অ্যানিমেশন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ক্রমান্বয়ে লাফানো বলের এ্যানিমেশন (চিত্র নিচে), যা এই ৬টি ফ্রেমের দ্বারা গঠিত।

এই এ্যানিমেশনটিতে প্রতি সেকেন্ডের মধ্যে ১০টি ফ্রেম দেখানো হয়েছে।

অ্যানিমেশন বা সজীবতা (ইংরেজি: Animation) হচ্ছে স্থির চিত্রের একটি ক্রম যেগুলোকে বিশেষ প্রক্রিয়া লক্ষ্য করলে জীবন্ত ও সচল বলে মনে হয়। এ্যানিমেশন তৈরী, সংরক্ষণ বা ধারণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে, যেমন: অ্যানালগ পদ্ধতিতে ক্রম-সচল বই, সচল ছবি, ভিডিও টেপ আর ডিজিটাল পদ্ধতিতে জিআইএফ, ফ্লাশ বা ডিজিটাল ভিডিও মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। এটি প্রদর্শনের জন্য ক্যামেরা, কম্পিউটার বা প্রজেক্টর ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সহজ অর্থে একে "চলমান চিত্র" বলেও অভিহিত করা যায়। চলচ্চিত্রর এবং অ্যানিমেশনের সংজ্ঞা এবং মূল কারিকরী নীতি একই। চলচ্চিত্রর সংজ্ঞা অ্যানিমেশনকে সঙ্গে নেয়। নির্মাণ প্রক্রিয়ার ভিন্নতা অনুসারে চলচ্চিত্রকে জীবন্ত গতি (live action), বা অ্যানিমেশন এই দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। জীবন্ত গতি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চলমান বস্তুটিকে ক্যামেরার সহায়তায় সময়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অন্তরালে (পারম্পরিক ভাবে সেকেণ্ডে ২৪টা) ফটো তোলা হয়। এই ছবিগুলি চলমান বস্তুটির বিভিন্ন মূহুর্তকে স্থির চিত্র করে ফেলা হয়। প্রতিটি ছবিকে একটি 'ফ্রেম' বলা হয়। পরে প্রজেক্টরের সহায়তায় এই 'ফ্রেম'গুলিকে ক্রম অনুসারে পর্দায় প্রক্ষেপণ করা হয়। দৃষ্টির জড়তা (Persistence of vision) পরিঘটনার জন্য আমাদের চোখ পরপর প্রক্ষেপিত স্থির চিত্রের ক্রমকে গতির ভ্রমে রূপান্তরিত করে এবং আমরা ছবিটিকে চলন্ত দেখি। পরে অবশ্য এই মতকে নাকচ করা হয়। লক্ষ্যনীয় যে এই পদ্ধতিতে একটি বিশেষ যন্ত্র (চলচ্চিত্র ক্যামেরা)র দ্বারা, চলনশীল একটি বস্তুর চলনকে 'ফ্রেমে'র রূপ দেয়া হয়। অ্যানিমেশন প্রক্রিয়া প্রতিটি ফ্রেমে আলাদা আলাদা সৃষ্টি করা হয়। পরে প্রতিটি ফ্রেমকে ক্রম অনুসারে পর্দায় নিক্ষেপন করে গতির আভাস দেয়া হয়। অ্যানিমেশন নির্মাণ করতে প্রতিটি ফ্রেম একটি একটি করে সৃষ্টি করা হয়। ফ্রেম নির্মাণ বিভিন্ন পদ্ধতিতে করা যায়। হাতে আঁকা এবং একটা বস্তুর অবস্থানের সামান্য পরিবর্তন করে তার ছবি নেওয়া সাধারণত ব্যবহৃত দুটি প্রক্রিয়া। বর্তমান গাণনিক যন্ত্রের (কম্পিউটার) সহায়তায় অ্যানিমেশন নির্মাণ করাটি জনপ্রিয় উপায়। অ্যানিমেশন দ্বিমাত্রিক (2D) বা ত্রিমাত্রিক (3D) হতে পারে।

শব্দের উৎপত্তি[সম্পাদনা]

১৯০৮ সালে এমিল সল-এর তৈরী করা এ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ফ্যান্টাসম্যাগোরী যা প্রথম এ্যানিমেশন-কৃত ছবি; এতে হাতে আঁকা চিত্র ব্যবহৃত হয়েছে।

লাটিন ভাষার শব্দ anima (আত্মা/soul), এর ক্রিয়াবাচক শব্দ হল Animate । Animate শব্দর অর্থ আত্মা দান করা, বা প্রাণ দিয়া।[১] অর্থাৎ একটি জড় বস্তুতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা। অ্যানিমেশনে জড়/স্থির চিত্রকে গতিশীল করে "প্রাণ দেয়া" হয় বলেই একে অ্যানিমেশন বলা হয়।

অ্যানিমেশনের ইতিহাস[সম্পাদনা]

ইরাণে পাওয়া একটি ফুলদানিতে আঁকা পাঁচটি ছবির ক্রম
একটি মিশরীয় সমাধি-ঘরে পাওয়া প্রায় ৪০০০ বছর পুরানো ম্যুরেল। এখানে কুস্তিযুদ্ধের ছবি অঙ্কন করা হয়েছে। এইগুলি অ্যানিমেশন ছবির শৃংখল লাগলেও তা গতিময় অবস্থায় চালানোর কোনো উপায় ছিল না। তথাপি এই গতি প্রতিফলিত করতে চিত্রকরের ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে।

স্থির চিত্রকে গতিশীল করার প্রচেষ্টা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে করা হয়েছে। ৩৫,০০০ বছর আগের গুহা চিত্রে আঁকা চারটি জন্তুর জায়গায় আঠটি পা এঁকে গতিশীল রূপে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছিল।[২] খ্রী.পূ. ১৬০০ শতকে মিশরের ফ্যারাও দ্বিতীয় রামসেস-এর নির্মাণ করা দেবী আইসিসের মন্দিরে ১১০-টা স্তম্ভ ছিল। প্রতিটি খুঁটিতে দেবীর একটি ভঙ্গিমাকে সময়ের হিসেবে পরিবর্তন করে আঁকা ছবি ছিল। দেখা হয় যে বেগে যাওয়া চালক দেবীর ভঙ্গিমা পরিবর্তন হয়ে যাওয়া দেখতে পেয়েছিল।[৩] অতীতের গ্রীকরা মাটির গোল পাত্রের চারদিকে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন হওয়া ভঙ্গিমার মানুষের ছবি এঁকেছিল। পাত্রটি জোরে ঘোরালে মানুষজন নড়াচড়া করা দেখতে পাওয়া যেত।[৩]

অবশ্য অ্যানিমেশনকে বর্তমান রূপ দেয়ার আগে চলচ্চিত্রের কলা-কৌশল পূর্ণাঙ্গ রূপে বিকশিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। চলচ্চিত্রর আগে আবিষ্কৃত হয়েছিল পর্দায় বড় করে ছবি প্রক্ষেপ করার প্রক্রিয়া। ১৬৪০ সালে এথোনেসিয়াস কার্চার (Athonasius Kircher) 'ম্যাজিক লন্ঠন' (Magic Lantern) নামের একটি যন্ত্র তৈরি করেন। তিনি কাঁচে ছবি এঁকে সেই ছবি ম্যাজিক লণ্ঠনের মাধ্যমে পর্দায় প্রক্ষেপ করে দেখিয়েছিলেন। অ্যানিমেশনের একটি রুক্ষ রূপও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন।

১৮২৪ সালে পিটার মার্ক রোজেট (Peter Mark Roget) প্রথমবার "দৃষ্টি জড়তা" পরিঘটনাটি লক্ষ্য করেন। এই পরিঘটনা মতে, আমাদের চোখের অক্ষিপটে (Retina) থেকে যেকোনো দৃশ্য কিছু সময়ের জন্য চোখে বর্তমান থাকে।[৪] সেই মুহূর্তের পরইে মানুষটিকে আলাদা দেখা পায়। যদি মধ্যবর্তী এই না দেখা সময়টিতে দৃশ্যের পরিবর্তন করা হয়, লোকজন পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টি ধরতে পারে না। দৃশ্যমান সময়ে যদি একটি গতির ক্রমাগতভাবে পরিবর্তিত ছবি দেখতে থাকা হয় এবং মাঝের না দেখা সময়টিতে দৃশ্যাবলীর পরিবর্তন ঘটানো হয়, তখন মানুহজন চোখের সম্মুখে চলমান দৃশ্যাবলী দেখতে পায়, যদিও প্রতিটি দৃশ্য অগোচরে চলমান হয়। এই 'দৃষ্টি জড়তা' ব্যতীত চলচ্চিত্র বা অ্যানিমেশন সম্ভবেই ছিল না।

রোজেটের আবিষ্কার কয়েকটি নতুন নতুন খেলনার জন্ম দেয়, যেখানে 'দৃষ্টি জড়তা'র সহায়তা নিয়ে কিছু দৃষ্টিভ্রম করানো হত। এই খেলনাসমূহই ছিল অ্যানিমেশনের আদিরূপ।

এমন একটি খেলনা ছিল থোমাট্রোপ (Thaumatrope)। [৪]ফেনাকিষ্টোস্কোপ (Phenakistoscope) একে নীতিতে তৈরি অন্য একধরনের খেলার সামগ্রী। [৪]

