পোল ভল্ট

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
অ্যাথলেটিক্স
পোল ভল্ট
দণ্ডলম্ফ
পুরুষদের রেকর্ড
বিশ্বরেকর্ডফ্রান্স র‍্যনো লাভিলনি ৬.১৬ মিটার (২০১৪)
অলিম্পিক রেকর্ডফ্রান্স র‍্যনো লাভিলনি ৫.৯৭ মিটার (২০১২)
প্রমিলাদের রেকর্ড
বিশ্বরেকর্ডরাশিয়া ইয়েলেনা ইসিনবায়েভা ৫.০৬ মিটার (২০০৯)
অলিম্পিক রেকর্ডরাশিয়া ইয়েলেনা ইসিনবায়েভা ৫.০৫ মিটার (২০০৮)

পোল ভল্ট (ইংরেজি: Pole vault) বা দণ্ডলম্ফ একধরনের ট্র্যাক ও ফিল্ড ক্রীড়া, যেখানে প্রতিযোগী ক্রীড়াবিদদেরকে একটি লম্বা ও নমনীয় দণ্ড (ইংরেজিতে "পোল") সহযোগে শূন্যে লাফিয়ে (ইংরেজিতে "ভল্ট") অনেক উঁচুতে অবস্থিত (সাধারণত ১৮ ফুট বা তার বেশি উচ্চতায় অবস্থিত) একটি প্রতিবন্ধক আড়দণ্ডের (ইংরেজিতে "বার") উপর দিয়ে সেটিকে স্পর্শ না করে অতিক্রম করতে হয়।[১] বর্তমানে লম্ফদণ্ডটি সচরাচর ফাইবারগ্লাস অথবা কার্বন ফাইবার-জাতীয় উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে। যিনি দণ্ডলম্ফ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন, তাকে দণ্ডলম্ফবিদ বা ইংরেজিতে "পোল ভল্টার" বলে।

প্রকৃতপক্ষে প্রায়োগিকভাবে কোন বস্তু বা বিষয় হিসেবে পরিখা, প্রাচীর, ছোট নদী ইত্যাদি অতিক্রমের জন্য এ ধারাটির প্রবর্তন করা হয় যা ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে প্রতিযোগিতামূলক ক্রীড়ায় রূপান্তরিত হয়। কোন দণ্ডের সাহায্যে লাফানোর এ প্রতিযোগিতাটি প্রাচীন গ্রিক, ক্রিটীয় এবং সেল্টীয় জাতিদের জানা ছিল।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেন প্রজাতন্ত্রের সের্গেই বুবকা-র ৬.১৪ মিটার উচ্চতা ভঙ্গ করে ফ্রান্সের র‍্যনো লাভিলনি ৬.১৬ মিটার উচ্চতা নিয়ে পুরুষদের এবং রাশিয়ার ইয়েলেনা ইসিনবায়েভা ৫.০৬ মিটার অতিক্রান্ত করে মহিলাদের বর্তমান বিশ্বরেকর্ডটি গড়েছেন।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

জলাভূমিবিশিষ্ট এলাকা হিসেবে উত্তর সাগর বরাবর নেদারল্যান্ডসের ফ্রিজল্যান্ড, কেমব্রিজশায়ার, হাটিংডনশায়ার, লিঙ্কনশায়ার এবং নরফোকের জলাময় এলাকার প্রাকৃতিক বাধা অতিক্রমের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো। কৃত্রিমভাবে তৈরি এসব জলাভূমি উন্মুক্ত নালা কিংবা খালের মাধ্যমে একে-অপরের সাথে নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। এগুলো পারাপারের উদ্দেশ্যে কোনরূপ না ভিজেই যাতে পারাপার হওয়া যায়, সেঁতুর বিকল্প হিসেবে প্রত্যেক বাড়ীতেই লাফানোর উপযোগী দণ্ড মজুত রাখা হতো। এ দণ্ড খালের উপর দিয়ে লাফানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো।

