মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দী
জন্ম
মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দী

(১৮৬০-০৫-২৯)২৯ মে ১৮৬০
মৃত্যু১২ নভেম্বর ১৯২৯(1929-11-12) (বয়স ৬৯)
জাতীয়তাভারতীয়
উপাধিমহারাজা স্যার মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দী
পূর্বসূরীমহারাণী স্বর্ণময়ী
উত্তরসূরীশ্রীশচন্দ্র নন্দী
দাম্পত্য সঙ্গীমহারাণী কাশীশ্বরী
সন্তানমহিমচন্দ্র, কীর্তিচন্দ্র, শ্রীশচন্দ্র নন্দী, সরোজিনী, কুমুদিনী, কমলিনী, মৃণালিনী
পিতা-মাতা
  • নবীনচন্দ্র নন্দী (পিতা)
  • গোবিন্দসুন্দরী দেবী (মাতা)

মহারাজা স্যার মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দী KCIE (২৯ মে ১৮৬০ - ১২ নভেম্বর,১৯২৯) ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কাশিমবাজারের মহারাজা ছিলেন। বাংলার নবজাগরণে তিনি ছিলেন এক সমাজসেবী ও সংস্কারবাদী ব্যক্তিত্ব।

দেশের নানা প্রয়োজনে, বিশেষত শিক্ষাবিস্তারের জন্য, তিনি বহু প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিবিশেষকে লক্ষ লক্ষ টাকা দান করেছেন। তা ছাড়াও তিনি বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতার একজন প্রথম শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বহু ছাত্র তার বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে শিক্ষালাভ করেছেন। স্বদেশী শিল্প ও বাণিজ্যের সম্প্রসারণে এবং বঙ্গভঙ্গ ও রাওলাট বিলের বিরুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।[১]

জন্ম ও পরিবার[সম্পাদনা]

মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর জন্ম ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে[১][২] পিতা নবীনচন্দ্র নন্দী। তাঁর মাতা ছিলেন কাশিম বাজার রাজপরিবারের মহারাজা কৃষ্ণনাথ রায়ের ভগিনী গোবিন্দসুন্দরী দেবী। মণীন্দ্রচন্দ্র মাতৃহারা হন মাত্র দু' বছর বয়সে এবং তার পিতাও মারা যান যখন তার বয়স বারো বছর। তাঁর সাত ভাইবোন ছিল - সর্বেশ্বরী (১৮৪৩), বিশ্বেশ্বরী (১৮৪৫), উপেন্দ্রচন্দ্র (১৮৪৮ - ১৮৭২), ভুবনেশ্বরী, যোগেন্দ্রচন্দ্র (১৮৫৪ - ১৮৬৮), সিদ্ধেশ্বরী ও রামেশ্বরী (১৮৫৭)।

১৮৭৫ সালে কেবল তাঁর তিন বিধবা ভগিনী জীবিত ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর মণীন্দ্রচন্দ্র পরিবারের হাল ধরেন। [৩]

কাশিমবাজার রাজপরিবারে সরাসরি পুরুষ বংশধর না থাকার কারণে রাজপরিবারের ইচ্ছানুসারে ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মহারাণী স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর পর মাতুল সম্পত্তির অধিকারী হন এবং ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে মে মহারাজা উপাধিতে ভূষিত হন। [৩]

শিক্ষা[সম্পাদনা]

মণীন্দ্রচন্দ্র চৌদ্দ বছর বয়সে গুরুতর অসুস্থতায় ভুগছিলেন, সেজন্য স্কুলে যেতে পারেননি। পরে সুস্থ হলে তিনি বাড়িতে পড়াশোনা করেন, তাই প্রথাগত শিক্ষা পাননি। [৩]

বিবাহ[সম্পাদনা]

