প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়
জন্ম(১৮৯২-০৭-২৫)২৫ জুলাই ১৮৯২
মৃত্যু৮ নভেম্বর ১৯৮৫(1985-11-08) (বয়স ৯৩)
পেশাবিশ্বভারতীর অধ্যাপক ও প্রখ্যাত রবীন্দ্রজীবনীকার
দাম্পত্য সঙ্গীসুধাময়ী মুখোপাধ্যায়
পিতা-মাতানগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (পিতা)
গিরিবালাদেবী (মাতা)
পুরস্কারদেশিকোত্তম
পদ্মভূষণ

প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় (২৫ জুলাই, ১৮৯২ – ৮ নভেম্বর, ১৯৮৫) ছিলেনপ্রখ্যাত রবীন্দ্রজীবনীকার।[২]

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রাণাঘাটে[১] উকিল পিতা নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কর্মক্ষেত্র ছিল তৎকালীন বিহারের (বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের) গিরিডিতে। স্ত্রী সুধাময়ী ছিলেন প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সুবিনয় রায়ের মাসিমা।[৩] গিরিডিতেই তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে গিরিডির ন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে সরকারী বিদ্যালয় হতে বিতাড়িত হন। পরে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) প্রবর্তিত প্রবেশিকা পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অধিকার করে দশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। পিতার মৃত্যু ও নিজের রুগ্নতার কারণে তার আর উচ্চ শিক্ষা সম্ভব হয় নি। শিক্ষক হিমাংশুপ্রকাশ রায়ের সাথে, ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে এসে গুরুদেবের স্নেহচ্ছায়ায় ব্রহ্মচর্যাশ্রমে যোগ দেন। সেই থেকেই তার শান্তিনিকেতনে বাস। কেবল ১৯১৬ -১৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সিটি কলেজের গ্রন্থাগারিক হয়েছিলেন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে পাঠভবনের শিক্ষকতার ও গ্রন্থাগারিকের কার্যভার নিয়ে শান্তি নিকেতনে ফিরে আসেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে কলেজ শাখায় অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ইতিহাস বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল বেশি। তবে সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়েও ক্লাস নিতেন। আর গ্রন্থাগারিক হিসাবে তিনি ছিলেন বিশ্বজ্ঞানের ভাণ্ডারী। বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগার গঠনে ও গ্রন্থাগারিক হিসাবে তার অবদানও প্রশংসনীয়। তার রচিত 'বাংলা গ্রন্থবর্গীকরণ' ও'বাংলা দশমিক বর্গীকরণ' বই দুটি গ্রন্থাগার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

সাহিত্যকর্ম[সম্পাদনা]

প্রভাত কুমার সারাজীবন জ্ঞানের সাধনায় কাটিয়েছেন। জাতীয় জাগরণের দিনের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রচনা করেছেন "প্রাচীন ইতিহাসের গল্প"। এটি মাত্র ২০ বৎসর বয়সে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা ও পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে খ্যাতিসম্পন্ন ফরাসি পণ্ডিত সিলভা লেভি ভারতে এলে তার কাছে চীনা ও তিব্বতি ভাষা শিখে গবেষণা শুরু করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল- বৌদ্ধ ও হিন্দুদর্শনের সমগ্র চীনা ভাষা। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ইতালির প্রখ্যাত প্রাচ্য ভাষাবিদ জোসেফ তুচ্চির কাছে চীনের বিশিষ্ট দার্শনিক কংফুৎসুর গ্রন্থ পাঠ করে তা অনুবাদ করেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রভাত কুমার কাশী বিদ্যাপীঠে বৃহত্তর ভারত সম্পর্কে যে বক্তৃতা করেন তা পরে "Indian Literature in China and Far East" নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এবং তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি বর্মি ভ্রমণে যান, তখন ইংরেজ প্রাচ্যবিদ ডঃ লুসো তাঁকে দেখে বলেছিলেন- "I know you. Your book is on my table" বিশ্বভারতীর ঐক্যের তত্ত্বে বিশ্বাসী প্রভাত কুমার ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে লিখলেন 'পৃথিবীর ইতিহাস'। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে যুক্তিবাদের প্রতি তার স্বাভাবিক আকর্ষণে লিখেছিলেন রামমোহন ও তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্য"।

রবীন্দ্রজীবনী - তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি[সম্পাদনা]