দূরত্বের উদ্দেশ্যে পোল ভল্ট প্রতিযোগিতা অদ্যাবধি উত্তর সাগরের নিম্নাঞ্চলে বার্ষিকাকারে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ ধরনের দূরত্বজনিত প্রতিযোগিতা বা ফার্লজিপেন উচ্চতা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয় না।[২] ১৮৪৩ সালে ফারনেসের (বর্তমান - কাম্বিয়া) আলভারস্টন ফুটবল ও ক্রিকেট ক্লাব মাঠে উচ্চতা আকারে পোল ভল্ট প্রথমদিককার প্রতিযোগিতারূপে গণ্য হয়েছে।[৩] পোল ভল্টের আধুনিক প্রতিযোগিতাটি ১৮৫০ সালের মধ্যে জার্মানিতে আরম্ভ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। সেখানে টার্নার জিমন্যাস্টিক ক্লাবের যোহন ক্রিস্টোফ ফ্রেইডরিখ গাটসমাথসফ্রেইডরিখ এল. জন অতিরিক্ত ক্রীড়া হিসেবে যুক্ত করেন। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিক পোল ভল্টের কৌশলের উন্নয়ন ঘটানো হয়।

সচরাচর, পোল ভল্টের রুক্ষ দণ্ডটি বাঁশ অথবা অ্যালুমিনিয়ামজাতীয় উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়। ১৯৫০-এর দশকের শুরুতে ফাইবারগ্লাস অথবা কার্বন ফাইবারজাতীয় উপকরণ দিয়ে গড়া নমনীয় দণ্ড সহযোগে প্রতিযোগিতায় ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের দণ্ড ভল্টারকে অধিক উচ্চতায় উঠার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।[৪]

বিবরণ[সম্পাদনা]

পোল ভল্টের জীবন্ত কিংবদন্তি সার্গেই বুবকা

উচ্চ লম্ফের অধিকারী ক্রীড়াবিদদের ন্যায় পোল-ভল্টারগণ ক্রসবার অতিক্রমের চেষ্টা চালান। পোল ভল্টের বারটি অনেক উঁচুতে, যাতে নমনীয় দণ্ডের প্রয়োজন পড়ে। দণ্ডটি যে কোন দৈর্ঘ্য কিংবা উচ্চতার হতে পারে। সাধারণতঃ দণ্ডটি ৪ থেকে ৫ মিটার (১২ থেকে ১৬ ফুট) লম্বা। এর উপর ভর দিয়ে, শারীরিক ভারসাম্য বজায় রেখে শূন্যে দেহ ভাসিয়ে বার অতিক্রম করতে হয়। দণ্ডটি যে কোনরূপ পদার্থের হতে পারে। পূর্বে অনেক ভারী কাঠ দিয়ে প্রতিযোগিতায় ব্যবহার করা হলেও এর পরিবর্তে ১৯০৪ সাল থেকে দণ্ডটি বাঁশের হয়। ধাতব পদার্থ দিয়ে গড়া ফাইবারগ্লাস অথবা কার্বন ফাইবারজাতীয় উপাদান দিয়ে ব্যবহৃত দণ্ড ছিল ১৯৬০-এর দশকে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

স্বল্পদূরত্বের দৌড়ে পোল ভল্টার লম্ফদণ্ডটি ক্রসবারের সামনে মাটিতে ভর দিয়ে ক্রসবার অতিক্রম করে মাটিতে শোয়ানো অবস্থায় একটি বাক্স আকারের নরম প্যাড ক্রসবারের নিচে থাকে যা ভল্ট বক্স নামে পরিচিত। ভল্টার দণ্ডটি ছেড়ে ক্রসবার অতিক্রম করে শূন্য থেকে ভূমিতে অবতরণের জন্য তাতে লাফিয়ে পড়ে। অবতরণের এ স্থানটি কমপক্ষে ৫ বর্গমিটারের হয়ে থাকে। এজন্যে ভল্টারকে তার পদযুগল প্রথমে ক্রসবারকে অতিক্রান্ত করে।

প্রত্যেক উচ্চতা অতিক্রমের জন্য একজন প্রতিযোগীকে তিনবার চেষ্টা চালাতে হয়। প্রত্যেকবারই তা ৮ থেকে ১৫ সে.মি. (৩ থেকে ৬ ইঞ্চি) করে বারটি উঁচু করা হয়। প্রদেয় উচ্চতা অতিক্রমে যদি ভল্টার তিনবার ব্যর্থ হয়, তাহলে ভল্টারকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। যখন ক্রীড়াবিদ দুই খুঁটির উপর আলতোভাবে লাগানো বার অতিক্রম করার সময় তা ফেলে দেয় অথবা পার্শ্ব দিয়ে অথবা বারের নীচ দিয়ে যায়, তখন এ প্রচেষ্টাটি ব্যর্থ হয়েছে বলে গণ্য করা হয়।

