আদিবুদ্ধ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
দেবদেবী ও বুদ্ধগণের একটি মণ্ডলের কেন্দ্রে সমন্তভদ্র (কুনতুজাংপো, "সর্ব-মঙ্গল")। কুনতুজাংপো হলেন র্ন্যিং-মা সম্প্রদায়ে প্রধান আদিবুদ্ধ। তিনি কুনজেদ গ্যালপো (সর্ব-স্রষ্টা রাজা) নামেও পরিচিত।
বজ্রধর, গ্সার-মা সম্প্রদায়ের প্রধান আদিবুদ্ধ

বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে আদিবুদ্ধ (তিব্বতি: དང་པོའི་སངས་རྒྱས།ওয়াইলি: dang po'i sangs rgyas) হলেন "প্রথম বুদ্ধ" বা "আদ্যকালীন বুদ্ধ"।[১] তাঁর অপর একটি সুপরিচিত নাম হল ধর্মকায় বুদ্ধ।[২]

"আদিবুদ্ধ" শব্দটি বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাহিত্য থেকে উদ্ভূত। বিশেষত কালচক্র গ্রন্থে এই শব্দটি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে।[৩] "আদি" শব্দের অর্থ"প্রথম", এবং সেই অর্থে "আদিবুদ্ধ" বলতে বোঝায় যিনি প্রথম বুদ্ধত্ব অর্জন করেছিলেন।[৩] "আদি" শব্দের অপর অর্থ "আদ্যকালীন"; এই অর্থে শব্দটি কোনও ব্যক্তিবাচক নয়, বরং সকল চেতন সত্ত্বায় উপস্থিত এক সহজাত প্রজ্ঞার ইঙ্গিতবহ।[৩]

ইন্দো-তিব্বতি বৌদ্ধ পরম্পরায়[সম্পাদনা]

ইন্দো-তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে আদিবুদ্ধ শব্দটির দ্বারা প্রায়শই বুদ্ধ সমন্তভদ্র (র্নিং-মা সম্প্রদায়ে), বজ্রধর বা কালচক্রকে (সর্মা সম্প্রদায়ে) নির্দেশ করা হয়।[৩][৪]

ভারতে মঞ্জুশ্রীকেও আদিবুদ্ধ গণ্য করার একটি ধারা বিদ্যমান ছিল। উদাহরণস্বরূপ, মঞ্জুশ্রীনামসংগীতি গ্রন্থের বিলাসবজ্র-কৃত ভাষ্যের উল্লেখ করা যেতে পারে।[৫] বিলাসবজ্র তাঁর ভাষ্যে লিখেছেন:

জ্ঞান-সত্ত্বা মঞ্জুশ্রী দশ ভূমির অধিপতি বোধিসত্ত্ব নন, বরং অদ্বয়জ্ঞান ও প্রজ্ঞাপারমিতা স্বয়ং।[৬]

অ্যান্টনি ট্রাইবের মতে, এই ধারাটি সম্ভবত গুহ্যসমাজ ভাষ্যের জ্ঞানপাদ শাখাটিকে প্রভাবিত করেছিল। সেই কারণেই উক্ত শাখায় মঞ্জুবজ্রকে (মঞ্জুশ্রীর একটি তান্ত্রিক রূপভেদ) গুহ্যসমাজ মণ্ডলের কেন্দ্রে স্থান দেওয়া হয়।[৭]

কালচক্র পরম্পরায় আদিবুদ্ধের ধারণাটি বর্ণনা করতে গিয়ে ভেসনা ওয়ালেস বলেছেন::

