প্রাণীবৈজ্ঞানিক ভূগোল

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ওয়ালেসের প্রাণীভৌগোলিক অঞ্চলসমূহ, ১৮৭৬

প্রাণীবৈজ্ঞানিক ভূগোল (ইংরেজিতেঃ Zoogeography) হচ্ছে জীব-ভূগোল বিজ্ঞানের একটি শাখা, যা প্রাণির প্রজাতিসমূহের ভৌগোলিক বিস্তারের (বর্তমানের এবং অতীতের) সাথে সংশ্লিষ্ট।[১]

গবেষণার বহুমুখী ক্ষেত্র হিসেবে, প্রাণীবৈজ্ঞানিক ভূগোলে বিশ্বব্যাপী অধ্যয়নের নির্দিষ্ট অঞ্চলসমূহে ঘটতে থাকা বিবর্তনীয় ঘটনাবলিকে চিত্রায়িত করার জন্য আণবিক জীববিজ্ঞান, জেনেটিক্স, অঙ্গসংস্থান, জাতিজনি এবং ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থার (জিআইএস) মত বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রাণীবৈজ্ঞানিক ভূগোল, এর জনক হিসেবে পরিচিত আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস দ্বারা প্রস্তাবিত হয়েছিল। জাতিজনিক সম্বন্ধগুলো প্রাণীভৌগোলিক অঞ্চলসমূহে পরিমাপ করা যায়, যার ফলে জীবের ভৌগোলিক বিস্তারের চারপাশে ব্যাপারটি আরও সুস্পষ্ট হয় এবং ট্যাক্সার বিবর্তনীয় সম্পর্কের ব্যাখ্যা দেয়।[২]

প্রাণিবিদ্যা বিষয়ক গবেষণাতে আণবিক জীববিজ্ঞান এবং বিবর্তন তত্ত্বের অগ্রগতি প্রজাত্যায়ন প্রক্রিয়া সংক্রান্ত বহু প্রশ্নের সমাধান দিয়েছে এবং ট্যাক্সার মধ্যে জাতিজনিক সম্পর্ককে প্রসারিত করেছে।[৩] জিআইএস এর সাথে ফাইলেজেনটিক্স যোগ করে কার্টোগ্রাফিক ডিজাইনের মাধ্যমে বিবর্তনীয় উৎসের সাথে যোগাযোগ করার জন্য একটি উপায় বের করা যায়। ফাইলেজেনটিক্স এবং জিআইএস-এর সাথে সংযুক্ত এজাতীয় গবেষণা দক্ষিণ আটলান্টিক, ভূমধ্যসাগরীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসমূহে পরিচালিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ডিএনএ বার-কোডিংয়ের সাম্প্রতিক উদ্ভাবনগুলোর ফলে আন্দামান সাগরে বাসকারী 'স্কর্পিনিডা' এবং 'টেট্রাওডোন্টিডা' নামের সামুদ্রিক বিষাক্ত মাছের দুটি পরিবারের মধ্যে ফাইলেজেনেটিক সম্পর্কের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়েছে।[৪] ভূমধ্যসাগরীয় এবং প্যারাটিথিস অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের কিলিফিশের (Aphanius এবং Aphanolebias) জীবাশ্ম রেকর্ডের উপর ভিত্তি করে ভূতাত্ত্বিক সময়কালে নিবদ্ধ প্রজাতি সমূহের বিবর্তনীয় বিচ্যুতি বোঝার জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালানোর ফলে মায়োসিন পিরিয়ডে জলবায়ুর প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়েছে।[৫] দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চলের বংশবিস্তার এবং সমজাতীয় অঞ্চলে জীবের বণ্টন সম্পর্কিত জ্ঞান, পরিবেশগত এবং ভৌগোলিক উভয় প্রকার উপাত্তের উপর নির্ভর করে প্রাণীবৈজ্ঞানিক ভূগোল সংক্রান্ত গবেষণা আরও বিস্তৃত হয়েছে।[৬]

