সিঙ্গাপুরে জাপানি দখলদারিত্ব

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
Syonan or Shonan
জাপানি নাম
কাঞ্জি 昭南
হিরাগানা しょうなん
কিউজিতাই 昭南
১৯৪৫ সালে সিঙ্গাপুর
জাপানি লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়ামাশিতা'র (বসা, বাঁ থেকে তৃতীয়) কাছে ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট জেনারেল পার্সিভাল (ডান থেকে দ্বিতীয়তে বসা, ক্যামেরার দিকে পেছন ফিরে) কর্তৃক সিঙ্গাপুর সমর্পণ

শোনান্‌ (ইংরেজি: Syonan; জাপানি: 昭南; হেপবার্ন: Shōnan), আনুষ্ঠানিকভাবে শোনান্‌তো (ইংরেজি: Syonanto; জাপানি: 昭南島; হেপবার্ন: Shōnan-tō) ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সিঙ্গাপুরের নাম, যখন জাপান সাম্রাজ্য ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর পতন ও আত্মসমর্পণের পর, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ তারিখে শহরটির দখল ও কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়।

সিঙ্গাপুরের যুদ্ধে ব্রিটিশ, ভারতীয়, অস্ট্রেলীয়, এবং মালয়ী যৌথবাহিনীকে পরাজিত করে জাপানি সামরিক বাহিনী শহরটির দখল নেয়। সিঙ্গাপুর দখল পরবর্তীকালে জাপান, ব্রিটেন, এবং সিঙ্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি দেশের ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। সিঙ্গাপুরের নাম বদলে রাখা হয় শোনান্‌তো, যার অর্থ “দক্ষিণ দ্বীপের আলো” এবং একে বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া সহ-সমৃদ্ধি বলয় (ইংরেজি: Greater East Asia Co-Prosperity Sphere; জাপানি: 大東亜共栄圏; হেপবার্ন: Dai Tōa Kyōeiken) এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[১][২]

১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ তারিখে তৎকালীন পৌর ভবনে (বর্তমানে সিটি হল) আনুষ্ঠানিক অস্ত্র সমর্পণের পর, সিঙ্গাপুর পুনরায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে প্রত্যাবর্তন করে। বিশ বছর পর ১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুর একটি সার্বভৌম নগর-রাষ্ট্রে পরিণত হয়। জাপানি শাসনের সেই অভিজ্ঞতা এখনো স্মরণ করা হয় পূর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষা দিবস পালনের মাধ্যমে, ১৯৪২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাপানিদের কাছে ব্রিটিশদের আত্মসমর্পণের দিন পালিত হয় এই দিবস।

দখল–পূর্ব ঘটনাপ্রবাহ[সম্পাদনা]

মাত্র দুই মাসের কিছু বেশি সময়ের মালয় অভিযানে (Malayan Campaign) জাপানিরা গোটা মালয় দখল করে নিয়েছিল। দ্বীপটিতে আক্রমণের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ তারিখে, সিঙ্গাপুরকে প্রতিরক্ষাকারী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল সিঙ্গাপুরের পতনকে “ভয়াবহ বিপর্যয় এবং ব্রিটিশ ইতিহাসে আত্মসমর্পণের সর্ববৃহৎ নজির” বলে আখ্যা দেন।[৩]

দখলদারিত্বের সময়কালে জীবনযাত্রা[সম্পাদনা]

গণ–আতঙ্কের সময়[সম্পাদনা]

কেম্পেইতাই (জাপানি সামরিক পুলিশ), যা ছিল সিঙ্গাপুরের প্রধান দখলদার বাহিনী, তারা সাধারণ জনতার ওপর নানাবিধ নৃশংসতা চালায়। তারা “সুক চিং” নামক একটি ব্যবস্থা চালু করে, চীনা ভাষায় যার অর্থ “পরিশোধনের মাধ্যমে পবিত্রকরণ” (purging through purification)। এটা ছিল বিশেষত তাদের জন্য যারা জাতিগতভাবে চীনা, জাপান সাম্রাজ্যের জন্য যাদের শত্রুভাবাপন্ন বলে গণ্য করা হত (স্থানীয় জনসংখ্যার জাপান–বিরোধী উপাদান)। সুক চিং গণহত্যায় সিঙ্গাপুরসহ প্রতিবেশি মালয়ে ২৫,০০০ থেকে ৫৫,০০০ চীনা বংশোদ্ভূত মানুষ প্রাণ হারায়। এই ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই ছিল পুরুষ, যাদের বয়স ছিল ১৮ থেকে ৫০ এর মধ্যে। তাদেরকে একত্র করে দ্বীপের কোন দূরবর্তী, জনশূন্য স্থানে যেমন – চাঙি সৈকত (Changi Beach), পাঙ্গল পয়েন্ট (Punggol Point), এবং সিগ্‌ল্যাপ (Siglap) এ নিয়ে যাওয়া হত এবং মেশিন গান ও রাইফেল দিয়ে ধারাক্রমে গুলি করে হত্যা করা হত।

