তড়িৎ প্রলেপন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
পিসিবির জন্য তামার তড়িৎ প্রলেপন যন্ত্র

তড়িৎ প্রলেপন করে কোন কঠিন বস্তুর ওপর ধাতুর প্রলেপ দেওয়া হয়। একমুখী বিদ্যুৎ প্রবাহ পাঠিয়ে ঐ ধাতুর ক্যাটায়নের বিজারন ঘটিয়ে প্রলেপন করা হয়। যেখানে প্রলেপ দেওয়া হবে সেটি একটি তড়িৎবিশ্লেষ্য বিশিষ্ট কোষের ক্যাথোড (ঋণাত্মক তড়িৎদ্বার) হিসাবে কাজ করে; তড়িৎবিশ্লেষ্য হল যে ধাতু দিয়ে প্রলেপ দেওয়া হবে, তার লবণের একটি দ্রবন; এবং অ্যানোড (ধনাত্মক তড়িৎদ্বার) হয় সাধারণত সেই ধাতুর একটি দণ্ড বা কোন নিষ্ক্রিয় পরিবাহী পদার্থের দণ্ড। একটি বহিস্থ শক্তি সরবরাহ থেকে সম্পূর্ণ বর্তনীতে তড়িৎ প্রবাহিত হয়।

শিল্পক্ষেত্রে এবং আলংকারিক শিল্পে, বস্তুর পৃষ্ঠতলের গুণাবলী উন্নত করতে, তড়িৎ প্রলেপন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে আছে ক্ষয় এবং জারণ থেকে রক্ষা। এছাড়া মসৃণতা, প্রতিফলন ক্ষমতা, বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা এবং দর্শনীয়তার বৃদ্ধির জন্য তড়িৎ প্রলেপন ব্যবহার করা হয়। এটি ছোট বা জরাজীর্ণ অংশগুলিতে পুরুত্ব বাড়ানোর জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। বৈদ্যুতিক অভিরূপন নামক একটি প্রক্রিয়ায় জটিল আকারের ধাতব পাত প্রস্তুত করতে এটি ব্যবহার করা হয়। এটি তামার মতো ধাতুকে পরিশুদ্ধ করতেও ব্যবহৃত হয়।

"তড়িৎ প্রলেপন" শব্দটি এমন কিছু প্রক্রিয়ার জন্য মাঝে মাঝে ব্যবহার করা যেতে পারে, যেখানে বৈদ্যুতিক প্রবাহ ব্যবহার করে একটি কঠিন বস্তুর অ্যানায়নগুলির জারণ ঘটানো হয়, যেমন রুপোর তারে সিলভার ক্লোরাইড জমা করে সিলভার/সিলভার ক্লোরাইড তড়িৎদ্বার সৃষ্টি।

বিদ্যুৎ মার্জন এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে বৈদ্যুতিক প্রবাহ ব্যবহার করে, কোনও ধাতব বস্তুর পৃষ্ঠতল থেকে ধাতব ক্যাটায়নগুলি সরিয়ে ফেলা হয়, এটি তড়িৎ প্রলেপনের বিপরীত হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।[১]

প্রক্রিয়া[সম্পাদনা]

তড়িৎ প্রলেপনের সরলীকৃত ছবি। পরিবাহী বস্তুতে (ঋণাত্মক তড়িৎদ্বার, "মি", ধূসর) তামার (কমলা রং) প্রলেপ। তড়িৎবিশ্লেষ্য হল কপার সালফেট, CuSO
4
দ্রবন। তামার ধনাত্মক তড়িৎদ্বার তামার ক্যাটায়ন Cu2+
দিয়ে তড়িৎ বিশ্লেষ্যটির ক্ষয় পূরণ করে, কারণ তড়িৎ বিশ্লেষ্যের তামা ঋণাত্মক তড়িৎদ্বারে প্রলিপ্ত হচ্ছে।