কালচক্র পরম্পরায় যখন অনাদি ও অনন্ত বুদ্ধ অর্থে আদিবুদ্ধের কথা বলা হয়, তখন তা সকল সচেতন সত্ত্বার মনে পরিব্যাপ্ত সহজাত জ্ঞানের কথা ইঙ্গিত করে। এটিই সংসার ও নির্বাণের মূল ভিত্তি। পক্ষান্তরে যখন অবিনশ্বর সুখের মাধ্যমে পরম প্রজ্ঞা অর্জনকারী প্রথম ব্যক্তি অর্থে আদিবুদ্ধের কথা বলা হয়, এবং যখন এই শব্দটির মাধ্যমে পরম বুদ্ধত্ব অর্জনে প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে, তখন শব্দটি ব্যক্তির নিজস্ব সহজাত জ্ঞানের প্রকৃত উপলব্ধির কথাই ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ বলা যায় যে, কালচক্র পরম্পরায় আদিবুদ্ধ ধারণাটির দ্বারা যুগপৎ নির্দেশ করা হয় ব্যক্তিমনের পরম প্রকৃতি এবং যে ব্যক্তি মনের শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে সেই সহজাত জ্ঞানকে উপলব্ধি করেছেন তাঁকে।[৮]

কুনজেদ গ্যালপোর অনুবাদক জিম ভ্যালবির মতে, জোগচেন পরম্পরায় সমন্তভদ্র ("সর্ব-মঙ্গল") ঈশ্বর নন, বরং "কারণ ও কার্যের অতীত আমাদের চিরন্তন শুদ্ধ পারম্যের উপস্থিতি" ("our timeless Pure Perfect Presence beyond cause and effect.")।[৯]

গুহ্যসমাজ তন্ত্রে বজ্রধর সম্পর্কে বলা হয়েছে:

"[তিনি] গুরু, যাকে সকল বুদ্ধগণ নত হয়ে প্রণাম করেন, [তিনি] তিন বজ্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, মহৎ শ্রেষ্ঠের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তিন বজ্রের পরম প্রভু।"[৪]

অ্যালেক্স ওয়েম্যান দেখিয়েছেন, প্রদীপোদ্দ্যোতনা নামে একটি তান্ত্রিক ভাষ্যে "তিনটি বজ্র" বলতে দেহ, বাক্য ও মনের তিনটি রহস্য বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যেগুলি আদিবুদ্ধের পরিচায়ক। ওয়েম্যান আরও লিখেছেন:

"সং-খা-পার চ্যান-’গ্রেল গ্রন্থের ব্যাখ্যা অনুযায়ী "দেহের প্রভু": দেহের একইসঙ্গে অসংখ্য বাস্তবায়ন; "বাক্যের প্রভু": তাঁর নিজের ভাষায় সীমাহীন সচেতন সত্ত্বার প্রত্যেকটিকে ধর্ম শিক্ষা দান; "মনের প্রভু": যা কিছু জানা সম্ভব বলে মনে হয় তা সবই বুঝতে পারা।[১]

চতুর্দশ দলাই লামার মতে, মহাযান বৌদ্ধধর্মেও আদিবুদ্ধকে মহাবিশ্ব, তার বিধান ও সত্য প্রকৃতির, বোধি ও কর্মের মূর্তপ্রকাশের এবং ত্রিকায়ের একটি প্রতীক গণ্য করা হয়।[১০]

পূর্ব এশীয় বৌদ্ধধর্মে[সম্পাদনা]

জাপানি বৌদ্ধধর্মের নিচিরেন বিদ্যালয়ের মধ্যে নিক্কো-বংশ বিশেষতঃ সোকা গাক্কাই এবং নিচিরেন শোশু, নিচিরেনকে আদিবুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করে এবং তাকে বোধিসত্ত্ব হিসাবে দেখে এমন অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিতর্ককে জাগ্রত রাখে।

নেপাল ও তিব্বতে আদিবুদ্ধের প্রচলন সর্বাধিক; আনুমানিক দশ শতকে পূর্ব-ভারতের নালন্দা মহাবিহারে এ মতবাদ গৃহীত হয় বলে মনে করা হয়। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর নিকটস্থ স্বয়ম্ভূ পাহাড়ে অবস্থিত প্রধান মন্দির আদিবুদ্ধের নামে উৎসর্গীকৃত।

স্বয়ম্ভূপুরাণের একটি উপকথায় নেপালে অগ্নিশিখার আকারে আদিবুদ্ধের প্রথম অভিব্যক্তির বিবরণ আছে; যেখানে আদিবুদ্ধকে আদিনাথ এবং স্বয়ম্ভূ লোকনাথ অথবা স্বয়ম্ভূ (স্বয়ংজাত প্রভু) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। করন্ডব্যূহের পৌরাণিক উপাখ্যান মতে, আদিবুদ্ধ সর্বপ্রথমে অবলোকিতেশ্বরকে সৃষ্টি করে তাঁর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে অন্যান্য দেবদেবীদের সৃষ্টি করেন।

