বর্গ (সৃষ্টিকর্মের প্রকার)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(সৃষ্টিকর্মের প্রকার থেকে পুনর্নির্দেশিত)

শিল্পকলা, বিনোদন ও যোগাযোগ মাধ্যমের আলোচনায় বর্গ শব্দটি দিয়ে পাঠক-শ্রোতা-দর্শকের উপভোগের জন্য সৃষ্ট বিভিন্ন পাঠ্য, শ্রাব্য বা দৃশ্য সৃষ্টিকর্মের একটি প্রকারভেদ, ধরন বা শ্রেণীকে নির্দেশ করা হয়, যেটির অন্তর্ভুক্ত সৃষ্টিকর্মগুলির বিষয়, আখ্যাবস্তু, রচনাকৌশল, গঠন, শৈলী, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, ইত্যাদি একই প্রকৃতির হয়ে থাকে।[১] উদাহরণস্বরূপ সঙ্গীত মাধ্যমের বিভিন্ন বর্গগুলি হল পপ, রক, মেটাল, ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীত, হিপ-হপ, ধর্মীয়, লোকসঙ্গীত বা পল্লীগীতি, ইত্যাদি। ইংরেজি ভাষায় সৃষ্টিকর্মের বর্গকে জনরা (ইংরেজি Genre) এবং মূল ফরাসিতে জঁর (ফরাসি: Genre) শব্দগুলি দিয়ে নির্দেশ করা হয়। সেখান থেকে বাংলাতেও "জনরা" শব্দটির প্রচলন আছে। অধিকন্তু, বাংলা সাহিত্য ও রচনার আলোচনা-সমালোচনা ক্ষেত্রে সাহিত্যের বর্গগুলিকে সাহিত্য সংরূপ বলে উল্লেখ করা হয়।

সাধারণত একটিমাত্র বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে কোনও বর্গকে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব হয় না; বরং একাধিক পুনরাবৃত্ত বিষয়গত, শৈলীগত, গাঠনিক, যোগাযোগমূলক, নান্দনিক, ক্রিয়ামূলক বা আলংকারিক উপাদানের একটি সমষ্টির ভিত্তিতে একটি বর্গকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। সৃষ্টিকর্মের বর্গগুলি বহুকাল ধরে সৃষ্টিকর্তা বা শিল্পী ও পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে গঠিত রীতিনীতি ও নিয়মকানুনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। সৃষ্টিকর্মের কোনও কোনও বর্গ বিশ্বজনীন হতে পারে, আবার কোনও কোনও বর্গ নির্দিষ্ট দেশ, অঞ্চল, জাতি, সম্প্রদায় বা সংস্কৃতির অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। সৃষ্টিকর্মের কোনও কোনও বর্গ কঠোর নিয়মকানুন ও রীতিনীতি মেনে চলতে পারে, আবার অন্য কোনও কোনও বর্গ সুসংজ্ঞায়িত না-ও হতে পারে। অনেক সময় সৃষ্টিকর্মের বর্গগুলির একাধিক উপবর্গ (সাবজঁর Subgenre) থাকতে পারে। অনেক সময় একই সৃষ্টিকর্ম একাধিক বর্গের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। বর্গ সৃষ্টি হয় সামাজিক রীতিনীতি থেকে যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন সংস্কৃতি বিভিন্ন নতুন নতুন বর্গের উদ্ভাবন ঘটায় এবং পুরনো বর্গগুলি অব্যবহৃত হয়ে যেতে পারে। বর্গের সৃষ্টি হয় কিছু শৈলগত মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে এবং যখন সমাজ এই মানদণ্ডের উপর একমত পোষণ করে।[২] বেশিরভাগ সময় কোনও একটি সৃষ্টিকর্ম একের অধিক বর্গের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে।

পাশ্চাত্যে প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যের শ্রেণীকরণ পদ্ধতি হিসেবে সৃষ্টিকর্মের বর্গীকরণ আরম্ভ হয়। গ্রিক দার্শনিক আরিস্তোতলেস বা অ্যারিস্টটলের কবিতায় এর উল্লেখ দেখা যায়।[৩] অ্যারিস্টটলের মতে গদ্য, পদ্য, অভিনয় এসবের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে যা ঐ বর্গের মানদণ্ডকে সমর্থন করবে। হাস্যরসাত্মক নাটকে ব্যবহৃত ভাষা বিয়োগান্ত নাটকের জন্য মানানসই নয় এবং বিয়োগান্ত নাটকের ব্যবহৃত ভাষা হাস্যরসাত্মক নাটকের জন্য মানানসই নয়। উদাহরণস্বরূপ এমনকি অভিনেতাদেরও আটকিয়ে রাখা হতো অন্য ধরনের কিছু করতে দেয়া হতো না, এটা মনে করা হতো একজন অভিনেতা শুধুমাত্র এক ধরনেরই গল্প সেরা অভিনয় করতে পারে।

