কল্কি পুরাণ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে


শ্রী কল্কি পুরাণ (সংস্কৃত: कल्कि पुराण) হলো সংস্কৃত ভাষায় রচিত একটি ভবিষ্যতবাণী ভিত্তিক ধর্মগ্রন্থ যেখানে বিষ্ণুর দশম ও শেষ অবতার কল্কির জীবনের বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। সৌটি দ্বারা উন্মোচিত এই কাহিনী কলি যুগ এর শেষের দিকে ভিত্তি করে উপস্থাপিত হয়েছে।

বিদ্যমান ধর্মগ্রন্থটি তিনটি অংশে বিভক্ত যেগুলো যথাক্রমে ৭, ৭ ও ২১টি অধ্যায় নিয়ে গঠিত।[১] এটিকে উপপুরাণ বা 'গৌণ পুরাণ' হিসেবে ধরা হলেও এর অনুচ্ছেদগুলো ১৮টি মূখ্য পুরাণ থেকে সংগৃহীত হয়েছে, যেমন বেদব্যাস কর্তৃক বর্ণিত বিষ্ণু পুরাণভাগবত পুরাণ। কল্কি পুরাণের তারিখ নবম শতাব্দী বা এর পরে নির্ধারিত হয়েছে।[২][৩]

গুরুত্ব[সম্পাদনা]

ভবিষ্যতবাণীর বই হিসেবে, কল্কি পুরাণে বিভিন্ন ঘটনার কথা লিখিত রয়েছে যেগুলো ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে বলে হিন্দু ধর্মালম্বীরা বিশ্বাস করে। এই পুস্তকটি বিভিন্ন পুরাণের একই বিষয় সম্পর্কিত অনুচ্ছেদগুলোর সংগ্রহের ফলাফল। কল্কি পুরাণ প্রাথমিকভাবে কলি যুগের সময় জগতে অধর্ম ও পাপ বৃদ্ধি এবং কলি যুগের বিনাশকারী ও সত্য যুগের আরম্ভকারী কল্কির জীবন বর্ণনা করে।

এই ধর্মগ্রন্থটি হিন্দু ধর্মের বৈষ্ণবধর্মের ঐতিহ্যের অংশ যেখানে ব্রহ্ম ও অন্যান্য দেবতারা কলি যুগের অধর্ম থেকে বিষ্ণুর কাছে সুরক্ষার জন্য যায়।[৪] ধর্মীয় উপাসকদের নিকট থেকে নির্যাতনের গল্প শোনার পর শম্ভল গ্রামে বিষ্ণু সুমতি ও বিষ্ণুযশার পরিবারে কল্কি নামে জন্মানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।[৪] তিনি বেদ ও অন্যান্য গ্রন্থ অধ্যায়ন করেন তারপর সিংহল সাম্রাজ্যের রাজকন্যা পদ্মাবতীকে বিবাহ করেন। কল্কি ও তার বাহিনী বিভিন্ন যুদ্ধে লড়াই করে এবং ধর্মকে নিপিড়ন ও ভূমি থেকে বিতাড়িতকারীদের ধ্বংস করে। অধর্ম বিনাশ ও ধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর কল্কি সম্ভলে ফিরে যায়। এরপর কলিযুগের সমাপ্তি হয় এবং সত্যযুগের শুরু হয়। কল্কি পুরাণ মতে এরপর কল্কি স্বর্গে ফিরে যায়।[৪] এরপর শুরু হয় নতুন যুগ। পুরাণে লেখা রয়েছে পরবর্তী যুগটি হবে আধ্যাত্মিকতা ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ের যুগ।[৪]