প্রভাত কুমারের জীবনের বৃহত্তম এবং মহত্তম কীর্তি তথা সর্বশ্রেষ্ঠ অনন্য সৃষ্টি হল চার খণ্ডে রচিত "রবীন্দ্রজীবনী"। জীবনীটি লিখতে তার সময় লেগেছে দীর্ঘ পঁচিশ বছর (১৯২৯ - ৫৪)। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন-

"১৯০১ সালের শেষ দিকে আমি রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে আসি। তারপর দীর্ঘ ৩২ বছর রবীন্দ্রনাথকে দেখবার,জানবার,তার কথা শোনবার, অপার স্নেহ পাওয়ার, কবির সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক এমনকি সভা সমিতিতে তার বিরোধিতা করার সুযোগ পেয়েছিলাম।... লাইব্রেরিতে আমার ঘরে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে যে সব লেখা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত তা রাখা থাকত। রবীন্দ্রনাথ সে সব লেখার ক্লিপিং আমার হেফাজতে রেখেছিলেন। আমি একজন সহকারীর সাহায্যে সেগুলো সাজানো গোছানো করতাম। তারপর খণ্ডে খণ্ডে তা বাঁধিয়ে রাখা হত। এইসব কার্তিকা খণ্ডগুলির দিকে তাকাতাম আর ভাবতাম এগুলিকে ব্যবহার করব না? সেগুলি হল আমার রবীন্দ্রজীবনী লেখার প্রেরণা।"

প্রভাত কুমার রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে কেবলমাত্র প্রথম খণ্ডটিই ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তার অন্যান্য গ্রন্থগুলি হল —

  • 'রবীন্দ্রগ্রন্থপঞ্জি' (১৯৩২)
  • 'রবীন্দ্র জীবনকথা'
  • 'রবীন্দ্রনাথের চেনাশোনা মানুষ'
  • 'রবি কথা'
  • 'শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী'
  • 'রবীন্দ্রগ্রন্থপরিচিতি'
  • 'গীতবিতান-কালানুক্রমিক। সূচী' (স্ত্রী সুধাদেবীর সাথে যুগ্মভাবে)

অধ্যাপক শিশিরকুমার ঘোষ 'রবীন্দ্রজীবনকথা' ইংরাজীতে অনুবাদ করেন - 'Life of Tagore' নামে।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রচিত অন্যান্য গ্রন্থ গুলি হল —

  • 'ভারতের জাতীয়তা'
  • 'ভারত পরিচয়' (১৩২৮ ব)
  • 'ভারতের জাতীয় আন্দোলন ' (১৩৩১ ব)
  • 'প্রচীন ইতিহাসের গল্প'
  • 'বঙ্গপরিচয়' - দুই খণ্ড (১৩৪২ ব ও ১৩৪৩ ব)
  • 'চীনে বৃদ্ধ সাহিত্য'
  • 'জাতীয় পরিষদের দিনগুলি'
  • 'ফিরে ফিরে চাই' (১৯৭৮)
  • 'বাংলা ধর্মসাহিত্য' (১৯৮১)
  • 'সোভিয়েত সফর'

সম্মাননা[সম্পাদনা]

প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় জীবনে বহু সম্মান পুরস্কার পেয়েছেন। নানা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট. উপাধিতে ভূষিত করেছে। রবীন্দ্র জীবনীকার হিসাবে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে 'বিশ্বভারতী' বিশ্ববিদ্যালয় 'দেশিকোত্তম' ও ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের 'পদ্মভূষণ' উপাধি প্রদান করে।

অন্যান্য[সম্পাদনা]

বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগারটিকে বিশিষ্ট জ্ঞানকেন্দ্রে রূপান্তরিত করেছেন। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে শান্তিনিকেতনের পারিপার্শ্বিক পল্লী উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি শান্তিনিকেতনের উপকণ্ঠে ভুবনডাঙায় নিজস্ব বাসভবনে কাটিয়েছেন। তার স্ত্রী পণ্ডিত সীতানাথ তত্ত্বভূষণের কন্যা সুধাময়ী শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের ছাত্রী ও বোলপুর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাত্রী ও প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন।

মৃত্যু[সম্পাদনা]

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কৃত্যবিদ্যা প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ ই নভেম্বর ৯৩ বৎসর বয়সে প্রয়াত হন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Prabhatkumar Mukhopadhyaya"। Visva Bharati। 
  2. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ৪১৬,৪১৭, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  3. "রবীন্দ্রসঙ্গীতের গভীরে যেতে হলে স্বরলিপি ভাঙতে হয় না"। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-১৪