অর্জুন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(অর্জুন (পাণ্ডব) থেকে পুনর্নির্দেশিত)
অর্জুন
বালির রাজপথে অর্জুনের মূর্তি
দাম্পত্য সঙ্গীদ্রৌপদী, উলূপী, চিত্রাঙ্গদাসুভদ্রা
সন্তান
পিতা-মাতা
পরিবারসহোদর ভ্রাতা

বৈমাত্রেয় ভ্রাতা

অর্জুন (সংস্কৃত: अर्जुन, আইএএসটি: Arjuna) হলেন মহাভারত মহাকাব্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে তৃতীয়। 'অর্জুন' শব্দের অর্থ 'উজ্জ্বল', 'জাজ্বল্যমান', 'সাদা' অথবা 'রূপালি'।[২] তিনি একজন অব্যর্থ ধনুর্বিদ। তাকে পার্থ এবং ধনঞ্জয় নামেও ডাকা হয়। অর্জুন এর আরো বেশ কিছু নাম রয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু নাম হল – অরিমর্দন, কপিকেতন, কপিধ্বজ, কিরীটী, কৃষ্ণসখ, কৃষ্ণসারথি, কৌন্তেয়, গাণ্ডিবধন্বা, গাণ্ডিবী, গুড়াকেশ, চিত্রযোধী, জিষ্ণু, তৃতীয় পাণ্ডব, ধনঞ্জয়, পার্থ, ফল্গুন, ফাল্গুনি, বিজয়, বীভৎসু, শব্দবেধী, শব্দভেদী, শুভ্র, শ্বেতবাহ, শ্বেতবাহন, সব্যসাচী।[৩] কুন্তী তাকে মন্ত্রবলে দেবরাজ ইন্দ্রের নিকট হতে লাভ করেন। তিনি দ্রোণাচার্য হতে ধনুর্বিদ্যা লাভ করেন। পাণ্ডব ভ্রাতৃগণের মধ্যে তার স্থান তৃতীয়। অর্জুন পাণ্ডু ও তার জ্যৈষ্ঠা মহিষী কুন্তীর পুত্র। অর্জুনকে নারায়ণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নর-নারায়ণের অবতার মনে করা হয়।[৪][৫] মহাভারতে তাকে 'চতুর্থ কৃষ্ণ' বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।[৬] কৃষ্ণ ছিলেন তার প্রিয় বন্ধু তথা সম্বন্ধী। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সূচনাপর্বে কৃষ্ণ তাকে যে উপদেশাবলি প্রদান করেন তাই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা নামে পরিচিত।

জন্ম[সম্পাদনা]

অর্জুনের পিতার নাম পাণ্ডু ও মাতার নাম কুন্তী। যুবক বয়সে পাণ্ডু রাজা কিন্দম মুনিকে হরিণ ভেবে শিকার করতে গিয়ে হত্যা করায় মুনি তাকে অভিশাপ দেন যে স্ত্রীসম্ভোগকালে তার মৃত্যু হবে। এ ঘটনার পর পাণ্ডু তার দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনবাসে যান। সেখানে কুন্তী, দুর্বাসা মুনির বর প্রাপ্ত মন্ত্র দিয়ে ভগবান ইন্দ্রের কাছে ভগবান ইন্দ্রেরই মত বলবান এবং তেজস্বী একটি পুত্রসন্তান প্রার্থনা করলে ভগবান ইন্দ্রের আশির্বাদে অর্জুনের জন্ম হয়। তাই অর্জুনকে ভগবান ইন্দ্রেরও পুত্র বলা হয়।

অস্ত্র শিক্ষা[সম্পাদনা]

অর্জুন অস্ত্র শিক্ষা লাভ করেন গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে। গুরু দ্রোণ, অর্জুন এবং তার একমাত্র ছেলে অশ্বত্থামাকে বেশ যত্নের সাথে ধনুর্বিদ্যা শিখিয়েছেন। সেই সময় অর্জুন তাদের মধ্যে সবার শ্রেষ্ঠ ছিলেন। অর্জুন ছিলেন কৌরব ও পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের প্রিয়তম শিষ্য। গুরুদক্ষিণা স্বরূপ দ্রোণাচার্য যখন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের বন্দিত্ব চান, তখন মূলত অর্জুনের বীরত্বতেই তা সম্ভব হয়। পাণ্ডবদের শৌর্যবীর্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা তাদের হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন জেনে পাণ্ডবরা বেশ কিছুদিন ছদ্মবেশে ছিলেন।[৭]

