মরুজ বার্নিশ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মধ্য অস্ট্রেলিয়ায় মরুবর্ত্মের উপরে মরুজ বার্নিশ

মরুজ বার্নিশ বা শিলা বার্নিশ হলো শুষ্ক পরিবেশে উন্মুক্ত শিলা পৃষ্ঠের উপর তৈরি হওয়া কমলা-হলুদ থেকে কালো রঙের আবরণ। মরুজ বার্নিশ প্রায় এক মাইক্রোমিটার পুরু এবং ন্যানোমিটার ক্রমের স্তর প্রদর্শন করে।[১] এর অপর নাম শিলা মরিচা বা মরুজ প্যাটিনা, তবে এগুলো কম ব্যবহৃত হয়।

উৎপত্তি[সম্পাদনা]

মরুজ বার্নিশ কেবল গঠনগতভাবে দৃঢ় ও উন্মুক্ত পাথরের পৃষ্ঠে উৎপন্ন হয়, যা ঘন ঘন বৃষ্টিপাত, ভাঙন বা অত্যধিক বায়ুপ্রবাহের সম্মুখীন হয় না। এটি মূলত লোহা ও ম্যাঙ্গানিজের অক্সাইডসমূহের সাথে মাটির কণার সমন্বয়ে গঠিত হয়।[২] এছাড়াও এতে প্রায় সবসময় কিছু জৈব পদার্থও থাকে। মরুজ বার্নিশের রং হালকা বাদামি থেকে কালচে হতে পারে।[৩]

মরুজ বার্নিশ কোনো "ছায়া জীবমণ্ডল" এর সম্ভাব্য সদস্য কিনা তা জানার জন্য বেশ কিছু গবেষণা চালানো হয়েছে।[৪][৫] তবে ২০০৮ সালে পরিচালিত একটি আণুবীক্ষণিক গবেষণায় দেখা গেছে, মরুজ বার্নিশ ইতোমধ্যে রাসায়নিকভাবে গবেষণাগারে প্রস্তুত করা হয়েছে। এর সাথে জীবনের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই এবং মূল উপাদানটি আসলে মাটি নয়, বরং সিলিকা। গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, মরুজ বার্নিশ অণুজীবের জীবাশ্ম নির্ণয়ে এবং পানির উপস্থিতি নির্দেশক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ধারণা করা হয়, মঙ্গল গ্রহে রোভাররা মরুজ বার্নিশ পর্যবেক্ষণ করেছে এবং পরীক্ষা করা হলে এতে মঙ্গল গ্রহের আর্দ্রকালীন সময়কার অশ্মীভূত জীবনের অস্তিত্ব মিলতে পারে।[৬]

গঠন[সম্পাদনা]

বিশপ টাফের উপর মরুজ বার্নিশ

প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, মরুজ বার্নিশ যে পাথরের পৃষ্ঠে তৈরি হয় তার ভিতরের বিভিন্ন উপাদান থেকেই এই বার্নিশের উৎপত্তি।[৭] কিন্তু আণুবীক্ষণিক ও অণুরাসায়নিক পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়, বার্নিশের একটি বড় অংশই কাদামাটি যা কেবল বায়ুপ্রবাহের কারণে জমা হতে পারে।[৮] কাদামাটি একটি সাবস্ট্রেট হিসেবে বিভিন্ন পদার্থকে আটকে রাখে। মরুভূমিতে সূর্যের অত্যধিক তাপে পাথরের তাপমাত্রা যখন অনেক বেশি হয়, তখন এসব পদার্থের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। রাত ও ভোরের দিকে যখন শিশির পড়ে, তখনও প্রক্রিয়াটিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়।[৩]