আধুনিক যুগের প্রাণীবৈজ্ঞানিক ভূগোল সামুদ্রিক এবং স্থলচর উভয় প্রকার প্রাণী প্রজাতি সমূহের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জনসংখ্যার গতিশীলতা সম্পর্কে আরও সুনির্দিষ্ট ধারণা এবং ভবিষ্যদ্বাণীমূলক মডেলকে সংহত করার জন্য জিআইএসের উপর নির্ভর করে। জিআইএস প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ভূসংস্থান, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, তাপমাত্রা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের মতো আবাসের অজৈব নিয়ামকগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করার মাধ্যমে ভূতাত্ত্বিক সময়ের ভিতরে প্রজাতি জনসংখ্যার বিস্তার ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। বাস্তুসংস্থানের প্রভাবে জীবের আবাস গঠন এবং অভিপ্রায়ণের বিন্যাসের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝতে পারলে, ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা সংক্রান্ত ঘটনাবলি কিংবা প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য নতুন আশ্রয়স্থল গ্রহণের কারণে উদ্ভূত প্রজাত্যায়নের ঘটনাবলির ব্যাখ্যা প্রদান করা যায়।[৭]   

জুজিওগ্রাফিক অঞ্চলসমূহ[সম্পাদনা]

শ্মারদা (১৮৫৩) ২১ টি অঞ্চল প্রস্তাব করেছিলেন,[৮][৯] উডওয়ার্ড প্রস্তাব করেছিলেন ২৭ টি স্থলজ এবং ১৮ টি সামুদ্রিক,[১০] মারে (১৮৬৬) প্রস্তাব করেছিলেন ৪ টি,[১১] ব্লাইথ (১৮৭১) করেছিলেন ৭ টি,[১২] অ্যালেন (১৮৭১) ৮ টি অঞ্চল,[১৩] হিলপ্রিন (১৮৭১) প্রস্তাব করেছিলেন ৬ টি,[১৪] নিউটন (১৮৯৩) ৬ টি,[১৫] গ্যাডো (১৮৯৩)প্রস্তাব করেছিলেন ৪ টি।[১৬]   

ফিলিপ স্ল্যাটার (১৮৫৮) এবং আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস (১৮৭৬)) বর্তমানে প্রচলিত বিশ্বের প্রধান চারটি জুজিওগ্রাফিক অঞ্চল শনাক্ত করেছিলেন: প্যালিআর্কটিক, ইথিওপিয়ান (বর্তমানে আফ্রোট্রপিক), ভারত (বর্তমানে ইন্দো-মালয়), অস্ট্রেলেশীয়, নিআর্কটিক এবং নিওট্রপিক্যাল[১৭][১৮][১৯][২০][২১]   

অর্টম্যান (১৮৯৬) এর মাধ্যমে সামুদ্রিক আঞ্চলিকীকরণ শুরু হয়েছিল।[২২][২৩]  

উদ্ভিদভৌগোলিক বিভাগগুলোর মতো একই উপায়ে, পৃথিবী জুজিওগ্রাফিক (প্রাণীকুল) অঞ্চলে বিভক্ত (এছাড়াও প্রদেশ, অঞ্চল এবং জেলা হিসাবে বিভক্ত), কখনও কখনও সাম্রাজ্য এবং ডোমেন বিভাগ সহ।  

বর্তমানে উদ্ভিদকুল বা প্রাণীকুলের অঞ্চলসমূহকে জীবভৌগোলিক অঞ্চলসমূহে শ্রেণীভুক্ত করার একটা প্রবণতা দেখা যায়।  

নিচে আঞ্চলিকীকরণের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হল:

স্ল্যাটার (১৮৫৮)[সম্পাদনা]

Creatio Palaeogeana (ক্রিয়েটিও প্যালিওজিয়ানা)

  • I. Regio Palaearctica
  • II. Regio Aethiopica
  • III. Regio Indica
  • IV. Regio Australiana

Creatio Neogeana (ক্রিয়েটিও নিওজিয়ানা)