তড়িৎবিশ্লেষ্যের মধ্যে অবশ্যই যে ধাতুর প্রলেপ দেওয়া হবে তার ধনাত্মক আয়ন (ক্যাটায়ন) থাকতে হবে। এই ক্যাটায়নগুলি ঋণাত্মক তড়িৎদ্বারে বিজারিত হয় শূন্যযোজী অবস্থায়। উদাহরণস্বরূপ, তামার প্রলেপনের জন্য তড়িৎবিশ্লেষ্যটি কপার (II) সালফেটের দ্রবন হতে পারে, যেটি বিশ্লিষ্ট হয়ে Cu২+ ক্যাটায়ন এবং SO2−
4
অ্যানায়ন তৈরি করে। ঋণাত্মক তড়িৎদ্বারে, Cu২+ দুটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে ধাতব তামায় বিজারিত হয়।

যখন ধনাত্মক তড়িৎদ্বারটি লেপন করার ধাতু দিয়ে তৈরি করা হয়, সেখানে বিপরীত প্রতিক্রিয়া ঘটে, এটি দ্রবীভূত ক্যাটায়নে পরিণত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ধনাত্মক তড়িৎদ্বারে দুটি ইলেকট্রন হারিয়ে তামা জারিত হয়ে Cu২+ গঠন করে। এই ক্ষেত্রে, যে হারে ধনাত্মক তড়িৎদ্বার দ্রবীভূত হয়, সেই হারেই ঋণাত্মক তড়িৎদ্বার তড়িৎলিপ্ত হয় এবং এইভাবে তড়িৎবিশ্লেষ্যের আয়নের ক্ষয় ধনাত্মক তড়িৎদ্বার দ্বারা অবিচ্ছিন্নভাবে পুনরায় পূরণ করা হয়। মূল ফলাফলটি হল ধনাত্মক তড়িৎদ্বার থেকে ঋণাত্মক তড়িৎদ্বারে ধাতুর কার্যকর স্থানান্তর।[২]

এর পরিবর্তে ধনাত্মক তড়িৎদ্বারটি এমন কোনও উপাদানের দ্বারা তৈরি করা যেতে পারে যেটি তড়িৎরাসায়নিক জারণকে প্রতিহত করে, যেমন সীসা বা কার্বন। এই রকম ক্ষেত্রে ধনাত্মক তড়িৎদ্বারে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন পারক্সাইড বা অন্য কিছু উপজাত উৎপন্ন হয়। এক্ষেত্রে, যে ধাতব আয়নগুলি দিয়ে প্রলেপন চলছে সেগুলি তড়িৎবিশ্লেষ্য দ্রবণ থেকে বের হয়ে গেলে পুনরায় পর্যায়ক্রমে বাইরে থেকে পূরণ করতে হবে।[৩]

প্রলেপটি সাধারণত একটি একক ধাতব উপাদান হয়, কোন সংকর ধাতু নয়। তবে কিছু সংকর ধাতু তড়িৎলিপ্ত হতে পারে, যেমন পিতল এবং সোল্ডার। প্রলিপ্ত "সংকর ধাতু" প্রকৃত সংকর ধাতু, অর্থাৎ কঠিন দ্রবন নয়, বরং ধাতুর ছোট ছোট আকারের স্ফটিক, যারা প্রলিপ্ত হয়। প্রলিপ্ত সোল্ডারের ক্ষেত্রে, কখনও কখনও "প্রকৃত সংকর ধাতু" থাকা প্রয়োজন হয়ে পড়ে এবং ধাতব সোল্ডার গলে গিয়ে টিন এবং সীসাকে একত্রিত করে একটি প্রকৃত সংকর ধাতু তৈরি করে দেয়। এই ক্ষেত্রে প্রকৃত সংকর ধাতু প্রলিপ্ত সংকর ধাতুর চেয়ে বেশি ক্ষয় প্রতিরোধী।