বিবাহ[সম্পাদনা]

অর্জুন মাছের চোখে শর বিদ্ধ করছেন।

অর্জুন ও বাকী চার পাণ্ডব মাতা কুন্তীর সাথে বনবাসে গেলে ঘটনাক্রমে তারা দ্রুপদ রাজার কন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভায় ছদ্মবেশে উপস্থিত হন। সেখানে দুর্যোধন এবং তার মামা শকুনিসহ কর্ণও উপস্থিত থাকেন। রাজা দ্রুপদ কন্যা দ্রৌপদীর জন্য অন্যরকম এক স্বয়ংবরসভার আয়োজন করেন। আয়োজনের সবটা রাজা দ্রুপদের একমাত্র পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন পরিচালনা করেন। আর সেই স্বয়ংবরসভার নিয়ম করা হলো চক্রমধ্য-মৎস্যের চোখে সেখানে থাকা ধনুকের সাহায্যে তীর বিদ্ধ করতে হবে। সেই ধনুকের ভার বহন করা কারোর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাদের মধ্যে কর্ণ সেই ধনুক উঠাতে পারলেন। কিন্তু, দ্রৌপদী কোনো সুত পুত্রকে বিবাহ করবেন না বলে জানান। আর সেই কারণে কর্ণ এই ধনুক উঠালেন না। তারপরে শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে সেখানে উপস্থিত ব্রাহ্মণদের সেই ধনুক উঠানোর জন্য অনুরোধ করেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। আর তখন ছদ্মবেশে থাকা অর্জুন সেই চক্রমধ্য-মৎস্যের চোখে তীর বিদ্ধ করতে সক্ষম হন এবং দ্রৌপদীকে বিয়ে করেন। তারপর পাঁচ ভাই কুটিরে ফিরে মাতা কুন্তীকে কি এনেছেন দেখতে বললে ধ্যানে থাকা মাতা কুন্তি কিছু না দেখে বলেন "যা এনেছো তা তোমরা পাঁচ ভাই মিলে ভাগ করে নাও।" তার এই কথায় শেষ পর্যন্ত মহামুনি ব্যাসদেবের কথা অনুসারে পঞ্চপাণ্ডবের সাথে দ্রৌপদীর বিয়ে হয়। এরপরে নারদ আরো একটা সমাধান দেন, আর তা হলো দ্রৌপদী যে সময়ে এক ভ্রাতার সঙ্গে থাকবেন, সেই সময় অন্য কোনো ভ্রাতা তাদের শয়ন-গৃহে প্রবেশ করতে পারবেন না।

তারপরেও অবশ্য অর্জুন আরও তিনজনকে বিবাহ করেছিলেন। তারা হলেন কৌরব্যনাগের কন্যা উলূপী (ইনি পূর্ব-বিবাহিতা ছিলেন), মণিপুররাজ চিত্রবাহনের কন্যা চিত্রাঙ্গদা এবং শ্রীকৃষ্ণ ভগিনী সুভদ্রা। তার চার পুত্রের নাম হল শ্রুতসেন (দ্রৌপদীর পুত্র), ইরাবান্ (উলুপীর পুত্র), বভ্রুবাহন (চিত্রাঙ্গদার পুত্র) ও অভিমন্যু (সুভদ্রার পুত্র)।[৮]

বনবাস[সম্পাদনা]

পাণ্ডব গুহা: পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে পাণ্ডবরা বনবাসে থাকাকালিন সময়ে এই দূর্গে বসবাস করতেন।[৯]