  • V. Regio Nearctica
  • VI. Regio Neotropica

হাক্সলি (১৮৬৮)[সম্পাদনা]

হাক্সলি (১৮৬৮) ক্রমবিন্যাস:[২৪]

  • আর্ক্টোজিয়া
    • নিআর্কটিক প্রদেশ
    • প্যালিআর্কটিক প্রদেশ
    • ইথিওপীয় প্রদেশ
    • ভারতীয় প্রদেশ
  • নোটোজিয়া
    • অস্ট্রো-কলম্বিয়া প্রদেশ (= নিওট্রপিকাল)
    • অস্ট্রেলেশীয় প্রদেশ (= অস্ট্রেলীয়; পূর্ব প্যালিওট্রপিকাল)

ওয়ালেস (১৮৭৬)[সম্পাদনা]

  • প্যালিআর্কটিক অঞ্চল
  • ইথিওপীয় অঞ্চল
  • ওরিয়েরন্টাল অঞ্চল
  • অস্ট্রেলীয় অঞ্চল
  • নিওট্রপিকাল অঞ্চল
  • নিআর্কটিক অঞ্চল

ট্রুসা (১৮৯০)[সম্পাদনা]

ট্রুসার ক্রমবিন্যাস (1890):[২৫]

  • সুমেরু অঞ্চল
  • কুমেরু অঞ্চল
  • প্যালিআর্কটিক অঞ্চল
  • নিআর্কটিক অঞ্চল
  • ইথিওপীয় অঞ্চল
  • ওরিয়েরন্টাল অঞ্চল
  • নিওট্রপিকাল অঞ্চল
  • অস্ট্রেলীয় অঞ্চল

ডার্লিংটন (১৯৫৭)[সম্পাদনা]

প্রথম ক্রমবিন্যাস:

  • মেগাজিয়া ক্ষেত্র: বিশ্বের মূল ভূখণ্ড
    • 1. ইথিওপীয় অঞ্চল: আফ্রিকা (উত্তর কোণ ব্যতীত), আরবের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু অংশ সহ
    • 2. ওরিয়েরন্টাল অঞ্চল: ক্রান্তীয় এশিয়া, আনুষঙ্গিক মহাদেশীয় অঞ্চল সহ
    • 3. প্যালিআর্কটিক অঞ্চল: ক্রান্তীয় অঞ্চলের উপরের ইউরেশিয়া,আফ্রিকার উত্তর কোণ সহ
    • 4. নিআর্কটিক অঞ্চল: উত্তর আমেরিকা, মেক্সিকোর ক্রান্তীয় অঞ্চল ব্যতীত
  • নিওজিয়া ক্ষেত্র
    • 5. নিওট্রপিকাল অঞ্চল: মেক্সিকোর ক্রান্তীয় অঞ্চল সহ দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা
  • নোটোজিয়া ক্ষেত্র
    • 6. অস্ট্রেলীয় অঞ্চল: অস্ট্রেলিয়া, নিউ গিনি সহ, প্রভৃতি

দ্বিতীয় ক্রমবিন্যাস:

  • জলবায়ু-সীমাবদ্ধ অঞ্চলসমূহ
    • 1. প্যালিআর্কটিক
    • 2. নিআর্কটিক অঞ্চল
  • পুরান বিশ্বের গ্রীষ্মমণ্ডলের প্রধান অঞ্চলসমূহ
    • 3. ওরিয়েরন্টাল অঞ্চল
    • 4. ইথিওপীয় অঞ্চল
  • বাধা-সীমাবদ্ধ অঞ্চলসমূহ
    • 5. নিওট্রপিকাল অঞ্চল
    • 6. অস্ট্রেলীয় অঞ্চল