এধরনের একটি উল্লেখনীয় সরঞ্জাম ছিল জুট্রোপ (Zoetrope), একে 'জীবনের চাকা' বলেও ডাকা হত। ১৮৬৭ সালে আমেরিকায় এইধরনের খেলনার প্রচলন হয়। দীর্ঘ কাগজের টুকরোতে একটি গতির ক্রমের ছবি এঁকে একটি চোঙার মধ্যে লাগানো হত। সেই চোঙাতে ছিল দীর্ঘ কিছু ফুটো। চোঙাটি জোরে ঘুরিয়ে সেই ফুটোকে চালিয়ে ভিতরের ছবিটি গতিশীল করা হত।[৫]

প্রাক্সিনোস্কোপ (Praxinoscope) আবিষ্কার করেছিলেন এমিল রেনড (Emile Reynaud)। এই যন্ত্রটি প্রায় জুট্রোপের মতোই ছিল, কিন্তু চোঙাটির অক্ষে অন্য একটি ছোট চোঙা বাইরে থেকে এনে লাগিয়ে দেওয়া হত। তারোপরে, এর চোঙার পরিধি ছিল বেসি। তাতে এর মধ্যে ৩০ ফুট দীর্ঘ কাগজের টুকরো লাগিয়ে ছবি আঁকা হত। অবশ্য এই যন্ত্রে কাগজ ব্যবহার না করে একধরনের পারদর্শী কাগজে ছবিটি আঁকা হত। এই কাগজটিকে বলা হত "ক্রিষ্টালয়েড্‌" (Crystaloid)। ছবি আঁকতে বেশি স্থান লাগার জন্য এই যন্ত্রে একেবারে ছোট গতির ছবি না এঁকে একটা সম্পূর্ণ নাটকীয় ঘটনা আঁকা হত। অ্যানিমেশনের মাধ্যমে কাহিনী বলার প্রক্রিয়া প্রচরন এই যন্ত্র থেকেই আরম্ভ হয়েছিল। [৫]

১৮৬৮ সালে বাজারে আসে অন্য একধরনের নতুন খেলনা, ফ্লিপার বুক (Flipper Book)। এতগুলি যন্ত্রর মধ্যে এটিই ছিল তুলনামূলক সরল এবং জনপ্রিয়। একটি ক্রমের কয়েকটি ছবি ক্রম অনুসারে একদিকে বেঁধে রাখা হত। অন্যদিকে, ছবির দমটির কাছে ধরে বেগে একটি একটি করে ঘোরালে ছবিটি গতি লাভ করত।[৫] এই ফ্লিপার বুক আজও বাজারে পাওয়া যায়। আজকাল অবশ্য আঁকা ছবির পরিবর্তে একটি ক্রমে থাকা তোলা ছবি দেখা যায়। 'ফ্লিপার বুক' বা 'ফ্লিপ বুক' পারম্পরিক 'অ্যানিমেটর'গণ এখনও প্রারম্ভিক পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করেন।

লক্ষ্যনীয় যে, এই সময় পর্যন্ত সর্বদাই হাতে আঁকা ছবি ব্যবহার করা হত। ক্যামেরার আবিষ্কার হয়েছিল, যদিও এমনসব খেলনার জন্য ক্যামেরায় তোলা ছবি ব্যবহার করা হত না। আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসন (Thomas Alva Edison) জুট্রোপ যন্ত্র দ্বারা অনুপ্রাণীত হয়ে একটি গতিশীল বস্তুর ক্রমিক ছবি তোলার একটি যন্ত্র আবিষ্কারে মনোনিবেশ করেন। এইকাজের জন্য ১৮৮৮ সালে তিনি সহযোগী উইলিয়াম ডিক্‌শন-কে (William K.L. Dickson) দায়িত্ব দেন। দুইজনে ক্রমিক ছবি তোলার জন্য কাইনেটোগ্রাফ (Kinetograph) এবং সেই ছবি চলমান অবস্থায় চালাবার জন্য কাইনেটোস্কোপ (Kinetoscope) নামে একধরনের যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। ১৮৯৪ সালে 'কাইনেটোস্কোপ' যন্ত্র বাজারে মুক্ত করা হয়। এই যন্ত্রে একটি ফুটোর মাধ্যমে চলমান ছবি দেখানোর ব্যবস্থা ছিল। তাতে একবারে একজন ব্যক্তি ছবি দর্শন করতে পারত। এই অসুবিধা দূর করতে প্রতিদ্বন্দ্বী আবিষ্কারকরা সেই ছবি পর্দায় বড়ো করে প্রক্ষেপ করার ব্যবস্থা চালু করে। টমাস এর্মাট (Thomas Armat) নির্মিত এমন একটি যন্ত্রের আধারে এডিসন নিজে একটি প্রজেক্টর (Projector) নির্মাণ করেন এবং নাম দেন ভিটাস্কোপ (Vitascope)।[৬]

১৮৯৬ সালে, নিউইয়র্কের এটি সংবাদপত্রে কার্টুনিস্ট জেমস‌ ষ্টুয়ার্ট ব্লেকটন (James Stuart Blackton) একটি সাক্ষাৎকারের জন্য এডিশনের কাছে যান। তখন ছবি আঁকায় ব্লেকটনের ক্ষীপ্রতা দেখে তিনি একটি ক্রমিক সমন্বয়কারী ছবি আঁকতে অনুরোধ করেন। সেই ছবিগুলির এডিসন ফোটো তুলে রাখেন। সেয়েই ছিল ফোটোগ্রাফি এবং ছবির প্রথম সংযোগ। ১৯০৫ তারা দুজনে "মজারু মুখের হাস্যরসাত্মক মূহুর্ত" (Humorous Phases of Funny Faces) নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্রটির জন্য প্রায় ৩০০০ টি ছবি আঁকা হয়েছিল। লোকেরা এই নতুন পরীক্ষা দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল।[৭] এটিই ছিল আধুনিক অ্যানিমেশনের পূর্বপুরুষ।

১৯০৮ সালে এমিল কোল (Emile Cohl) নির্মাণ করেন ফ্যান্টাসমাগরি নামে একটি অ্যানিমেশন ছবি। এটি প্যারিসে প্রথম দেখানো হয়েছিল।প্রেক্ষাগৃহে বড় ছবির এটির মাধ্যমে একটি সম্পূর্ণ কাহিনী দেখানো হয়েছিল। চরিত্রসমূহের ছাড়াও বিদ্যুতের খুঁটি, ঘর ইত্যাদিও এতে নড়চড় করেছিল, সুখী বা দুখীও হয়েছিল। এই ছবিটিতে অ্যানিমেশনের সফল প্রয়োগের আরম্ভ হয়েছিল। পরবর্তীকালে অ্যানিমেশনের ক্ষেত্রে মেনে চলা একটি নীতি এখানেই প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল —'ক্যামেরাতেও যা করা যায় সেইটি না করা, ক্যামেরার কাজ না করা।'[৮] চলচ্চিত্র ইতিহাসবিদদের মতে এটিই পৃথিবীর সর্বপ্রথম অ্যানিমেটেড কার্টুন।[৯]

উইনসর মেক্‌কে (Winsor McCay)[সম্পাদনা]

উইনসর মেক্‌কে-ই প্রথম অ্যানিমেশনকে একটি শিল্পকলা হিসেবে জন্ম দেওয়ার প্রয়াস করেন।[৮] মেক্‌কে ছিলেন একজন কম‌িক্স শিল্পী। তার 'আজব দেশে ছোট্ট নিমো' (Little Nemo in Wonderland) ছিল এটি জনপ্রিয় কমিক্‌স। নিজের সন্তানের জন্য তিনি প্রায় ৪০০০ ছবিকে[৮] 'ছোট্ট নিমো'-Little Nemo (১৯১১) নামে অ্যানিমেশন ছবির রূপ দেন। তার এই চলচ্চিত্র খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯১২ সালে তিনি নির্মাণ করেন আরেকটি অ্যানিমেশন ছবি How a Mosquito Operates। ১৯১৪ সালে তিনি Gertie the Dinosaur নামে আরেকটি অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণ করেন।[১০] এই ছবিটির প্রদর্শনের সময়ে 'গার্টি' নামে ডাইনোসরটির চলচ্চিত্র পর্দায় প্রক্ষেপ করা হয়েছিল এবং মেক্‌কে নিজে পর্দার আগে স্থির হয়ে 'গার্টি'কে আপেল খাইয়েছিলেন। 'গার্টি দা ডাইনোোসর' ছবিটিকে অ্যানিমেশন শিল্পের একটি মাইলফলক বলে মানা হয়। প্রথমবার সুনিপুণ ছবির মাধ্যমে 'গার্টি'কে আঁকা হয়েছিল, 'গার্টি'র হাত-পা চালনা ছিল একেবারে জীবন্ত এবং 'গার্টি'র ভাল লগা, দুঃখ পাওয়া ইত্যাদিরও সুন্দর রূপ দেওয়া হয়েছিল। ছবিটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এই ছবিটিই অ্যানিমেশনকে একটি বিশিষ্ট শিল্প রূপে তুলে ধরে। ১৯১৮ সালে ২৫,০০০ ছবির সেই সময় পর্যন্ত দীর্ঘতম অ্যানিমেশন ছবি 'The Sinking of the Lusitania' নির্মাণ করেন মেক্‌কে-ই।[১১] এর পরে মেক্‌কে আরো তিনটি অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণ করেছিলেন।[১২]