বজ্রধরের যুগলরূপে কল্পিত শক্তির নাম প্রজ্ঞাপারমিতা। বজ্রধরের এই একক ও যুগলবদ্ধ মূর্তি একটি (একক) শূন্যমূর্তি অন্যটি (যুগলবদ্ধ) বোধিচিত্ত, একটি শূন্যতা অপরটি করুণা, একটি পরমাত্মা অপরটি জীবাত্মা ইত্যাদিভাবে বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। মূর্তিদুটির একসঙ্গে থাকাকালীন এদের দ্বয়ভাব অদ্বয়ে পরিণত হলে উভয়ে মিলে একক মূর্তিতে পরিণত হয় বলে ধারণা।[১১]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

পাদটিকা[সম্পাদনা]

  1. Wayman, Alex (২০১৩)। The Buddhist Tantras: Light on Indo-Tibetan Esotericism। Routledge। পৃষ্ঠা 53। আইএসবিএন 978-1-135-02922-7 
  2. Gray, David (2007), The Cakrasamvara Tantra (The Discourse of Sri Heruka): Śrīherukābhidhāna: A Study and Annotated Translation (Treasury of the Buddhist Sciences), p. 32.
  3. Buswell, Robert E.; Lopez, Jr., Donald S. (2013). The Princeton dictionary of Buddhism. Princeton: Princeton University Press. আইএসবিএন ৯৭৮১৪০০৮৪৮০৫৮. Entry on "ādibuddha".
  4. Wayman, Alex; The Buddhist Tantras: Light on Indo-Tibetan esotericism, page 53.
  5. Tribe, Anthony (2016). Tantric Buddhist Practice in India: Vilāsavajra’s commentary on the Mañjuśrī-nāmasaṃgīti, p. 3. Routledge.
  6. Tribe, Anthony (2016). Tantric Buddhist Practice in India: Vilāsavajra’s commentary on the Mañjuśrī-nāmasaṃgīti, p. 8. Routledge.
  7. Tribe, Anthony (2016). Tantric Buddhist Practice in India: Vilāsavajra’s commentary on the Mañjuśrī-nāmasaṃgīti, p. 8. Routledge.
  8. Wallace, Vesna (2001). The Inner Kalacakratantra: A Buddhist Tantric View of the Individual, p. 18. Oxford University Press. Quote: when the Kalacakra tradition speaks of the Ādibuddha in the sense of a beginningless and endless Buddha, it is referring to the innate gnosis that pervades the minds of all sentient beings and stands as the basis of both samsara and nirvana. Whereas, when it speaks of the Ādibuddha as the one who first attained perfect enlightenment by means of imperishable bliss, and when it asserts the necessity of acquiring merit and knowledge in order to attain perfect Buddhahood, it is referring to the actual realization of one's own innate gnosis. Thus, one could say that in the Kalacakra tradition, Ādibuddha refers to the ultimate nature of one's own mind and to the one who has realized the innate nature of one's own mind by means of purificatory practices.
  9. Valby, Jim (2016). Ornament of the State of Samantabhadra - Commentary on the All-Creating King - Pure Perfect Presence - Great Perfection of All Phenomena. Volume One, 2nd Edition, p. 3.
  10. "Dalai Lama Answers Questions on Various Topics"hhdl.dharmakara.net (ইংরেজি ভাষায়)। 
  11. Sunithananda, Bhikkhu (২০১২)। "Adibuddha"Islam, Sirajul; Jamal, Ahmed A.। Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh (Second সংস্করণ)। Asiatic Society of Bangladesh 

গ্রন্থপঞ্জী[সম্পাদনা]

  • Grönbold, Günter (1995). Weitere Adibuddha-Texte, Wiener Zeitschrift für die Kunde Südasiens / Vienna Journal of South Asian Studies 39, 45-60