পল্লবীতে সন্তানের সামনে প্রকাশ্যে পিতাকে হত্যা মামলা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

পল্লবীতে সন্তানের সামনে প্রকাশ্যে পিতাকে হত্যা মামলা ২০২১ সালের মে মাসে ঢাকা পল্লবী থানায় দায়ের করা হয়। ২০২১ সালের ১৬ মে অপরাহ্নে পল্লবীর ডি-ব্লকের ৩১ নম্বর রোডে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সাহিনুদ্দিন নামক জনৈক ব্যক্তিকে। জমি নিয়ে বিরোধে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। এই হত্যাকাণ্ডের সূত্রে লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, তরীকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব ও হ্যাভিলি প্রপার্টিজের স্বত্বাধিকারী এম. এ. আউয়ালসহ ১০জন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া গ্রেপ্তারের উদ্যোগে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে হত্যাকারী মানিক সহ দুজন ব্যক্তি নিহত হয়।

ডিবি পুলিশের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) সৈয়দ ইফতেখার হোসেনকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়েছে। মামলাটি পুলিশ তদন্ত করলেও র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ছায়াতদন্ত করছে।[১][২]

পটভূমি ও ঘটনা[সম্পাদনা]

পল্লবীতে ‘সুমন বাহিনী’ নামে একটি সমাজবিরোধী সন্ত্রাসী রয়েছে। মাদক ব্যবসা ও জুয়া খেলাসহ নানা অপকর্মে জড়িত ‘সুমন বাহিনী’। এসবের প্রতিবাদ করলে বা তাদের কথামতো কাজ না-করলেই কুপিয়ে মানুষকে রক্তাক্ত করে তারা। এর নেতা সুমন ব্যাপারী ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক। সে এলকারা চিহ্নিত সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। সুমন ব্যাপারী ছাড়া বাহিনীর অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছে আপন আহমেদ ওরফে আপন, সিফাত, রনি, জামান আহমেদ জামাল, লিজা, রাজন, সাগর, দুলাল, টিটু, দীপু, কাল্লু, লিটন, আবুল, বাবু ওরফে ইয়াবা বাবু, রুবেল, জাকির, তাহের, হাবিব প্রমুখ।[৩]

সাহিনুদ্দিন ও সুমন দুজনই এম এ আউয়ালের হ্যাভেলি প্রপার্টিজের পক্ষে কাজ করতো। পল্লবীর আলীনগর বুড়িরটেকে আউয়ালের একটি আবাসন প্রজেক্ট রয়েছে। সেখানে সাহিনুদ্দিনদের জমি আছে। ওই জমি এম এ আউয়াল দখল করতে চেয়েছিলেন। সাহিনুদ্দিন অসম্মত হওয়ায় তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্বের জেরেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ১১ মে ২০২১ নিহত সাহিনুদ্দিনের মাতা আকলিমা পল্লবী থানায় ‘সুমন বাহিনী’র সুমন ব্যাপারী সহ ছয়জনকে আসামি করে থানায় ‘জেনারেল ডায়েরী’ করেন। এদের একজন হ্যাভেলি প্রপার্টিজের স্বত্বাধিকারী ও সাবেক এমপি এমএ আউয়াল। জিডিতে আকলিমা আশঙ্কা করেন, যে কোনো সময় তার ছেলে সাহিনুদ্দিনকে হত্যা করা হতে পারে। এই আশঙ্কার পাঁচদিনের মাথায় তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।[৪][৫]

হত্যাকাণ্ড[সম্পাদনা]

ঘটনার ৪/৫ দিন আগে এম. এ. আউয়ালের কলাবাগানের অফিসে সাইনুদ্দিনকে হত্যা মূল পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা করে বাবু ও হাসান। ২০২১ সালের ১৬ মে তারিখে বিকেল ৪টায় সুমন ও টিটু নামে দুই যুবক সাহিনুদ্দিনকে জমির বিরোধ মেটানোর কথা বলে ফোন করে ডেকে নিয়ে যায়। সাহিনুদ্দিন পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের সিরামিক রোডের বাসিন্দা ছিলেন। দুই পক্ষের সমস্যা সমাধানের কথা বলে সাহিনুদ্দিনকে বাসা থেকে ডেকে আনে আসামী মুরাদ। এ সময় সাহিনুদ্দিনের মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয়। মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিল মুরাদ। মাঝখানে বসা ছিল সাহিনুদ্দিনের ছেলে মাশরাফি (বয়স ৭ বৎসর) আর পেছনে বসা ছিলেন সাহিনুদ্দিন। মোটরসাইকেল চালিয়ে মুরাদ পল্লবী ‘ডি’ ব্লকের ২৩ নম্বর রোডের সিরামিক গলির উলটা পাশে এসে থামে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল সুমন ব্যাপারী ও মনিরসহ সন্ত্রাসীরা। সাত বছরের ছেলের মাশরাফির চোখের সামনেই হিন্দি চলচ্চিত্রের নাটকীয় কায়দায় মোটরসাইকেল থেকে টেনেহিঁচড়ে সাহিনুদ্দিনকে নামিয়ে আনে সুমন ব্যাপারী। পরে মনির ও মানিক তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। এতে সাহিনুদ্দিনের মৃত্যু হয়। পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের ৩১ নম্বর রোডের ৩৬ নম্বর বাড়ির সম্মুখে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। ঘটনাস্থলের পাশেই একটি বাড়িতে সাহিনুদ্দিনের মা বসবাস করেন। পিতাকে কোপানো শুরু করলে বালক ছেলে মাশরাফি দৌড়ে ওই বাসায় গিয়ে তার দাদি আকলিমাকে বলে, “সুমন গুন্ডা আমার বাবাকে কোপাচ্ছে।” পরে স্বজনরা এসে সাহিনুদ্দিনের বীভৎস লাশ দেখতে পান। সাহিনুদ্দিনকে হত্যার পরই আউয়ালকে ফোনে হত্যার বিষয়টি সুমন নিশ্চিত করে। তাদের মধ্যে কথা হয় ৩০ সেকেন্ড।[৪][৬]

