বাবা বড় কাছারি মন্দির

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বাবা বড় কাছারি মন্দির

বাবা বড় কাছারী মন্দির হল গ্রামবাংলার লৌকিক ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসে প্রতিষ্ঠা পাওয়া হিন্দুদের পূজার্চনার স্থল। পরমেশ্বর শিব এখানে পূজিত হন।[১] বর্তমানে এটি স্থানীয় মানুষের গ্রামীণ জীবনচর্যায় এক বিশেষ স্থান অর্জন করেছে। এটি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বিষ্ণুপুর থানার বাখরাহাটের নিকটস্থ ঝিকুরবেডিয়া গ্রামে অবস্থিত। মহানগর কলকাতা হতে সড়কপথে ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।

পটভূমি[সম্পাদনা]

গ্রামবাংলার লৌকিক দেবদেবীর অন্ত নেই। গ্রামের পথেঘাটে, বিশাল প্রান্তরে, শস্যক্ষেত্রে অথবা জটাজুটধারী কোন বটবৃক্ষতলে আসন পাতেন গ্রামের এইসব দেবদেবীরা। পুরাণবর্ণিত দেবদেবীর তালিকায় হয়তো এঁদের দেখতে পাওয়া যাবে না। কোথাও এঁরা সাড়ম্বরে প্রতিষ্ঠিত আবার কোথাও বা সমাজের নিম্নস্তরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে প্রবেশ করে স্থানীয় রীতিতে পূজার্চনায় নানা জাতীয় বিশ্বাসে ও সংস্কারে প্রতিষ্ঠালাভ করে থাকেন। পরে উচ্চবর্ণের মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে ব্রাহ্মণ পুরোহিতের পূজার্চনার মধ্য দিয়ে সেই লৌকিক দেবদেবীর পৌরাণিকত্ব প্রাপ্তি ঘটে। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল বাবা বড় কাছারির মন্দিরের ক্ষেত্রে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এই ঝিকুরবেডিয়া গ্রামটি এক সময় গোবিন্দপুর-সুতানুটির জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের তালুকের অন্তর্গত ছিল। জনশ্রুতি হল - বহু বছর আগে এখানে এক জঙ্গলের মাঝে এক শ্মশান ছিল। এই শ্মশানে নাকি গভীর রাতে স্বয়ং শিবশম্ভু ভূতনাথ বেশে বিচার সভা বসাতেন। সেকারণে স্থানটিকে অনেকে এখনো ভূতের কাছারিও বলেন। আর যেহেতু সে বিচার ভূতনাথরূপী শিবের দরবারে, সুতরাং তার বিচারই সর্বশ্রেষ্ঠ।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

মন্দির স্থাপনার প্রকৃত সময় আর কেনই বা মানুষের এই মন্দিরের প্রতি ধর্মবিশ্বাস তার সম্পর্কিত তথ্য সবই স্থানীয় মানুষের মধ্যে বংশানুক্রমে যা শ্রুত তাহাই। তবে অধিক প্রচলিত কাহিনীটি হল ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে নবাব আলীবর্দী খানের শাসনামলে বাংলায় আক্রমণকারী মারাঠাদের অত্যাচার ও হামলা হয়। সেই হামলা হতে বাঁচতে এই অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন প্রধানত কৃষককুল, শ্মশান সংলগ্ন জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। কিছুকাল পরে এক সাধু ব্যক্তি শ্মশানের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় কিছুদিন শ্মশানে আশ্রয় নেন। জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া মানুষেরা বিভিন্ন সময়ে তার কাছে এসে তাদের নানান অসুবিধা, অসুস্থতার কথা বলত এবং তিনি সাফল্যের সাথে সেগুলির প্রতিকারের ব্যবস্থা করতেন, উপদেশ দিতেন। নানাভাবে উপকৃত হতে থাকেন স্থানীয়েরা। ফলস্বরূপ, বাকসিদ্ধ সেই সাধু পুরুষ তাদের কাছে ভূতনাথের প্রতিভূ হিসাবে গণ্য হতে থাকেন । পরে মারাঠাদের সঙ্গে নবাবের শান্তি স্থাপনের পর বাংলার অন্যান্য স্থানের সাথে এ অঞ্চলের প্রভূত উন্নতি হয়। হঠাৎ কোন এক সময় সেই সাধুর মৃত্যু হলে, তার মরদেহ না পুডিয়ে সেই শ্মশানে সমাধিস্থ করে ভক্তগণ। পরে সেই সমাধিক্ষেত্র হতে এক অশ্বত্থ গাছ জন্মায়। স্থানীয়েরা তখন ওই অশ্বত্থ গাছকে সাধুর প্রতিমূর্তি হিসাবে মান্য করতে থাকে আর সেই বৃক্ষতলে পূজার্চনার স্থান হয় শিবলিঙ্গের। মানুষজন তাদের মনস্কামনা গাছটির কাছে জানালে অদ্ভুতভাবে পূরণ হতে থাকে। আর সেই বিশ্বাসে ভর করেই স্থানটির মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের বন্যায় অশ্বত্থ গাছটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। ভক্তদের ইচ্ছানুসারে এক নতুন অশ্বত্থ গাছ বসানো হয় এবং তার তলে এক গোলাকার বেদী নির্মাণ করে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এইটি বাবা বড় কাছারির মন্দিরে পরিণত হয়েছে।

পূজার প্রচলিত রীতি[সম্পাদনা]

প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বেশ ধুমধাম সহ পূজা হয়। বহু দূরদূরান্ত হতে ভক্তমানুষেরা আসেন নিজের নিজের মনস্কামনা নিয়ে পুজো দিতে। তারা এক ছোট্ট কাগজে তাদের প্রার্থনা দরখাস্তের আকার লিখে মন্দিরের গায়ে বেঁধে দেন। দুঃখকষ্ট লাঘব হয়, মনোবাঞ্ছাও পূরণ হয়। জনসমাগম বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ আসেন পুজো দিতে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন দপ্তরের আর্থিক সহায়তায় মন্দিরের প্রবেশদ্বারে একটি তোরণ নির্মাণ সহ সংস্কারের কাজ স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। আসল পূজাস্থান তথা মন্দিরটি সামান্য বেদী বা মঞ্চের আকারে হলেও তোরণটি নির্মাণে বাংলার চার চালা স্থাপত্য রীতি ব্যবহার করা হয়েছে।[২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]