কল্কির উল্লেখ বৌদ্ধ ধর্মের বইগুলোতেও পাওয়া যায়, যেমন কালচক্র তন্ত্রে[৫][৬] বৌদ্ধদের পুস্তকে উল্লেখ রয়েছে শম্বলের কল্কি নামক এক রাজা ধাম্মার বিরুদ্ধে এক সৈন্যবাহিনী নেতৃত্ব দেবে। তারপর অধর্মের উপর ধর্মের বিজয় অর্জন সহ ধর্মীয় স্বাধীনতা অর্জনের পরে কল্কি নতুন যুগের সূচনা করবে।[৭][৮][৯] পরবর্তী যুগ বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থ বিমলাপ্রভায় কালচক্র তন্ত্র ও কল্কির উল্লেখ পাওয়া যায়।[১০]

কল্কি পুরাণে বর্ণিত ঘটনাসমূহ[সম্পাদনা]

কলি যুগ[সম্পাদনা]

কল্কি ও তার ঘোড়া, দেব দত্ত।

কালানুক্রমিকভাবে কৃষ্ণকে ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার বলা হয়। পুরাণ অনুযায়ী কলি যুগের সূচনালগ্নে দ্বাপর যুগে বর্ণ ব্যবস্থার অবনতি ঘটবে। এরপর শীঘ্রই কলি যুগের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায় শুরু হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের সময় মানুষ ঈশ্বরের নাম ভুলে যাবে এবং দেবদের উদ্দেশ্যে আর যজ্ঞ করবেনা। চতুর্থ পর্যায়ে স্বজাতি ভক্ষণ প্রথা সারা বিশ্বে মানুষদের মধ্যে প্রচলিত হবে। এই সমস্যার সমাধান করতে দেবরা ব্রহ্মের কাছে সমাধানের জন্য একত্রিত হবে। এই যুগের শেষে দেবরা বিষ্ণুর কাছে সাহায্য পাওয়ার জন্য বৈকুণ্ঠে ভ্রমণ করবে। তারপর কলি যুগ শেষ করার উদ্দেশ্যে ভগবান বিষ্ণুর পৃথিবীতে পুনর্জন্ম হবে।

পার্থিব জীবন[সম্পাদনা]

ঘোড়ার পিঠে কল্কি

শ্রী কল্কি হবেন সর্বশ্রেষ্ঠ পরাভ্রমণকারী ভগবান বিষ্ণুর অবতার। তিনি তাঁর চিরন্তন সহধর্মিণী লক্ষ্মীকে বিয়ে করবেন যিনি তার স্বর্গীয় মাতা। তিনি তারপর তার কলি যুগ শেষ করার উদ্দেশ্যের জন্য কাজ শুরু করবেন এবং পৃথিবী থেকে সব খারাপ রাজা, অশুভ ব্যক্তিদের দূর করবেন তারপর সত্য যুগের সূচনা করবেন। ভবিষ্যৎবাণীতে প্রলয় বা কলি যুগ সমাপ্তির উল্লেখ রয়েছে।

পরশুরাম অবতার: কল্কি অবতারের গুরু[সম্পাদনা]

ভগবান বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম কল্কি অবতারের আচার্যের গুরু (শিক্ষক) হবেন বলে পুরাণে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে। এই পুস্তকে পরশুরাম কল্কিকে বেদ শিক্ষা দেন যাতে কল্কি অধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আগে নৈতিকতা ও ধর্মের শিক্ষা পায়। এর সাথে পরশুরাম তাকে ধনুর্বেদ শেখান যাতে কল্কি যুদ্ধের সময় সঠিক কৌশলে অশুভদের মোকাবেলা করতে পারে।

অধর্মের ধ্বংস[সম্পাদনা]

ভগবান বিষ্ণুর কল্কি রূপে পৃথিবীর আগমনের অন্যতম প্রধান কারন হলো অশুভ শক্তি কে পরাজিত ও ধ্বংস করা। তিনি তার যুদ্ধ শুরু করেন কিটকপুরে শূন্যবেদীদের বিরুদ্ধে যারা মানুষদের বিপথে এনেছে। পরবর্তীতে একটি যুদ্ধ হয় কলিদেবদের বিরুদ্ধে। তারপর কলি সত্য যুগের রূপে ধর্মের হাতে পরাজিত হবে যা অশুভের বিপরীত।[১১]

