তাকওয়া

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

তাকওয়া (আরবি: تقوى) শব্দের অর্থ বিরত থাকা, বেঁচে থাকা, নিষ্কৃতি লাভ করা, ভয় করা, নিজেকে রক্ষা করা। ব্যবহারিক অর্থে: দ্বীনদারি, ধার্মিকতা, পরহেজগারি, আল্লাহভীতি, খোদাভীতি, আত্মশুদ্ধি , আল্লাহ ও সত্যের প্রতি সচেতন এবং পরিজ্ঞাত হওয়া, "ধর্মপরায়ণতা, আল্লাহর ভয়" ইত্যাদি বোঝায়।

ইসলামি পরিভাষায়,

সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে হারাম থেকে বেঁচে থাকা এবং তাঁর হুকুম-আহকাম মেনে চলাই হল তাকওয়া।[১] অন্যকথায় সকল প্রকার হারাম থেকে নিজেকে রক্ষা করে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করাকে তাকওয়া বলা হয়।

এটি প্রায়শই কুরআনে পাওয়া যায়। যারা তাকওয়া অনুশীলন করে — ইবনে আব্বাসের ভাষায়, "আল্লাহর সাথে শিরক পরিহার করে এবং তাঁর আনুগত্যে কাজ করে এমন বিশ্বাসী"- তাদের বলা হয় মুত্তাকি (আরবি: مُتَّقِينَ, আল-মুত্তাকিন, ধার্মিক) বা তাক্বী (আরবি: تقي)।

শব্দতত্ত্ব[সম্পাদনা]

"তাকওয়া" শব্দটি ওয়াকা (আরবি: وقى) ক্রিয়া থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার আক্ষরিক অর্থ আত্মরক্ষা, সংরক্ষণ, সুরক্ষা, ঢাল ইত্যাদি। আরবি শব্দ তাকওয়া মানে "সহনশীলতা, ভয় এবং বিরত থাকা। সূরা লাইল এর ৮ নং আয়াত অনুযায়ী তাকওয়ার বিপরীত হলো ইস্তিগনাহ (আরবি: اسْتِغْنَاء), এটি আরবি ক্রিয়ামূল গনী (আরবি: غَنِيٌّ) থেকে এসেছে, যার অর্থ অভাবমুক্ত হওয়া, সুতরাং ইস্তিগনাহর যে সকল অর্থ হতে পারে বা যে সকল আভিধানিক অর্থ পাওয়া গিয়েছে সে অনুযায়ী এর ইসলামী অর্থ হলো আল্লাহর সীমা থেকে মুক্ত হওয়া, বেপরোয়া আচরণ করা, বাড়াবাড়ি করা, সীমালঙ্ঘন করা, দুঃসাহস দেখানো, দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা ইত্যাদি।

ইসলামিক উৎস থেকে শব্দটির কিছু বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত:

  • "আল্লাহর চেতনা... ধার্মিকতা, আল্লাহর ভয়, আল্লাহর প্রতি ভালবাসা এবং আত্মসংযম"।
  • "আল্লাহর-চেতনা বা খোদাভীরু তাকওয়া", "পুণ্য", "সতর্কতা"।
  • আল্লাহর ভয়, "সতর্ক থাকা, পরকালে নিজ স্থান জেনে রাখা"। তাকওয়ার "প্রমাণ" হল আল্লাহর "ভয় পাওয়ার অভিজ্ঞতা", যা "একজন ব্যক্তিকে অন্যায় কাজ থেকে সতর্ক থাকতে অনুপ্রাণিত করে" এবং আল্লাহকে খুশি করে এমন কাজ করতে আগ্রহী করে।
  • আক্ষরিক অর্থে "রক্ষা করা"। সাধারণভাবে, নিজেকে "আল্লাহর ক্রোধ থেকে" রক্ষা করার জন্য "আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তাতে লিপ্ত না হওয়া"।
  • "হৃদয়ের একটি উচ্চ অবস্থা, যা একজনকে আল্লাহর উপস্থিতি এবং তাঁর জ্ঞান সম্পর্কে সচেতন রাখে।" তাকওয়া সেই ব্যক্তিকে অনুপ্রাণিত করে যে এটি "সৎ কাজ করতে" এবং নিষিদ্ধ কাজগুলি এড়িয়ে চলতে নিজের মাঝে ধারণ করে।
  • এরিক ওহল্যান্ডারের মতে, কুরআনিক আরবীতে, তাকওয়া বলতে বোঝায় আল্লাহর অসন্তুষ্ট করা থেকে নিজেকে রক্ষা করার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহকে ভয় করা।
  • (আল্লাহর দেওয়া) নিরাপদ সীমার ভেতরে থেকে নিজেকে রক্ষা করা।