পাণ্ডবগণ তাদের নতুন রাজ্যে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলে সেখান থেকে মামা শকুনির পরামর্শে তক্ষক নাগ পাণ্ডবদের সকল অশ্ব নিয়ে পালিয়ে যায়। সেই অশ্ব রক্ষা করার জন্য অর্জুন অস্ত্র আনতে সঙ্গমরত যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদী এর শয়ন-গৃহে ঢুকতে বাধ্য হলেন। যুধিষ্ঠির এতে নিয়ম ভঙ্গ হয় নি বললেও, অর্জুন আত্মগ্লানিতে সত্যরক্ষার জন্য বনবাসে যান। সেই সময়ে অর্জুন একে একে উলূপী, চিত্রাঙ্গদা সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং তাদের বিয়ে করেন। স্বামীহীনা উলুপী স্নানরত অর্জুনকে হরণ করে নিয়ে আসেন পিত্রালয়ে। সেখানে তিনি অর্জুনের কাছে এক ক্ষেত্রজ পুত্র কামনা করেন। উলুপীর নিমন্ত্রণে তার গর্ভসঞ্চার করেন অর্জুন। এই মিলনের ফলে অর্জুনের ঔরসে উলুপী গর্ভবতী হন ও এক পুত্রের জন্ম দেন। এই অর্জুন- উলূপীর মিলনজাত পুত্রের নাম হয় ইরাবান। পূর্ব-বিবাহিতা বলে অর্জুন প্রথমে তাকে বিয়ে করেন নি। পরে অর্জুন উলুপীকেও ভার্যার সম্মান দেন। অর্জুন দ্বাদশবর্ষব্যাপী ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনের সময় ভ্রমণ করতে করতে এলেন মণিপুররাজ্যে। সেই সময়ে অর্জুন চিত্রাঙ্গদার প্রেমে পড়েন। তার ও চিত্রাঙ্গদার বিবাহ হল। তাদের মিলনের ফলে অর্জুনের ঔরসে চিত্রাঙ্গদার গর্ভে সন্তান জন্মায়। তাদের সেই মিলনজাত পুত্রের নাম হয় বভ্রুবাহন। অর্জুন বভ্রুবাহন কে মণিপুরের রাজা বানিয়ে দেন। পরে অর্জুন তার মিত্র কৃষ্ণ এর সাহায্যে কৃষ্ণ ও বলরাম এর একমাত্র বোন সুভদ্রাকে বিয়ে করেন। অর্জুনের ঔরসে দেবী সুভদ্রার গর্ভে এক বলশালী পুত্র হয়। তার নাম অভিমন্যু। অগ্নিদেবের হিতার্থে খাণ্ডব অরণ্য যাতে কৃষ্ণ ও অর্জুন দহনে করতে পারেন,তারজন্য বরুণদেব অর্জুনকে একটি রথ আর সেই সঙ্গে বিখ্যাত গাণ্ডীবধনু দিয়েছিলেন। এই অস্ত্র পেয়ে অর্জুন বিশেষভাবে বলশালী হন।[১০]

দ্যূতক্রীড়া[সম্পাদনা]

দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হয়ে পাণ্ডবরা যখন বনবাসে গিয়েছিলেন, তখন যুধিষ্ঠিরের আদেশে দিব্যাস্ত্রলাভের জন্য অর্জুন ইন্দ্রলোকে যান। ইন্দ্র তাকে মহাদেবের আরাধনা করতে বলেন। আর তাই অর্জুন মহাদেবের কাছ থেকে তার পাশুপত অস্ত্র লাভ করেন। এরপর ইন্দ্র নিজেও অর্জুনকে নানাবিধ দিব্যাস্ত্রে শিক্ষা দেন। ইন্দ্রের নির্দেশে ইন্দ্রসখা চিত্রসেন অর্জুনকে গীত ও নৃত্যে পারদর্শী করেন। সেইখানে নৃত্যরতা অপ্সরাদের মধ্যে উর্বশীর দিকে অর্জুন বারংবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন দেখে, ইন্দ্র উর্বশীকে অর্জুনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। অর্জুন কামনা বসে তার দিকে তাকাননি, উর্বশীকে পুরু বংশের জননী হিসেবে দেখছিলেন। কিন্তু অর্জুন তাকে প্রত্যাখ্যান করায় উর্বশী অপমানিত হয়ে অর্জুনকে অভিশাপ দিলেন যে, অর্জুনকে নর্তকরূপে স্ত্রীলোকদের মধ্যে নপুংসক হয়ে থাকবেন। উর্বশীর এই অভিশাপ পাণ্ডবরা যখন বিরাটরাজের সভায় অজ্ঞাতবাস করছিলেন, তখন খুব কাজে লেগেছিল। সেখানে অর্জুন বৃহন্নলা সেজে বিরাটরাজের কন্যা উত্তরাকে নৃত্য, গীত ইত্যাদি শিক্ষা দিয়েছেন।[১১]