মেক্‌কের অ্যানিমেশন ছবিগুলি জনপ্রিয় হওয়া ছাড়াও শিল্পকলাত্মক দিক থেকেও উল্লেখযোগ্য ছিল। অ্যানিমেশনকে একটি শিল্প হিসেবে গড়ার ক্ষেত্রেও মেক্‌কের অবদান অনস্বীকার্য।[১২][১৩] অ্যানিমেশন ছবির নির্মাণ ছাড়াও দক্ষ চিত্রকর এবং শিল্পী হিসেবে মেক্‌কে ছিলেন অসাধারণ। তাকে 'কার্টুন জগতের মোজার্ট' বলে সম্বোধন করা হয়। International Animated Film Society (ASIFA - Hollywood)-এ তার নামের পুরস্কারটি জীবন-ব্যাপী সাধনার পুরস্কার নামকরণ করেছে। [১০]

মেক্‌কের অ্যানিমেশন খুব জনপ্রিয় এবং শিল্পকলাত্মক দিক থেকেও উন্নত হওয়ার পরেও কিন্তু সাধারণভাবে অ্যানিমেশন ছবির মান উন্নত ছিল না। মেক্‌কে নিজেই ছবি আঁকতেন এবং তার কোনো সহকারীও ছিল না। তার পদ্ধতি ছিল যথেষ্ট সময়বহুল এবং কষ্ট সাপেক্ষ। তাতে সেই ধরনে বাণিজ্যিকভাবে অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণের কাজ করা সম্ভব ছিল না।[১২] বাণিজ্যিক অ্যানিমেশন শিল্পীদের আয়োজিত একটি সভায় তিনি নতুন অ্যানিমেটরদের টাকার নামে একটি শিল্পকে ধূলিস্যাৎ করার অভিযোগ করেছিলেন।[১১]

বাণিজ্যিক স্টুডিওতে অ্যানিমেশন এবং বিকাশ[সম্পাদনা]

অ্যানিমেশন ছবির জন্য প্রয়োজন বহু সংখ্যক হাতে আঁকা ছবি। তাতে একজন মানুষের জন্য দীর্ঘ অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণ করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে, অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণের জন্য স্টুডিও গড়ে ওঠে। কয়েকজন শিল্পী একসাথে ছবি আঁকেন এবং সেগুলি ক্যামেরায় ফোটোর মাধ্যমে তুলে অ্যানিমেশন ছবি তৈরি করা হয়। অ্যানিমেশন ছবিগুলিকে কার্টুন (Cartoon) বলা হত। অ্যানিমেশনের জন্য প্রথম স্টুডিও খুলেছিল রাওল বার (Raoul Barre) নামে একজন লোক ১৯১৪ সালে। ১৯১৫ সালে পত্তন হয় 'ব্রে-হার্ড প্রসেস কোম্পানী'র (The Bray-Hurd Process Company)। এই স্টুডিও পরবর্তী ১৭ বছর কার্টুন ছবি নির্মাণ করে। অন্য অনেক স্টুডিও এই সময়কালে উঠে আসে। এই স্টুডিওগুলিকে অ্যানিমেশন ছবি মসৃণ এবং নির্মাণকার্য্য সহজ করে তুলবার জন্য নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করতে হয়েছিল।[১৪]

মেক্স ফ্লেইসার (Max Fleischer) আবিষ্কার করেছিলেন রটোস্কোপ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে 'জীবন্ত ছবি'র (live action) ফ্রেমকে পরিবর্ধিত করে সেই ছবির ওপরে বুলিয়ে বুলিয়ে অ্যানিমেশন ছবির ফ্রেম আঁকা হত। জীবন্ত মানুষের ছবির থেকে আঁকা হওয়ার জন্য হাতে-ধরে সঞ্চালনের শুদ্ধ রূপ ফুটে উঠেছিল।[১৪]

অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ছিল 'সেল'-এর (Cel) ব্যবহার। 'সেল' একধরনের পারদর্শী কাগজের মতো পাত। 'সেলুলয়েড দ্বারা নির্মাণ হওয়ার জন্যই একে সংক্ষেপে সেল বলা হত। আসলে সেল সেলুলয়েড সেলুলোজ নাইট্রেট এবং কর্পূরের মিশ্রণ। কিন্তু এটি অতিমাত্রায় জ্বলনশীল এবং সহজে নস্ট হয়ে যায় বলে পরে সেলুলয়েডের পরিবর্তিত সেলুলোজ অ্যাসিটেট দ্বারা নির্মিত সেল ব্যবহার করা হয়। ১৯৯০-র দশক থেকে সেলের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে স্টুডিওগুলি কম্পিউটার প্রোগ্রামের সহায়তা নিতে আরম্ভ করে।

১৯২০-৩০-র সময়কালে কয়েকটি অ্যানিমেশন স্টুডিও গড়ে ওঠে। এই স্টুডিওসমূহ নিজের ছবির প্রতি দর্শক আকৃষ্ট করার জন্য অহরহ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। সেই সময়ে স্টুডিওতে নির্মিত কার্টুন ছবিগুলি দেখানো হত ছবিঘরে মূল ছবি প্রদর্শনের আগে আগে। স্টুডিওগুলি জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য কিছু জনপ্রিয় হয়ে যাওয়া চরিত্রকে বারে বারে ব্যবহার করত।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ওঠা অ্যানিমেশন স্টুডিওগুলি মূলতঃ কিছু জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দিত। আর সেই চরিত্রের বিভিন্ন কাণ্ড-কারখানার ছোট অ্যানিমেশন ছবি তৈরি করে দর্শক বাড়ানো হত। বহু এমন চরিত্রের মধ্যে বিশেষ স্থান লাভ করা একটি চরিত্র ছিল 'ফেলিক্স-দা ক্যাট' (Felix the Cat)। পারামাউণ্ট (Paramount) স্টুডিওর ব্যানারে অটি মেসমার সৃষ্টি করেছিলেন এই কার্টুন মেকুরীটির। ফেলাইন ফোলিস (Feline Follies) নামের ছবিতে এই চরিত্রের প্রথম অভিষেক ঘটেছিল।[১৫]

মেক্স ফ্লেইসারের ইঙ্কওয়েল স্টুডিও থেকে (Inkwell Studios) উঠে এসেছিল অন্য একটি জনপ্রিয় চরিত্র 'ইঙ্কওয়েলের বহুরূপী' (The Inkwell Clown)। প্রথম অবস্থায় এই 'বহুরূপী'র চরিত্রটির কোনো নাম দেওয়া ছিল না বলে তিনি নিজেই 'ইঙ্কওয়েলের বহুরূপী' নাম দিয়ে নেন। পরে অবশ্য 'কোকো' (Koko) হিসাবে নামকরণ করা হয়। এই বহুরূপী চরিত্রটি আঁকতে রটোস্কোপ পদ্ধতির সহায়তা নেওয়া হয়েছিল। এইভাবে বাস্তব বস্তুর সাথে যোগাযোগ করা প্রথম কার্টুন চরিত্র হওয়ার গৌরবও 'ইঙ্কওয়েলের বহুরূপী'র প্রাপ্য।[১৬]

সেই সময়ের অন্য একটি জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র হ'ল 'বঞ্জো' (Bonjo the Dog, স্রষ্টা: জর্জ ষ্টাডি (George Studdy))। [১৭]

১৯২১ সালে ওয়াল্ট ডিজনি (Walt Disney) নিজে লাফ-ও-গ্রাম (Laugh-O-Gram) নামে একটি স্টুডিও খোলেন এবং ১৯২২ সাল পর্যন্ত ছয়টি কার্টুন ছবি নির্মাণ করেন।[১৮] অ্যানিমেশন ছবিকে উন্নত করে একটি সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা দেওয়া ওয়াল্ট ডিজনি এবং ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর (Walt Disney Studio) বিষয়ে অন্য একটি অনুচ্ছেদে আলোচনা করা হয়েছে।

১৯২৭ সালে ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও থেকে নির্মাণ হয় মিকি মাউসের প্রথম কার্টুন ছবি[১৯] এবং সেটি থেকে হলিউডের (Hollywood) অ্যানিমেশন ছবির ইতিহাস ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে।

মিকি মাউজ[সম্পাদনা]

মিকি মাউজের প্রথম ছবি ছিল 'প্লেন ক্রেজি' (Plane Crazy) (১৯২৮), দ্বিতীয় ছবি ছিল 'দ্য গ্যালোপিং গচো' (The Galloping Gaucho) (১৯২৮)। অবশ্য এই দুটি ছবি়ই পরিবেশকের অভাবের জন্য মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি।[১৯] ১৯২৮ সালে ওয়াল্ট ডিজনি সবাক করে নির্মাণ করেন আরেকটি মিকি মাউজের ছবি, 'স্টিমবোট উইলি' (Steamboat Willie)। এই ছবিটি মুক্তি দেয় সেলিব্রিটি পিকচার্স (Celibrity Pictures)। ১৯২৮ সালের ১৮ নভেম্বর তারিখে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি অভূতপূর্ব প্রশংসা লাভ করে। এর পরে কয়েকটি মিকি মাউজের ছবি নির্মাণ করা হয়।[১৯]

ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও[সম্পাদনা]