কুরআন[সম্পাদনা]

এরিক ওহল্যান্ডারের মতে, "তাকওয়া" শব্দটি কুরআনে ১০০ বারের বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। [২] "অক্সফোর্ড ডিকশনারি অফ ইসলাম" অনুসারে, "তাকওয়া" শব্দটি এবং এর থেকে উৎপন্ন শব্দসমূহ কুরআনে "২৫০ বারের বেশি" উপস্থিত হয়েছে।[৩]

এটা সেই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই, (এটি) মুত্তাকিনদের (যারা তাকওয়া অবলম্বন করে অর্থাৎ আল্লাহকে মেনে চলে তাদের) জন্য হেদায়েত বা পথনির্দেশ।

তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।

— হুজুরাত:১৩

হে মু’মিনগণ বা বিশ্বাসীগণ! আল্লাহকে তাকওয়া করো বা মেনে চলো যেমনভাবে তাঁকে তাকওয়া করা বা মেনে চলা উচিত। আর তোমরা (পরিপূর্ণ) মুসলিম বা আত্মসমর্পণকারী না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।

— সূরা আলে-ইমরান, ৩ঃ১০২

কাজেই তোমরা আল্লাহকে তাকওয়া কর বা মেনে চলো তোমাদের পরিপূর্ণ সাধ্য অনুযায়ী, তোমরা (তাঁর বাণী, আদেশ নিষেধ) শুন, তোমরা (তাঁর) আনুগত্য কর এবং (তাঁর পথে) ব্যয় কর, এটা তোমাদের নিজেদেরই জন্য কল্যাণকর। যারা অন্তরের সংকীর্ণতা (شُّحَّ, শুহহা) থেকে রক্ষা পেল, তারাই সফলকাম।

— সূরা তাগাবুন ৬৪ঃ১৬

বল, ‘পার্থিব ভোগ অতি সামান্য এবং যে মুত্তাকী তার জন্য পরকালই উত্তম। আর তোমাদের প্রতি খেজুরের আঁটির ফাটলে সুতো বরাবর (সামান্য পরিমাণ)ও যুলুম করা হবে না।’

— নিসা, ৪:৭৭

বস্তুতঃ ক্ষমা করাই তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী এবং তোমরা পারস্পরিক সহায়তা হতে বিমুখ হয়ো না, যা কিছু তোমরা করছ আল্লাহ নিশ্চয়ই তার সম্যক দ্রষ্টা।

— বাকারা, ২ঃ২৩৭

কুরআনে তাকওয়ার ফজিলত[সম্পাদনা]

তাকওয়া দ্বারা, একজন ব্যক্তিকে কষ্ট থেকে রক্ষা করা হয়, সন্দেহ দূর করা হয়, এবং আল্লাহ তার জন্য সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্তি এবং সমস্ত বিপদ থেকে মুক্তির পথ তৈরি করেন এবং তার জন্য এমন জায়গা থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করেন যেখান থেকে তিনি আশাও করেন না। পাশাপাশি আল্লাহ তাকে ফোরকান বা জ্ঞানচক্ষু বা বিবেক[৪] দান করেন যার দ্বারা সে হক ও বাহিল পার্থক্যকারী হিতাহিত জ্ঞান লাভ করে। কুরআনে এসেছে,