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ[সম্পাদনা]

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন তার রথের সারথি নিয়োগ করেন মৎস্য রাজ্য বা বিরাটনগরের রাজা বিরাটের পুত্র উত্তর ও অর্জুনের নিজস্ব মিত্র কৃষ্ণকে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন কৌরবদের অনেক সেনাকে হত্যা করেন। তার হাতে কৌরবদের সেনাপতি ভীষ্মকে শরশয্যায় নিপাতিত করেছেন। অবশ্য তার জন্য তাকে শিখণ্ডীর সাহায্য নিতে হয়েছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয়ের অন্যতম কারণ হল অর্জুনের রণনৈপুণ্য। তাছাড়া অর্জুন ভগদত্ত, জয়দ্রথ, কর্ণকে তিনি বধ করেছেন। কিন্তু ভীষ্মকে শরশয্যায় নিপাতিত করতে তাকে শিখণ্ডীকে সামনে রাখতে হয়েছে। এই অন্যায় যুদ্ধের জন্য বসু দেবতাগণ অর্জুনকে নরকবাসের অভিশাপ দিয়েছিলেন। অভিশাপ কাটাতে বসুদেবগণ বলেন, নিজের পুত্রর হাতে অর্জুনের মৃত্যু হলে অভিশাপ কেটে যাবে। তাই উলূপী কৌশলে বভ্রুবাহনকে দিয়ে অর্জুনের মৃত্যু ঘটায়। আর তারপর নাগমণি দিয়ে জীবন দেয়।

শেষ জীবন ও মৃত্যু[সম্পাদনা]

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় যজ্ঞিয় অশ্বকে নিয়ে বহুদেশ জয় করে যখন মণিপুরে পৌঁছলেন, তখন নিজপুত্র বভ্রুবাহনের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অর্জুন এই শাপমুক্ত হন। কৃষ্ণের মৃত্যুর পর অর্জুন তার শক্তি হারাতে শুরু করলেন। একদল গোপালক দস্যুরা যখন যাদব বিধবাদের হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের রক্ষা করার জন্য বহু চেষ্টা করেও দিব্যাস্ত্রের প্রয়োগ পদ্ধতি অর্জুন স্মরণ করতে পারলেন না। দস্যুরা সফলকাম হল। অর্জুন যখন ব্যাসদেবকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন, তখন অর্জুনকে তিনি বললেন দুঃখ না পেতে। অর্জুনদের কাজ শেষ হয়েছে, এখন মহাপ্রস্থানের সময় আসছে। মহাপ্রস্থানের পথে দ্রৌপদী, সহদেব ও নকুলের পরে অর্জুনের মৃত্যু হয়।

পাদটীকা[সম্পাদনা]

  1. Viswanathan, Priya (২০১৯-০৩-১৭)। "Arjuna and His Sons - Two Generations of Courage"Dolls of India (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০১-২২ 
  2. Maharishi Mahesh Yogi on the Bhagavad-Gita, a New Translation and Commentary, Chapter 1-6. Penguin Books, 1969, p 31 (v 4)
  3. অর্জুনের নাম
  4. Mahābhārata, Adi Parva, Section I
  5. Devi Bhagawatam, fourth book, chapter XXII
  6. Hiltebeitel, Alf (১৯৯০)। The ritual of battle: Krishna in the Mahābhārata। Albany, N.Y: State University of New York Press। আইএসবিএন 0-7914-0249-5  p61
  7. অমর সাহিত্যঃ মহা ভারত
  8. অভিমন্যু
  9. "These places in India have distinct Mahabharata, Ramayana connections"cnbctv18.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১ জুলাই ২০২০ 
  10. কৃষ্ণচরিত্র - প্রথম খণ্ড
  11. দ্যূতক্রীড়া

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]