদনা]

চৌরি চৌরার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহৃত হয়। কিন্তু একা এই জাতীয় গণ আন্দোলন থামানো সত্ত্বেও ১৯২২ সালের ১০ মার্চ গান্ধীজিকে গ্রেফতার করা হয়। ১৮ মার্চ রাজদ্রোহমূলক লেখালিখির অভিযোগে তার দুইবছর কারাদণ্ড হয়। যে ব্রিটিশ বিচারক এই মামলার রায়দান করেন, তিনি প্রশংসার আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, সরকার গান্ধীজিকে মুক্তি দিলে তিনিই সবচেয়ে খুশি হবেন।

কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ গান্ধীজির অবস্থানকে সমর্থন করলেও অনেকেই তার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হন। আলি ভাতৃদ্বয় তার তীব্র সমালোচনা করেন। মোতিলাল নেহেরুচিত্তরঞ্জন দাশ স্বরাজ্য পার্টি গঠন করে গান্ধীজির নেতৃত্ব অস্বীকার করেন। অনেক জাতীয়তাবাদী নেতা মনে করেন, একটি বিচ্ছিন্ন হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়ে গান্ধীজি সঠিক কাজ করলেন না। তারা গান্ধীজির নেতৃত্বের উপর হতাশা ব্যক্ত করেন।

সমসাময়িক ঐতিহাসিক ও সমালোচকদের কথা থেকে জানা যায়, এই আন্দোলন এতটাই তীব্র আকার ধারণ করেছিল যে ১৯৪৭ সালের বহু আগেই তা ব্রিটিশ শাসনের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে ভারতে স্বাধীনতা এনে দিতে পারত। আবার অনেক ঐতিহাসিক ও নেতা গান্ধীজির অবস্থানকে সমর্থন করতেও দ্বিধা করেননি। তাঁদের মতে, তিনি যদি আন্দোলন প্রত্যাহার করে না নিতেন, তবে এই আন্দোলন অরাজক অভ্যুত্থানে পর্যবসিত হত এবং সাধারণ মানুষের সমর্থন বিচ্যুত হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবীদেরই উৎসাহদান করে যেত।

আন্দোলন পুনর্সংগঠন[সম্পাদনা]

ডান্ডিতে গান্ধী, এপ্রিল ৫, ১৯৩০, লবণাক্ত কাঁদামাটির ডেলা তুলছেন।

১৯৩০ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতে পুনরায় অহিংস গণ আন্দোলন শুরু করেন গান্ধীজি। লক্ষ লক্ষ দেশবাসী লবণ সত্যাগ্রহের মাধ্যমে বিশ্বের সামনে ভারতের অহিংস আন্দোলনের উজ্জ্বল ভাবমূর্তিটি তুলে ধরেন। সত্যাগ্রহ শেষ হয় গৌরবময় সাফল্যমণ্ডিত হয়ে। ভারতীয়দের দাবি মেনে নেওয়া হয় এবং কংগ্রেস ভারতীয় জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধির মর্যাদা লাভ করে। ভারত শাসন আইন ১৯৩৫ দেশের মানুষকে প্রথম গণতন্ত্রের স্বাদ দেয় – স্বায়ত্তশাসন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]