‘যে আল্লাহকে তাকওয়া করে (ভয় করে ও মেনে চলে), তিনি তার জন্য (সমস্যা থেকে) উত্তরণের (মুক্তির/নিষ্কৃতির) পথ তৈরি করে দেন। আর তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দেন; যা সে ধারণাও/কল্পনাও করতে পারে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা করে; আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। .. যে আল্লাহকে তাকওয়া করে বা মেনে চলে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।...আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে তাকওয়া করে বা মেনে চলে, আল্লাহ তার পাপসমূহ মুছে দেন এবং তার কর্মের প্রতিফল/প্রতিদান/পুরস্কারকে বেশি/বর্ধিত করে দেন।

— (সুরা তালাক : আয়াত ২-৫)

সুতরাং যে দান করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে (আল্লাহর তথা ইসলামের আদেশ নিষেধ মেনে চলে), আর উত্তমকে সত্যায়ন করে ও বিশ্বাস করে, আমি তার জন্য সহজ পথে চলা সহজ করে দেই। আর যে কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয় বা ইস্তিগনাহ করে এবং উত্তম বিষয়কে অসত্যায়ন ও অবিশ্বাস করে, আমি তাকে কষ্টের বিষয়ের জন্যে সহজ পথ দান করি।

— সূরা লাইল, ৯২: ৫-৭

হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর তবে তিনি তোমাদেরকে ফুরকান (আরবি ফারাক বা পার্থক্য হতে আগত, পার্থক্যকারী, ন্যায়-অন্যায় (হক-বাতিল) পার্থক্য করার শক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি, মানদণ্ড, অন্তরচক্ষু, জ্ঞানচক্ষু, হিতাহিত জ্ঞান) দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। এবং আল্লাহ্ মহাকল্যাণের অধিকারী।

— সূরা আনফাল ৮:২৯

কুরআনে তাকওয়ার বিনিময়ে আল্লাহর দেওয়া যে ফজিলতগুলোর কথা এসেছে তার মধ্যে ইহকালীন ফজিলতগুলো হলঃ

