গিইয়োম আপলিনের

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
গিইয়োম আপলিনের
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের বসন্তে তোলা আপলিনেরের আলোকচিত্র; কপালে ১ম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত-ঢাকা পট্টি দৃশ্যমান।
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের বসন্তে তোলা আপলিনেরের আলোকচিত্র; কপালে ১ম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত-ঢাকা পট্টি দৃশ্যমান।
জন্মWilhelm Albert Włodzimierz Apolinary Kostrowicki
(১৮৮০-০৮-২৬)২৬ আগস্ট ১৮৮০
রোম, ইতালি
মৃত্যু৯ নভেম্বর ১৯১৮(1918-11-09) (বয়স ৩৮)
প্যারিস, ফ্রান্স
পেশাকবি, লেখক, সমালোচক

স্বাক্ষর

গিইয়োম আপলিনের (ফরাসি: Guillaume Apollinaire; আ-ধ্ব-ব: [ɡijom apɔlinɛʁ]; ২৬শে আগস্ট ১৮৮০ - ৯ নভেম্বর ১৯১৮) পোলীয়-বেলারুশীয়-ইতালীয় বংশোদ্ভূত ফরাসি কবি, নাট্যকার, ছোট গল্পকার ও শিল্প-সাহিত্য সমালোচক। আপলিনের ২০শ শতকের শুরুর দিকের সর্বপ্রধান কবিদের একজন হিসেবে পরিগণিত হন। তিনি ঐ সময় ফরাসি শিল্প ও সাহিত্যের অঙ্গনে যে অগ্রসৈনিক (আভঁ-গার্দ) আন্দোলনগুলি বিকাশ লাভ করে, সেগুলিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সংক্ষিপ্ত ৩৮ বছরের জীবনে তিনি কবিতা রচনাকে অনাবিষ্কৃত বিভিন্ন দিকে চালিত করেন। তাঁর কবিতাগুলি দুঃসাহসিক ও প্রথাবিরুদ্ধ কারিগরি পরীক্ষায় পূর্ণ। রৌপ ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে আধুনিক হবার দৃঢ়সংকল্প থেকে তিনি কোনও যতিচিহ্ন ছাড়াই কবিতা লিখতেন।[১] তাঁর মুদ্রিত কিছু কবিতার হরফগুলিকে এমনভাবে ছাপানো হয় যাতে কবিতাটি নিজেই একটি চিত্রের মতো দেখতে হয়; এগুলিকে তিনি ফরাসিতে কালিগ্রাম নাম দিয়েছিলেন, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় "চারুলেখ"। তিনি অস্বাভাবিক শাব্দিক সম্বন্ধ সৃষ্টির মাধ্যমে বিস্ময়কর বা তাক লাগানো প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা করেন। একারণে তাঁকে কেউ কেউ শিল্পকলা ও সাহিত্যে পরাবাস্তবতাবাদের (স্যুরিয়ালিজম) একজন পূর্বপুরুষ হিসেবে গণ্য করেন। এছাড়া তাঁকে ঘনকবাদের সবচেয়ে বড় অনুরাগী সমর্থকদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। শিল্পকলার আলোচনায় তাঁকেই "পরবাস্তবতাবাদ", "ঘনকবাদ" ও "ওর্ফেউসবাদ" পরিভাষা তিনটির উদ্ভাবক বলে মনে করা হয়।[২] তিনি ১৯১১ সালে পাবলো পিকাসো, জর্জ ব্রাক, ইত্যাদি শিল্পীর হাতে উদীয়মান শিল্পকলা আন্দোলনটিকে "ঘনকবাদ" (Cubisme ক্যুবিজম), এর একটি শুদ্ধতাবাদী শাখাকে (রোবের দ্যলোনেফান্তিশেক কুপকা-র সৃষ্টিকর্ম বর্ণনা করতে গিয়ে) ১৯১২ সালে "ওর্ফেউসবাদ" (Orphisme অর্ফিজম) এবং ১৯১৭ সালে এরিক সাতি-র বালে-নৃত্যকর্ম বর্ণনা করতে গিয়ে "পরাবাস্তবতাবাদ" (Surréalisme স্যুরেয়ালিজ্‌ম) পরিভাষাটি ব্যবহার করেন। জীবদ্দশায় তিনি এমন কিছু তরুণ কবির শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন, যারা পরবর্তীতে পরাবাস্তবতাবাদী কবিদের কেন্দ্রীয় দলটি গঠন করে (অঁদ্রে ব্র্যতোঁ, লুই আরাগোঁ, ফিলিপ সুপো, প্রমুখ)। আপলিনেরের কবিতা শুরু থেকেই স্বতন্ত্র প্রকৃতির ছিল এবং এর উপরে কোনও বিশেষ ঘরানার কোনও প্রভাব ছিল না; ফলে তিনি ২০শ শতকের প্রথমার্ধে যে সাহিত্যিক বিপ্লব ঘটে, তিনি ছিলেন তার অগ্রদূতদের একজন। আপলিনেরের শিল্প কোনও তত্ত্ব নয়, বরং একটিমাত্র সরল মূলনীতির উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে: সৃষ্টির কাজটিকে অবশ্যই কল্পনা ও অন্তর্জ্ঞান থেকে উৎসারিত হতে হবে, কেননা এটিকে যথাসর্বোচ্চ সম্ভব জীবন, প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানবসত্তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থাকতে হবে।

