বৈরোচনসম্বোধি সূত্র

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মহাবৈরোচন তন্ত্র থেকে শুভকরসিংহের উপদেশনায় ব্যবহৃত গর্ভধাতু মণ্ডলবৈরোচন এই মণ্ডলের কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।

বৈরোচনসম্বোধি সূত্র (সংস্কৃত: 𑀯𑁃𑀭𑁄𑀘𑀦𑀸𑀪𑀺𑀲𑀁𑀩𑁄𑀥𑀺𑀲𑀽𑀢𑁆𑀭) হল একটি গুরুত্বপূর্ণ বজ্রযান বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ। এটি মহাবৈরোচন তন্ত্র (সংস্কৃত: 𑀫𑀳𑀸𑀯𑁃𑀭𑁄𑀘𑀦𑀢𑀦𑁆; ঐতিহ্যগত চীনা: 大毘盧遮那成佛神變加持經; পিনয়িন: Dà Pílúzhēnà Chéngfó Shénbiàn Jiāchí Jīng; অপর নাম 大日经 Da ri Jing) নামেও পরিচিত। এটি রচিত হয়েছিল ৬৭৪ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে কোনও এক সময়ে।[১] ভারতীয় তান্ত্রিক ধর্মগুরু বুদ্ধগুহ্য (জীবৎকাল আনুমানিক ৭০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ) এই গ্রন্থটিকে চর্যাতন্ত্রের শ্রেণিভুক্ত করেন। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে এখনও এই গ্রন্থটি চর্যা শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়।[১] জাপানে এই গ্রন্থটি মহাবৈরোচন সূত্র নামে পরিচিত। সেখানে এই গ্রন্থ এবং বজ্রশেখর সূত্রকে একযোগে শিনগোন সম্প্রদায়ের দু'টি কেন্দ্রীয় ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ধরা হয়। উল্লেখ্য, এই দুই গ্রন্থই জাপানের তেনদাই সম্প্রদায়েও মান্য।

বৈরোচনসম্বোধি সূত্রের দীর্ঘতর নামটি হল মহাবৈরোচন-অভিসম্বোধি-বিকুর্বিতাধিষ্ঠান-বৈপুল্য-সূত্রেন্দ্র-রাজনাম-ধর্মপর্যায় ("মহাবৈরোচনের সম্বোধি ও তাঁর অলৌকিক ক্ষমতায়ন" নামক ধর্মালোচনা, শ্রেষ্ঠ বিস্তারিত শাস্ত্রসমূহের রাজা)।[১] পরবর্তীকালের ভারতীয় টীকাকার সহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ এই গ্রন্থটিকে তন্ত্র বলে উল্লেখ করলেও, গ্রন্থটিতে এটিকে তন্ত্র বলে অভিহিত করা হয়নি।[১]

রচনা ও ইতিহাস[সম্পাদনা]

তিব্বতি চিত্রকলায় বৈরোচন বুদ্ধ। এই ছবিতে তাঁর শ্বেতবর্ণ, ধর্মচক্রমুদ্রা ও অলংকৃত সিংহাসনে উপবেশনের মতো বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায়।

মহাবৈরোচন তন্ত্রই প্রথম প্রকৃত বৌদ্ধ তন্ত্র তথা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের আদিতম সমন্বিত সারগ্রন্থ। সম্ভবত সপ্তম শতাব্দীতে ভারতের নালন্দায় এটি রচিত হয়েছিল।[২] যে প্রমাণগুলির ভিত্তিতে এটিকে নালন্দায় রচিত গ্রন্থ মনে করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে বুদ্ধগুহ্যশুভকরসিংহ সহ যে বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ এটির প্রচারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁরা সবাই ছিলেন নালন্দার অধিবাসী। এই গ্রন্থে যে গাছপালার উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলিও নালন্দা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার সাধারণ বৈশিষ্ট্য।[৩]

রোলফ গিয়েবেলের মতে, "শুভকরসিংহ (৬৩৭-৭৩৫) ও তাঁর চীনা শিষ্য য়িহিং (৬৮৩-৭২৭) ৭২৪-২৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই গ্রন্থের চীনা অনুবাদটি রচনা করেন। আপাতভাবে মনে করা হয় যে, এই অনুবাদটির ভিত্তি ছিল বেশ তার কয়েক দশক আগে চীনা ভিক্ষু উহিং কর্তৃক চীনে প্রেরিত একটি পুথি। এই উহিং ৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতেরই প্রয়াত হয়েছিলেন।"[৪]

এর পরে এবং ৮১২ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে কোনও এক সময় শীলেন্দ্রবোধিকাওয়া পালৎসেক কর্তৃক এই গ্রন্থটি তিব্বতি ভাষায় অনূদিত হয়।[৫]

