বিরজাশঙ্কর গুহ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিরজাশঙ্কর গুহ
জন্ম(১৮৯৪-০৮-১৫)১৫ আগস্ট ১৮৯৪
মৃত্যু২০ অক্টোবর ১৯৬১(1961-10-20) (বয়স ৬৭)
জাতীয়তাভারতীয়
মাতৃশিক্ষায়তনকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়
পেশানৃতত্ত্ববিদ
পিতা-মাতাঅভয়শঙ্কর গুহ

বিরজাশঙ্কর গুহ (১৫ আগস্ট ১৮৯৪ ― ২০ অক্টোবর ১৯৬১) ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় বাঙালি জৈবিক নৃতত্ববিদ। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে তিনি বৈচিত্র্যময় ভারতে বসবাসকারী জনসমষ্টিকে জাতিগোষ্ঠীতে শ্রেণীবদ্ধ করেন। তেমনই ভাষার বৈচিত্র্যে তিনি তাঁর বৈজ্ঞানিক ধারনায় স্থানীয় ভাষাকে জনপ্রিয় করার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। [১] তিনি অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (এ এস আই-এর (১৯৪৫-১৯৫৪) প্রথম পরিচালক। [২] [৩]

জন্ম ও শিক্ষাজীব[সম্পাদনা]

বিরজাশঙ্করের জন্ম ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই আগস্ট  বৃটিশ ভারতের মিশ্রিত অসমের তৎকালীন রাজধানী অধুনা মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলং-এ। পিতা রায়বাহাদুর অভয়শঙ্কর গুহ ছিলেন অসমের জেলা ও রাজ্যস্তরের এক প্রথিতযশা সিভিলিয়ান। বিরজাশঙ্কর গুয়াহাটির কটন কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা, কলকাতার সিটি কলেজ থেকে আই.এ, স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে স্নাতক হন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। [৪]

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

বিরজাশঙ্কর কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে দর্শনের অধ্যাপক হিসাবে কিছুদিন কাজ করেন। এখানে স্যার ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের পরামর্শে পৃথিবীর জীববিজ্ঞান ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বাড়ে এবং তিনি অতীতের পুরাবস্তু সংগ্রহে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের উদ্যোগে তিনি বাংলা সরকারের নৃবিজ্ঞান স্কলার হয়ে ১৯১৭ খ্রি হতে ১৯২০ খ্রি পর্যন্ত অসমের খাসি উপজাতিদের উপর সমীক্ষা চালান। তাঁর কৃতিত্ব পূর্ণ এই গবেষণার জন্য তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের 'হেমেনওয়ে ফেলোশিপ' নিয়ে আমেরিকায় যান। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি হার্ভার্ড মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি (নিউ ইয়র্ক) এবং ওয়াশিংটন ডিসির স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের ব্যুরো অফ এথনিসিটিতে গবেষক হিসেবে কাজ করেন।  বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞানে এম.এ পাশের পর তিনি  রোল্যান্ড ডিক্সন এবং আর্নেস্ট হুটনের অধীনে  ‘দি রেসিয়ান বেলিস অফ দি কাস্ট সিস্টেম ইন ইন্ডিয়া’ বিষয়ে গবেষণা করে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এই বিষয়ে ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি।[৫] ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন খোলা নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান বিভাগে ফিজিক্যাল অ্যানথ্রোপলজির অস্থায়ী লেকচারার হিসাবে  শরৎচন্দ্র মিত্রের স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি জুয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার নৃতাত্ত্বিক বিভাগে অফিসার ইনচার্জ নিযুক্ত হন। [৬]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে জুয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বারাণসীতে স্থানান্তরিত হলে তিনি সেখানে যান। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ জুয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া থেকে পৃথক হয়ে যায়, তখন তিনি এই নতুন সংস্থার 'অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি' ছিলেন। পরে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১লা আগস্ট সংস্থার নাম হয় অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এবং তিনি হলেন সংস্থাটি প্রথম পরিচালক এবং ভারত সরকারের নৃ-বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা। তাঁর উদ্যোগে সংস্থার প্রথম কাজ ছিল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পর্যবেক্ষণ। উপজাতিদের মধ্যে কাজ করার প্রথম ভারতীয় দলের নায়ক হয়ে তিনি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে আন্দামান যান। সার্ভের কাজ সুচারুভাবে করার জন্য ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে আন্দামানে এবং ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে শিলংয়ে আঞ্চলিক কেন্দ্র খোলেন। প্রায় দশ বৎসরের চেষ্টায় তিনি সংস্থাটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন।[৪] [৬] [৭]