মরুভূমির কালো রঙের বার্নিশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো- এটিতে ম্যাঙ্গানিজের অস্বাভাবিক উচ্চ ঘনত্ব রয়েছে। পৃথিবীর ভূত্বকের উপাদান হিসেবে ম্যাঙ্গানিজ তুলনামূলকভাবে বিরল, এর পরিমাণ মাত্র ০.১২%। কিন্তু মরুভূমির কালো বার্নিশে ম্যাঙ্গানিজের পরিমাণ ৫০ থেকে ৬০ গুণ বেশি থাকে। মরুজ বার্নিশ গঠনের পদ্ধতি সম্পর্কে একটি প্রস্তাবনা হলো-[৯] এটি ম্যাঙ্গানিজ-অক্সিডাইজিং অণুজীবের (মিক্সোট্রফ্স) মাধ্যমে তৈরি হয়। এসব অণুজীব জৈব পুষ্টি উপাদানের অভাব আছে এমন পরিবেশে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। তবে মাইক্রো-পরিবেশে পিএইচ মাত্রা ৭.৫ এর বেশি হলে, ম্যাঙ্গানিজ একত্রকারী অণুজীবসমূহের জন্য তা প্রতিকূল হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে কমলা রঙের বার্নিশ বিকাশ লাভ করে, যেগুলোতে ম্যাঙ্গানিজের (Mn) পরিমাণ কম তবে লোহা (Fe) বেশি।[১০] ম্যাঙ্গানিজ ও লোহার মাত্রা ওঠানামার বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য একটি বিকল্প অনুকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ম্যাঙ্গানিজ সমৃদ্ধ বার্নিশ সম্ভবত আর্দ্র পরিবেশে এবং লোহা সমৃদ্ধ বার্নিশ শুষ্ক পরিবেশে বেশি জন্মায়।[১১]

নেভাদার লাস ভেগাসের কাছে অবস্থিত ভ্যালি অফ ফায়ারে মরুজ বার্নিশের খোদাই। এক মিটার জায়গা দেখানো হয়েছে।

মরুজ বার্নিশে লোহা এবং ম্যাঙ্গানিজের উচ্চ ঘনত্ব থাকলেও এর কোনো উল্লেখযোগ্য আধুনিক ব্যবহার নেই। তবে কিছু স্থানীয় আমেরিকান লোক গুহার গায়ের মরুজ বার্নিশ প্রয়োজনমতো ঘষে অন্তর্নিহিত পাথর উন্মোচনের মাধ্যমে পেট্রোগ্লাইফ তৈরি করে।

মরুভূমির বার্নিশ প্রায়ই অন্তর্নিহিত পাথরটির উপস্থিতি অস্পষ্ট করে ফেলে। বিভিন্ন পাথরের বার্নিশ উৎপাদন এবং ধরে রাখার ক্ষমতা বিভিন্ন রকম। উদাহরণস্বরূপ, চুনাপাথরে সাধারণত বার্নিশ থাকে না, কারণ এগুলো পানিতে খুবই দ্রবণীয় এবং তাই বার্নিশ গঠনের জন্য স্থিতিশীল পৃষ্ঠ সরবরাহ করতে পারে না। পক্ষান্তরে, তুলনামূলকভাবে বিরূপ আবহাওয়া সহনশীল ও উচ্চ প্রতিরোধসম্পন্ন হওয়ায় ব্যাসল্ট, সূক্ষ্ম কোয়ার্টজাইটস এবং রূপান্তরিত শিলায় চকচকে, ঘন এবং কালো রঙের বার্নিশ তৈরি হয়।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. David Krinsley, Ronald Dorn, N. K. Tovey 1995. Nanometer-Scale Layering in Rock Varnish: Implications for Genesis and Paleoenvironmental Interpretation, The Journal of Geology, 103(1): 106–113
  2. Perry, R.S. and Adams, J.B. 1978. Desert varnish: evidence for cyclic deposition of manganese. Nature 276(5687):489–491.
  3. Chernicoff, Stanley and Whitney, Donna 2007. Geology: An Introduction to Physical Geology 4th ed. Pearson Education p. 585
  4. Cleland, C.E. (2007) Epistemological issues in the study of microbial life: alternative biospheres. Studies in the History and Philosophy of Biological and Biomedical Sciences 38:847–861.
  5. "Life on Earth… but not as we know it", Robin McKie, 14 April 2013, The Guardian
  6. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১২ মার্চ ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ 
  7. Blake, W.P. 1905. Superficial blackening and discoloration of rocks especially in desert regions. Transactions of the American Institute of Mining Engineers 35:371–375.
  8. Potter, R.M. and Rossman, G.R. 1977. Desert varnish: the importance of clay minerals. Science 196(4297):1446–1448.
  9. The Photocatalytic Reactions of Desert Varnish, Lacie Johnson (Carrick Eggleston), 2013, [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে
  10. Dorn, R.I. and Oberlander, T.M. 1981. Microbial origin of desert varnish. Science 213:1245–1247.
  11. Tanzhuo Liu and Ronald I. Dorn 1996. Understanding the Spatial Variability of Environmental Change in Drylands with Rock Varnish Microlaminations. Annals of the Association of American Geographers 86(2): 187–212.

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]