বর্ষপঞ্জির ইতিহাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বর্ষপঞ্জির ইতিহাস , যা কিনা মানুষেরা দিন এবং সময়ের বৃহত্তর অংশের উপর নজর রাখার জন্য তৈরি এবং ব্যবহার করে, এটি একটি অনুশীলন যা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে।

প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সময় গণনার পদ্ধতিগুলি পুনর্গঠন করেছেন যা প্রাগৈতিহাসিক সময়ে নিয়ে যায় ও কমপক্ষে নব্যপ্রস্তরযুগের সমান পুরানো। বেশিরভাগ ঐতিহাসিক সভ্যতাগুলি সময় গণনার জন্য প্রাকৃতিক একক যেমন দিন, সৌর বছর এবং চন্দ্রমাস ব্যবহার করত । বর্ষপঞ্জিগুলি সময় গণনার সুস্পষ্ট মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। প্রথম ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত এবং সূত্রকৃত বর্ষপঞ্জিগুলি ব্রোঞ্জ যুগের ছিল , এই তথ্য প্রাচীন নিকট প্রাচ্যে লেখার বিকাশের উপর নির্ভরশীল। সুমেরীয় বর্ষপঞ্জিটি হল প্রাচীনতম, তারপরে মিশরীয় , অ্যাসিরীয় বর্ষপঞ্জী এবং এলামাইট বর্ষপঞ্জি ।

প্রাচীন নিকট প্রাচ্যের বহু সংখ্যক বর্ষপঞ্জিগুলি যেগুলি আসিরিয়ান এবং ব্যাবিলনীয় বর্ষপঞ্জির উপর ভিত্তি করে তৈরী হয়েছিল , সেগুলি লৌহ যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে হাখমানেশী সাম্রাজ্যের বর্ষপঞ্জি , যা পারসী বর্ষপঞ্জির পাশাপাশি হিব্রু বর্ষপঞ্জিরও জন্ম দিয়েছিল ।

আদিম বর্ষপঞ্জিগুলি সাধারণত সৌরচান্দ্রিক ছিল, সৌর এবং চান্দ্র বছরগুলিকে পরস্পরের সঙ্গে সারিবদ্ধ করার জন্য আন্তঃকালীন মাসগুলি প্রবেশ করানোর উপর নির্ভরশীল ছিল। এটি বেশিরভাগ পর্যবেক্ষণের উপরেই নির্ভর ছিল, তবে প্রাথমিক প্রচেষ্টা হয়ে থাকতে পারে অ্যালগোরিদম অনুসারে  আন্তঃকালীনতার পরিকাঠামো তৈরী করার ,  যেমন খণ্ডিত দ্বিতীয় শতাব্দীর কলিগনি বর্ষপঞ্জিতে দেখা গিয়েছে। তা সত্ত্বেও, রোমান বর্ষপঞ্জিতে পূর্ব-ইস্ট্রাস্কানের ১০ মাসের সৌরবর্ষের খুব প্রাচীন অবশেষ দেখা যায় ৷[১]

রোমান ক্যালেন্ডার ৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজার দ্বারা সংস্কার করা হয়েছিল। জুলীয় বর্ষপঞ্জি আর অমাবস্যা পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভরশীল ছিল না , একটি সহজ অ্যালগরিদম অনুসরণ করে প্রতি চার বছর অন্তর এক লিপ দিন প্রবেশ  করানো হয়েছিল । এটি  বর্ষপঞ্জির মাস এর থেকে চান্দ্রমাসের একটি বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছিল।

ইরানে একাদশ শতাব্দীতে, ওমর খৈয়ামের নেতৃত্বে একটি বর্ষপঞ্জি প্রকাশিত হয়েছিল ১০৭৯ সালে , যখন বছরের দৈর্ঘ্য ধরা হত ৩৬৫.২৪২১৯৮৫৮১৫৬ দিন ।[২] যেহেতু  কোনও ব্যক্তির জীবদ্দশায় , বছরের দৈর্ঘ্য ষষ্ঠ দশমিক স্থানে পরিবর্তিত হচ্ছে তাই এটি প্রকৃতই সঠিক। তুলনার জন্য বলা যায় ১৯ শতকের শেষে বছরের দৈর্ঘ্য ছিল ৩৬৫.২৪২১৯৬ দিন, এবং এর দৈর্ঘ্য  ৩৬৫.২৪২১৯০ দিন। [২]

গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিটি জুলিয়ান বর্ষপঞ্জির সংশোধন হিসাবে ১৫২২ সালে  প্রবর্তিত হয়েছিল এবং এটি আজ বিশ্বজুড়ে  জনপ্রিয় বর্ষপঞ্জি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতার সাপেক্ষে  ব্যবহৃত হচ্ছে।

ব্যুৎপত্তি[সম্পাদনা]