গিইয়োম আপলিনের ছিল কবির ফরাসিকৃত ছদ্মনাম। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল গিয়েলমুস (বা ভিলহেল্ম) আলবের ভোজিমির্জ আপোনিলারি দ্য ভাজ-কস্ত্রভিৎস্কি (Wilhelm Albert Włodzimierz Apolinary de Wąż-Kostrowicki)। তিনি ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে আগস্ট ইতালিতে (সম্ভবত রোম নগরীতে) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অভিবাসী পোলীয় মা ও ইতালীয় সরকারি কর্মকর্তা বাবার ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। তিনি ২০ বছর বয়সে ফ্রান্সের প্যারিস নগরীতে পাড়ি জমান ও সেখানে বোহেমীয় জীবনযাপন শুরু করেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেশ কিছু মাস জার্মানিতে কাটান এবং রাইনলান্ড অঞ্চলের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। পরে তিনি তাঁর কবিতাগুলিতে এই অঞ্চলটির অরণ্য ও কিংবদন্তীগুলিকে ধারণ করেছেন। আপলিনের পরবর্তীকালে এক ইংরেজ মহিলার প্রেমে পড়ে এবং তার টানে লন্ডন নগরী পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন, যদিও তার প্রেম ব্যর্থ হয়। আপলিনের তাঁর এই প্রণয়ঘটিত দুঃখ-হতাশা পরবর্তীতে শঁসোঁ দ্যু মাল-এমে (আক্ষরিক অর্থে "ভালবাসার দীনতায় ভোগা ব্যক্তির গান") শীর্ষক তাঁর বিখ্যাত কবিতাটিতে প্রকাশ পায়।

প্যারিসে ফেরত আসার পর আপলিনের একজন লেখক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন এবং সাহিত্যিকদের আনাগোনায় পূর্ণ প্যারিসের কফিঘরগুলিতে প্রায়ই যেতেন। তিনি এসময় বেশ কিছু তরুণ চিত্রশিল্পীর সাথেও বন্ধুত্ব করেন, যারা পরবর্তীতে খ্যাতিলাভ করেন, যেমন মোরিস দ্য ভ্লামনিক, অঁদ্রে দ্যরাঁ, রাউল দ্যুফি ও পাবলো পিকাসো। আপলিনের তাঁর সমকালীন শিল্পীদেরকে অঁরি রুসো-র চিত্রকর্মগুলি ও আফ্রিকান ভাস্কর্যকলার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি পিকাসোর ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং পিকাসোর অনুরূপে চিত্রকলার পাশাপাশি সাহিত্যেও একটি ঘনকবাদী (কিউবিস্ট) নান্দনিকতার মূলনীতিগুলি সংজ্ঞায়িত করার কাজটিতে মনোনিবেশ করেন। ১৯১৩ সালে তিনি পাঁত্যুর ক্যুবিস্ত ("ঘনকবাদী চিত্রকলা") নামক একটি বই রচনা করেন।

