চাটগাঁইয়া রন্ধনশৈলী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(চাঁটগাঁইয়া রন্ধনশৈলী থেকে পুনর্নির্দেশিত)
ফুচকার জন্য চাটনী
ঐতিহ্যবাহী মেজবানি পরিবেশন
জনপ্রিয় দুরুস কুরা
গরুর মাংসের আখনি

চাটগাঁইয়া রন্ধনশৈলী বলতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের চাটগাঁইয়াদের বিখ্যাত এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার সমূহকে বুঝায়। মেজবানি গোশত, কালাভুনা, শুটকি, মধুভাত, বেলা বিস্কুট, দুরুস, বাকরখানি, লক্ষিশাক, গরুর গোস্ত ভুনা, ফেলন ডাল, বিরিয়ানি, আফলাতুন হালুয়া, তালের পিঠা, নোনা ইলিশ প্রভৃতি চট্টগ্রামের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী খাবারের অন্তর্ভূক্ত।[১][২] পর্তুগিজরা ১৫২৮ সালের দিকে চট্টগ্রামে এসে গোড়াপত্তন করে।[৩] যদিও মুঘল বিজয়ের পরে ১৬৬৬ সালে[৪] চলে যায়।[৫] তবে মোগল ও পর্তুগিজদের খাদ্যাভ্যাসে থাকা রুটি, পাউরুটি, বিস্কুটসহ বেকারি পণ্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।[৬] জনপ্রিয়তার কারণে বেকারি পণ্য বেলা বিস্কুট রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে থাকা প্রবাসী চাটগাঁইয়াদের কাছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস হওয়ায় চাটগাঁইয়া খাবারদাবারে পাহাড়ি এলাকার খাদ্যাভ্যাস যেমন পরিলক্ষিত হয়, তেমনি বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় হওয়ায় সামুদ্রিক খাবারও বেশ জনপ্রিয়।[৭] চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলে হাটহাজারিতে যেখানে লাল মরিচ ও ঝাল কম খাওয়ার প্রবণতা বেশি, সেখানে দক্ষিণাঞ্চলে শুকনো লঙ্কার পাশাপাশি কাঁচা লঙ্কা বেঁটে ঝাল বেশি খাওয়ার প্রচলন দেখা যায়। এমনকি হিন্দু-মুসলমানদের রান্নার পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন। তবে মগ, আরকানী, আরব, পর্তুগীজ, মুঘল এবং ব্রিটিশদের আগমনের সাথে তাদের খাদ্যরুচি ও সংস্কৃতি এখানকার মানুষের মাঝে একাকার হয়ে আছে।[৮] মুসলিমদের পবিত্র মাস রমজানের ইফতারিতে চনা (ছোলা), মুড়ি, পেয়াজু, বেগুনি অন্যতম উপাদান।[৯] সাথে মেজবানি মাংসও ইফতারের মেন্যুতে স্থান করে নিয়েছে।[১০]

ভাত[সম্পাদনা]

বেশিরভাগ বাংলাদেশীরা যেখানে সিদ্ধ ভাত খেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন,[১১][১২][১৩] সেখানে শুধুমাত্র চাটগাঁইয়াসিলেটিরা আতপ চালের ভাত পছন্দ করেন।[১৪][১৫] এটি বাঙালিদের সাথে চাটগাঁইয়াদের অন্যতম পার্থক্য।

আখনী[সম্পাদনা]

চাল, ঘি, গরম মশলা, সবজি এবং মাংস মিশিয়ে প্রস্তুত করা ঐতিহ্যবাহী খাবার,[১৬] আখনী বাংলাদেশের চাটগাঁসিলেট অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় প্রচলিত খাবার।[১৭] জনশ্রুতি রয়েছে যে একজন সাধারণ চাটগাঁইয়া লোক সপ্তাহে অন্তত এক প্লেট আখনী খেয়ে থাকে।[১৮]

মধুভাত[সম্পাদনা]