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Darlington, P.J., Jr. 1957. Zoogeography: The Geographical Distribution of Animals. New York, "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি" (পিডিএফ)। ২০১৮-০৮-১৩ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৪ .
  2. Holt, B. G., et al. (2013). An update of Wallace’s zoogeographic regions of the world. Science, vol. 339, no. 6115, pp. 74-78.
  3. Taylor, E. B., McPhail, J.D., 1998. Evolutionary history of an adaptive radiation species in pairs of threespine sticklebacks (Gasterosterus): insights from mitochondrial DNA. Biological Journal of the Linnean Society. 66: 271-291.
  4. Sachithanandam, V., Mohan, P.M., Muruganandam, N., 2015. DNA barcoding of marine venomous and poisonous fish of families Scorpaenidae and Tetraodontidae from Andaman waters. Ecology and Conservation: 351-372.
  5. Reichenbacher, B., Kowalke, T., 2009. Neogene and present-day zoogeography of killifishes (Aphanius and Aphanolebias) in the Mediterranean and Paratethys areas. Palaeogeography, Palaeoclimatology, Palaeoecology. 281: 43-56.
  6. Fiege, D., Ramey, P.A., Ebbe, B., 2010. Diversity and distributional patterns of Polychaeta in the deep South Atlantic. Deep-Sea Research I.57:1329-1344.
  7. Taylor, E. B., McPhail, J.D., 1998. Evolutionary history of an adaptive radiation species in pairs of threespine sticklebacks (Gasterosterus): insights from mitochondrial DNA. Biological Journal of the Linnean Society. 66: 271-291.Palumbi, S.R., 1996. What can molecular genetics contribute to marine biogeaography? An urchin’s tale. Journal of Experimental Marine Biology and Ecology. 203: 75-92.
  8. Schmarda L. K. 1853. Die geographische Verbreitung der Tiere. Wien, Gerold und Sohn, .
  9. Ebach, M.C. (2015). Origins of biogeography. The role of biological classification in early plant and animal geography. Dordrecht: Springer, xiv + 173 pp., .
  10. Woodward, Samuel Pickworth. A Manual of the Mollusca; or a Rudimentary Treatise of Recent and Fossil Shells. 3 parts. London, 1851-56, .
  11. Murray, A. 1866. The Geographical Distribution of Mammals. London: Day and Son, .
  12. Blith, E. (1871): A suggested new division of the earth into zoological regions. Nature 3: 427
  13. Allen, J. A. 1871. On the mammals and winter birds of East Florida. Bulletin of the Museum of Comparative Zoology 2:161–450.
  14. Heilprin, A. 1887. The geographical and geological distribution of animals. New York: Appleton, .
  15. Newton, A. (1893). Article on Geographical Distribution in the Dictionary of Birds, p. 311. London, .
  16. Gadow, H. 1893. Vögel. II. Systematischer Theil. In H. G. Bronn (ed.), Klassen und Ordnungen des Thier-Reichs, vol. 6. Leipzig: C. F. Winter, .
  17. Holt, B. G., et al. (2013). An update of Wallace’s zoogeographic regions of the world. Science, vol. 339, no. 6115, pp. 74-78.
  18. Sclater, P.L. (1858). On the general geographical distribution of the members of the class Aves. J. Proc. Linnean Soc. Zool. 2: 130–145, .
  19. Wallace A.R. 1876. The geographical distribution of animals. Macmillan, London, .
  20. Cox, C. B. (2001). The biogeographic regions reconsidered. Journal of Biogeography, 28: 511-523, .
  21. Cox, C. B., Moore, P.D. & Ladle, R. J. 2016. Biogeography: an ecological and evolutionary approach. 9th edition. John Wiley & Sons: Hoboken, p. 12, .
  22. Morrone, J. J. (2009). Evolutionary biogeography, an integrative approach with case studies. Columbia University Press, New York, .
  23. Ortmann, A.E. (1896). Grundzüge der marinen Tiergeographie. Jena: Gustav Fischer, .
  24. Huxley, T.H. 1868. On the classification and distribution of the Alectoromorphae and Heteromorpha. Proceedings of the Zoological Society of London 1868: 294-319, .
  25. Trouessart, E. L. (1890). La géographie zoologique. Bailliere, Paris, .