এছাড়াও, কেম্পেইতাই-রা গোটা দ্বীপজুড়ে স্থানীয় গুপ্তচরের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল, সন্দেহভাজন জাপানি–বিরোধী লোকজন শনাক্ত করার জন্য। এই সব চরদের কেম্পেইতাই গণ ভালো অর্থকড়ি দিত এবং দখলদারি বাহিনীর কাছে এদের বিশ্বস্ততা নিয়ে কোন সন্দেহ ছিল না বলে, গ্রেপ্তার হওয়ার কোন ভয়ও তাদের ছিল না। এই চরেরা কেম্পেইতাই শনাক্তকরণ কেন্দ্রগুলোতে কাজ করত, যেখানে জাপানিরা শাস্তি দেওয়ার জন্য সন্দেহভাজন জাপানি–বিরোধীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করত। জাপানি সৈন্য এবং কেম্পেইতাইরা প্রায়শই রাস্তাঘাটে টহল দিত এবং তাদের দেখলে সাধারণ মানুষজনকে ঝুঁকে সম্মান দেখাতে হত। যারা এমনটা করতে ব্যর্থ হত, তাদের চড়–থাপ্পড়, সাজা, মারধর এবং এমনকি কাউকে কাউকে হাজতে ঢোকানো বা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হত।

অন্যান্য পরিবর্তন[সম্পাদনা]

পশ্চিমা প্রভাবকে নিরুৎসাহিত করা, দখলদারিত্বের একদম গোড়া থেকেই যেটা জাপানিদের অভিপ্রায় ছিল, সেজন্য তারা বিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে, এবং স্থানীয় লোকজনকে তাদের ভাষা (জাপানি) শিখতে চাপ প্রয়োগ করে। পাঠ্যপুস্তক ও ভাষা নির্দেশিকাসমূহ কেবল জাপানি ভাষায় ছাপানো হত এবং বেতার ও চলচ্চিত্র সম্প্রচার ও প্রদর্শন করা হত জাপানি ভাষায়। প্রত্যহ সকালে, বিদ্যালয়গামী শিশুদের জাপানের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে (সিঙ্গাপুর থেকে যা ছিল উত্তর–পূর্ব দিকে) জাপানের জাতীয় সংগীত (“কিমিগায়ো”) গাইতে হত। সিঙ্গাপুরের সর্বত্র জাপানি প্রচারণা ব্যানার আর পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল, সেই সাথে জাপানের উদীয়মান সূর্যবিশিষ্ট পতাকা উত্তোলন এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ দালান থেকে ঝোলানো থাকত।

মৌলিক চাহিদার অপ্রতুলতা[সম্পাদনা]

যুদ্ধের সময় প্রচলিত দশ ডলার মূল্যমানের "কলা টাকা"র নোট

দখলদারিত্বের সময় খাদ্য থেকে শুরু করে ওষুধপথ্য পর্যন্ত সব মৌলিক সংস্থানেরই ঘাটতি দেখা দেয়। অধিমুদ্রাস্ফীতির কারণে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে অত্যাবশ্যক মৌলিক সামগ্রীর দাম আকস্মিকভাবে বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, চালের দাম প্রতি ১০০ কাটি (catties) (৬০ কি.গ্রা. বা ১৩০ পাউন্ড) $৫ থেকে বেড়ে, আগস্ট–সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ এ দখলদারিত্বের শেষ সময়ে $৫,০০০ এ গিয়ে পৌঁছে।