অনেক প্রলেপের তড়িৎবিশ্লেষ্যে যে ধাতু দিয়ে প্রলেপন হবে তার সায়নাইড ছাড়াও অন্যান্য ধাতুর সায়নাইড থাকতে পারে (যেমন পটাশিয়াম সায়ানাইড)। এই মুক্ত সায়ানাইডগুলি ধনাত্মক তড়িৎদ্বারের ক্ষয় সহজতর করে, একটি ধ্রুবক ধাতব আয়ন স্তর বজায় রাখতে এবং প্রবাহে অবদান রাখতে সহায়তা করে। অতিরিক্তভাবে, পরিবাহিতা বাড়ানোর জন্য কার্বনেট এবং ফসফেটের মতো ধাতুবিহীন রাসায়নিকগুলি যুক্ত হতে পারে।

বস্তুটির নির্দিষ্ট কয়েকটি অঞ্চলে প্রলেপ বাঞ্ছনীয় না হলে, সেই অঞ্চলগুলি যাতে তড়িৎবিশ্লেষ্যের সংস্পর্শে আসতে বাধা পায়, সে জন্য সেখানে কিছু বাধক প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত বাধকগুলির মধ্যে ব্যবহার হয় ফিতা, তবক, বার্ণিশ এবং মোম[৪]

কোন প্রলেপের সমানভাবে প্রলিপ্ত করার ক্ষমতাটিকে বলা হয় নিক্ষেপ শক্তি; নিক্ষেপ শক্তি যত ভাল হয়, প্রলেপ তত সমান আকারের হয়।[৫]

ধারক[সম্পাদনা]

প্রাথমিকভাবে, ধারক বা ঝলক নামে পরিচিত একটি বিশেষ ধরনের উচ্চতর মানের প্রলেপ ব্যবহার করা হয় যেগুলি খুব পাতলা প্রলেপ (সাধারণত ০.১ মাইক্রো মিটারের থেকে কম পুরু)। এই প্রলেপগুলির প্রলিপ্ত স্তরের সাথে ভাল সংসক্তি থাকে। এটি পরবর্তী প্রলেপ প্রক্রিয়াগুলির জন্য ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। এই ধারক উচ্চ ঘনত্বের তড়িৎ প্রবাহ ব্যবহার করে এবং এর তড়িৎবিশ্লেষ্যের ঘনত্ব কম হয়। প্রক্রিয়া ধীরলয়ে এগোয়, তাই, কাঙ্ক্ষিত ধারক বেধ পাওয়ার পরে, পরবর্তী পর্যায়ে আরও দক্ষ প্রলেপ প্রক্রিয়াগুলি ব্যবহৃত হয়।

ধারক পদ্ধতিটি বিভিন্ন ধাতুর প্রলেপের সমাহারে একত্রেও ব্যবহৃত হয়। ক্ষয় প্রতিরোধের উন্নতি করতে যদি ধাতুতে এক ধরনের উপাদানের প্রলেপ করা বাঞ্ছনীয় হয়, অথচ সেই প্রলেপটির এই ধাতুর সাথে সহজাতভাবে সংসক্তি কম হয়, একটি ধারক প্রথমে প্রলেপ দেওয়া যেতে পারে যা উভয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই পরিস্থিতির একটি উদাহরণ হল দস্তা সংকর ধাতুতে নিকেল তড়িৎবিশ্লেষ্যের কম সংসক্তি। এই ক্ষেত্রে একটি তামা ধারক ব্যবহার করা হয়, যার উভয়ের সঙ্গে ভাল সংসক্তি রয়েছে।[৩]

আরো দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. https://www.electro-glo.com/faqs/
  2. Dufour 2006, পৃ. IX-1।
  3. Dufour 2006, পৃ. IX-2
  4. Dufour 2006, পৃ. IX-3
  5. "Pollution Prevention Technology Profile Trivalent Chromium Replacements for Hexavalent Chromium Plating" (পিডিএফ)। Northeast Waste Management Officials’ Association। ২০০৩-১০-১৮। ২০১১-০৭-২০ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। 

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]