ওয়াল্ট ডিজনি ১৯২১ সালে গৃহ শহর কানসাসে (Kansas) প্রথম 'লাফ-ও-গ্রাম' স্টুডিও খুলে অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণ আরম্ভ করে। ২ বছর পরে এই স্টুডিও বন্ধ করে ওয়াল্ট ডিজনি হলিউডে আসে এবং সেখানেই ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও খোলে। এই স্টুডিও থেকেই ১৯২৪ সালে প্রথমে নির্মাণ করে 'অ্যালিসের ওয়াণ্ডারল্যাণ্ড' (Alice's Wonderland) নামে একটি অ্যানিমেশন এবং 'জীবন্ত গতি'র (Live Action) মিশ্রিত ছবি। এই ছবিসমূহে অ্যালিসের চরিত্রে অভিনয় করেছিল একটি ছোট মেয়ে এবং অ্যালিসের সাথে অভিনয় করা কার্টুন চরিত্রগুলি ছিল হাতে আঁকা।[১৮]

১৯২৭ সালে ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও থেকে আরেকটি কার্টুন চরিত্রের জন্ম দেওয়া হয়। সেটি ছিল 'অসওয়াল্ড, দা লাকি র্যাবিট' (Oswald the Lucky Rabbit)। 'অসওয়াল্ড'-এর ছবিসমূহ প্রভূতভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯২৮ সালে ওয়াল্ট ডিজনির ছবি পরিবেশক 'ইউনিভার্সাল স্টুডিও' ওয়াল্টকে উপযুক্ত টাকা দিতে অস্বীকার করায় তিনি নিজে একটি স্টুডিও খুলে অসওয়াল্ডের ছবি নির্মাণ করা আরম্ভ করেন।[২০]

ওয়াল্ট ডিজনি নিজে থেকে একটি কার্টুন চরিত্র তৈরির চেষ্টা করে সৃষ্টি করেন 'মিকি মাউজ' (Mickey Mouse)। মিকি মাউজ কার্টুন জগতের অন্যতম এক জনপ্রিয় চরিত্র, এবং এই মিকি মাউজের ছবিসমূহ ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওকে একটি উল্লেখযোগ্য স্টুডিও হিসেবে পরিচিতি দেয়।[১৯]

ওয়াল্ট ডিজনি নতুন নতুন প্রক্রিয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অ্যানিমেশন ছবির উন্নতিসাধনের চেষ্টা করেছিলেন। ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর অ্যানিমেটর উব ইয়ের্কস (Ub Iwerks) ছিলেন এই ক্ষেত্রে ওয়াল্টের সহযোগী। দুইজনের প্রচেষ্টায় ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও থেকে কয়েকটি পদ্ধতির সূচনা করা হয় যা অ্যানিমেশন নির্মাণের উন্নতিসাধন সম্ভব করে তুলেছিল।

সেই সময়ে প্রচলিত অ্যানিমেশন ছিল রুক্ষ। চরিত্রসমূহকে চলা-ফিরা করিয়ে মানুষকে হাসাতে পারলেই হল বলে ভাবা হত। তাছাড়া, কম সময়ে এই অধিক সংখ্যক ছবি নির্মাণের দায়িত্ব এসেছিল মালিক কর্তৃপক্ষ থেকে। যতদূর কম পরিশ্রমে এবং কম সময়ে ছবিসমূহ আঁকার চেষ্টা করা হত। তাতে অ্যানিমেশন ছবিসমূহে সুকুমার শিল্পের গাম্ভীর্য্য দেখা যেত না। ওয়াল্ট ডিজনি অ্যানিমেশন ছবির এই বিশেষ অসুবিধা দূর করার চেষ্টা করে অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণের সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে পুনর্নির্মাণ করেন।

ওয়াল্ট ডিজনি সঙ্গীতের গতির সাথে চরিত্রের গতির সঙ্গতি রখার চেষ্টা করেন যাতে চরিত্রের গতিতে সুষমতার অনুভব হয়। এই উদ্দেশ্যে স্টুডিওর সঙ্গীতজ্ঞ কার্ল ষ্টালিং (Carl Stalling) ছবির সঙ্গীত আগেই বানীবদ্ধ করার জন্য নেন। পরে অ্যানিমেটর সেই সঙ্গীতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চরিত্রের গতির ছবি আঁকেন। এই পদ্ধতিতে নির্মাণ করা 'সিলি সিম্ফোনি' (Silly Symphonies) এমনই এক ছবি যা ডিজনীর অ্যানিমেশনকে অন্যান্য স্টুডিওর অ্যানিমেশনের থেকে পৃথক এবং সুসংহত রূপ দেয়। ছবির সংলাপও আগে থেকে রেকর্ডিং করার ব্যবস্থা করা হয়।[২১]

ডিজনী স্টুডিওতে প্রথমে ব্যবহার করা হয়েছিল বর্তমান অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণের একটি খুব জরুরী পর্ব —'স্টোরি বোর্ড' (Story Board) অঙ্কন। একটি গল্প ছবি হিসেবে কতটা লাগবে তার একটি আভাষ পাওয়ার জন্য কমিক্‌সের মতো করে গল্পটির একগুচ্ছ ছবি আঁকা হয়েছিল, এবং সেই ছবির ক্রমান্বয়িক আলোচনা করে ঠিক করা হয়েছিল কোনটিতে আরও ভাল করে পরিবেশন করার জায়গা আছে। তাতে স্টুডিওর ছবির গল্পের মান আগের থেকে উন্নত হতে আরম্ভ করেছিল।[২২]

এবার ওয়াল্ট 'ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অ্যানিমেশন' (Personality Animation) নির্মাণের ওপর জোর দেন। সেই সময়ের কার্টুন চরিত্রগুলিকে ক্ষোভ, দুঃখ, আনন্দ ইত্যাদি প্রকাশ করার জন্য সক্ষম করা হয়েছিল যদিও একটি বিশেষ ব্যক্তিত্ব আহরণ করার জন্য সক্ষমতা ছিল না। উদাহরণ স্বরূপ, নায়ক এবং খলনায়কের হাসি, কান্না ইত্যাদিতে একই ধরনের হাত-মুখ নড়াচড়া করানো হত। ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও এই অসুবিধা দূর করার জন্য অ্যানিমেটরদেরকে ছবি অঙ্কনের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া আরম্ভ করে। চরিত্রানুসারী ব্যক্তিত্ব লাভ করার জন্য সক্ষম হওয়া প্রথম অ্যানিমেশন ছবি ছিল 'থ্রী লিট্‌ল পিগ্‌স' (১৯৩৩, Three Little pigs)।[২২]

১৯৩৪ সালে ওয়াল্ট ডিজনি প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের অ্যানিমেশন ছবি 'স্নো হোয়াইট অ্যান্ড সেভেন ডোয়ার্ফস'-এর (Snow White and Seven Dwarfs)[২৩] নির্মাণের কাজ আরম্ভ করেন। প্রথমে স্টুডিওর আর্টিষ্টদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে নিয়ে ওয়াল্ট ডিজনি এই কাজে হাত দিয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে এই ছবিটি নির্মাণ হয়ে যায় এবং অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে।[২৪] এর পরে ডিজনী স্টুডিও কয়েকটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি নির্মাণ করেন এবং কয়েকরকম নতুন নতুন আঙ্গিক প্রয়োগ করে অ্যানিমেশন ছবিকে এক স্বয়ং সম্পূর্ণ রূপ দেন।

ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর সমসাময়িক অন্যান্য স্টুডিও[সম্পাদনা]

ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও-র সমসাময়িক অন্য কার্টুন ছবি নির্মাতা স্টুডিওসমূহ ডিজনীর 'জীবিত-সদৃশ' (Life Like) অ্যানিমেশনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্য মাত্রা দেওয়ার জন্য গল্পের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়ে বানানো অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। এরা অনেক উল্লেখযোগ্য কাজ শুরু করে গিয়েছে। এই স্টুডিওসমূহের মধ্যে 'স্ক্রীন জেমস‌' (Screen Gems), 'ইউনিভার্সাল'(Universal), 'টেরীটু‌নস' (Terrytoons), 'বার্নার ব্রাদার্স' (Warner Bros.) ইত্যাদি প্রধান।[২৫]

১৯৩৬ সালে 'বার্নার ব্রাদার্স' স্টুডিওতে যোগদান করে তিনজন অ্যানিমেটর ক্রমে 'টেক্স আভেরি' (Tex Avery), 'চাক্‌ জোন্‌স' (Chuck Jones) এবং 'বব ক্ল্যাম্পেট' (Bob Clampett), এবং এই ত্রিমূর্তি 'বার্নার ব্রাদার্স স্টুডিওকে নতুন প্রাণ দিতে সক্ষম হন। 'পর্কি পিগ' (Porky Pig) এবং 'দেফি ডাক' (Daffy Duck) চরিত্র দুটি বার্নার ব্রাদার্সের অ্যানিমেশন সিরিজ 'লুনি টিউন‌স'-কে (Looney Tunes) নতুন রূপ দিয়ে জনপ্রিয়তা আহরণ করতে সক্ষম হয়।[২৬] টেক্স এভেরী ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দে সৃষ্টি করা 'বাগ্‌ছ বানী' (Bugs Bunny) একটি খুব জনপ্রিয় চরিত্র। টেক্স আভেরি ডিজনী প্রবর্তন করা বাস্তবানুগ অ্যানিমেশনের বিপরীতে খুব নাটকীয় এবং বন্য চাল-চলনে ভরা অথচ হাস্যরসে ভরপুর অ্যানিমেশন সৃষ্টি করায় গুরুত্ব দেন।[২৭] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ডিজনীর অ্যানিমেশন এবং টেক্স আভেরির অ্যানিমেশন দুটি বিশেষ ঘরানার সৃষ্টি করে।