বেসামরিক জনতার মধ্যে বণ্টিত সামগ্রীর পরিমাণ সীমিত করার উদ্দেশ্যে জাপানিরা রেশন কার্ড চালু করে, যা “শান্তির জীবনের সনদপত্র” নামেও পরিচিত ছিল।[৪] প্রতি মাসে প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশুরা জনপ্রতি যথাক্রমে ৫ কেজি (১১ পাউন্ড) এবং ২ কেজি (৪.৪ পাউন্ড) করে চাল কিনতে পারতো। যুদ্ধের অগ্রগতির সাথে সাথে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বরাদ্দ চালের পরিমাণ ২৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়, কেননা চালের অপ্রতুল সরবরাহ জাপানি সেনাদের খাবারের যোগান হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হত।[৫]

দখলদারিত্বের সময়কালে, জাপানিরা “কলা টাকা” (Banana Money; এইসব নোটের গায়ে কলা গাছের ছবি ছাপানো থাকত বলে এমন নাম দেওয়া হয়) নামক এক ধরনের অর্থমুদ্রার প্রচলন করে কেননা ব্রিটিশদের স্ট্রেইট মুদ্রা (Straits Currency) ক্রমেই বিরল হয়ে আসছিল এবং ১৯৪২ সালে জাপানিরা আসার পর এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যায়। তারা সরকার নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি’র (Command Economy) কিছু কিছু অনুষঙ্গ প্রবর্তন করে যেখানে জিনিসপত্রের চাহিদা ও যোগানের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এর ফলে একটি জনপ্রিয় কালোবাজার সৃষ্টি হয় যেখান থেকে স্থানীয়রা প্রধান কিছু অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী যেমন– চাল, মাংস এবং ওষুধ কিনতো। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে “কলা টাকা” ভুগতে শুরু করে এবং এর মান খুব দ্রুত নিম্নমুখী হতে থাকে, কেননা দখলদার কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনমাফিক শুধু টাকা ছাপিয়ে যেত; এর ফলস্বরূপ কালোবাজারে স্ট্রেইট মুদ্রা অধিক প্রচলিত ছিল।

খাদ্যের প্রাপ্যতা ও মান– উভয়েরই ভীষণ অবনতি ঘটে। মিষ্টি আলু (Sweet Potato), ট্যাপিওকা এবং রাঙা আলু (Yam) সিঙ্গাপুরিদের প্রধান খাদ্য হয়ে ওঠে, কারণ এগুলো চালের চেয়ে সস্তা ছিল এবং অল্প সময়ে, সহজে বাড়ির পেছনের উঠানে ফলানো সম্ভব ছিল। সেগুলো থেকে মিষ্টান্নসহ দিনের তিন বেলার জন্য নানা পদের খাবার তৈরি করা যেত। এসব খাবার ক্ষুধা নিবারণের জন্য সহায়ক ছিল বটে কিন্তু পুষ্টিগুণ ছিল সীমিত। একঘেয়েমি দূর করার জন্য মিষ্টি আলু, ট্যাপিওকা এবং রাঙা আলু’র সাথে অন্য কিছু মিশিয়ে নিয়মিত নতুন নতুন ধরনের খাবার উদ্ভাবন করা হত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এবং জাপানি দখলদার কর্তৃপক্ষ উভয়ই, নিজেদের অল্প পরিমাণ জমি থাকলেও, সেখানে নিজেদের খাদ্য নিজেদেরকেই উৎপাদনের প্রতি স্থানীয় জনগণকে উৎসাহিত করত। এই উৎসাহ এবং উৎপাদন অনেকটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে পশ্চিমা দেশগুলোর (প্রধানত ইউরোপে) “বিজয় উদ্যান” (Victory Gardens) এর মত, যেহেতু তখন খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি ছিল।[৬] কলমি শাক (Ipomoea aquatica) সহ অন্যান্য শাকসবজি, যেগুলো জলাধারের আশেপাশে মোটামুটি সহজেই ফলানো যেত, সেগুলো বেশ জনপ্রিয় খাদ্যশস্যে পরিণত হয়।

শিক্ষা[সম্পাদনা]

সিঙ্গাপুর দখলের পর, মালয়, চীনা, ভারতীয় এবং ইউরেশীয়দের জাপানি ভাষায় দীক্ষিত করার জন্য, জাপানিরা শোনান জাপানি বিদ্যালয় (昭南日本学園, Shōnan Nihon Gakuen) প্রতিষ্ঠা করে। আন্ডার অ্যান ইম্পেরিয়াল সান : জাপানিজ কলোনিয়াল লিটারেচার অফ তাইওয়ান অ্যান্ড দ্য সাউথ গ্রন্থের রচয়িতা ফেই ইউয়ান ক্লিম্যান (Faye Yuan Kleeman) এর ভাষ্যমতে, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় এমন বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এটিই ছিল সফলতম।[৭] দখলের সময়কালেই জাপানিরা শোনান ফার্স্ট পিপলস্‌ স্কুল নামে আরেকটি বিদ্যালয় চালু করে।[৮]

