অল্লোপনিষদ্

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

অল্লোপনিষদ্‌ বা আল্লাহ্‌ উপনিষদ্‌ হচ্ছে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে ১৬ থেকে ১৭ শতকে ভারতে মুসলিম শাসনের সময় লেখা একটি অনিশ্চিত উৎসের বই।[১][২][৩] মাত্র ১০টি শ্লোক নিয়ে এই বইটি রচিত হয়েছে। আরবি শব্দ ‘আল্লাহ’ এবং সংস্কৃত শব্দ ‘উপনিষদ’-এর অনুকরণে এর নামকরণ করা হয়েছে। উপনিষদ্‌ হচ্ছে বৈদিক ধর্মশাস্ত্রের একটি শ্রেণিবিভাগ, যেখানে প্রসিদ্ধ উপনিষদের সংখ্যা ১২টি ধরা হয়।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর রচিত বই সত্যার্থ প্রকাশে যুক্তি দেখানো হয়েছে অল্লোপনিষদ ‘উপনিষদ’ শাস্ত্রের কোনো অংশ নয়, এমনকি অথর্ববেদের সাথেও যুক্ত নয়।[৪] বিখ্যাত মুক্তিকা উপনিষদ, যেখানে রাম হনুমানকে ১০৮টি প্রামাণিক উপনিষদের কথা বলেছিলেন, সেখানেও অল্লোপনিষদের উল্লেখ নেই। বেশিরভাগ পণ্ডিতদের মতে বইটি মুঘল যুগে (সম্ভবত আকবরের রাজত্বকালে) লেখা হয়েছে। এই উপনিষদে আকবরকে আল্লাহর রসুল (অল্লোরসূল মহামদরকবরস্য = অল্লো+রসুল মহামদ+আকবর+অস্য) বলা হয়েছে।[৫]

রচয়িতা ও প্রামাণ্যতা সম্পর্কে মতামত[সম্পাদনা]

ধর্মতত্ত্ববিদ আর. অনন্তকৃষ্ণ শাস্ত্রী লিখেছেন, ভারতে মুসলমানদের শাসনামলে "আর্য পণ্ডিতরা শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে" এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। তিনি আরও বলেছেন যে, এই গ্রন্থটি "সাধারণ উপনিষদ্‌গুলির রচনাভঙ্গি অনুসরণ করে লেখা হয়নি" এবং এই গ্রন্থে ব্যবহৃত শব্দগুলি "শুনতে অনেকটা আরবির মতো।"[৬] ভট্টাচার্য ও সরকার অল্লোপনিষদ্‌কে "ইসলামি রচনা" হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে, আকবরের কোনো হিন্দু সভাসদ এটিকে "অথর্ববেদের একটি অপ্রামাণিক অধ্যায়" হিসেবে রচনা করেন। চার্লস এলিয়টের মতে, এই গ্রন্থটি সম্ভবত দীন-ই-ইলাহি ধর্মীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং "এবং একটি অণুকরণ মাত্র।" স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছেন যে, অল্লোপনিষদ্‌ যে অনেক পরবর্তীকালের রচনা তার প্রমাণ রয়েছে। তিনি শুনেছিলেন আকবরের রাজত্বকালে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে এই উপনিষদ্‌টি রচিত হয়েছিল।[৭] সদাশিবন লিখেছেন, আকবর যখন নতুন ধর্ম নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন, তখন ব্রাহ্মণেরা তার জন্য এই গ্রন্থটি রচনা করেন।[৮] দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আকবরের রাজত্বকালে হিন্দুদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থটি রচিত হয়।[৯] বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন যে, অল্লোপনিষদ্‌ ছিল "ভারতের মুসলমান শাসকদের কিছু তোষামোদকারীর নির্লজ্জ রচনা।"[১০] আব্রাহাম ইর‍্যালি লিখেছেন যে, মুঘল যুগে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কিছু আন্তঃসাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের উদ্যোগ। এর উদ্দেশ্য ছিল দুটি সম্প্রদায়কে কাছাকাছি আনা।[১১]

বেদাচার্য বেদবিশারদ দূর্গাদাস লাহিড়ীর পৃথিবীর ইতিহাস প্রথম খণ্ড ৬৬ পৃষ্ঠায় বলেছেন,