১৯৪০ সালে অন্য দুটি খুব জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্রের জন্ম হয়। 'টম অ্যান্ড জেরি' (Tom and Jerry), এহাল মেকুরী এবং নিগনি। জেরিকে ধরতে গিয়ে প্রতিবারই নাকানি-চোবানি খাওয়া টমে-র স্রষ্টা ছিলেন 'উইলিয়াম হানা' (William Hanna) এবং 'জোসেফ বারবারা' (Joseph Barbara)।[২৮]

প্রক্রিয়া[সম্পাদনা]

একটি দ্বি-মাত্রিক এ্যানিমেশন

অ্যানিমেশনের প্রকার[সম্পাদনা]

পারম্পরিক অ্যানিমেশন[সম্পাদনা]

পারম্পরিক অ্যানিমেশনের উদাহরণ, ঘোড়াটির দৌড়াতে থাকা মূহুর্তের কয়েকটি ছবি ক্রমে সাজিয়ে এই অ্যানিমেশন নির্মাণ করা হয়েছে। স্থির চিত্রগুলি 'রটোস্কোপ' পদ্ধতিতে ঘোড়ার ছবির থেকে আঁকা হয়েছে।
Joy & Heron - Animated CGI Spot by Passion Pictures

পারম্পরিক অ্যানিমেশন (একে সেল (Cel) অ্যানিমেশন বা হাতে আঁকা (Hand drawn) অ্যানিমেশন বলেও ডাকা হয়): বিংশ শতকের অ্যানিমেশন ছবি এই পদ্ধতির নির্মাণ করা হয়েছিল। গতিশীল চরিত্র বা বস্তু একটির ক্রমিক চিত্র কাগজে হাতেরে এঁকে নেওয়া হয়। অ্যানিমেশনের জন্য ছবি আঁকা ব্যক্তিকে 'অ্যানিমেটর' (Animator) বলে। প্রতিটি ছবি একটা গতির ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হওয়া স্থানের ছবি। কাগজ থেকে পারদর্শী 'সেল'-এ ছবিটি 'ট্রেসিং' করে নেওয়া হয়। এই সেলের ওপরে রঙ লাগানো হয়। প্রয়োজন অনুসারে একটির বেশি 'সেল' এর ওপরে লাগিয়ে দিয়ে বহু চরিত্র একসাথে রাখা যায়। 'ব্যাকগ্রাউণ্ড'-এর ছবিও আলাদাভাবে এঁকে সেলের তলায় রাখা হয়। পরে সেই ছবি ক্যামেরায় একটি একটি করে চলচ্চিত্রের 'ফিল্ম'-এ (Film) ফুটিয়ে তোলা হয়।[২৯] আজকাল অবশ্য 'সেল' ব্যতীত আবার 'ট্রেস' করার পরিবর্তিত 'গাণনিক যন্ত্র'র সহায়তায় 'ডিজিটাল' পদ্ধতির ছবি তৈরি করে নিয়ে তাতে রঙ লাহানো ইত্যাদি কাম করা হয়। পিনোক্কিও' (Pinocchio, ১৯৪০, আমেরিকা), আকিরা (Akira, ১৯৮৮, জাপান), লায়ন কিং (The Lion King, ১৯৯৪, আমেরিকা), স্পিরিটৈড অ্যাওয়ে (Spirited Away, ২০০১, জাপান) ইত্যাদি এই পদ্ধতিতে নির্মিত অ্যানিমেশন ছবি। পরম্পরাগত অ্যানিমেশনের ছবি বাস্তবানুগ বা কেরিকেচার ধর্মী হতে পারে।

  • সম্পূর্ণ অ্যানিমেশন (Full Animation): পরম্পরাগত পদ্ধতিতে উচ্চ মানের ছবি এবং মসৃণ চলা-ফেরা গতিতে নির্মাণ করা অ্যানিমেশন। এই ধরনের অ্যানিমেশনে চলন মসৃণ রাখার জন্য নির্মাতাকে অধিক কষ্ট করতে হয়।
  • সীমিত অ্যানিমেশন (Limited animation): পরম্পরাগত পদ্ধতি ব্যবহার করে নির্মাণ করলেও এটিতে কম মানসম্পন্ন ছবি এবং গতির মসৃণতা বজায় রাখতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সাধারণত দূরদর্শনের জন্য নির্মাণ করা অ্যানিমেশন ছবিতে ব্যবহার হয়। এই পদ্ধতিতে নির্মাণ করলে কষ্ট এবং সময় দুইই লাঘব হয়, সেই দ্রুত গতিতে ছবি নির্মাণ করতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
  • রটোস্কোপিং (Rotoscoping) মেক্স ফ্লেইসাার-এর (Max Fleischer) ১৯১৭ সালে উদ্ভাবন করা একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে প্রথমে একজন অভিনেতার দ্বারা অ্যানিমেশন করণীয় অংশের চলচ্চিত্র বানিয়ে নেওয়া হয়। পরে সেই ছবি একটি একটি করে কাগজে পরিবর্ধন করে 'ট্রেসিং' করে ছবি আঁকা হয়। এই পদ্ধতিতে বাস্তব চলাচলের নকল তৈরি করা যায়। অবশ্য বাস্তব চলাচল ট্রেসিং করলে চলাচলের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যেতে দেখা যায়। সাম্প্রতিক কালের 'ওয়াল্ট্‌জ উইথ বশির' (Waltz with Bashir, ২০০৮, ইজরাইল) এই পদ্ধতিতে নির্মিত ছবি।
  • জীবন্ত ছবি এবং অ্যানিমেশনের সমাহার (Live-action/animation): এই পদ্ধতিতে একটি ফ্রেমে আঁকা ছবি এবং সিনেমার ক্যামেরায় তোলা ছবি থাকে। 'হু ফ্রেম্‌ড্‌ রোজার রাবিট' ('Who Framed Roger Rabbit?' ১৯৮৮, আমেরিকা) এই পদ্ধতিতে নির্মিত একটি বিখ্যাত ছবি।

স্টপ মোশন (Stop Motion)[সম্পাদনা]

স্টপ মোশন পদ্ধতিতে নিজে নিজে গিয়ে থাকা মুদ্রার অ্যানিমেশন তৈরি করা হয়েছে।

বাস্তব জগতের বস্তু বা পুতুল-মডেলের স্থান অল্প অল্প করে পরিবর্তিত করে একটি ক্রমে ফুটিয়ে তুলে নির্মাণ করা অ্যানিমেশন। এতে পারম্পরিক অ্যানিমেশনের মতো ছবি আঁকা যায় না। বহু পদ্ধতিতে স্টপ মোশন ছবি নির্মাণ করা যায়।

  • পুতুল অ্যানিমেশন (Puppet animation): হাতে ভরে বিভিন্নভাবে জোরে নড়াচড়া করা পুতুল ব্যবহার করে এই অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণ করা হয়। 'দা নাইটমেয়ার বিফোর খ্রীষ্টমাস (The Nightmare Before Christmas, ১৯৯৩, আমেরিকা), 'কর্পস ব্রাইড' (Corpse Bride, ২০০৫, আমেরিকা) এই পদ্ধতিতে নির্মিত ছবি।
    • পাপেটুন (Puppetoon), জর্জ পল-এর (George Pal) ব্যবহার করা একটি পদ্ধতি। একটি চরিত্রের বিভিন্ন ভঙ্গীমার অনেকগুলি পুতুল সাজিয়ে নেওয়া হয়। পরে একটির পরে আরেকটি করে যথাস্থানে রেখে ফুটিয়ে তুলে চলচ্চিত্রের রূপ দেওয়া হয়।
Clay animation
  • ক্লে' অ্যানিমেশন (Clay animation), বা প্লাষ্টিসিন (Plasticine) অ্যানিমেশন: সংক্ষেপে 'ক্লেমেশন' বলেও ডাকা হয়। আকার দেওয়া থেকে আঠালতীয়া মাটি বা প্লাষি্টসিনের পুতুল সাজিয়েয়ে সেই পুতুলকে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় রেখে একটি একটি ফ্রেম সাজানো হয় এবং তার ছবি তোলা হয়। 'ওয়াালেস অ্যান্ড গ্রোমিট' ('Wallace and Gromit') সিরিজের অনেকগুলি ছবি়েই এই পদ্ধতিতে নির্মিত।
  • কাট-আউট (Cutout animation) কাপড় বা কাগজর টুকরো কেটে কেটে সঠিক স্থানে রেখে ফুটিয়ে তুলে এই অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণ করা হয়। 'গল্পের গল্প' (Tale of Tales, ১৯৭৯, রাশিয়া) এই পদ্ধতিতে নির্মিত।
ফিনল্যান্ডের একটি টিভি বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত ক্লে'মেশন।
    • সাঁ অ্যানিমেশন (Silhouette animation) কাট-আউট অ্যানিমেশনের প্রকারভেদ। এটি কেটে নেওয়া টুকরোগুলি আয়নার ওপরে রেখে পিছনদিক থেকে আলোর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে বানানো হয়। 'এডভেন্সা‌র্স অব প্রিন্স আক্‌মেদ' ('The Adventures of Prince Achmed' ১৯২৬, জার্মানি) এই পদ্ধতিতে নির্মিত।
  • মডেল অ্যানিমেশন (Model animation) 'জীবন্ত গতি' ছবিতে ব্যবহার করা এই পদ্ধতিতে বড়ো আকারের মডেল সাজিয়ে নেওয়া হয়। এই মডেলকে দরকার অনুসারে নড়াচড়া করে অ্যানিমেশন সৃষ্টি করা হয়। রে হ্যারিহোসেন এই পদ্ধতি ব্যবহার করে চমকপ্রদ কিছু প্রাগৈতিহাসিক জীব-জন্তু জীবন্ত রূপে দেখান 'দা লষ্ট ওয়ার্ল্ড' (The Lost World) চলচ্চিত্রে। 'কিং কং' ('King Kong', ১৯৩৩) ছবিতে কিং কং একটি মডেল অ্যানিমেশন ছিল।
    • গো মোশন (Go motion) 'ইণ্ডাষ্ট্রিয়াল লাইট অ্যান্ড ম্যাজিক' নামের প্রতিষ্ঠানটি 'ফিলি টিপেট'-এর সহায়তায় এই পদ্ধতির সূত্রপাত করে। এটি মূলতঃ মডেল অ্যানিমেশনের একটি প্রকার। এই পদ্ধতিতে মডেল অ্যানিমেশনের সময়ে দুটি ফ্রেমের মধ্যে সামান্য অস্পষ্টতা যোগ করা যায়। এই অস্পষ্টতাই মডেল অ্যানিমেশনকে এক 'জীবন্ত গতি'র মতো দেখতে করে তোলে। 'ড্রাগন স্লেয়ার' (Dragonslayer, ১৯৮১) এবং 'ষ্টার ওয়ার্স: এম্পায়ার ষ্ট্রাইক্স ব্যাক' ('Star Wars: Empire Strikes Back', 1980) ছবিতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল।
  • অবজেক্ট অ্যানিমেশন (Object animation) স্টপ মোশন অ্যানিমেশনে ব্যবহৃত হয়ে থাকা বস্তুগুলিকে আগে-পিছে করার পদ্ধতি।
    • গ্রাফিক অ্যানিমেশন (Graphic animation) আগে আঁকা ফুটিয়ে, খবরের-কাগজর টুকরো ইত্যাদিকে এদিক-সেদিক করে নির্মাণ করা অ্যানিমেশন।
  • পিক্সিলশন (Pixilation) জীবন্ত মানুষকে একটি একটি ভঙ্গিমায় রেখে একটি একটি করে ফুটিয়ে তুলে তৈরি করা অ্যানিমেশন।