চাল, নারকেল, দুধ এবং চিনির সমন্বয়ে তৈরি মধুভাত একধরনের শীতকালীন মিষ্টান্ন খাবার যা চট্টগ্রামের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী খাবারের অন্যতম। এটি মূলত করা হয় আগের দিন রাতে ভাত রান্না করে, পরদিন সকালে পরিবেশন করা মধুভাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘক্ষণ ঢেকে রাখার ফলে গাঁজন প্রক্রিয়ার এতে কিছুটা অ্যালকোহল উৎপাদিত হয় বলে মধুভাত খাবার পর ঝিমুনি আসে।[১৯] চাটগাঁইয়া জনগোষ্ঠী ব্যাতীত অপরাপর অঞ্চলের বাঙালিরা এর সাথে তেমন পরিচিত না।

মাংস[সম্পাদনা]

কালাভুনা[সম্পাদনা]

গরুর মাংসের কালোভুনা

কালাভুনা গরু বা খাসির মাংস দিয়ে তৈরী চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী মাংসের তরকারি যা বর্তমানে সমগ্র বাংলাদেশেই বিখ্যাত ও জনপ্রিয়।[২০][২১] সাধারণত ভাত, পরোটা, নান রুটি কিংবা রুটির সাথে কালাভুনা খাওয়া হয়। ফলে মেজবান ছাড়াও বিয়ে, ঈদ বা রমজানে সাহরি বা ইফতারেও কালাভুনা একটি পছন্দের খাবারে পরিণত হয়েছে।

মেজবানি মাংস[সম্পাদনা]

মেজবানি গোস বা মাংস মূলত বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বহুমাত্রিক ঐতিহ্যবাহী একটি ভোজ অনুষ্ঠানের খাবার যা আতপ চালের সাদা ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয়।[২২]

মাছ[সম্পাদনা]

শুঁটকি[সম্পাদনা]

চাটগাঁইয়া সমাজে শুটকী বা হুনি দিয়ে বেগুন রান্নার রেওয়াজ আছে অনেক দিনের। সাধারণত দোহাজারীর শঙ্খ নদীর চরের বেগুন অথবা চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলের কাঁটা বেগুন, ছোট আকারের এক ধরনের বেগুন দিয়ে শুটকী রান্না হয়ে থাকে।[৮] বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় চট্টগ্রামে বিভিন্ন প্রকারের মাছ থেকে শুটকি করা হয়। ফলে শুঁটকি মাছ এখানকার বিখ্যাত খাবার গুলোর মধ্যে অন্যতম। শুধু মাত্র শুঁটকি দিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার তৈরী করা হয়। চট্টগ্রামের ঐতিহ্য হিসেবে শুঁটকির ভর্তা স্থান পেয়েছে বিভিন্ন রেস্তরাঁর আইটেমের মধ্যে।[২৩]

দোমাছা[সম্পাদনা]

দোমাছা মূলত তাজা ও শুঁটকি দুই ধরনের মাছের সমন্বয়ে রান্না করা হয়। জনপ্রিয় এই পদটি ফেনী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে খুব পরিচিত।[২৪] আলু, সিমের বিচি, টমেটো ইত্যাদি দিয়ে এই খাবারটি রান্না করা হয়।[২৫]

বেলা বিস্কুট[সম্পাদনা]

গোলাকার,[২৬] আকারে বড় এবং সাধারণ বিস্কুটের তুলনায় তুলনামূলক শক্ত বেলা বিস্কুট চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এবং উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট, যা সারা বাংলাদেশ জুড়ে জনপ্রিয়।

বাকরখানি[সম্পাদনা]

চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাকরখানি

বাকরখানি ময়দা দিয়ে প্রস্তুত রুটি জাতীয় খাবার বিশেষ, যা মূলত গম, দুধ, লবণ, চিনি, ডালডা, ঘি, পনির এবং খামির দিয়ে তৈরি করা হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাকরখানি রসালো ও সুমিষ্ট হয়ে থাকে।[২৭]


তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. “হাজার বছরের চট্টগ্রাম” (দৈনিক আজাদী কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থ)
  2. "ভোজন রসিকদের জন্য চট্টগ্রামের সেরা পাঁচ খাবার"বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। ২০২০-১২-১২। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-১৮ 
  3. Gupta, Taniya; Navarro-Tejero, Antonia (২০১৪-০১-০৮)। India in Canada: Canada in India (ইংরেজি ভাষায়)। Cambridge Scholars Publishing। আইএসবিএন 978-1-4438-5571-6 
  4. Eaton, Richard M. (১৯৯৬-০৭-৩১)। The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760 (ইংরেজি ভাষায়)। University of California Press। আইএসবিএন 978-0-520-20507-9 
  5. Boda, Sharon La (১৯৯৪)। International Dictionary of Historic Places: Asia and Oceania (ইংরেজি ভাষায়)। Taylor & Francis। আইএসবিএন 978-1-884964-04-6 
  6. "ব্রিটিশ আমল থেকে জনপ্রিয় 'বেলা বিস্কুট'"কালের কণ্ঠ। ২০২১-০২-২৮। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-১৮ 
  7. "ভ্রমণে ভোজন"thedailystar.net। ২০১৬-০৮-০১। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-১৮ 
  8. "চাটগাঁইয়া রন্ধন সংস্কৃতি ও রসবোধ"দৈনিক পূর্বদেশ। ১৩ জুলাই ২০২১। সংগ্রহের তারিখ ১ মার্চ ২০২২ 
  9. "ফটিকছড়িতে রোজাদারগণ আকৃষ্ট হচ্ছেন মুখরোচক খাবারের প্রতি"cvoice24.com। ২০১৮-০৬-২১। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-১৮ 
  10. "ইফতারে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য 'মেজবানের মাংস'"সমকাল। ২০১৯-০৫-২৯। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-১৮ 
  11. "আতপ চাল খাওয়ার অভ্যাস কত দিনে হবে?"। বাংলা ট্রিবিউন। ৫ অক্টো ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ২১ এপ্রিল ২০২০ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  12. "ওএমএসে আতপ চাল পেয়ে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা"। banglanews24.com। ২০ সেপ্টে ২০১৭। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ এপ্রিল ২০২০ 
  13. "আতপ চাল, তাই ক্রেতা শূন্য ওএমএসের চালের দোকান"এনটিভি (বাংলাদেশ)। ২০ সেপ্টে ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ২১ এপ্রিল ২০২০ 
  14. "চট্টগ্রামসহ দুই বিভাগের জন্য আতপ চাল কিনছে সরকার"প্রথম আলো। ১৩ ফেব্রু ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ২১ এপ্রিল ২০২০ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  15. "বঙ্গে নতুন উপদ্রপ- আতপ চালের 'নক্তা'"bdnews24.com। ১৯ সেপ্টে ২০১৭। ১৭ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ এপ্রিল ২০২০ 
  16. "সিলেটের ঐতিহ্য আখনি ও পাতলা খিচুড়ি"বাংলাদেশ প্রতিদিন অনলাইন। ১২ জুন ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১৭ 
  17. "ইফতারে সিলেটি আখনী পোলাও"বিডিমর্নিং.কম অনলাইন। ১২ জুলাই ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১৭ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  18. "আখনি বিরিয়ানী একটু সময় সাপেক্ষ!"বাংলা ট্রিবিউন। ২৮ ফেব্রু ২০১৬। ১০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ 
  19. "যেভাবে তৈরি করবেন চট্টগ্রামের প্রিয় খাবার মধুভাত রেসিপি"একুশে টেলিভিশন। ২০২০-১০-০৪। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-১৮ 
  20. "আঞ্চলিক খাবারের স্বাদে..."বাংলা ট্রিবিউন। ২০২০-০২-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০২-১৫ 
  21. "Bangladesh cuisine part I - delectable and diverse"দ্য ডেইলি স্টার। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০২-১৫ 
  22. "A mouthful of Chittagong"thedailystar.net। ২০১৫-১০-১৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-১৮ 
  23. "চট্টগ্রামে বৈশাখে মাতছে রেস্তরাঁ"dailyjanakantha। ২০১৮-০৪-১৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-১৮ 
  24. "দোমাছা"prothomalo। ২০২০-১১-১৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-১৮ 
  25. "চট্টগ্রাম অঞ্চলের রান্না"prothomalo। ২০২০-১০-১২। ২০২২-০২-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-১৮ 
  26. ক্রেইগ, ব্রুস; সে, কলিন টেলর। Street Food around the World: An Encyclopedia of Food and Culture: An Encyclopedia of Food and Culture (সচিত্র, পুনঃমুদ্রণ সংস্করণ)। পৃষ্ঠা ৪৪। আইএসবিএন 9781598849554। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জুলাই ২০১৯ 
  27. naminghistorybd.com[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]