বেগম লুৎফুন্নেসা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
লুৎফুন্নেসা বেগম
খোশবাগে লুৎফুন্নেসা বেগমের সমাধি
বঙ্গ, বিহার এবং উড়িষার রানী
কার্যকাল৯ এপ্রিল ১৭৫৬ - ২৩ জুন ১৭৫৭
জন্মরাজকুনোয়ারি
১৭৪০
মৃত্যু১০ নভেম্বর ১৭৯০(1790-11-10) (বয়স ৪৯–৫০)
মুর্শিদাবাদ , ভারত
সমাধি
দাম্পত্য সঙ্গীসিরাজউদ্দৌলা
বংশধরকুদসিয়া বেগম সাইবা (উম্মে জোহরা)

লুৎফুন্নেসা বেগম (লুৎফা, রাজকুনোয়ারি) (১৭৪০ - ১৭৯০) বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার তৃতীয় প্রিয়তম স্ত্রী এবং প্রাথমিক সঙ্গী।[১] প্রথমত তিনি ছিলেন সিরাজের নানীজান শরীফুন্নেছা বেগমের হিন্দু পরিচারিকা[২] এবং তখন তাঁকে রাজকুনোয়ারি বলে ডাকা হতো। সিরাজের সাথে বিবাহের পর তিনি ধর্মান্তরিত হন এবং সিরাজ তার নাম রাখেন লুৎফুন্নেসা বেগম।[৩]

জীবনের প্রথমার্ধ[সম্পাদনা]

জন্মসূত্রে লুৎফুন্নেসা ছিলো একজন হিন্দু নারী, যার নাম ছিল রাজকুনোয়ারি। প্রথমত সে সিরাজ উদ-দৌলার নানীজান বেগম শরীফুন্নেছার পরিচারিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।[৪] তখন সিরাজ তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যান এবং তার নানীর কাছ থেকে তাকে নিজের হেফাজতে নেবার জন্য নানীজানের নিকট প্রস্তাব পাঠান । সিরাজের নানীজান বেগম শরীফুন্নেসা সিরাজের প্রস্তাব মেনে নেন এবং তাকে তার হেফাজতে পাঠিয়ে দেন। ধীরে ধীরে সিরাজ এবং লুফুন্নেছার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে এবং তারা একে অপরের প্রেমে পড়ে যান। অতঃপর তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়, এবং সিরাজ তার নতুন নাম রাখেন লুৎফুন্নিসা বেগম (সংক্ষেপে লুৎফা) । যদিও তখনো তার বেগম জায়েবুন্নেছা এবং উমদাতুন্নেছা বেগম নামের আরো দুটি স্ত্রী ছিলো, কিন্তু লুৎফাই ছিলো তার সবচাইতে প্রিয়তম স্ত্রী।[৩][৫]

বিয়ের পরের জীবন[সম্পাদনা]

১৭৪৮ সালে, সিরাজের বাবা জৈনুদ্দিন আহমেদ খান মুস্তাফা খানের নেতৃত্বে আফগান বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন । সে সময় সিরাজের নানাজান নবাব আলীবর্দী খান সিরাজকে তাঁর পিতার বিহারের নায়েব নাজিমের প্রাক্তন পদে স্থলাভিষিক্ত করেন। যদিও তিনি সিরাজকে মুর্শিদাবাদে তাঁর সাথেই রাখার মনস্থ করেন। এই সময় লুফুন্নেসা বেগম তার প্রধান সহধর্মিণী হন এবং সিরাজের প্রথম সন্তান উম্মে জোহরা বেগমের জন্ম দেন। পলাশী বিপর্যয়ের পর সিরাজ স্ত্রী লুৎফুন্নেসা, তাঁদের একমাত্র কন্যা জোহরা এবং একজন অনুগত খোজাসহ ১৭৫৭ সালের ২৪ জুন রাতে নিভৃতে শহর ত্যাগ করেন। কিন্তু অচিরেই তিনি ধরা পড়েন এবং সপরিবারে তাঁকে মুর্শিদাবাদ ফিরিয়ে আনা হয় এবং মীর জাফরের আদেশে সিরাজকে হত্যা করা হয়।[৬]