কম্পিউটার অ্যানিমেশন[সম্পাদনা]

ঘূর্ণনরত পৃথিবীর gif অ্যানিমেশন

কম্পিউটারের সহায়তায় নির্মাণ করা অ্যানিমেশনকেই কম্পিউটার অ্যানিমেশন বলা যায়। কম্পিউটার অ্যানিমেশনের কয়েকটি প্রকার আছে এবং এছাড়া অনেক কম্পিউটারকে বিভিন্ন ধরনে ব্যবহার করা হয়।

দ্বিমাত্রিক অ্যানিমেশন (2D animation)[সম্পাদনা]

দ্বিমাত্রিক ছবি সংযোগ এবং সম্পাদনা করে 'দ্বিমাত্রিক অ্যানিমেশন' নির্মাণ করা হয়। দ্বিমাত্রিক ছবিটি কম্পিউটারের সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে আঁকা হতে পারে বা হাতে এঁকে স্ক্যান করে নেওয়াও হতে পারে। অবশ্য প্রয়োজনীয় ফ্রেম হাতে এঁকে স্ক্যান করলে সেইটি সঠিক অর্থে কম্পিউটার অ্যানিমেশন নয়। সাধারণত মূল ফ্রেমগুলি হাতে এঁকে মাঝের ফ্রেমটি কম্পিউটারের সহায়তায় এঁকে নেওয়া (inbetweening, morphing) অথবা কম্পিউটারের দ্বারা 'রটোস্কোপ' করে নেওয়া ইত্যাদিকে কম্পিউটার অ্যানিমেশন বলা হয়। কম্পিউটারে দ্বিমাত্রিক অ্যানিমেশন সৃষ্টির জন্য বহু সফটওয়্যার পাওয়া যায়। 'ফ্লাশ' (Flash) একটি বহুল ব্যবহৃত তেমনি সফটওয়্যার।

ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন (3D animation)[সম্পাদনা]

ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন আগে উল্লেখ করা 'মডেল অ্যানিমেশন'-এর কম্পিউটার রূপ বলা যায়। ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন নির্মাণ করার জন্য কম্পিউটার সফটওয়্যারে ত্রিমাত্রিক মডেল (3D Model) সাজিয়ে নেওয়া হয়। সেই মডেলকে সফটওয়্যারে সময়ের হিসেবে গতি দিয়ে এই অ্যানিমেশন তৈরি করা হয়। খুব ভাল করে বানানো ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন 'জীবন্ত গতি'র সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। আজ কাল বহু চলচ্চিত্রে 'জীবন্ত গতি'র সাথে স্পেশাল এফেক্ট হিসাবে ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন প্রয়োগ করা হয়। ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ১৯৮০-র দশকের প্রথম ভাগ থেকেই ব্যবহার হয়ে এসেছে যদিও 'টয় ষ্টোরি' (Toy Story, ১৯৯৫, আমেরিকা) সম্পূর্ণরূপে কম্পিউটারে নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র।

কম্পিউটার অ্যানিমেশন সম্পর্কীয় কিছু পরিভাষা[সম্পাদনা]
  • জীবন্ত ছবির মতো অ্যানিমেশন (Photo realistic animation): সাধারণত কম্পিউটারে নির্মিত ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশনের গতি এবং দৃশ্যে একটি কৃত্রিমতা দেখা যায়, যার জন্য তাকে অ্যানিমেশন ছবি বলে সহজে বোঝা যায়। এই কৃত্রিমতা দূর করার জন্য বিভিন্ন চেষ্টা চালানো হয়েছে , যদিও সম্পূর্ণ সফলতা লাভ করা সম্ভব হয়নি। Final fanatsy: the spirits within নামের ছবিটিতে প্রথম অ্যানিমেশনকে সম্পূর্ণ জীবন্ত রূপ দেয়ার প্রয়াস করা হয়। যথেষ্ট ফলপ্রসূ হ'লেও এই প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে সফল হয়নি। ২০০৯ সালে নির্মিত হলিউডের ছবি অবতার-এ এই ক্ষেত্রে বহু অগ্রগতি হতে দেখা গিয়েছে।
  • মোশন ক্যাপচার (Motion capture): জীবন্ত অভিনেতাকে বিশেষ পোশাক পরিয়ে তার গতি এবং মুখমণ্ডলের অঙ্গ-ভঙ্গিকে কম্পিউটারের সহায়তায় ত্রিমাত্রিক মডেলের ওপরে আরোপ করা হয়। এর দ্বারা ত্রিমাত্রিক মডেলটর বাস্তব অভিনেতাটির মতোই অভিনয় করার আভাস পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে নির্মিত 'লর্ড অব দ্য রিংস' (Lord of the Rings) চলচ্চিত্র সিরিজের 'গোল্লাম' (Gollum) নামের চরিত্রটিকে এই পদ্ধতির এক উল্লেখনীয় অবদান বলা হয়।

অ্যানিমেশনের কিছু অন্য পদ্ধতি[সম্পাদনা]

  • ফিল্মর ওপরে অঙ্কন (Drawn on film animation): এই পদ্ধতিতে চলচ্চিত্রের রিলের প্রতিটি ফ্রেমে ছবি এঁকে অ্যানিমেশন তৈরি করা হয়। এই পদ্ধতিতে অ্যানিমেশন নির্মাণ করা কিছু ব্যক্তির নাম: Norman McLaren, Len LyeStan Brakhage.
  • কাঁচের ওপরে পেণ্ট অ্যানিমেশন (Paint-on-glass animation): কাঁচের ওপরে ধীরে শুকানো রঙ (সাধারণত তেল রঙ) ব্যবহার করে আঁকাটি শুকাবার আগেই রঙটি সঠিক ভাবে এদিক-সেদিক করে প্রতিটি ফ্রেমের ছবি নেওয়া হয়। অস্কার পুরস্কার বিজয়ী রুশ অ্যানিমেটর আলেকসেন্দ্র পেট্রভ-এ (Alexandr Petrov) এই পদ্ধতিতে কয়েকটি অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণ করেছেন।
  • মুছে মুছে নির্মাণ করা অ্যানিমেশন (Erasure animation): শিল্পী আঁকা ফুটিয়ে তুলে ফ্রেম সাজিয়ে তৈরি করা অ্যানিমেশন।
  • পিনের পর্দা অ্যানিমেশন (Pinscreen animation): একটি পর্দার ওপরে 'পিন' বিঁধিয়ে নিয়ে পিনগুলিকে সময়মত ওলোট-পালট করে নির্মাণ করা অ্যানিমেশন। এই পদ্ধতিতে আলোর কোণাকুণি করে পর্দাটির ওপরে ফেলা হয় যাতে উঠে থাকা পিনের ছায়া বাকী অংশে পড়ে একটি দৃশ্যের সৃষ্টি করতে পারে।
  • বালি অ্যানিমেশন (Sand animation): তলার থেকে বা ওপর পর্যন্ত আলো পড়ে থাকা কাঁচের ওপরের বালির তরপকে হাতের মাধ্যমে এদিক-সেদিক করে নির্মাণ করা অ্যানিমেশন।