" ক্যালেন্ডার " শব্দটি  " ক্যালেন্ড " থেকে নেওয়া হয়েছে, রোমান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মাসের প্রথম দিনের জন্য শব্দটি ব্যবহার করা হয় যা কিনা " ক্যালারে " ক্রিয়া  " আহ্বান করা " সাথে জড়িত ,  অমাবস্যার চাঁদ সবেমাত্র দেখা গেছে এমন ঘোষণা করতে ব্যবহৃত হত । ল্যাটিন ক্যালেন্ডারিয়াম শব্দের অর্থ " হিসাবের খাতা " , কেননা প্রতি মাসের ক্যালেন্ডে হিসাবনিকাশগুলির নিষ্পত্তি করা হত এবং ঋণগুলি আদায় করা হত।

ল্যাটিন শব্দটি প্রাচীন ফরাসী ভাষায় ক্যালেন্ডিয়ার হিসাবে এবং সেখান থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মধ্য ইংরেজিতে ক্যালেন্ডার হিসাবে গৃহীত হয়েছিল।  ক্যালেন্ডার শব্দের বানান আদি আধুনিক ইংরাজির।

একটি বিকল্প তত্ত্ব  "ক্যালেন্ডার"  শব্দটি স্লাভিকে প্রাক-খ্রিস্টান কোলেদারির সাথে সম্পর্কিত , যা কিনা পরে ক্রিসমাসের সাথে  সংযুক্ত হয়েছিল। কোলো মানে "বৃত্ত, চক্র" এবং দার এর অর্থ "একটি উপহার"।

বিষুব যেটি দেখা গেছে পিজো ভেন্টোর জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত পঞ্জিকা থেকে ফন্ডাচেলি-ফ্যান্টিনা সিসিলি - তে

[ভারতে 'কালগনক' শব্দের অর্থ ক্যালেন্ডার। ভারতীয় গণিত-জ্যোতিষ সঠিকভাবে 'অমাবস্যা', 'পূর্ণ চাঁদ দিবস' এবং গ্রহণের পূর্বাভাস দেয়। প্রায় ১১০০ মিলিয়ন ভারতীয় 'সময়' সন্ধান করে এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হওয়া 'বিক্রমাব্দ' এর উপর ভিত্তি করে তাদের উৎসবগুলি সম্পাদন করে।] [৩]


['শ্রীশতাব্দ'-এর নববর্ষ চৈত্র-মাসের অমাবস্যা দিন থেকে শুরু হয় যখন ভারতের বেশিরভাগ মানুষ বর্ণময় উৎসব উদ্‌যাপন করেন, হোলিকাদহনের' ঠিক পরের দিন , ফাল্গুন মাসের' পূর্ণিমায় যখন আগের বছর শেষ হয়। সুতরাং 'শ্রীশতাব্দ' চৈত্র মাসের অমাবস্যার দিনে শুরু হয় এবং ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা দিনে শেষ হয়। শ্রীশতাব্দ হ'ল বিক্রমাব্দের মতো 'চন্দ্র-সৌরকেন্দ্রিক' , তবে তিথি মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে মাসের শেষ দিন অর্থাৎ পূর্ণিমার দিনে শেষ হয় ৷

প্রাগৈতিহাসিক[সম্পাদনা]

বেশ কয়েকটি প্রাগৈতিহাসিক বস্তু চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলি সম্ভবত সময় দেখার উদ্দেশ্যে  তৈরী করা হয়েছিল (সাধারণত সৌর বর্ষের হিসাব রাখার জন্য )। এর মধ্যে অনেকগুলি মেগালিথ বস্তুও রয়েছে এবং নব্যপ্রস্তরযুগেরও কিছু জিনিস রয়েছে ।

অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ায়, উড়দি ইউয়াং প্রস্তর কাঠামোটি  ১১,০০০ বছরের বেশি পুরানো , তবে কিছু অনুমান অনুসারে এটি ২০,০০০ বছরেরও বেশি পুরানো ৷[৪] এই অনুমানটি বর্ষপঞ্জির অযথাযথতার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে , যা সেই সময়ে পৃথিবীর  কক্ষপথ কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করা হয় ৷[৫] অঞ্চলটিকে বিশ্বের প্রাচীনতম স্থায়ী মৎস্য চাষ স্থানের নিকটে খুঁজে পাওয়া গেছে ।

স্লাতিনো ফার্নেস মডেল হিসাবে পরিচিত বুলগেরিয়ার একটি চীনামাটির  হস্তনির্মিত বস্তুকে  স্থানীয় প্রত্নতাত্ত্বিক এবং গণমাধ্যম দ্বারা প্রাচীনতম বর্ষপঞ্জি  হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে , যদিও মূলধারার মতামত এই দাবিকে সমর্থন করে না।[৬]

স্কটল্যান্ডের ওয়ারেন ফিল্ড, আবারডিনশায়ারে , প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্বের  বারোটি খাত এবং একটি বক্ররেখাংশ সমন্বিত মধ্যপ্রস্তর যুগের বিন্যাসকে , চন্দ্র পঞ্জিকা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং ২০১৩ সালে এটিকে "বিশ্বের প্রাচীনতম ক্যালেন্ডার" নামে অভিহিত করা হয়েছে ।[৭]