  • আল্লাহর হিদায়েত লাভ হওয়া [সূরা বাকারা: (১-২)]‎
  • আল্লাহর রহমত লাভ [সূরা আরাফ: (১৫৬)]
  • আল্লাহর মহব্বত লাভ [সূরা আলে ইমরান: (৭৬)]‎
  • পার্থিব জগতে আল্লাহর সংঘ ও সাথীত্ব অর্জন [সূরা হাদীদ: (৪)], [সূরা মুজাদিলা: (৭)], [সূরা তওবা: (৪০)], [সূরা নাহাল: (১২৮)], [সূরা বাকারা: (১৯৪)]
  • শুভ পরিণতি বা শেষ ফল লাভ [সূরা ত্বহা: (১৩২)], [সূরা সাদ: (৪৯)], [‎সূরা হুদ: (৪৯)]‎
  • পার্থিব জগতে সুসংবাদ লাভ [সূরা ‎ইউনুস: (৬৩-৬৪)]
  • পার্থিব জগতে কাজ সহজ হওয়া [সূরা লাইল: (৫-৭)]
  • কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া এবং এমন জায়গা থেকে রিযক লাভ ‎করা, যা কল্পনার ঊর্ধ্বে। [সূরা তালাক: (২-৩)‎]
  • দুনিয়াবাসীর তাকওয়ার ফলে আসমান ও যমিনের বরকত উন্মুক্ত হওয়া [সূরা আরাফ: (৯৬)]‎
  • আমল বিশুদ্ধ হওয়া ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করা এবং পাপ মোচন হওয়া। [সূরা আহযাব: (৭০-৭১)]‎
  • দুনিয়া ও আখেরাতের কোন প্রতিদান নষ্ট না হওয়া [সূরা ইউসুফ: (৯০)]‎
  • শয়তানের সব অনিষ্ট থেকে সুরক্ষা [সূরা আরাফ: (২০১)]
  • কাফেরদের অনিষ্ট থেকে নিরাপত্তা লাভ [সূরা ‎আলে ইমরান: (১২০)]‎
  • মুসিবত ও দুশমনের মোকাবিলার মুহূর্তে আসমান থেকে সাহায্য অবতীর্ণ হওয়া [সূরা আলে ইমরান: (১২৩-১২৫)]
  • মুসিবত ও সীমালঙ্ঘন থেকে নিরাপত্তা লাভ [সূরা মারইয়াম: (১৭-১৮)]‎
  • রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আদব প্রদর্শনে সক্ষম হওয়া [সূরা হুজুরাত: (৩)]‎
  • আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে সক্ষম হওয়া। [সূরা ‎হাজ্জ: (৩২)]‎
  • ফুরকান (হক ও বাতিল এবং সত্য ও মিথ্যা পার্থক্য করার জ্ঞান) লাভ করা [সূরা আনফাল ৮:২৯] [সূরা ‎হাদীদ: (২৮)]‎
  • ইলম ও জ্ঞান অর্জন [সূরা বাকারা: (২৮২)]‎
  • অন্তরের সংকীর্ণতা (شُّحَّ, শুহহা) থেকে মুক্ত হওয়া [তাগাবুন  : ১৬]
  • যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তারা মুত্তাকী নারীদের ওপর লোভ করার সুযোগ ও সাহস পায় না [সূরা ‎আহযাব: (৩২)]‎
  • মুত্তাকীরা অসিয়ত ও ভাগ-বণ্টনে কারো ওপর যুলুম করে না [সূরা বাকারা: (১৮০)]‎
  • মুত্তাকী পুরুষদের থেকে তালাক প্রাপ্ত নারীদের জরুরী খোর-পোষ ও বরণ-পোষণ লাভ [সূরা বাকারা ‎‎: (২৪১)]

পরকালীন উপকারিতাগুলো হলো:

  • আখেরাতে আল্লাহর নিকট সম্মান লাভ হবে। [সূরা হুজুরাত: (১৩)]‎
  • আখিরাতে সফলতা ও কামিয়াবির চাবিকাঠি হবে। [সূরা হুজুরাত: (৫২)]‎
  • কিয়ামতের দিন আল্লাহর শাস্তি থেকে নাজাত মিলবে। [সূরা মারইয়াম: ‎‎(৭১-৭২)] [সূরা লাইল: (১৭)]‎
  • আমল কবুল হবে। [সূরা মায়েদা: (২৭)]‎
  • জান্নাতের মিরাস ও উত্তরাধিকার লাভ হবে। [সূরা মারইয়াম: (৬৩)]‎
  • আখেরাতে জান্নাতে সুদৃঢ় প্রাসাদ থাকবে, যার উপরেও থাকবে প্রাসাদ, তার নিচ দিয়ে ‎নদী প্রবাহিত।[সূরা যুমার: (২০)]‎ [টীকা ১]
  • কিয়ামতের দিন পুনরুত্থানের মুহূর্তে, হাশরের ময়দানে, চলার পথে ও বসার ‎‎স্থানে কাফেরদের উপরে অবস্থান করবে। তারা জান্নাতের সুউচ্চ স্থানে সমাসীন হবে। [সূরা বাকারা: (২১২)]‎
  • আখেরাতে জান্নাত লাভ হবে [সূরা আলে ইমরান: (১৩৩)] [সূরা মায়েদা: (৬৫)]‎

“যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার ভয় (خَافَ, খাফা) করবে ও কুপ্রবৃত্তি থেকে বেঁচে থাকবে, তার স্থান হবে জান্নাত।”