মিত্রবাহিনীর অভিযানসমূহ[সম্পাদনা]

জেড-ফোর্সের আরো দুই সদস্যের সাথে অপারেশন জেউইকের সাফল্য উদযাপন করছেন ইভান লিয়ন (মাঝে)

জাপানি সামরিক বাহিনীর কার্যক্রম ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে, মিত্রবাহিনীর বেশ কতগুলো পরিকল্পিত আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল সিঙ্গাপুর। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩ সালে, মেজর ইভান লিয়ন এর নেতৃত্বে, জেড–ফোর্স (Z–Force) নামে পরিচিত মিত্রবাহিনীর একটি কমান্ডো দল, সিঙ্গাপুর পোতাশ্রয়ে অনুপ্রবেশ করে সাতটি জাপানি জাহাজ ডুবিয়ে বা ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়, যার সম্মিলিত ভর ছিল প্রায় ৩৯,০০০ দীর্ঘ টন (৪০,০০০ মেট্রিক টন)। একই লক্ষ্য নিয়ে প্রায় এক বছর পর লিয়ন আরেকটি অপারেশনে নেতৃত্ব দেন, যার সাংকেতিক নাম ছিল “রিমাউ”, এবং তিনটি জাহাজ নিমজ্জিত করেন। লিয়ন এবং তার ১৩ জন সহযোগী জাপানিদের সাথে যুদ্ধে নিহত হন। এই অপারেশনের বাকি ১০ জন বন্দি হন, এবং প্রহসনমূলক এক বিচারে (Kangaroo court) গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন।

ফোর্স ১৩৬ এর লিম বো সেং আরেকটি অপারেশন পরিচালনা করেন, যার সাংকেতিক নাম ছিল গুস্তাভুস (Gustavus)। তিনি চীন ও ভারত থেকে নিবিড় সামরিক গোয়েন্দা অভিযানের মাধ্যমে শতাধিক গুপ্তচর সংগ্রহ করেন এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেন। তিনি ১৯৪২ সালে স্পেশাল অপারেশন্স এক্সেকিউটিভ (SOE) এর ক্যাপ্টেন জন ডেভিস এর সাথে মিলে ফোর্স ১৩৬ নামক একটি চীনা–ব্রিটিশ গেরিলা টাস্কফোর্স গঠন করেন। অপারেশন গুস্তাভুস এর লক্ষ্য ছিল মালয় ও সিঙ্গাপুরজুড়ে গুপ্তচরবৃত্তির নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা ও জাপানিদের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা, এবং এর মাধ্যমে জাপানিদের কাছ থেকে সিঙ্গাপুর পুনর্দখলের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশদের পরিকল্পিত অপারেশন জিপার – এ সহায়তা করা। যুদ্ধ শেষে ফোর্স ১৩৬ ভেঙে দেওয়া হয়।

আগস্ট ১৯৪৫ এ, সিঙ্গাপুর পোতাশ্রয়ে অনুপ্রবেশ করে, নাছোড় মাইন (limpet mine) দ্বারা জাপানি যুদ্ধজাহাজ তাকাও (Takao) এবং মিয়োকো’র (Myōkō) ক্ষতিসাধন করার লক্ষ্যে, যুক্তরাজ্যের রাজকীয় নৌবাহিনীর দুটি XE–শ্রেণির ক্ষুদ্র ডুবোজাহাজ, অপারেশন স্ট্রাগল – এ অংশ নেয়। তারা তাকাও এর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে, যার জন্য লেফটেন্যান্ট ইয়ান এডওয়ার্ড ফ্রেজার ভিক্টোরিয়া ক্রস (ব্রিটেনের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান) অর্জন করেন। নভেম্বর ১৯৪৪ থেকে মে ১৯৪৫ পর্যন্ত ব্রিটিশ ও আমেরিকান দূর-পাল্লার বোমারু বিমানের লক্ষ্যবস্তু ছিল সিঙ্গাপুর।