মহাবৈরোচন তন্ত্রের মূল সংস্কৃত পাঠটি হারিয়ে গিয়েছে, তবে এটির চীনা ও তিব্বতি অনুবাদগুলি এখনও পাওয়া যায়।[১] চীনা অনুবাদে সিদ্ধম লিপিতে মূল সংস্কৃত মন্ত্রগুলি সংরক্ষিত হয়েছে। উভয় ভাষা থেকেই গ্রন্থটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।

৭৬০ খ্রিস্টাব্দে বুদ্ধগুহ্য রচিত টীকাটি এই গ্রন্থের একটি প্রধান টীকা। এটিও তিব্বতি ভাষায় রক্ষিত হয়েছে। হোজ মূল গ্রন্থটির সঙ্গে এই টীকাটিও ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। বৈরোচনসম্বোধির চারটি মূল সংস্কৃত টীকা পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে দু'টি শুভকরসিংহের (চীনাতেও অনূদিত) এবং দু'টি বুদ্ধগুহ্যের অনুবাদ করা।[১]

কুকাই ৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে মহাবৈরোচন তন্ত্র শিক্ষা করেন এবং ৮০৪ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থ থেকে নির্দেশিকা গ্রহণের জন্য চীন যাত্রা করেন।

বিষয়বস্তু[সম্পাদনা]

মহাবৈরোচন, দ্বাদশ শতাব্দীর চিত্রকলা, হেইয়ান যুগ। নেজু জাদুঘরে সংগৃহীত

মহাবৈরোচন তন্ত্র তিনটি প্রাথমিক মণ্ডল নিয়ে গঠিত। এই তিনটি মণ্ডল মহাবৈরোচনের দেহ, বাক্য ও মনের প্রতীক। এছাড়া এই গ্রন্থে প্রাথমিক ধর্মানুশীলন ও দীক্ষাপদ্ধতিও বর্ণিত। বুদ্ধগুহ্য রচিত পিণ্ডার্থ (তন্ত্রের প্রধান বিষয়গুলির একটি সারসংক্ষেপ) অনুযায়ী, মহাবৈরোচন তন্ত্রের অনুশীলন পদ্ধতির তিনটি স্তর রয়েছে: প্রাথমিক, প্রায়োগিক ও সিদ্ধিমূলক। সেই সঙ্গে এই গ্রন্থে যত্রতত্র মতবাদগত পংক্তি ও সাধনপদ্ধতি সন্নিবিষ্ট হয়েছে, যে মূল মণ্ডলগুলির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

সূত্রটির তিব্বতি পাঠান্তরের হোজ-কৃত অনুবাদের ভিত্তিতে নিম্নলিখিত রূপরেখাটি দেওয়া হল। অধ্যায়ের ভিত্তিতে চীনা পাঠান্তরে কিছু ভিন্নতা দৃষ্ট হয়।

অধ্যায়[সম্পাদনা]

  • প্রথম অধ্যায় - মহাবৈরোচন বুদ্ধের প্রাসাদের (সকল অস্তিত্বের প্রতীক) সময়াতীত প্রেক্ষাপটে মহাবৈরোচন বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্য বজ্রসত্ত্বের মধ্যে একটি কথোপকথনের মাধ্যমে সূত্রটির সূচনা। প্রথম অধ্যায়ে বোধিসত্ত্বদের এক মহাসমাবেশে বৈরোচন বুদ্ধকে ধর্ম উপদেশ দিতে দেখা যায়। এই উপদেশে তিনি আকার ও শূন্যতার মধ্যে সম্পর্কটিতে গুরুত্ব আরোপ করেন।
  • দ্বিতীয়-পঞ্চম অধ্যায় - দেহ রহস্যের মণ্ডল-সংক্রান্ত তিনটি অধ্যায়। এখানে মণ্ডল অঙ্কন ও অভিষেক ক্রিয়ার বিস্তারিত নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। এই মণ্ডলটি গর্ভধাতু মণ্ডল (সংস্কৃত: গর্ভকোষ) নামেও পরিচিত।
  • সপ্তম-নবম অধ্যায় - তিনটি বিবিধ অধ্যায়, যা মূলে গ্রন্থটির শেষে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। চীনা পাঠান্তরে এগুলি গ্রন্থের শেষেই রয়েছে।
  • দশম-দ্বাদশ অধ্যায় - বাক্য রহস্যের মণ্ডল-সংক্রান্ত তিনটি অধ্যায়। এগুলিতে বিভিন্ন মিশ্রণে বর্ণমালার অক্ষরগুলি ব্যবহার করে ধ্যানের উপর একগুচ্ছ টীকা সংযোজিত হয়েছে।
  • দ্বাদশ-ষোড়শ অধ্যায় - মন রহস্যের মণ্ডল-সংক্রান্ত পাঁচটি অধ্যায়।
  • সপ্তদশ অধ্যায় - একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়, যা একসময় পৃথকভাবে প্রচারিত হত।
  • অষ্টাদশ-ঊনবিংশ অধ্যায় - নিজেকে বুদ্ধ হিসেবে দেখতে দেখতে বর্ণমালার বিভিন্ন বর্ণকে শরীরে সংস্থাপন-বিষয়ক ধ্যান সংক্রান্ত আরেকটি অধ্যায়।
  • বিংশ অধ্যায় - বোধিসত্ত্বদের প্রতি উপদেশনা-সংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়।
  • একবংশ-পঞ্চবিংশ অধ্যায় - শতাক্ষরী ধ্যান-সংক্রান্ত চারটি অধ্যায়।
  • ষড়বিংশ-ত্রিংশ অধ্যায় - ছয় প্রকার হোম-বিষয়টি পাঁচটি বিবিধ অধ্যায়।