— (সূরা আন-নাযিআত, আয়াত ৪০-৪১)
  • আখেরাতে গুনাহের কাফফারা হবে। [সূরা মায়েদা: (৬৫)]
  • আখেরাতে মনের চাহিদা পূরণ হবে ও চোখের শীতলতা লাভ হবে।[সূরা নাহাল: (৩১)] ‎
  • আখেরাতে ভয় ও পেরেশানি দূর হবে এবং কিয়ামতের দিন কোন অনিষ্ট মুত্তাকীকে স্পর্শ করতে পারবে না। [আল-জুমার : ৬০] [সূরা ইউনুস: (৬২-৬৩)]‎
  • কিয়ামতের দিন অভিযাত্রী দল হিসেবে (বর যাত্রীর ন্যায়) উপস্থিত করা হবে। তারা বাহনে চড়ে ‎আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে, এরাই সর্বোত্তম অভিযাত্রী। [সূরা মারইয়াম: (৮৫)]‎[৫]
  • আখেরাতে জান্নাত কাছে নিয়ে আসা হবে। [সূরা শুআরা: (৯০)] [সূরা ক্বাফ: (৩১)]‎
  • আখেরাতে পাপী ও কাফেরদের বরাবর হবে না। [সূরা সাদ: (২৮)]‎
  • সকল বন্ধুত্ব কিয়ামতের দিন শত্রুতায় পরিণত হবে, শুধু মুত্তাকীদের বন্ধুত্ব ব্যতীত। [সূরা যুখরুফ: (৬৭)]‎
  • আখেরাতে নিরাপদ স্থান, জান্নাত ও ঝর্ণাধারা থাকবে। [সূরা দুখান: (৫১-৫৬)]‎
  • আখেরাতে আল্লাহর নিকট তাদের তাকওয়া অনুপাতে বিভিন্ন আসন থাকবে। [সূরা ‎কামার: (৫৪-৫৫)]‎
  • আখেরাতে বিভিন্ন নহরে গমন করতে পারবে। যেমন পরিচ্ছন্ন পানির নহর, সুস্বাদু দুধের নহর যার স্বাদ কখনো নষ্ট হবে না এবং মজাদার শরাব, যা পানকারীদের জন্য হবে সুপেয়। [সূরা মুহাম্মদ: (১৫)] [টীকা ২]
  • আখেরাতে তাকওয়ার ফলে মুত্তাকীরা জান্নাতের বৃক্ষসমূহের তলদেশ দিয়ে বিচরণ করবে ও তার ছায়া উপভোগ করবে। [সূরা মুরসালাত: (৪১-৪৩)]‎
  • আখেরাতের মহাভীতির কারণে পেরেশান হবে না। তাদের সাথে ফেরেশতারা সাক্ষাত করবে সূরা ইউনুস: (৬২-৬৪)‎ [সূরা আম্বিয়া: (১০৩)]‎
  • আখেরাতে রয়েছে চমৎকার ঘর। [সূরা নাহাল: (৩০)‎]
  • আখেরাতে তাদের নেকি ও প্রতিদান বহুগুন বর্ধিত করা হবে। [ সূরা হাদীদ: (২৮)]

হাদীস[সম্পাদনা]

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো, কোন কাজটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহভীতি (তাকওয়া) ও উত্তম চরিত্র।’ আবার তাকে প্রশ্ন করা হলো, কোন কাজটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘মুখ ও লজ্জাস্থান।’

— তিরমিজি, হাদিস : ২০০৪

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন, "জনমণ্ডলী! তোমাদের প্রভু একজন। তোমাদের পিতাও একজন। তোমরা সবাই আদম থেকে আর আদম মাটি থেকে সৃষ্টি। তোমাদের মাঝে যারা সর্বাধিক মুত্তাকি, খোদাভীরু তারাই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান। তাকওয়া ছাড়া কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।/হে লোক সকল! নিশ্চয়ই তোমাদের পালনকর্তা এক এবং তোমাদের পিতা (আদম) এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে উত্তম নয় এবং একজন অনারব একজন আরবের চেয়ে উত্তম নয়; একজন লাল মানুষ একজন কালো মানুষের চেয়ে উত্তম নয় এবং একজন কালো মানুষ লাল মানুষের চেয়ে উত্তম নয় - শুধুমাত্র তাকওয়া (তাকওয়া) ব্যতীত..."