সময়ের সাথে সাথে দর্শক আর বিনোদন নির্মাতাদের পরিবর্তন আসে এবং তার ফলশ্রুতিতে বর্গেরও অনেক প্রসার এবং উন্নয়ন ঘটে। বর্তমানে বর্গ ধারণাটি অনেক বিস্তৃত, এরিস্টটলের সেই ধরাবাঁধা নিয়মের ঊর্ধ্বে।[৪] বর্গ সাধারণ জনগণকে বিভিন্ন শিল্প বা বিনোদন কর্মকে সনাক্ত করতে সহয়তা করে এবং একি ধরনের আরও সৃষ্টিকর্ম খুঁজে পেতে সাহায্য করে।

উপবর্গ[সম্পাদনা]

কোনো বর্গেরও নিজস্ব বর্গ বা প্রকারভেদ থাকতে পারে। একে উপবর্গ (সাবজনরা) বলা হয়।[৫][৬] যেমনঃ লোকসঙ্গীত বা পল্লিগীতির উপবর্গ হল ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা ইত্যাদি আবার ধর্মীয়সঙ্গীতের উপবর্গ হল কীর্তন, ভজন, গজল, খ্রিস্টসঙ্গীত ইত্যাদি। আবার একই বর্গ কিন্তু অতি সামান্য ভিন্নতার কারনে সেটিকে উপবর্গ হিসাবে গণ্য করা হয়, যেমনঃ “কল্পকাহিনী” বিনোদন মাধ্যমের একটি বর্গ, কিন্তু এই “কল্পকাহিনী" গল্পটি যদি ভয়ানক এবং কালো হয় তাহলে তাকে “কালোকল্পকাহিনী” বলা হয়, আবার যদি গল্পে জাদুর তলোয়ার এবং জাদুকর থাকে তাহলে সেটাকে “তলোয়ার ও জাদুবিদ্যা” উপবর্গে শ্রেণীভুক্ত করা হয়।

অণুবর্গ[সম্পাদনা]

অণুবর্গ (মাইক্রোজনরা) কোন সংস্কৃতির একটি অত্যন্ত উচ্চবিশেষায়িত সংকীর্ণ শ্রেণিবিন্যাস অর্থাৎ যেসব বর্গ সম্পর্কে খুবই কম লোকজনই জানেন অথবা খুব কম লোকই এই বর্গে অভিজ্ঞ অথবা এটি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনও উপবর্গ। অণুবর্গ পরিভাষাটি একাবিংশ (২১শ) শতাব্দীতে প্রচলন লাভ করে। এটি বিশেষ করে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।[৭] উদাহরণস্বরূপঃ সঙ্গীতের অণুবর্গ হল সিন্থওয়েভ, নাইটকোর, লফি বা লোফাই, হাইপার পপ, মাম্বল বা বিড়বিড় র‍্যাপ ইত্যাদি। উলেক্ষ্য যে অণুবর্গের শিল্পকর্ম অনেকে সময় জনপ্রিয় হলেও বেশিরভাগ লোক একে সনাক্ত করতে পারে না বা এই বর্গ সম্পর্কে অবগত নয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. মিলার, ক্যারোলিন আর. (১৯৮৪-০৫-০১)। "Genre as social action"Quarterly Journal of Speech৭০ (২): ১৫১–১৬৭। আইএসএসএন 0033-5630ডিওআই:10.1080/00335638409383686 
  2. Keywords in writing studies। পিটার ভান্ডেনবার্গ, পলl হেইল্কার। লোগান, ইউতাহ: ইউতাহ স্টেট ইউনিভার্সিটি প্রেস। ২০১৪। পৃষ্ঠা ৮২–৮৭। আইএসবিএন 978-0-87421-974-6ওসিএলসি 903985868 
  3. "The Internet Classics Archive | Poetics by Aristotle"classics.mit.edu। ২০১৪-১২-২৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২১ 
  4. Todorov, Tzvetan; Berrong, Richard M. (১৯৭৬)। "The Origin of Genres"New Literary History8 (1): 159–170। আইএসএসএন 0028-6087ডিওআই:10.2307/468619 
  5. "Definition of subgenre | Dictionary.com"www.dictionary.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২১ 
  6. "subgenre"The Free Dictionary 
  7. "A Recent History of Microgenres"The FADER (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২১