তিনি সতেরো বছর বয়সে পূর্ব বর্ধমানের জবাগ্রামের মহারাণী কাশীশ্বরীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের তিন পুত্র ও চার কন্যা ছিল। জ্যেষ্ঠ দুই পুত্র মহিমচন্দ্র (১৮৮১ - ১৯০৬) ও কীর্তিচন্দ্র (১৮৮৫ - ১৯০৩) টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে অল্প বয়সে মারা যান। কাশিমবাজারের শ্রীশচন্দ্র নন্দী তাঁর ছোট ছেলে। তাঁর চার মেয়ে - সরোজিনী (১৮৮৯), কুমুদিনী (১৮৯৩), কমলিনী (১৯০০) ও মৃণালিনী (১৯০৬)। বড়ো দুই মেয়ে কম বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। [৩]

শিক্ষার প্রচারে অবদান[সম্পাদনা]

কৃষ্ণনাথ কলেজ[সম্পাদনা]

১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে, মণীন্দ্রচন্দ্রের মামা এবং মহারাণী স্বর্ণময়ীর স্বামী রাজা কৃষ্ণনাথ রায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে বহরমপুর কলেজটির নামকরণ করা হয় কৃষ্ণনাথ কলেজ। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে, কৃষ্ণনাথ কলেজের পরিচালনভার এক পরিচালনা পর্ষদের উপর অর্পিত হলে মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দী তার সভাপতি হন। তিনি কলেজটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বার্ষিক ৪৫,০০০ টাকা ব্যয় করেন। [৩][৪]

কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল[সম্পাদনা]

মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা ব্যয়ে বহরমপুর কলেজে কৃষ্ণনাথ কলেজ বিদ্যালয়ের জন্য এক সুবিশাল ভবন নির্মাণ করেন যাতে প্রতি বছর ১২০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনার সুযোগ পায়। বিদ্যালয় ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে এবং আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে। [৫]

বিভিন্ন স্কুল[সম্পাদনা]

মণীন্দ্রচন্দ্র বর্ধমানের মাথরুনে তার পৈতৃক গ্রামে ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি হোস্টেল সহ একটি ইংরেজি মাধ্যমের উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি শিক্ষাবিস্তারের জন্য অন্য গ্রামেও বিদ্যালয় স্থাপনে এবং কলকাতায় প্রতিবন্ধীদের জন্য মূক-বধির বিদ্যালয় স্থাপনে সহায়তা করেন। [৩]

বিভিন্ন কলেজ[সম্পাদনা]

তিনি ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে দ্য ক্যালকাটা মেডিকেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস অব বেঙ্গল নির্মাণের জন্য ১৫,০০০ টাকা দান করেন [৬] তিনি ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে দৌলতপুর কলেজের জন্য ৫ হাজার টাকা, রংপুর কলেজের জন্য ৫০,০০০ টাকা অনুদান হিসাবে দেন। এছাড়াও বনরস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২ লক্ষ টাকা, বসু বিজ্ঞান মন্দিরে ২ লক্ষ টাকা, বহরমপুর মেডিক্যাল স্কুল স্থাপনের জন্য ৪০ হাজার টাকা এবংবেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতিতেও বহুটাকা দান করেছেন। [৩]

সাহিত্য ও সঙ্গীতে অনুরাগ[সম্পাদনা]

সেসময় বাংলার সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতিও মহারাজার অকৃত্রিম অনুরাগ ছিল। তারই যত্নে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রচেষ্টায় বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন হয়। তারই প্রদত্ত হালশিবাগানে (আপার সার্কুলার রোডের উপর) জমির ওপর ও অর্থসাহায্যে পরিষদের ভবন নির্মিত হয়। [১]

মণীন্দ্র চন্দ্র বহরমপুর মিউজিক সোসাইটি স্কুল স্থাপন করেন এবং তিনি আচার্য রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীকে সেই সঙ্গীত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ করেন। পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীসহ বহু সঙ্গীতের দিকপালরা সেখানে সঙ্গীতশিক্ষা নেন। [৭] মণীন্দ্রচন্দ্র যেমন সাধারণ শিক্ষাবিস্তারের জন্য স্কুল, কলেজ স্থাপন করেছেন, তেমনই আয়ুর্বেদ পুনরুদ্ধার ও উন্নতির জন্য 'গোবিন্দসুন্দরী আয়ুর্বেদ বিদ্যালয়' শিল্প শিক্ষার জন্য কলকাতার বাগবাজারে পলিটেকনিক স্কুলও স্থাপন করেছিলেন। কলকাতার টাউন হলও তারই অর্থে নির্মিত।