— (মুসনাদে আহমদ, ২২৩৯১, ২২৯৭৮; আল-সিলসিলাত আল-সহীহ, ২৭০০)।

ইবনু ’উমার (রাঃ) বলেন, ’বান্দা প্রকৃত তাকওয়ায় পৌঁছতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে, মনে যে বিষয় সন্দেহের সৃষ্টি করে, তা পরিত্যাগ না করে।

— বুখারী ২

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তাকে জুলুম করবে না। তাকে লাঞ্ছিত ও তুচ্ছ মনে করবে না। তাকওয়া এখানে থাকে। এ বলে তিনি তার বুকের দিকে তিনবার ইশারা করলেন। কোন লোকের খারাপ হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ মনে করবে। প্রত্যেক মুসলিম একে অন্যের উপর হারাম, তার রক্ত, তার সম্পদ ও তার সম্মান হরণ করা।

— (মুসলিম হাঃ ৩২-[২৫৬৪])

আবূ উমামাহ রাদিয়াল্লাহু ’আনহু বলেন যে, আমি বিদায় হজ্জের অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ভাষণ দিতে শুনেছি, ’’তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, তোমাদের পাঁচ ওয়াক্তের (ফরয) নামায পড়, তোমাদের রমযান মাসের রোযা রাখ, তোমাদের মালের যাকাত আদায় কর এবং তোমাদের নেতা ও শাসকগোষ্ঠীর আনুগত্য কর (যদি তাদের আদেশ শরীয়ত বিরোধী না হয়), তাহলে তোমরা তোমাদের প্রভুর জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’

— তিরমিযী ৬১৬, আহমাদ ২১৬৫৭, ২১৭৫৫, (তিরমিযী, তিনি বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ)

আবূ বকর ইবনু আবূ শায়বা, ইসহাক ইবনু ইবরাহীম ও মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু নুমায়র (রহঃ) ... যাযিদ ইবনু আরকাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি তোমাদের কাছে তেমনই বলব যেমন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন। তিনি (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলতেনঃ "হে আল্লাহ! আমি আপনার কছে আশ্রয় চাই, অক্ষমতা, অলসতা, কাপুরুষতা, কৃপণতা, বার্ধক্য এবং কবরের আযাব থেকে। হে আল্লাহ! আপনি আমার নফসে (অন্তর) তাকওয়া দান করুন এবং একে পরিশুদ্ধ করে দিন। আপনি একে সর্বোত্তম পরিশোধনকারী, আপনিই এর মালিক ও এর অভিবাবক। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই অনুপকারী ইলম থেকে ও ভয় ভীতিহীন কলব থেকে; অতৃপ্ত নফস থেকে ও এমন দুআ থেকে যা কবুল হয় না।"

— মুসলিম ৬৬৫৮

আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (দু’আয়) বলতেন,

’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আস্আলুকাল হুদা- ওয়াত্তুকা- ওয়াল ’আফা-ফা ওয়াল গিনা-’’

(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে হিদায়াত [সঠিক পথ], তাকওয়া [পরহেযগারিতা], হারাম থেকে বেঁচে থাকা ও অমুখাপেক্ষিতা প্রত্যাশা করি)।

— মুসলিম ২৭২১, তিরমিযী ৩৪৮৯, ইবনু মাজাহ ৩৮৩২, ইবনু আবী শায়বাহ্ ২৯১৯২, আহমাদ ৩৯৫০, সহীহ ইবনু হিব্বান ৯০০, সহীহ আল জামি‘ ১২৭৫।

আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেনঃ তুমি যেখানেই থাক আল্লাহ্ তা’আলাকে তাকওয়া কর (ভয় কর ও মেনে চলো), মন্দ কাজের পরপরই ভাল কাজ কর, তাতে মন্দ দূরীভূত হয়ে যাবে এবং মানুষের সাথে উত্তম আচরণ কর