প্রাচীনতম ইউরোপীয় বর্ষপঞ্জিটি আধুনিক ক্রোয়েশিয়ার ভুকোভারের কাছে পাওয়া গেছে । এটি একটি চীনামাটির পাত্র যাতে মহাজাগতিক বস্তুর চিত্রলিপি খোদাই করা আছে ।

প্রাচীন নিকট প্রাচ্য[সম্পাদনা]

প্রাচীন সুমেরীয় বর্ষপঞ্জি এক বছরকে ২৯  বা ৩০ দিনের ১২ টি চন্দ্র মাসে বিভক্ত করেছিল ৷ [৮]  প্রতি মাস অমাবস্যা  দিয়ে শুরু হত । ধর্মীয় বৈচিত্র্যের কারণে সুমেরীয় মাসগুলির গোটা সুমের জুড়ে বিভিন্ন নাম ছিল ৷ [৯] এর ফলশ্রুতিতে শাস্ত্রবিদ ও পণ্ডিতগণ মাসগুলিকে "প্রথম মাস", "পঞ্চম মাস" ইত্যাদি হিসাবে উল্লেখ করেছেন [উদ্ধৃতি প্রয়োজন]  ৩৫৪ দিনের চন্দ্র বর্ষকে ৩৬৫.২৪২ দিনের সৌরবর্ষের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে একটি অতিরিক্ত মাস সময়ে সময়ে যুক্ত করা হত অনেকটা গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষের মতো I [৯] সুমেরীয় বর্ষপঞ্জিতে  কোনও সপ্তাহ ছিল না ৷ [১০] পবিত্র দিন এবং কাজ থেকে অবকাশের দিনগুলি সাধারণত প্রতি মাসের প্রথম , সপ্তম এবং পঞ্চদশ দিনগুলিতে উদযাপিত হত। এই পবিত্র দিনগুলি ছাড়াও ভোজের দিনও ছিল , যেগুলি শহর বিশেষে বিভিন্ন  ছিল ৷

আধুনিক বর্ষপঞ্জিসমূহ[সম্পাদনা]

গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিটি বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষ উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হয় , তবে জুলীয় বর্ষপঞ্জি , হিব্রু বর্ষপঞ্জী , ইসলামি বর্ষপঞ্জি , বিভিন্ন হিন্দু বর্ষপঞ্জী , পার্সী বর্ষপঞ্জি ইত্যাদি বিভিন্ন মধ্যযুগীয় বা প্রাচীন বর্ষপঞ্জিগুলি ধর্মীয় বা সামাজিক উদ্দেশ্যে আঞ্চলিকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।

এছাড়াও বিভিন্ন আধুনিক বর্ষপঞ্জি রয়েছে যেগুলির সীমিত ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় নতুন কোনো ধর্মীয় আন্দোলনে বা পুরানো ধর্মীয় বর্ষপঞ্জিগুলির সংস্কারকরণে বা আঞ্চলিক বা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ।

  • জাভান বর্ষপঞ্জি (১৬৩৩)
  • জোক্যো বর্ষপঞ্জি (১৬৮৫)
  • ফরাসি প্রজাতান্ত্রিক বর্ষপঞ্জি (১৭৯৩)
  • বাহাই বর্ষপঞ্জি (১৮৭৩)
  • সৌর হিজরি বর্ষপঞ্জি (১৯২৫)
  • পাটাফিজিক্যাল বর্ষপঞ্জি (১৯৪৯)
  • ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি (১৯৫৭)
  • এরিসীয় বর্ষপঞ্জি (১৯৬৩)
  • জুচে বর্ষপঞ্জি (১৯৯৭)

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Religion in the Etruscan period" in Roman religion in Encyclopædia Britannica
  2. "Khayyam biography"www-history.mcs.st-and.ac.uk। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০১-০২ 
  3. various books on Jyotis"
  4. Hegarty, Stephanie (২০১১-১০-০৬)। "Stargazing at an 'Aboriginal Stonehenge'"BBC News। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০১-১৩ 
  5. Fitzsimmons, Hamish (২০১৬-১০-১২)। "Ancient Aboriginal site dubbed 'Australia's Stonehenge' could be world's oldest observatory"ABC News। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০১-১৩ 
  6. Bailey D., 2000, Balkan Prehistory: Exclusion, Incorporation and Identity, London:Routledge p. 325
  7. [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৯ আগস্ট ২০১৩ তারিখে
  8. "Mesopotamia, Calendar"History-world.org। International World History Project। ২০১৭-১২-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৮-১৪ 
  9. "Calendar"। Encyclopædia Britannica Online। Encyclopædia Britannica। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-১৪ 
  10. Yust, Walter (১৯৪৭)। "Encyclopædia Britannica: A New Survey of Universal Knowledge"। Encyclopædia Britannica। পৃষ্ঠা 576। 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

  • "The Calendar", বিবিসি রেডিও ৪ , রবার্ট পুলে, ক্রিস্টেন লিপিনকট এবং পিটার ওয়াটসনের সাথে আলোচনা (আমাদের সময়ে, ১৯ ডিসেম্বর ২০০২)