১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি  রাঁচির 'সোশ্যাল এডুকেশন অরগানাইজারস্ ট্রেনিং সেন্টার' -এর পরিচালক হিসাবে যোগ দেন। পরের বছর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে  তিনি রাঁচির  'বিহার ট্রাইবাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট'-এ অধিকর্তা হন।

অবদান[সম্পাদনা]

বিরজাশঙ্কর  ভারতের  জনসমষ্টিকে জাতিগোষ্ঠীতে শ্রেণীবদ্ধ করার জন্য  সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ভারতে জনসমষ্টির  মধ্যে নেগ্রিটো,  প্রটো-অস্ট্রলয়েড,  মঙ্গলয়েড, মেডিটোরিয়ান,  ওয়েস্টার্ন ব্রাকিসেফালস ও নর্ডিক  ― এই ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর অবস্থান চিহ্নিত করেছিলেন।  যদিও বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীরা জাতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। তবে বিরজাশঙ্করের তত্ত্বগুলির  ঐতিহাসিক গুরুত্ব যথেষ্টই। জাতি একটি মিথ এবং মানুষের জনসংখ্যার মিশ্রণ হল বাস্তবতা সুতরাং, তথাকথিত 'জাতি' এর ভিত্তিতে নির্মিত জাতিগুলিও একটি মিথ। মানব সভ্যতা মিশ্রণের একটি পণ্য এবং একচেটিয়া জৈবিক ডোমেনে জাতি শব্দটির ব্যবহার সংরক্ষণ করা ভাল [৮]

ভারতীয় উপজাতি ছাড়াও, তিনি উত্তর আমেরিকান ভারতীয়দের উপর কিছু গবেষণা করেছিলেন [৯]


বিরজাশঙ্কর ছিলেন ভারতের প্রথম নৃবিজ্ঞানী যিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুদের ভারতে চলে আসার কারণ অনুসন্ধান করে তিনি পুনর্বাসনে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। [১০] [১১] [১২] তিনি ভারতের নৃতত্ত্বের ইতিহাস রচনায় আগ্রহী ছিলেন যেখানে তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। [১৩] এ ছাড়াও, সামাজিক নৃতাত্ত্বিক ও সমাজবিজ্ঞান বিষয় যেমন ― বস্তুগত সংস্কৃতি, যুব আস্তানা, জাতীয় জীবনে আদিবাসীদের স্থান,  সংস্কৃতির যোগাযোগ, উপজাতি কল্যাণ এবং প্রশাসন এবং জাতি গঠনে সামাজিক বিজ্ঞানের ভূমিকা নিয়ে তিনি স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন [১৪] [১৫]

প্রকাশনা[সম্পাদনা]