হত্যাকাণ্ডের ভিডিও[সম্পাদনা]

প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে সাহিনুদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করার একটি ভিডিও সামাজিক-যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, সুমন বাহিনীর সদস্য মনির ও মানিক রামদা দিয়ে সাহিনুদ্দিনকে একের পর এক কুপিয়ে যাচ্ছে। আশপাশ থেকে ভেসে আসছে চিৎকার-কান্না। মাটিতে লুটিয়ে ছটফট করতে করতে বাঁচার আকূতি জানান সাহিনুদ্দিন। সাহিনের হাত-পা, গলা, মুখ, পেট, ঊরু, মাথা, হাঁটুসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলাপাতাড়ি কোপানো হয়। কিছুক্ষণ কুপিয়ে মানিক চলে গেলেও মনির কুপিয়ে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে গলায় কুপিয়ে কুপিয়ে শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করার পর স্থান ত্যাগ করে মনির।[৫]

আসামী গ্রেপ্তার[সম্পাদনা]

এ মামার এজাহারভুক্ত আসামী হলো: সাবেক এমপি আউয়াল, আবু তাহের, মো. সুমন, মো. মুরাদ, মো. মানিক, মো. মনির, মো. শফিক, মো. টিটু, আব্দুর রাজ্জাক, মো. শফিক, কামরুল, কিবরিয়া, মো. দিপু, মরন আলী, লিটন, আবুল, সুমন ওরফে নাটা সুমন, কালু ওরফে কালা বাবু, কালু ওরফে কালা বাবু, বাবু ওরফে বাইট্টা বাবু এবং বাবু ওরফে ইয়াবা বাবু।

১৯ মে ২০২১ তারিখ থেকে মামলার তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা পুলিশের মিরপুর স্থানীয় দল। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় যাত্রাবাড়ী থানার রায়েরবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বদানকারী সুমন ব্যাপারীকে গ্রেফতার করা হয়। সুমন ব্যাপারীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পল্লবী থানার স্কুল ক্যাম্প কালাপানি এলাকা থেকে আরেকজন অভিযুক্ত রকিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। ১৬ই মে মুরাদ ও ১৮ই মে টিটু নামের দুজনকে গ্রেফতার করে দুইদিনের রিমান্ডে নেয় পল্লবী থানা পুলিশ। রিমান্ড শেষে আজ তাদের আদালতে হাজির করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, জমিজমা দখলকে ঘিরে পল্লবীতে একাধিক গ্রুপ গড়ে উঠেছে। সাবেক এমপি এমএ আওয়াল এবং সাবেক মেজর মোস্তাফা কামাল বড় দুটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন। ২২শে মে শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার অদূরে কাঁচপুরে অভিযান চালিয়ে শরীফকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২১শে মে শুক্রবার ভোরবেলায় হত্যাকারীদের একজন মানিক মিরপুর রুপনগরের ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। সে এই মামলার ৫ নম্বর আসামি২১ মে আরেক আসামি ইকবাল নুরকে শরীয়তপুর জেলার সখিপুর থেকে র‍্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা গ্রেপ্তার করে। ২২ মে নারায়ণগঞ্জ জেলার কাঁচপুর এলাকা থেকে শরিফকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা। চাঁদপুর থেকে হাসান ও পটুয়াখালী থেকে জহিরুল ইসলাম বাবুকে গ্রেপ্তার করে। [৭][৮]

বিচার প্রক্রিয়া[সম্পাদনা]

হত্যাকাণ্ডের পর দিন ২০২১ সালের ১৭ মে নিহত ব্যক্তির মা আকলিমা ২০ জনের নাম ও অজ্ঞাত আরও ১৪/১৫ জনের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মামলা করেন। লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম. এ. আউয়ালকেও আসামী করা হয়। আসামীদের গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া চলমান। বিচার প্রক্রিয়া অংশত শুরু হয়েছে। তবে পুলিশ এখনও অভিযোগ পত্র দায়ের করে নি।

দোষ স্বীকার[সম্পাদনা]

এ হত্যার মামলায় নিজের দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে অভিযুক্ত আসামী ছাত্রলীগ নেতা সুমন ব্যাপারী। ২৪ মে ২০২১ সোমাবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) সৈয়দ ইফতেখার হোসেন সুমনকে আদালতে হাজির করেন। সুমন স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় তা রেকর্ড করার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবদাস চন্দ্র অধিকারী সুমনের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

আদালতের রায়[সম্পাদনা]

মামলাটি ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিমের আদারতে বিচারাধীন। বিচার শেষ হলে রায় পাওয়া যাবে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]