পরবর্ত্তীকালে উপনিষৎ-সম্বন্ধে অনেক ব্যভিচার ঘটিয়াছিল; এমন কি, তখন যে কোনও ব্যক্তি আপন মত-প্রতিষ্ঠার জন্য উপনিষদ নামে গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। অল্লোপনিষৎ প্রভৃতিই ইহার প্রমাণ। কথিত হয় হিজরি ৯৮৩ সালে (১৫৭৫) খ্রিঃ সম্রাট আকবর বাদায়ুনী নামক জনৈক মুসলমানকে অর্থববেদের অনুবাদ করিতে বলেন। ইসলাম ধর্মের সহিত অথর্ববেদের কতকগুলি ধর্মোপদেশের ঐক্য আছে-শুনিতে পাইয়া বাদশাহ সেই আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন। অনুবাদকালে বাদায়ুনী অথর্ববেদের অর্থ উপলব্ধি করিতে পারেন না। তখন ফৈজি ও ইব্রাহিমের উপর সেই অনুবাদের ভার ন্যস্ত হয়। কিন্তু তাঁহারাই বা কি করিবেন? ইতিমধ্যে ভাবন নামক জনৈক দক্ষিণ-দেশীয় ব্রাহ্মণ,মুসলমান ধর্ম্ম অবলম্বন করেন। তখন তাঁহারই সাহায্যে পারস্য ভাষায় অথর্ব্ববেদের অনুবাদ আরম্ভ হয়। বাদায়ুনী এবং ইব্রাহিমকে শেখ ভাবন যেরুপভাবে বুঝাইয়া দিতেন, তাঁহারা সেই ভাবেই অনুবাদ কার্য্য সম্পন্ন করিয়া যাইতেন। সেই অনুবাদের সময় বেদের এক স্থানে কোরাণের 'লা ইল্লাহ্' বচনের মত কোনও অংশ দেখিতে পাইয়া, শেখ ভাবন তাহার রুপান্তর সংঘটিত করেন। অনেকে, ভাবনের  কৌশল বুঝিতে না পারিয়া, সত্য সত্যই বেদে 'আল্লার' কথা আছে মনে করিয়া,ভ্রমে পতিত হয়; এবং তদনুসারে মুসলমান ধর্ম্ম গ্রহণ করে।অর্থবব্বেদের যে দুইটি মন্ত্রের উপর নির্ভর করিয়া শেখ ভাবন আপনার উদ্দেশ্য-সিদ্ধি করিয়াছিলেন,সে দুইটি মন্ত্র এইঃ "আদলাবুক-মেককং। অলাবুক নিখাতং"। এই হইতে প্রথমে "আদল্লাবুকমেককং। অল্লাং বুকং" ইত্যাদি বাক্যের সৃষ্টি হয়; এবং পরিশেষে 'অল্লোপনিষৎ' রচিত হইয়া থাকে। অল্লোপনিষদের উপসংহারে পরিবর্ত্তনের মাত্রা চরম পন্থা পরিগ্রহ করে। তাহাতে লিখিত হয়, "ইল্লাকবর ইল্লাকবর ইল্লল্লেতি ইল্লাল্লাঃ ইল্লা ইল্লাল্লা অনাদিস্বরুপা অথর্ব্বনী শাখাং হ্রং হ্রীং জনান্ পশূন্ সিদ্ধান্ জলচরান্ অদৃষ্টং কুরু কুরু ফট।"অর্থাৎ আকবর বাদশাহ পর্য্যন্ত উপনিষদে স্থান লাভ করেন।ইহার অধিক শাস্ত্রের দুর্দশা আর কি হইতে পারে?

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Raghavan, V. (১৯৬৬)। New catalogus catalogorum: an alphabetical register of Sanskrit and allied works and authors (ইংরেজি ভাষায়)। University of Madras। পৃষ্ঠা 410। ওসিএলসি 1163653281 
  2. "Allopaniṣad (Work) - Pandit"www.panditproject.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৪ 
  3. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৩ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মে ২০১৬ 
  4. http://www.aryasamajjamnagar.org/chapterfourteen.htm#79
  5. Eliot, Sir Charles (২০০৪)। Hinduism and Buddhism: An Historical Sketch, Volume 1। Philadelphia, USA: Psychology Press। পৃষ্ঠা 270। আইএসবিএন 978-0-7007-0679-2It declares that the Allah of the prophet Muhammad Akbar (i.e., not the Allah of the Koran) is the God of Gods. 
  6. Sastri, R Ananthakrishna (১৮৯৮)। "Allopanishad or Mahomed Upanishad"The Theosophist। Madras, India: Theosophical Publishing House। XIX: 177। সংগ্রহের তারিখ মে ১, ২০১২ 
  7. Vivekananda, Swami (১৯০৮)। Lectures from Columbo to Almora: Issue 16 of Himalayan series। Madras, India: Prabuddha Bharata Press। পৃষ্ঠা 123। সংগ্রহের তারিখ মে ১, ২০১২ 
  8. Sadasivan, S. N. (২০০০)। A Social History Of India (Illustrated সংস্করণ)। New Delhi, India: APH Publishing। পৃষ্ঠা 178। আইএসবিএন 978-81-7648-170-0 
  9. Tagore, Satyendranath; Devi, Indira (২০০৬)। The Autobiography Of Devendranath Tagore (Reprint সংস্করণ)। Whitefish, Montana, USA: Kessinger Publishing। পৃষ্ঠা 74। আইএসবিএন 978-1-4286-1497-0 
  10. Bijlert, Viktor A. van (১৯৯৬)। "Sanskrit and Hindu National Identity in Nineteenth Century Bengal"। Houben, Jan E. M.। Ideology and Status of Sanskrit: Contributions to the History of the Sanskrit Language: Volume 13 of Brill's Indological Library (Illustrated সংস্করণ)। Leiden, The Netherlands: E. J. Brill। পৃষ্ঠা 358আইএসবিএন 978-90-04-10613-0 
  11. Abraham Eraly, The Mughal World: Life in India's Last Golden Age, Penguin Books India 2007