নভেম্বর ১৯৪৪ থেকে মে ১৯৪৫ এর মধ্যবর্তী সময়ে, সিঙ্গাপুরের নৌঘাঁটি ও বন্দরগুলো আমেরিকান বিমান ইউনিট কর্তৃক এগার বার বোমা হামলার শিকার হয়। এই হামলাগুলোতে তাদের লক্ষ্যবস্তুর কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলেও অনেক বেসামরিক লোক নিহত হয়। তবে অধিকাংশ সিঙ্গাপুরিরা এই হামলাকে স্বাগত জানিয়েছিল, কেননা সেগুলোকে তারা জাপানি শাসন থেকে সিঙ্গাপুরের মুক্তির বার্তা হিসেবে দেখত।

দখলদারিত্বের সমাপ্তি[সম্পাদনা]

১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ তারিখে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পর, জাপানি প্রতিনিধদল সিঙ্গাপুর পৌরভবন ত্যাগ করছে।
উল্লসিত জনতা ব্রিটিশ বাহিনীর প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানাচ্ছে (৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫)।
পুনর্দখল বাহিনীর অংশ হিসেবে অবতরণের পর, ৫ম ভারতীয় ডিভিশন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে।

৬ আগস্ট ১৯৪৫ তারিখে, যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা শহরে একটি আণবিক বোমা হামলা চালায়। ১৬ ঘণ্টা পর, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান জাপানকে আবারও আত্মসমর্পণের আহ্বান করেন, নয়তো “আকাশ থেকে এমন ধ্বংসের বর্ষণ অবশ্যম্ভাবী, যা এই পৃথিবী আগে কখনোই দেখেনি”– এই বলে হুঁশিয়ারি জানান।

৮ আগস্ট ১৯৪৫ তারিখে, সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদী জাপানের পুতুল–রাষ্ট্র মাঞ্চুকুও (Manchukuo) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ৯ আগস্ট সেখানে আক্রমণ করে। পরে ঐ একই দিনে, যুক্তরাষ্ট্র জাপানের নাগাসাকি শহরে আরেকটি আণবিক বোমা বর্ষণ করে।

এই ঘটনাগুলোর পর, জাপানের সম্রাট হিরোহিতো হস্তক্ষেপ করেন এবং যুদ্ধ-নির্দেশনা বিষয়ক সর্বোচ্চ পরিষদকে, যুদ্ধ সমাপ্ত করার উদ্দেশ্যে মিত্রবাহিনীর দেওয়া পট্‌সডাম ঘোষণা’র শর্তাবলি মেনে নিতে আদেশ করেন। আরও বেশ কয়েক দিন ধরে পর্দার আড়ালে চলা আলাপ–আলোচনা আর একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর, ১৫ আগস্ট সমগ্র সাম্রাজ্যজুড়ে সম্রাট হিরোহিতো পূর্বে ধারণকৃত একটি বেতার ভাষণ দেন। জুয়েল ভয়েস ব্রডকাস্ট (玉音放送 ; Gyokuon-hōsō) নামক ঐ বেতার ভাষণে তিনি মিত্রবাহিনীর কাছে জাপানের আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেন।

২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ তারিখে, যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর রণতরী ইউএসএস মিজৌরিতে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এতে জাপান সরকারের কর্মকর্তাবৃন্দ জাপানি সরঞ্জাম আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন, এবং এর মাধ্যমে সকল বৈরিতার অবসান ঘটে।

১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ তারিখে, সিঙ্গাপুর পৌরভবনে একটি সরঞ্জাম আত্মসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর পাদাঙে (Padang) কুচকাওয়াজ সহকারে বিজয় উদযাপিত হয়। জেনারেল হিসাইচি তেরাউচি’র পক্ষ হতে আগত জেনারেল সেইশিরো ইতাগাকি’র কাছ থেকে জাপানি বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ গ্রহণ করতে, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া কমান্ডে মিত্রবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার (Supreme Allied Commander) লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন সিঙ্গাপুরে আসেন। আত্মসমর্পণকৃত জাপানি ফৌজকে নিরাপত্তা বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে, একটি ব্রিটিশ সামরিক প্রশাসন গঠিত হয়েছিল, যা মার্চ ১৯৪৬ পর্যন্ত দ্বীপের তত্ত্বাবধানে ছিল।