একজন ক্রীড়াবিদকে উচ্চমাত্রায় সময়, গতি, ক্ষীপ্রতা ইত্যাদি সমন্বয় সাধন করে জিমন্যাস্টের ন্যায় সক্ষমতা দেখাতে হয়। আধুনিককালে ভল্টারকে ৪০ মিটার (১৩২.২ ফুট) দণ্ড বহন করে খুবই দ্রুতবেগে দৌড়ে বাদধা পেরিয়ে সফলকাম হতে হয়।

অলিম্পিক ক্রীড়া[সম্পাদনা]

২০১২ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের পোল ভল্টের স্বর্ণপদক বিজয়ী র‍্যনো লাভিলনি

১৮৯৬ সালে প্রচলিত আধুনিক গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে পূর্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিষয়রূপে এটি গণ্য করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বব রিচার্ডস প্রথম পোল-ভল্টার, যিনি ১৯৫২১৯৫৬ সালের প্রতিযোগিতায় দু’টি অলিম্পিক স্বর্ণপদক জয়ে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেনের সার্গেই বুবকা পোল ভল্টের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৯৮৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জয় করেন তিনি। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি ২০ ফুট বা ৬.১ মিটার উচ্চতা অতিক্রম করেন ১৯৯১ সালে। ৩১ অক্টোবর, ১৯৯৪ তারিখে বুবকা ৬.১৪ মিটার উচ্চতা অতিক্রমের মাধ্যমে পোল ভল্টে বিশ্বরেকর্ড গড়েন। তিনি তাঁর গড়া বিশ্বরেকর্ড ভঙ্গ করেন ত্রিশবারেরও অধিক।

বার্লিনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ইসিনবায়েভা

১৯৯০-এর দশকে নারীদের মাঝেও পোল ভল্ট ক্রমশঃ জনপ্রিয় হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে ২০০০ সাল থেকে এ প্রতিযোগিতাটি প্রমিলা ক্রীড়াবিদদের জন্য প্রচলন ঘটানো হয়। প্রমিলাদের পোল ভল্ট ক্রীড়ায় বর্তমান বিশ্বরেকর্ডের অধিকারিনী হচ্ছেন রাশিয়া’র ইয়েলেনা ইসিনবায়েভা। তিনি পোল ভল্টে অসামান্য ক্রীড়ানৈপুণ্যের দরুন বৈশ্বিক ক্রীড়াপরিমণ্ডলে সর্বকালের সেরা প্রমিলা পোল-ভল্টার হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে আছেন।[৫][৬] ২০০৫ সালে বিশ্বের প্রথম মহিলা হিসেবে পাঁচ মিটারের বাধা অতিক্রম করেন তিনি। ৫.০১ মিটারের উচ্চতা নিয়ে তার গড়া বিশ্বরেকর্ডটি মাত্র এক বছর টিকেছিল।[৭] ২৮ আগস্ট, ২০০৯ তারিখে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অনুষ্ঠিত আউটডোর প্রতিযোগিতায় ৫.০৬ মিটার অতিক্রান্ত করে বর্তমান বিশ্বরেকর্ডটি গড়েন।[৮] এ পর্যন্ত আটাশবার প্রমিলাদের পোল ভল্টে বিশ্বরেকর্ড ভঙ্গ করেছেন।[৯]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. The Vault - pole vault video mix
  2. "Info"। Polsstokverspringen/ Fierljeppen Holland। ৫ সেপ্টেম্বর ২০১২। ২ অক্টোবর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ 
  3. Turnbull, Simon (2009-06-13). Kate Dennison: 'It helps being a little bit crazy'. The Independent. Retrieved on 2009-06-15.
  4. http://news.google.com/newspapers?nid=1356&dat=19620207&id=CWxPAAAAIBAJ&sjid=MwUEAAAAIBAJ&pg=4887,840268
  5. "Pole-Vaulter Keeps a Low Profile During Her Ambitious Ascent"The New York Times। ২ ফেব্রুয়ারি ২০০৭। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুন ২০১১ 
  6. "Athletics: Pole-vault diva toys with foes and fans"The New York Times। ২৯ আগস্ট ২০০৭। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুন ২০১১ 
  7. "New world record for Isinbayeva"Eurosport। Yahoo! Sports। ২৩ জানুয়ারি ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জানুয়ারি ২০১২ 
  8. ""World Records Ratified". Retrieved November 9, 2009."। অক্টোবর ২৩, ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১৬, ২০১৩ 
  9. ""Pole Vault Results". USATF. 2 March 2013. Retrieved 3 March 2013."। ২৩ জুলাই ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০১৩ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]