  • রেসিয়াল এলিমেন্টস্ ইন দ্য পপুলেশন  (১৯৪৪) অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস  প্রকাশিত (একটি ডিজিটাল সংস্করণ ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া যায় )
  • দ্য রেসিয়াল অ্যাফেনিটিজ অফ দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়া ইন সেনসাস অফ ইন্ডিয়া,১৯৩১ (১৯৩৫ ), ভারত সরকার প্রেস, সিমলা
  • এ  বায়োমেট্রিক স্টাডি অন দ্য ট্রাইবস্ অফ নর্থ-ওয়েস্টার্ন হিমালয়ান রিজিয়ন  (এস কে মজুমদারের সাথে যৌথভাবে)
  • এ রিপোর্ট অন দ্য হিউম্যান রেলিকস রিকভার্ড বাই দি নাগা হিলস (বার্মা) *এক্সপেডিশন ফর দি অ্যাবলিশন অফ হিউম্যান স্যাক্রিফাইস্ ডিয়্যুরিং ১৯২৬-১৯২৭ (অ্যানথ্রোপলজিক্যাল বুলেটিনস্, দ্য জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া; বুলেটিন)   
  • মোশুপ লেগেপ ডোয়িং অ্যাগোম লুনেন; অর দ্য মাইথলজিক্যাল অরিজিন অফ দ্য আবর ডরমিটরি সিস্টেম
  • স্টাডিজ ইন সোস্যাল টেনশনস্ এমাং দ্য রিফিউজিস্ ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান     
  • এ আর্কিওলজিক্যাল ট্যুর ইন গেড্রোসিয়া
  • দ্য অ্যানথ্রোপলজিক্যাল বেসিস অফ পি ডব্লিউ শ্মিট অ্যান্ড অ্যস্ট্রিচ   
  • এ রিপোর্ট অন দি বোনস এক্সকাভেটেড অ্যাট নাল
  • এ রিপোর্ট অন দি হিউম্যান রিমেন্স এক্সকাভেটেড অ্যাট মহেঞ্জাদারো ইন ১৯২৮-২৯

সম্মাননা[সম্পাদনা]

বিরজাশঙ্কর গুহ নৃ-বিজ্ঞান সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বহু সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এশিয়ার মানববিজ্ঞান বিষয়ে অসামান্য মেধাভিত্তিক গবেষণার জন্য ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল তাঁকে সোসাইটির অ্যানানডেল মেমোরিয়াল মেডেল দ্বারা সম্মানিত করে। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি  গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডের রয়েল নৃতাত্ত্বিক ইনস্টিটিউটের ফেলো এবং আন্তর্জাতিক নৃবিজ্ঞান কংগ্রেসের স্থায়ী পরিষদের সদস্য হন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্সের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি হন।

জীবনাবসান[সম্পাদনা]

বিরজাশঙ্কর ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ২০ শে অক্টোবর তৎকালীন বিহারের বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলা রেল দুর্ঘটনায় মারা যান।

আরো দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Guha, Abhijit। "BS_Guha_Bengali_Book_Races_India.PDF" 
  2. Guha, Abhijit। "B.S.Guha by Kamal Kumar Kundu(Desh).PDF" 
  3. Guha, Abhijit। "Obituary of B.S.Guha" 
  4. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত,সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ৪৮৭, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  5. "B S Guha was the first Indian to get PhD from Harvard (ইংরাজীতে)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-১০ 
  6. "Appendix K: The Anthropological Survey of India (The Andamanese by George Weber)"। ২০০৫-০৯-১০। ২০০৬-০৫-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১১-১২ 
  7. Guha, Abhijit। "History of Anthropological Survey of India by Verrier Elwin(Part I&II)" 
  8. Guha, Abhijit। "Race & Nationality by B S Guha(1959)" 
  9. The Transfer of Anthropological Power in India: The Life and Work of Biraja Sankar Guha (1894–1961) (Abstract ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে), Kelli M. Kobor, George Mason University
  10. Guha, Abhijit। "Studies in Social Tensions among the refugees from eastern Pakistan by B.S.Guha(General Introduction).PDF" 
  11. Guha, Abhijit। "Social tensions PART I JIRAT" 
  12. Guha, Abhijit। "Social Tensions PART II AZADGARH" 
  13. Guha, Abhijit। "BS Guha on the progress of Anthropology in ISC silver jubilee volume1938" 
  14. Guha, Abhijit। "Social_anthropology_of_B_S_" 
  15. Guha, Abhijit। "The Role of Social Sciences in India by B.S.Guha"