সত্য যুগ[সম্পাদনা]

পৃথিবীতে অধর্মের পরাজয়ের পর সত্য যুগের সূচনা হবে। কল্কি এক সোনালী যুগ নিয়ে আসবে। কল্কি সাম্রাজ্যকে তার দুই সেনাপতির মাঝে ভাগ করে দিবে। তার অভিভাবক সুমতি ও বিষ্ণুযশ তারপর তীর্থস্থান বদ্রিকর্শনে গমন করবে এবং সেখানে তারা বসবাস করবে। তাদের কোন মৃত্যু নেই। তারা কল্কির সাথে বৈকুণ্ঠে যাবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার পর কল্কি বিশ্ব শাসন করবে।

আরো দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Rocher, Ludo (১৯৮৬)। "The Purāṇas"। Jan Gonda। A History of Indian Literature। Vol.II, Epics and Sanskrit religious literature, Fasc.3। Wiesbaden: Otto Harrassowitz Verlag। পৃষ্ঠা 183। আইএসবিএন 3-447-02522-0 
  2. The Tibet Journal, Volume 22। Library of Tibetan Works & Archives। ১৯৯৭। পৃষ্ঠা 36। Emil Abegg based on the reference to struggles between Visnuism and Buddhism, suggests that parts of the Kalki-Purana might date back to the 9th century 
  3. Sarasvati Bhavana Granthamala, Vol. 103 (পিডিএফ)Sarasvati Bhavana Granthamala। ১৯৭২। পৃষ্ঠা 3–12। Then in all probability the Kalki-Purana may have been composed during the ninth and tenth century A.D 
  4. Ludo Rocher (১৯৮৬)। The Purāṇas। Otto Harrassowitz Verlag। পৃষ্ঠা 183 with footnotes। আইএসবিএন 978-3-447-02522-5 
  5. John Newman (২০১৫)। Donald S. Lopez Jr., সম্পাদক। Buddhism in Practice: (Abridged Edition)। Princeton University Press। পৃষ্ঠা 203। 
  6. Sopa, Lhundub। The Wheel of Time: Kalachakra in Context। Sambhala। পৃষ্ঠা 83–84 with note 4। 
  7. Yijiu JIN (২০১৭)। Islam। BRILL Academic। পৃষ্ঠা 49–52। আইএসবিএন 978-90-474-2800-8 
  8. [a] Björn Dahla (২০০৬)। Exercising Power: The Role of Religions in Concord and Conflict। Donner Institute for Research in Religious and Cultural History। পৃষ্ঠা 90–91। আইএসবিএন 978-952-12-1811-8 , Quote: "(...) the Shambala-bodhisattva-king [Cakravartin Kalkin] and his army will defeat and destroy the enemy army, the barbarian Muslim army and their religion, in a kind of Buddhist Armadgeddon. Thereafter Buddhism will prevail.";
    [b] David Burton (২০১৭)। Buddhism: A Contemporary Philosophical Investigation। Taylor & Francis। পৃষ্ঠা 193। আইএসবিএন 978-1-351-83859-7 
    [c] Johan Elverskog (২০১১)। Anna Akasoy; ও অন্যান্য, সম্পাদকগণ। Islam and Tibet: Interactions Along the Musk Routes। Ashgate Publishing। পৃষ্ঠা 293–310। আইএসবিএন 978-0-7546-6956-2 
  9. John Newman (২০১৫)। Donald S. Lopez Jr., সম্পাদক। Buddhism in Practice (Abridged সংস্করণ)। Princeton University Press। পৃষ্ঠা 202–205। 
  10. John Newman (১৯৮৫)। Geshe Lhundub Sopa, সম্পাদক। The Wheel of Time: Kalachakra in Context। Sambhala। পৃষ্ঠা 56–78, 83–86 with notes। 
  11. . Raja Shashidhwaja, a great devotee of Vishnu, has been granted a boon by Lord Vishnu of defeating Kalki on the battlefield.

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]