রচিত গ্রন্থ[সম্পাদনা]

মহারাজা মণীন্দ্র চন্দ্রের রচিত গ্রন্থগুলি হল -

  • দ্য ইন্ডিয়ান মেডিসিনাল প্ল্যান্ট,
  • এ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান ফিলোজফি *ফান্ডামেন্টাল ইউনিটি অফ ইন্ডিয়া
  • হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান শিপিং অ্যান্ড ইন্ডিয়ান মেরিটাইম অ্যাক্টিভিটি [৩]

যে যে পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন[সম্পাদনা]

মণীন্দ্রচন্দ্র ১৯২২, ১৯২৩ এবং ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইম্পেরিয়াল আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি বহরমপুর পৌরসভা ও মুর্শিদাবাদ জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। [৩] তিনিবেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ছিলেন এবং পরে এর সভাপতিও হন। তিনি ছিলেন হিন্দু মহাসভার একজন সক্রিয় নেতা এবং সদস্য [৮]

পুরস্কার এবং সম্মান[সম্পাদনা]

মণীন্দ্রচন্দ্র ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে মহারাজার উপাধি লাভ করেন। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে নাইটহুড পেয়েছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ফেলো ছিলেন। [৩]

মৃত্যু[সম্পাদনা]

মহারাজা মণীন্দ্র চন্দ্র কিছুদিন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কাশিমবাজারেই ছিলেন। কিন্তু রোগমুক্তি না হওয়ায় তাঁকে কলকাতায় এনে ডাক্তার নীলরতন সরকারের চিকিৎসাধীনে রাখা হয়। কিন্তু ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই নভেম্বর (১১ নভেম্বর মধ্যরাত্রির পরে ১টা ২২ মিনিটে) তিনি প্রয়াত হন। তার মৃত্যুর পর কলকাতার টাউন হলে এক বিরাট শোকসভার আয়োজন করা হয়। সুভাষচন্দ্র বসু মর্মাহত হয়ে বলেন -

“বর্তমান রাজনীতির সঙ্গে মহারাজের তেমন ঘনিষ্ঠ ছিল না বটে, কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের যুগে সর্বপ্রথম বিদেশী বর্জ্জন সভার সভাপতিরূপে তাঁহার নাম চিরদিন মনে রাখিবে। মহারাজ দেশের সেবায় তাঁহার সর্ব্বস্ব দিয়া গিয়াছেন।”

[৯]

স্মৃতিসৌধ[সম্পাদনা]

কাশিমবাজারের শেষ মহারাজা, তার পুত্র শ্রীশচন্দ্র নন্দী কলকাতায় পিতার স্মৃতির উদ্দেশ্যে মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন ।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Sengupta, Subodhchandra; Bose, Anjali (২০১৬)। Samsad Bangali Charitabhidhan(Biographical dictionary)। Sahitya Samsad। পৃষ্ঠা 533। 
  2. Bhattacharya, Jagadish Chandra (১৯২৯)। Maharaja Manindra Chadra। পৃষ্ঠা 9। 
  3. Official website of Murshidabad Fire Dekha ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩০ জুন ২০২১ তারিখে, Biography of Maharaja Manindra Chandra Nandy
  4. Official website of Murshidabad Fire Dekha ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৬ মে ২০২১ তারিখে, History of Krishnath College
  5. Official website of Murshidabad Fire Dekha ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৬ জুন ২০১৮ তারিখে, History of Krishnath College School
  6. Official website of R. G. Kar Medical College and Hospital Batch 1982–1987 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৩ জুলাই ২০১৪ তারিখে, History of R. G. Kar Medical College and Hospital
  7. "Bishnupur Gharana travelled to Murshidabad"। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৫-০৩ 
  8. Najarula Isalāma (১ জানুয়ারি ২০০৫)। Son of the Soil। Viva Books। আইএসবিএন 978-81-309-3097-8 
  9. "পত্র-পত্রিকায় মণীন্দ্রচন্দ্রের প্রয়াণ-তর্পণ"। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৫-০৬