উল্লেখযোগ্য এর বাইরেও অন্য বহু উপায়ে অ্যানিমেশন নির্মাণ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯২ সালে পিওটর ডুমালার (Piotr Dumala) নির্মিত ফ্রাঞ্জ কাফকায় (Franz Kafka) প্লাষ্টারের নির্মিত ফলকের ওপরে কালো রঙ দিয়ে পরে সেই রঙ অল্প অল্প করে তুলে অ্যানিমেশন নির্মাণ করা হয়েছিল। [৩০]

অ্যানিমেশনের আরও কিছু পদ্ধতি[সম্পাদনা]

অ্যানিমেশন ছবির নির্মাণ পদ্ধতি[সম্পাদনা]

একটি অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণ প্রক্রিয়া একটি 'জীবন্ত গতি' চলচ্চিত্রের নির্মাণ প্রক্রিয়ার থেকে ভিন্ন হয়। সাধারণ ভাবে মেনে চলা প্রক্রিয়াটি নিম্নলিখিত ধরনের।‌[২৯]

১. কাহিনী এবং চিত্রনাট্য: যেকোনো কাহিনী ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রথম ধাপ হল একটি কাহিনী এবং সেই কাহিনীর ভিত্তিতে একটি চিত্রনাট্য। অ্যানিমেশন ছবির চিত্রনাট্যে সংলাপে করে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় দৃশ্যমান কার্য্যভিত্তিক (visual action) প্রকাশভঙ্গীকে। প্রায়ই একটি চিত্রনাট্য মূল ছবির কাঠামো হয়ে থাকে, নির্মাণের পরের পর্য্যায়ে চিত্রনাট্য পরিবর্তিত হওয়া দেখা যায়।

২. স্টোরিবোর্ড (Storyboard): চিত্রনাট্যের ওপরে ভিত্তি করে ছবির পরিচালক ষ্টোরিবোর্ড শিল্পীর হাতে চিত্রনাট্যটির দৃশ্যাবলীর ছবি এঁকে কমিক্সের মতো করে সাজিয়ে নেন। ডিজনি স্টুডিয়োতে স্টোরিবোর্ডের একটা দৃশ্যাংশের ওপরে ব্যাপক আলোচনা হয় এবং সেই দৃশ্যাবলীকে এবং প্রায়ই নতুন দৃশ্যাংশের সংযোগ, বা থাকা দৃশ্যাংশ মুছে ফেলে বা ভিন্ন ধরনে দর্শোবার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই আলোচনার সময়ে ছবিটির চূড়ান্ত পর্য্যায়ের রূপ দেয়ার প্রয়াস করা হয়।

৩. সংলাপ রেকর্ডিং (Soundtrack): 'জীবন্ত ছবি' চলচ্চিত্রে সংলাপসমূহ শুটিং-য়ের সময়ে রেকর্ডিং করা হয় এবং পরে ডাবিং করে অধিক উন্নত করা হয়। কিন্তু অ্যানিমেশনে এই কাজটি আগে করা হয়। কারণ অভিনেতা-অভিনেত্রী সংলাপ নিক্ষেপনের সময়ে যে আবেগ জড়িত করেন, সেই আবেগ অনূ্ভূতিকে শুদ্ধ করে প্রকাশ করার জন্য ছবি আঁকা আরম্ভ করার আগেই বিশদভাবে জানা প্রয়োজনীয়। কিন্তু রেকর্ডিং সংলাপ না হলে সেটি আগেই নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আগে থেকে সংলাপ রেকর্ডিং করলে ছবির ফ্রেম আঁকাগুলি সংলাপের জন্য লাগা সঠিক সময়েরও আভাস পায়।

৪. ট্র্যাক ব্রেকডাউন (Track Breakdown): সব সংলাপ রেকর্ডিং হওয়ার পরে সম্পাদক সেই সংলাপসমূহকে চলচ্চিত্রের ফ্রেম সংখ্যার সাথে মিলিয়ে একটি টিকা বানিয়ে নেন। উদাহরণস্বরূপ, ধরা হল একজন অভিনেতা সংলাপ হিসেবে একটি কাশির দৃশ্য করছেন। সম্পাদক সেই কাশিটি কত নম্বর ফ্রেমে আরম্ভ হয়ে কোথায় শেষ হয়েছে তার একটি তালিকা প্রস্তুত করে।

৫. ডিজাইন (Design): ছবির সঙ্গীত এবং সংলাপ রেকর্ডিং করার সময়ে ডিজাইনার ছবিটির ছবিসমূহ কেমন ধরনের রাখা হবে, কেমন হলে ছবির কাহিনীর জন্য অনুকূল এবং দর্শকের জন্য উপভোগ্য হবে, সেটি ঠিক করে পরিচালকর সাথে কথা বলেন। ডিজাইনগুলি পরিচালকের মনঃপূত হলে সেই ডিজাইনসমূহ অ্যানিমেটর, ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্টদের কাছে পাঠানো হয়।

৬. লাইকা রিল (Leica Reel): ষ্টোরিবোর্ডের ছবি এবং সংলাপ একসাথে ফুটিয়ে তুলে একটি সিনেমার মতো করে সাজিয়ে নেওয়া হয়। লাইকা রিলের জন্য ষ্টোরিবোর্ডের ছবিসমূহ ভাল করে এঁকে নেওয়া হয় এবং প্রয়োজন অনুসারে 'ব্যাকগ্রাউন্ড' ছবিও সংযোগ করা হয়। ছবি আঁকাতে ডিজাইনের ডিজাইন, ফ্রেমিং ইত্যাদি বিষয়ও গুরুত্ব দেওয়া হয়। লাইকা রিল পরিচালকের মনঃপূত হওয়ার পরে প্রকৃত ছবি আঁকার কাজ আরম্ভ করা হয়।

৭. লাইন টেস্ট (Line Test): লাইকা রিল পরিচালকের মনঃপূত হলে স্টোরিবোর্ডের রূপ অ্যানিমেটরদের কাছে পাঠানো হয়। অ্যানিমেটর ফ্রেম-ফ্রেম করে চরিত্র বা বস্তুটির গতির ছবি আঁকেন। বড়ো ছবিগুলিতে এক-একটি চরিত্র র ওপরে এক-একজন অ্যানিমেটর কাজ করেন। কোন্ চরিত্র কোন্ অ্যানিমেটরকে দেওয়া হবে সেটি মূল (Lead Animator) অ্যানিমেটরের বিশেষ দক্ষতা এবং সামর্থ্যর ওপরে নির্ভর করে ঠিক করা হয়। স্টোরিবোর্ডের মতে অ্যানিমেটর নিজ নিজ চরিত্রের ছবি এঁকে যান। একটি দৃশ্যে গতির গুরুত্ব অনুসারে সেকেণ্ডে ১২ বা ২৪-টা ফ্রেমের হিসেবে ছবি আঁকতে হয়। সাধারণত মূল অ্যানিমেটর একটি গতির নির্ণায়ক ফ্রেম, যাকে ইংরাজীতে Key Frame বলে, সেইসব ছবিই আঁকেন। সেই ছবির ওপর ভিত্তি করে মাঝের ছবিগুলিকে আঁকেন কনিষ্ঠ অ্যানিমেটরগণ, তাদেরকে "ইন্‌বিট্‌উইনার" (Inbetweener) বলেও ডাকা হয়। অবশ্য মাঝের এই ছবিগুলিকে (Inbetweens) কেমন দেখতে হবে, গতির কেমন পার্থক্য থাকবে, সেই বিষয়গুলি মূল অ্যানিমেটরই নির্ধারণ করে দেন। কিছু মূল অ্যানিমেটর অবশ্য 'দ্রুত গতি' (fast action) থাকা অংশগুলির inbetweens নিজেই এঁকে নেওয়া পছন্দ করেন।[৩১] একাধিক চরিত্র যোগাযোগ করা দৃশ্যগুলি দুজন মূল অ্যানিমেটর একসাথে বসে আলোচনা করে আঁকেন। এমনমতো হয়ে ওঠা একটা দৃশ্যাংশ পরিচালকের 'লাইকা রীল'-এ যোগ্য স্থানে সংযোজন করে মনঃপূত হলে সেটি 'ক্লীন-আপ' শিল্পীর কাছে (Cleanup Artist) পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

৮. ক্লীন-আপ (Cleanup): মূল অ্যানিমেটর এঁকে দেওয়া চরিত্রের গতির ফ্রেমগুলি সাধারণত 'স্কেচ'-এর মতো হয়, এবং সময়ের অপচয় না করার জন্য তাকে নিজের মতন করে আঁকার যত্ন করা হয় না। আসলে মূল অ্যানিমেটরের কাজ হল শুধু চরিত্রের গতির রূপরেখা তৈরি করে দেওয়া, সেজন্য হাত-পা, চোখ-মুখের স্থান ইত্যাদি শুদ্ধ করে আরো সঠিক অনু্ভূতি প্রকাশ করে এঁকে দেওয়াই তার মূল কাজ, দেখানোর মত সুন্দর ছবি তিনি না আঁকলেইও চলে। মূল অ্যানিমেটরের এঁকে দেওয়া ছবিটি কনিষ্ঠ শিল্পী মূল ছবিতে ব্যবহার করে নিজের মত ছবি এঁকে নেয়। এইটি কনিষ্ঠ শিল্পীর থেকে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েই তারা পরে মূল অ্যানিমেটরের স্থান লাভ করে।