লুৎফুন্নেসাকে তাঁর কন্যাসহ মুর্শিদাবাদে বন্দি রাখা হয়। ১৭৫৮ সালে তাঁদেরকে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। বুড়িগঙ্গা নদীর নিকট জিনজিরা প্রাসাদে তাঁরা সাত বছর অন্তরীণ থাকেন। ১৭৬৫ সালে লুৎফুন্নেসা মুক্তি পেয়ে মুর্শিদাবাদ ফিরে যান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে তাঁর এবং তাঁর কন্যার জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করা হয়। পরে লুৎফুন্নেসা এ পেনশন নিয়মিতভাবে লাভের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে আবেদন জানান। প্রথমে তাঁর জামাতা এবং পরে ১৭৭৪ সালে তাঁর কন্যার মৃত্যু হলে তাঁদের রেখে যাওয়া চার কন্যার অভিভাবকত্বের দায়িত্ব লুৎফুন্নেসাকেই গ্রহণ করতে হয়।

চারজন এতিম পৌত্রীকে সুযোগ্য করে গড়ে তোলার প্রয়োজনে পেনশনের জন্য অনুরোধ জানিয়ে ১৭৮৭ সালের মার্চ মাসে লুৎফুন্নেসা গভর্নর জেনারেল কর্নওয়ালিস বরাবর আরেকটি আবেদন প্রেরণ করেন। কোম্পানির পক্ষ থেকে ভাতা বৃদ্ধির আবেদন নাকচ করে দিয়ে উল্লেখ করা হয় যে, লুৎফুন্নেসা বেগম প্রয়াত নওয়াবের বংশধরগণের জন্য পাঁচশত টাকা এবং নিজের জন্য একশত টাকা খরচ করতে পারবেন। পাটনায় লুৎফুন্নেসার শ্বশুরের সমাধিস্থল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নওয়াব আলীবর্দী তাঁকে একটি জায়গির অনুমোদন করেছিলেন। কোম্পানি এ ব্যবস্থাপনায় কোনরূপ হস্তক্ষেপ করেনি। এ সম্পত্তির মুতাওয়ালি­ হিসেবে লুৎফুন্নেসা সম্পত্তি থেকে অর্জিত অর্থে সমাধিস্থল দেখাশুনা অব্যাহত রাখেন।

নওয়াব আলীবর্দী এবং সিরাজের সমাধিসৌধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোম্পানি প্রতি মাসে তিনশত পঞ্চাশ টাকার অনুদান অনুমোদন করে। সমাধিস্থলে লুৎফুন্নেসা প্রতিদিন পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াতের ব্যবস্থা সহ বিকালে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সমাধি পরিদর্শন করতেন এবং সেখানে মোমবাতি জ্বেলে দিতেন।[৩]

মৃত্যু[সম্পাদনা]

১৭৯০ সালের নভেম্বর মাসে লুৎফুন্নেসার মৃত্যু হয়। খোশবাগে সিরাজউদ্দৌলার কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।[৩]

সংস্কৃতিতে জনপ্রিয়তা[সম্পাদনা]

  • লুৎফুন্নেসা এবং সিরাজউদদ্দৌলার এই মর্মান্তিক প্রেমগাথা নিয়ে ভারতীয় ঔপন্যাসিক শ্রী পরাবত ১৯৬০ সালে 'আমি সিরাজের বেগম' নামের উপন্যাস রচনা করেন।[৭]
  • ২০১৮ - ১৯ সালে শ্রী পরাবতের উপন্যাস 'আমি সিরাজের বেগম' অবলম্বনে ধারাবাহিক নির্মিত হয় , যেটি ভারতীয় চ্যানেল স্টার জলসায় প্রচারিত হয়। এতে ভারতীয় অভিনেত্রী 'পল্লবী দে' লুৎফুন্নেসা- এর চরিত্রে অভিনয় করেছেন।[৮]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Mahmud, Jamil (২০১২-১০-০৪)। "The women in Siraj ud-Daulah's life"The Daily Star (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-১২ 
  2. Markovits, Claude (২০০৪-০২-০১)। A History of Modern India, 1480-1950 (ইংরেজি ভাষায়)। Anthem Press। আইএসবিএন 978-1-84331-004-4 
  3. শাহরিয়ার জেড.আর ইকবাল (২০১২)। "লুৎফুন্নেসা বেগম"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  4. Markovits, Claude (২০০৪-০২-০১)। A History of Modern India, 1480-1950 (ইংরেজি ভাষায়)। Anthem Press। আইএসবিএন 978-1-84331-004-4 
  5. "নবাবি প্রেমগাথা"SAMAKAL (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-১২ 
  6. "নবাব সিরাজউদ্দৌলার হত্যার পর যেভাবে নির্মমতা নেমে আসে অন্যদের ওপর"BBC News বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-১২ 
  7. "আমি সিরাজের বেগম - শ্রী পারাবত"www.rokomari.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-১২ 
  8. "টিভি পর্দায় সিরাজউদ্দৌলা'র বউ"Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৮-১০-২১। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-১২