জাপানের আত্মসমর্পণের পর, ব্রিটিশরা তখন পর্যন্ত এসে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ না করায়, সিঙ্গাপুরে এক অস্থিতিশীল অনাচারমূলক অবস্থা দেখা দেয়। জনগণের ওপর জাপানিদের নিয়ন্ত্রণ তখন অনেকাংশেই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেখানে ব্যাপক হারে লুটতরাজ এবং প্রতিশোধমূলক খুনখারাবি হতে থাকে। বন্দর সুবিধা, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ এবং টেলিফোন পরিষেবাসহ অধিকাংশ অবকাঠামোই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অর্থনীতি যুদ্ধ–পূর্ব অবস্থায় পৌঁছাতে আরও চার–পাঁচ বছর লেগে যায়। অবশেষে যখন ব্রিটিশ সেনারা এসে পৌঁছে, জনগণ তাদের উল্লাস ও হর্ষধ্বনির মাধ্যমে বরণ করে নেয়।

দখলদারিত্বের অবসানের সাথে সাথেই কলা টাকা মূল্যহীন হয়ে পড়ে।

স্মৃতিসৌধসমূহ[সম্পাদনা]

জাপানি দখলদারিত্বের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের এর শিক্ষা তুলে ধরতে, সিঙ্গাপুর সরকার বেশ কয়েকটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে, যার কয়েকটি প্রাক্তন গণহত্যা-ভূমিগুলোতে অবস্থিত।

বেসামরিক যুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ (Civil War Memorial)[সম্পাদনা]

বিচ রোডে যুদ্ধ স্মৃতি উদ্যানে অবস্থিত বেসামরিক যুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ। চারটি স্তম্ভ দ্বারা সিঙ্গাপুর অধিবাসী চারটি প্রধান জাতি: চীনা, মালয়, ভারতীয় এবং ইউরেশীয়দের প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

বিচ রোডের যুদ্ধ স্মৃতি উদ্যানে (Singapore Chinese Chamber of Commerce and Industry) এর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বেসামরিক যুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভটি অবস্থিত। ৬১ মিটার উচ্চতার, চারটি সাদা কংক্রিট স্তম্ভ নিয়ে গঠিত এই স্মৃতিস্তম্ভটি দ্বারা যুদ্ধে নিহত সকল বর্ণের বেসামরিক জনগণের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। ষাটের দশকে শুরুর দিকে, পুনঃনগরায়নের ধুম পড়লে সমগ্র সিঙ্গাপুরজুড়ে সহস্রাধিক দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। এরপরই এই সৌধটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৬৭ সালে জাপানি দখলদারিত্বের রজতজয়ন্তীতে, সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ (Lee Kuan Yew) এই স্মৃতিস্তম্ভটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।[৯] ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে, জাপানি সরকার কর্তৃক ‘রক্ত ঋণ’ এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে সিঙ্গাপুরকে দেওয়া ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি অংশ ব্যয় করে এটি নির্মিত হয়।[৯] এর উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী লি বলেন:

আমরা এখানে সমবেত হয়েছি সেই সব নারী–পুরুষকে স্মরণ করতে যারা ইতিহাসের এক আগুনে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলি হয়েছেন…আজ যদি আমরা অতীতের এই শিক্ষাগুলো মনে রাখি, নিজেদের ভবিষ্যতকে নিরাপদ করতে নিজেদের সংকল্প ও প্রতিজ্ঞাকে আরও মজবুত করি, তাহলেই যে নারী–পুরুষদের জন্য আজ আমরা শোকাহত, তাদের মৃত্যু বৃথা যাবে না।[৯]

প্রতি বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি এই স্মৃতিস্তম্ভে স্মারক কর্মসূচি (জনগণের জন্য উন্মুক্ত) পালন করা হয়।

সুক চিং সেন্টার স্মৃতিসৌধ[সম্পাদনা]

এই স্মৃতিস্তম্ভটি চায়নাটাউনের হং লিম কমপ্লেক্সের ভেতরে অবস্থিত। স্মৃতিসৌধের গায়ে খোদাই করে লেখা আছে:

চাঙি সৈকতের গণহত্যা স্মৃতিসৌধ[সম্পাদনা]

এই স্মৃতিসৌধটির অবস্থান সিঙ্গাপুরের পূর্বাংশে চাঙি সৈকত উদ্যানে (ক্যাম্প সাইট ২ এর কাছে)। এই সৌধের খোদাই করা রয়েছে:

পাঙ্গল সৈকতের গণহত্যা স্মৃতিসৌধ[সম্পাদনা]