আপলিনেরের প্রথম কবিতার সংকলন লঁশঁতর পুরিসঁ (L’Enchanteur pourrissant; "পচনশীল জাদুকর") ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হয়, যাতে কিংবদন্তীর জাদুকর মের্লিন ও জলপরী ভিভিয়ানের মধ্যে কবিতার ভাষায় একটি কথোপকথন বিধৃত হয়েছে। এর পরবর্তী বছরে ১৯১০ সালে লেরেজিয়ার্ক এ কোঁপাইনি (L’Hérésiarque et Cie, "উৎপথগামীদের নেতা ও তার সঙ্গীরা") নামক কবিতা সংকলনে কতগুলি খামখেয়ালি ও দূরকল্পনায় পূর্ণ প্রাণবন্ত কবিতা স্থান পায়। এর পরের বছর তিনি ল্য বেস্তিয়ের (১৯১১) প্রকাশ করেন, যেখানে বিভিন্ন চতুর্পংক্তি স্তবকে লেখা কবিতার সন্নিবেশ ঘটে। ১৯১৩ সালে লেখা আলকোল কবিতা সংকলনটিকে তাঁর সেরা সাহিত্যকর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়।

১৯১৪ সালে আপলিনের ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ও পদাতিকবাহিনীর দ্বিতীয় লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন। ১৯১৬ সালে যুদ্ধের সময় মাথায় আঘাত পেয়ে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পান ও প্যারিসে ফেরত আসেন। সে বছরই তিনি একটি প্রতীকী গল্প রচনা করেন, যার নাম ছিল ল্য পোয়েত আসাসিনে (Le Poète assassiné, "আততায়ীর হাতে নিহত কবি")। ১৯১৮ সালে কালিগ্রাম নামে আরেকটি কবিতা সংকলন মুক্তি পায়, যাতে যুদ্ধ ও নতুন প্রণয়ের মতো বিষয়গুলি আধিপত্য বিস্তার করে। ১৯১৭ সালে তাঁর রচিত নাটক লে মামেল দ্য তিরেজিয়াস প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থ হয়। আপলিনের নাটকটিকে "পরাবাস্তববাদী" (স্যুরেয়ালিস্ত) হিসেবে চরিত্রায়িত করেন; অনেকের মতে এটি ছিল "পরাবাস্তববাদী" পরিভাষাটির সম্ভাব্য প্রথম ব্যবহার।

সাহিত্যকর্ম ছাড়াও আপলিনের একজন সাংবাদিক ও শিল্প সমালোচক হিসেবে সক্রিয় ছিলেন এবং ল্য মাতাঁ, লাঁত্রাঁসিজঁ, লেস্প্রি নুভো, মের্ক্যুর দ্য ফ্রঁসপারি জুর্নাল নামক সাময়িকীগুলিতে তাঁর রচনা প্রকাশিত হয়। ১৯১২ সালে তিনি লে সোয়ারে দ্য পারি নামের একটি শৈল্পিক ও সাহিত্যিক সাময়িকী প্রতিষ্ঠা করেন।

বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতগুলির কারণে হীনবল আপলিনের স্পেনীয় ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারীর সময় সেই রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ই নভেম্বর তারিখে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ফ্রান্সের প্যারিস নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পরে যুদ্ধের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা প্রদর্শনের জন্য তাঁকে "ফ্রান্সের জন্য শহীদ" (মর পুর লা ফ্রঁস, Mort pour la France) খেতাব দেওয়া হয়।[৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]