— , মিশকাত ৫০৮৩, তিরমিজী ১৯৮৭

ফিকহ[সম্পাদনা]

তাফসির ইবনে কাসির এর মতে তাকওয়ার মূল অর্থ হল কোনটি আল্লাহ অপছন্দ করেন তা এড়ানো। উমর বিন খাত্তাব, উবাই ইবনে কাবকে তাকওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাবে বললেন, "আপনি কি কখনো এমন পথে হেঁটেছেন যেখানে কাঁটা বিছানো রয়েছে?" উমর বললেন, হ্যাঁ। উবাই জিজ্ঞাসা করলেন, "তখন আপনি কি করেছেন?" এর উত্তরে উমর বললেন, আমি অনেক সচেতনতার সাথে পথ চলেছি যাতে কাঁটা থেকে নিরাপদে থাকা যায় ।" উবাই বলেন, "এটিই তাকওয়া, জীবনের বিপজ্জনক যাত্রার মধ্য দিয়ে নিজেকে পাপ থেকে রক্ষা করা, যাতে পাপের দ্বারা আবদ্ধ না হয়ে সবসময় সতর্কতার সাথে থেকে যাত্রা সফলভাবে শেষ করা যায়"।[৬]

ওমর বিন আবদুল আজিজ বলেন, "দিনে রোজা রাখা বা রাত জেগে ইবাদত করার নাম তাকওয়া নয়; বরং তাকওয়া হলো আল্লাহ যা ফরজ করেছেন তা মানা এবং যা হারাম করেছেন তা থেকে দূরে থাকা।"[৭]

ইবনে তাইমিয়া বলেন, "তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা প্রতিপালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করা।"[৮]

জারুল্লাহ যামাখশারী বলেন, “ইসলামী শরীআতের পরিভাষায় মুত্তাকী হল ঐ ব্যক্তি, যে নিজ সত্তাকে রক্ষা করে এমন বিষয় থেকে, যার জন্য সে শাস্তির উপযোগী হয়ে যায়; সেটি করণীয় হোক বা বর্জনীয়।"[৯]

ফিকহ (ইসলামী আইনশাস্ত্র) এর কমপক্ষে একটি জনপ্রিয় রচনায় "কিতাবুত তাকওয়া বা তাকওয়ার বই", যা হারাম (নিষিদ্ধ) বিষয় সম্পর্কে নিষেধ করেছে, মাকরুহ (নিরুৎসাহিত) এবং "ইসলামের স্তম্ভগুলি" এর বাইরে বিষয়গুলিও নিষিদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: খাবার, পোশাক, যৌনতার সাথে সম্পর্কিত জিনিসগুলি ("ব্যক্তিগত বিষয়গুলি"), সংগীত, পরনিন্দা, খারাপ কথা, খারাপ সঙ্গ, দাড়ি ছাঁটাই ইত্যাদি।[১০]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

টীকা[সম্পাদনা]

  1. হাদীসে এসেছে:‎ { إن في الجنة لغرفاً يرى بطونها من ظهورها، وظهورها من بطونها } فقال أعرابي: لمن هذا يا رسول الله؟ قال: { لمن أطاب الكلام، وأطعم الطعام، وصلّى بالليل والناس نيام }. “নিশ্চয় জান্নাতের মধ্যে এমন কিছু প্রাসাদ রয়েছে, যার অভ্যন্তর বাহির থেকে দেখা যাবে এবং বাহির ভেতর থেকে দেখা ‎যাবে। এক বেদুঈন জিজ্ঞাসা করল: হে আল্লাহর রাসূল, এ প্রাসাদগুলো কার জন্যে হবে ? তিনি বললেন: “যে সুন্দর কথা ‎বলবে, খানা খাওয়াবে ও মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকবে, তখন সে সালাত পড়বে।‎
  2. হাদীসে এসেছে, ‎রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:‎ { إذا سألتم الله تعالى فاسألوه الفردوس، فإنه أوسط الجنة وأعلى الجنة، ومنه تفجر أنهار الجنة، وفوقه عرش الرحمن }. “তোমরা যখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, তখন জান্নাতুল ফেরদাউসের প্রার্থনা করবে। কারণ এটা মধ্যবর্তী ও সর্বোচ্চ ‎জান্নাত, সেখান থেকে নহরসমূহ প্রবাহিত। তার উপরে রয়েছে আল্লাহর আরশ।‎