৯. ট্রেস এবং পেইণ্ট (Trace and Paint): ক্লীন-আপ করার পরে পরিচালক ছবিটি একটি লাইকা রিলে সংযোগ করে প্রত্যক্ষ করেন এবং সবকিছু ঠিক থাকলে সেইটি 'ট্রেস অ্যান্ড পেইণ্ট' বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মন রাখতে হবে যে, ক্লীন-আপ পর্য্যায পর্যন্ত ছবিটির সকল রূপরেখা (Outline) থাকে বা সেই স্কেচ ছবির মতো হয়ে থাকে এবং তাকে কাগজে আঁকা হয়। 'ট্রেস অ্যান্ড পেইণ্ট' বিভাগে ছবিটি সেলে (cel - পারদর্শী সেলুলোজের পাত) ট্রেসিং করে নেওয়া হয় এবং তাতে রঙ দেওয়া হয়। যেদিকে ট্রেস করা হয়েছে তার উল্টোদিকে রঙ ঘষা হয়। প্রথমে এই কাজের জন্য শিল্পী ছিল, আজকাল এই কাজটি কম্পিউটারে 'স্ক্যান' করে নিয়ে ডিজিটাল ছবিতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রঙ করা হয়।

১০. পৃষ্ঠপট অঙ্কন (Background): মূল অ্যানিমেটর চরিত্র অঙ্কন করার সময়ে অন্য একটি শিল্পীগোষ্ঠী পৃষ্ঠপট (Background: দৃশ্যাংশ যে স্থানে বর্ণিত হয়েছে তার ছবি) অঙ্কন করে। এই কাজের জন্য বিশেষ পারদর্শিতা থাকা শিল্পী থাকে। তারা একটি দৃশ্যের নড়াচড়া না থাকা সকল অংশরে ছবি আঁকেন। অবশ্য পৃষ্ঠপটের পরিবর্তে তারা সম্মুখ পটি অঙ্কন করেন। কিছু দৃশ্যাংশে চরিত্রের সম্মুখে নড়াচড়া না করা অংশ থাকে, তাকে সম্মুখপট (Foreground) বলা হয়। পরিচালক স্টোরিবোর্ডের ওপরে ভিত্তি করে পৃষ্ঠপট বা সম্মুখপট কেমন হবে সেটি ঠিক করেন।

১১. পরীক্ষণ (Checking): সম্পূর্ণ হওয়া 'সেল' এবং 'পৃষ্ঠপট' পরীক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া। 'পরীক্ষকগণ (Checker) প্রতিটি 'পৃষ্ঠপট', প্রতিটি 'সেল' পুংখানুপুংখভাবে পরীক্ষা করেন সবকিছু ঠিকই আছে কিনা এবং অন্তিম পর্য্যায়ের চিত্রগ্রহণের জন্য তৈরি হয়ে আছে কি নেই। পরীক্ষকগণ সন্তুষ্ট হ'লে তারা দৃশ্যাংশ অনুসারে 'সেল' এবং পৃষ্ঠপটগুলিকে ক্রমাগতভাবে সাজান এবং চিত্রগ্রহণের জন্য পাঠিয়ে দেন। কোনোরকম অসুবিধা ধরা পরলে তা ঠিক করার জন্য ফেরত পাঠানো হয়।

১২. চিত্রগ্রহণ (Final Shoot): এই পর্য্যায়ে পরীক্ষিত সেল এবং পৃ্ষ্ঠপটসমূহ চিত্রগ্রহণকারীর কাছে পাঠানো হয়। 'বিশেষ ক্যামেরা'র (Rostrum Camera) তলায় একাদিক্রমে পৃষ্ঠপট, চরিত্র ও সম্মুখপট ইত্যাদি নিচ থেকে ওপরে সাজানো হয় এবং সেই ক্যামেরায় তার ছবি তোলা হয়। একটি ছবির পরে তার পরবর্তী গতির ছবিটি তোলা হয়, এমনভাবে একটি একটি করে ফ্রেমের ফোটোর মাধ্যমে তোলা হয়।

১৩. রাশ‌ (Rushes): একটি দৃশ্যাংশের চিত্রগ্রহণ হওয়ার পরে সেই রিল পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। যাতে ফিল্ম প্রস্ফূটন করা হয়, সেটিও স্টুডিওতে পাঠানো হয়। দৃশ্যাংশের এমন ফিল্মকে রাশ‌ বলা হয়। পরিচালক সেই রাশে সন্তুষ্ট হ'লে সেটি গ্রহণ করেন, কিংবা অসুবিধা হলে যে পর্য্যায়ে সেই অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে তা ঠিক করার প্রয়োজন পড়ে। গ্রহণযোগ্য রাশ‌গুলি থেকে সম্পাদক সঠিক দৈর্ঘ্যের ফিল্ম কেটে নেন এবং পরবর্তী দৃশ্যাংশের সাথে জুড়ে দেন। এইভাবে গোটা দৃশ্যাংশের সম্পাদনা হয়ে যাওয়ার পরে নির্মীয়মান ছবিটি সম্পূর্ণ রূপে পাওয়া যায়।

১৪. ডাবিং (Dubbing): সম্পূর্ণ হওয়া ছবিটি পরিচালক, সম্পাদক মিলে শব্দযন্ত্রীর সহায়তায় উপযুক্ত স্থানে সঙ্গীতের বিশেষ ব্যঞ্জনা, আবহ-সঙ্গীত ইত্যাদি সংযোগ করেন। 'জীবন্ত ছবি'তে ডাবিং প্রক্রিয়ায় অভিনেতা-অভিনেত্রী পুনরায় কণ্ঠ সংযোজিত করেন, অ্যানিমেশনে কিন্তু সংলাপ আগে রেকর্ডিং করা হয়। এই প্রক্রিয়ার দ্বারা ছবিতে ব্যবহৃত শব্দ, সংলাপ, সঙ্গীতের সম্পূর্ণ শব্দট্র্যাক (Soundtrack) তৈরি করা হয়।

১৫. অ্যানসার প্রিন্ট (Answer Print): এইবার সম্পূর্ণ হওয়া ছবি এবং শব্দ জোটটি একসঙ্গে পরীক্ষাগারে নিয়ে পাঠানো হয়। পরীক্ষাগারে একটি শব্দ এবং ছবি ফিল্মে সংযোগ করা হয় এবং দর্শকের চোখে এটি সবাক ছবি হয়ে উঠে। এই ছবির রিলটিকে ছবিঘরে প্রজেক্টরের মাধ্যমে পর্দায় ফেলে বড়ো আকারের করে তোলা হয়।

ওপরে উল্লেখিত বর্ণনা পারম্পরিক পদ্ধতির অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হয়। কম্পিউটার অ্যানিমেশনের জন্য স্টোরিবোর্ড, সংলাপ এবং ডিজাইন তৈরি হওয়ার পরে চরিত্র এবং পরিবেশের ত্রিমাত্রিক মডেল নির্মাণ করা হয়, চরিত্রের মডেলের হাত-পা, চোখ-মুখে অ্যানিমেটর গতি সংযোগ করেন, আলোর বিশেষজ্ঞ দৃশ্যাংশে সঠিক 'আলোর নির্মাণ' করেন; কাপড়, জল, ধোঁয়া ইত্যাদির জন্য বিশেষ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়; সাথে তৈরি হয়ে থাকা সঙ্গীত এবং সবকিছু মিলিয়ে কম্পিউটারের সহায়তায় একটি একটি করে ফ্রেম 'রেন্ডারিং' (Rendering) করা হয়। নির্মিত প্রতিটি ফ্রেমকে একত্রে চলচ্চিত্রে ফিল্মে আনা হয়। এমনভাবেই একটি কম্পিউটার ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন ছবি তৈরি করা হয়।

পুরস্কার ও সম্মাননা[সম্পাদনা]

৫টি ছবির ক্রম যা পরস্পরায় এসে একটি এ্যনিমেশন তৈরী করে

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. , আহরণ করা তারিখ জুলাই ২৮, ২০১১
  2. Williams 2009, পৃ. ১১.
  3. Williams 2009, পৃ. ১২.
  4. Williams 2009, পৃ. ১৩.
  5. Williams 2009, পৃ. ১৪.
  6. britannica.com আহরণ করা তারিখ জুলাই ২৮, ২০১১
  7. Williams 2009, পৃ. ১৫.
  8. Williams 2009, পৃ. ১৬.
  9. Beckerman, Howard (১ সেপ্টেম্বর ২০০৩)। Animation: the whole story। Skyhorse Publishing Inc.। পৃষ্ঠা 17। আইএসবিএন 978-1-58115-301-9। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০১১ 
  10. Beck 2004, পৃ. ১৪.
  11. Williams 2009, পৃ. ১৭.
  12. Beck 2004, পৃ. ১৫.
  13. Williams2009, পৃ. ১6.
  14. Beck 2004, পৃ. ১৭.
  15. Beck 2004, পৃ. ১৮.
  16. Beck 2004, পৃ. ১৯.
  17. Beck 2004, পৃ. ২৪.
  18. Beck 2004, পৃ. ২০.
  19. Beck 2004, পৃ. ৩৪.
  20. Beck 2004, পৃ. ২১.
  21. Beck 2004, পৃ. ৩৬.
  22. Beck 2004, পৃ. ৩৭.
  23. Thomas 1984, পৃ. ২৪.
  24. Beck 2004, পৃ. ৫৯.
  25. Beck 2004, পৃ. ৬৭.
  26. Beck 2004, পৃ. 67.
  27. Beck 2004, পৃ. ৮৪.
  28. Beck 2004, পৃ. ৯৪.
  29. White 1988
  30. আহরণ করা তারিখ ২ জুলাই, ২০১১
  31. Williams, 2009

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]