গুহ্য অনুশাসন[সম্পাদনা]

সূত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ে সময় নামে পরিচিত চারটি অনুশাসনের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলি গুহ্য বৌদ্ধ ধর্মানুশীলনকারদের চারটি মূল অনুশাসন:

  • সদ্ধর্ম পরিত্যাগ করবে না;
  • নিজের বোধিপ্রাপ্ত চিত্ত থেকে সরে যাবে না;
  • বৌদ্ধ শিক্ষা অপরের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার বিষয়ে রক্ষণশীল হবে না;
  • কোনও চেতন সত্ত্বার অনিষ্ট করবে না।

শিনগোন পরম্পরা[সম্পাদনা]

মহাবৈরোচন তন্ত্রে এই গ্রন্থটিকে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক শাক্যমুনি বুদ্ধের পরম্পরাভুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়নি। পরিবর্তে এটিকে সরাসরি মহাবৈরোচনের থেকে উদ্ভূত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। শিনগোন পরম্পরার মতে, এই সূত্রের পরম্পরাটি নিম্নরূপ:

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Silk, Jonathan A. (editor) Brill’s Encyclopedia of Buddhism Volume I: Literature and Languages, p. 382.
  2. Hajime Nakamura, Indian Buddhism: A Survey with Bibliographical Notes, Motilal Banarsidass 1996, p.321
  3. Hodge, Stephen (৯ ডিসেম্বর ২০০৫)। The Maha-Vairocana-Abhisambodhi Tantra: With Buddhaguhya's Commentary (ইংরেজি ভাষায়)। Routledge। পৃষ্ঠা 17। আইএসবিএন 978-1-135-79654-9 
  4. Giebel (2006), p. xiv.
  5. Hodge, Maha-Vairocana-Abhisambodhi Tantra, p. 17.

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

  • Abé, Ryuichi (1999). The Weaving of Mantra: Kukai and the Construction of Esoteric Buddhist Discourse. New York, NY: Columbia University Press, আইএসবিএন ০-২৩১-১১২৮৬-৬.
  • Giebel, Rolf, transl. (2006), The Vairocanābhisaṃbodhi Sutra, Numata Center for Buddhist Translation and Research, Berkeley, আইএসবিএন ৯৭৮-১-৮৮৬৪৩৯-৩২-০.
  • Hodge, Stephen, transl. (2003). The mahā-vairocana-abhisaṃbodhi tantra: with Buddhaguhya’s commentary, London: RoutledgeCurzon, ISBN 978-1138980150.
  • Hodge, Stephen (1994). "Considerations of the dating and geographical origins of the Mahavairocanabhisambodhi-sutra", The Buddhist forum, volume III; ed by T. Skorupski, pp. 57 – 83
  • Snellgrove, David (2002). Indo-Tibetan Buddhism : Indian Buddhists and their Tibetan Successors, Boston: Shambala.
  • Tajima, R. (1936 ; reprint : 1992), Étude sur le Mahāvairocana-sūtra (Dainichikyō), Paris: Adrien-Maisonneuve.
  • Wayman, A and Tajima, R. (1998). The Enlightenment of Vairocana, Delhi: Motilal Banarsidass.
  • Yamamoto, Chikyo. (1990). Mahāvairocana-Sūtra : translated into English from Ta-p’I-lu-che-na ch’eng-fo shen-pien chia-ch’ih ching, the Chinese version of Śubhakarasiṃha and I-hsing (AD 725) New Delhi: International Academy of Indian Culture.
  • Yamasaki, T. (1988). Shingon: Japanese Esoteric Buddhism, Fresno, CA: Shingon Buddhist International Institute.

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]