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "তাকওয়া : এক মহিমান্বিত গুণ - মাসিক আলকাউসার"আল-কাউসার। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০২৩ 
  2. Erik S. Ohlander. "Fear of God (taqwa) in the Qur'an: Some Notes on Semantic Shift and Thematic Context." Journal of Semitic Studies 50.1 (2005): 137-52. Print.
  3. John L. Esposito, সম্পাদক (২০০৩)। The Oxford Dictionary of Islam। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 314। আইএসবিএন 978-0-19-975726-8। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৭-১৫ 
  4. Hodgson, Douglas Charles (২৬ মে ২০২৩)। Transcendental Spirituality, Wisdom and Virtue: The Divine Virtues and Treasures of the Heart (ইংরেজি ভাষায়)। John Hunt Publishing। আইএসবিএন 978-1-80341-144-6। সংগ্রহের তারিখ ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩ 
  5. ইবনে কাসীর রহ. নুমান ইব্‌ন বাশির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন:‎ ( كنا جلوساً عند علي فقرأ هذه الآية: يَوْمَ نَحْشُرُ الْمُتَّقِينَ إِلَى الرَّحْمَنِ وَفْدًا.. قال: لا والله ما على أرجلهم يحشرون، ولا يحشر الوفد على أرجلهم، ولكن بنوق لم ير الخلائق مثلها، عليها رحائل من ذهب، فيركبون عليها حتى يضربوا أبواب الجنة ). আমরা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু নিকট বসে ছিলাম, তিনি আমাদেরকে উপরোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করে শুনালেন। তিনি বললেন: ‎আল্লাহর শপথ, তারা তাদের পায়ে ভর করে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবে না। আর অভিযাত্রীদের পায়ে হেঁটে উপস্থিত ‎করানো হয় না, বরং এক ধরণের বাহন থাকবে, অনুরূপ বাহন কেউ দেখেনি। তার উপর স্বর্ণের শিবিকা থাকবে, তার উপর ‎চড়ে তারা জান্নাতের দরোজাসমূহ অতিক্রম করবে। ‎
  6. আবদুর-রহমান, মুহাম্মদ সাঈদ (২০০৯)। মহিমান্বিত কুরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা। এমএসএ পাব্লিকেশন লিমিটেড। পৃষ্ঠা ৬৩। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জুলাই ২০১৫ 
  7. ফয়সাল, ফেরদৌস (২০২৩-০৩-২৯)। "তাকওয়া আল্লাহর ভালোবাসা আদায়ের পথ"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-১৫ 
  8. কাবীরুল ইসলাম, মুহাম্মাদ (নভেম্বর ২০১৩)। তাক্বওয়া (আল্লাহভীতি) (পিডিএফ)। রাজশাহী: শ্যামলবাংলা একাডেমী। পৃষ্ঠা ৫। আইএসবিএন 978-984-337930-6। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুলাই ২০২৩ 
  9. "ইসলামে 'তাকওয়া'র স্বরূপ ও সমাজ জীবনে এর প্রভাব - IslamHouse.com"islamhouse.com। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুলাই ২০২৩ 
  10. ফিকহের প্রয়োজনীয় হানাফী হাতবই, মাওলানা ইউসুফ তালাল আলী আল-আমরিকির রচিত 'কাজী থানা উল্লাহর মা লা বুদা মিনহু' এর একটি অনুবাদ, (কাজী পাবলিকেশনস, লাহোর, পাকিস্তান), পাতা ১৫০-১৬৮

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]