চায়নাটাউনের হং লিম কমপ্লেক্সে অবস্থিত সুক চিং সেন্টার স্মৃতিসৌধ

এই সৌধটি উত্তর–পূর্ব সিঙ্গাপুরের পাঙ্গল সড়কে অবস্থিত। এই স্মৃতিসৌধের খোদাই করে লেখা আছে:

জনপ্রিয় সংস্কৃতি[সম্পাদনা]

চলচ্চিত্র[সম্পাদনা]

  • লেফটেন্যান্ট আদনান (২০০০), সিঙ্গাপুরের যুদ্ধ নিয়ে নির্মিত একটি মালয়েশিয়ান চলচ্চিত্র

Television series[সম্পাদনা]

  • টেঙ্কো (১৯৮১-১৯৮৫) এর প্রাথমিক পর্বসমূহ, একটি বিবিসি/ এবিসি প্রযোজনা
  • দ্য হিরোজ (১৯৮৯), একটি অস্ট্রেলীয়-ব্রিটিশ যৌথ প্রযোজনা
  • হিরোজ ২ : দ্য রিটার্ন (১৯৯১), একটি অস্ট্রেলীয় সংক্ষিপ্ত ধারাবাহিক নাটক
  • দ্য লাস্ট রিদম (১৯৯৬), টেলিভিশন কর্পোরেশন অফ সিঙ্গাপুর (টিসিএস) কর্তৃক চীনা ভাষায় প্রযোজিত
  • দ্য প্রাইস অফ পিস (১৯৯৭), টিসিএস কর্তৃক প্রযোজিত
  • এ ওয়ার ডায়েরি (২০০১), মিডিয়াকর্প কর্তৃক প্রযোজিত
  • এ পারস্যুট অফ পিস (২০০১), মিডিয়াকর্প কর্তৃক প্রযোজিত
  • চাঙি (২০০১), অস্ট্রেলীয় ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন কর্তৃক প্রযোজিত
  • দ্য জার্নি : টিউমাল্টাস টাইমস (২০১৪), মিডিয়াকর্প কর্তৃক প্রযোজিত
  • দ্য ফরগটেন আর্মি : আজাদি কে লিয়ে (২০২০), কবির খান ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেড কর্তৃক প্রযোজিত

স্মৃতিসৌধ এবং ঐতিহাসিক স্থানসমূহের তালিকা[সম্পাদনা]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Abshire, Jean (২০১১)। The History of Singapore। ABC-CLIO। পৃষ্ঠা 104। আইএসবিএন 978-0313377433 
  2. Giggidy, Kevin; Hack, Karl (২০০৪)। Did Singapore Have to Fall?: Churchill and the Impregnable Fortress। Routledge। পৃষ্ঠা 132। আইএসবিএন 0203404408 
  3. Churchill, Winston S. Second World War IV. 6 vols, London, 1948–54 p. 81.
  4. "PEACE LIVING CERTIFICATE ISSUED DURING JAPANESE OCCUPATION"। National Archives of Singapore। ১২ এপ্রিল ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ অক্টোবর ২০১৬ 
  5. "Japanese Occupation"। AsiaOne। ৯ মে ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ মে ২০০৬ 
  6. "Hungry years"। AsiaOne। ৯ মে ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ মে ২০০৬ 
  7. Kleeman, Faye Yuan. Under an ImSun: Japanese Colonial Literature of Taiwan and the South. University of Hawaii Press, 2003. p. 43. আইএসবিএন ০৮২৪৮২৫৯২৬, টেমপ্লেট:Isbnt. "The most successful was the Japanese school in Singapore. A month after the British surrendered (February 15, 1942), Japan renamed the island Syonan-to (literally "illuminating the south") and founded the famous Shonan Japanese School (Shōnan Nihon Gakuen 昭南日本学園)"
  8. "A BRIEF HISTORY আর্কাইভইজে আর্কাইভকৃত ২ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে." The Japanese School Singapore. Retrieved on 2 January 2014.
  9. Lee, "Remembering The Hapless Victims of The Fires of History", pp. 327—9.
  10. Modder, "Sook Ching Registration Centre in Chinatown", p. 72.
  11. Modder, "Changi Beach Massacre", p. 69.
  12. Modder, "Punggol Beach Massacre", p. 67.

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

Marius B. Jansen (১৫ অক্টোবর ২০০২)। The Making of Modern Japan। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ছাপাখানা। আইএসবিএন 978-0-674-03910-0 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]