রূপরাম চক্রবর্তী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

রূপরাম চক্রবর্তী মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবি। তাঁকে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যবাহী ধর্মমঙ্গল কাব্য শাখার একজন অন্যতম প্রধান রচয়িতা হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি আনুমানিক ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে অনাদিমঙ্গল কাব্য রচনা করেন। তাঁকে ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রথম রচয়িতা বলে মনে করা হয়, তাঁর পরবর্তী ধর্মমঙ্গল রচয়িতারা তাঁকে আদি রূপরাম বলে চিহ্নিত করেছেন।[১]

জীবনী[সম্পাদনা]

রূপরাম চক্রবর্তী বর্ধমান জেলার (বর্তমানে পূর্ব বর্ধমান জেলা) দক্ষিণ প্রান্তে রায়না থানার অন্তর্গত গ্রাম কাইতি-শ্রীরামপুরে পৈতৃক ভিটায় জন্মগ্রহণ করেন। কবি রূপরামের পিতার নাম শ্রীরাম চক্রবর্তী এবং মাতার নাম দৈমন্তী দেবী (অথবা, দয়মন্তী বা দময়ন্তী বা দয়াবন্তী)।[২] পিতা শ্রীরাম চক্রবর্তী খ্যাতিমান সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন, তাঁর টোলে শতাধিক ছাত্র অধ্যয়ন করতো। পিতা শ্রীরামের মৃত্যুর পর রূপরামের জ্যেষ্ঠভ্রাতা রত্নেশ্বরের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য হলে রূপরাম পার্শ্ববর্তী আড়ুই গ্রামের পণ্ডিত রঘুরাম ভট্টাচার্যের টোলে উপস্থিত হন। সেখানে কিছুদিন অধ্যয়ন করার পর রূপরামের তর্কপরায়ণতায় অতিষ্ঠ হওয়ায় গুরুশিষ্যের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়। রূপরামকে অন্যত্র পড়তে জেতে বললে রূপরাম নবদ্বীপের উদ্দেশ্যে গমন করেন। কিন্তু কিছুদূর যেতেই তাঁর মায়ের কথা মনে পরলে তিনি বাড়িমুখে অগ্রসর হন।[৩] ফেরার পথে পলাশনের কাছে তিনি দিকভ্রষ্ট হলে ধর্মঠাকুর ব্রাহ্মণ বেশে তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দেন এবং ধর্মমঙ্গল রচনার আদেশ দেন। ধর্মঠাকুর অন্তর্হিত হলে রূপরাম দেখে দুটি বাঘ তার দিকে চেয়ে লেজ নাড়ছে। রূপরাম ভয় পেয়ে সোজা বাড়ির দিকে দৌড় দেয়। ঘরে ধুকতেই দাদা রত্নেশ্বরের মুখোমুখি হলে দাদার কাছে অপমানিত হয়ে মাকে না দেখেই আবার গৃহ ত্যাগ করে।[৪] এরপর ধর্মঠাকুরের ছলনা ও দীর্ঘ কষ্টভোগের পর কবি গোপভূমের রাজা গণেশের সভায় উপস্থিত হয় এবং রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনায় ব্রতী হন।[৫] কাব্যরচনা সম্পন্ন হলে রাজা গণেশ ধর্মীয় রীতিনীতির গানের পরিবেশনের জন্য সমস্ত ব্যবস্থা করেছিলেন।[৬] তৎকালীন সময়ে ধর্মঠাকুরের উপাসনার অপরাধে ব্রাহ্মণ সমাজ দ্বারা তাঁকে সমাজে পতিত হতে হয়েছিল।[৭]

কাব্য বৈশিষ্ট্য[সম্পাদনা]

কবি রূপরামের ধর্মমঙ্গলের প্রকাশভঙ্গীর সরলতা ও সরসতা একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রূপরাম ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনার পূর্বের তাঁর দুঃখময় কাহিনিকে কাব্যরসের বন্ধনে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। কাব্য রচনার ক্ষেত্রে যেখানে মানুষের প্রসঙ্গ এসেছে, সেখানে তিনি তার জীবন্ত আলেখ্য অঙ্কন করতে সার্থক হন। মঙ্গলকাব্যের ধারায় সকল কথার শেষে দেবতার মাহাত্মকীর্তন গাওয়া হলেও তিনি দেবমহিমা ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি তৎসময়ের মানুষের জীবনযাত্রাকেও তুলে ধরতে সচেষ্ট হন।[৫] ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গলের পাশাপাশি কবি রূপরাম রচিত ধর্মমঙ্গল কাব্যও বঙ্গ অঞ্চলে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে।[৬]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. সেন, দীনেশচন্দ্র (১৯১৪)। Vanga Sahitya Parichaya or Selections from the Bengali literature: from the earliest times to the Middle of the Nineteenth Century। কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। পৃষ্ঠা ৩৮৫। 
  2. সেন, সুকুমার; মণ্ডল, পঞ্চানন, সম্পাদকগণ (১৯৪৪)। রূপরামের ধর্মমঙ্গল: (বন্দনা হইতে লাউসেন - চুরি পালা পর্যন্ত)। প্রথম খণ্ড। বর্ধমান: সাহিত্য-সভা। 
  3. ভট্টাচার্য, আশুতোষ (১৯৫৯)। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (তৃতীয় সংস্করণ)। ২, রামনাথ বিশ্বাস লেন, কলকাতা: বুক সিণ্ডিকেট প্রাইভেট লিমিটেড। পৃষ্ঠা ৯৯। 
  4. সেন, সুকুমার। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সপ্তদশ - অষ্টাদশ শতাব্দী। দ্বিতীয় খণ্ড। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ। পৃষ্ঠা ১৩৪। আইএসবিএন 81-7215 025-3 
  5. ঘোষ, ভোলানাথ (১৯৫৭)। বাঙ্লা সাহিত্য পরিক্রমা। কলকাতা: এস, ব্যানার্জি এণ্ড কোং। পৃষ্ঠা ১৬৫। 
  6. সেন, সুকুমার (১৯৬০)। History of Bengali literature। Duke University Libraries। নতুন দিল্লি: সাহিত্য একাডেমী। পৃষ্ঠা ১৪০। 
  7. জানা, প্রিয়নাথ (১৯৫৫)। বঙ্গীয় জীবনীকোষ: আদি - অষ্টাদশ শতাব্দী। প্রথম খণ্ড। কলকাতা: মাতৃভাষা পরিষদ। পৃষ্ঠা ৫০৪।