পূর্ববঙ্গীয় রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
লর্ড কর্নওয়ালিস বাংলায় ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন করেন যার ফলে জমিদাররা শাসক শ্রেণীরূপে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।

পূর্ববঙ্গীয় রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন-১৯৫০ (পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ আইন ১৯৫০ নামেও পরিচিত) তদানীন্তন পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত পূর্ব বাংলার নবগঠিত গণতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক গৃহীত একটি আইন ছিল। ১৯৪৮ ইং সনের ৩১ মার্চ পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিকে এই বিলটির খসড়া হয়েছিল যা ১৯৫১ ইং সনের ১৬ মে পাস হয়েছিল। এটি আইন সভায় পাস হওয়ার আগে বাংলায় ভূমি রাজস্ব আইনসমূহে ১৭৯৩ইং সনের স্থায়ী বন্দোবস্ত বিধিমালা ও ১৮৮৫ সনের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব বিধিমালা প্রযোজ্য ছিল।

১৭৯৩ইং সনের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় একটি ভূমি অভিজাত শ্রেণী সৃষ্টি করা হয়েছিল যারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত থাকবে। গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৯৩ইং সনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথাটি এই দেশে প্রবর্তন করেছিলেন। ১৮৮৫ইং সনের আইনে জমিদারদের সাথে রায়তের অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত ছিল। ১৯৪৮ইং সনে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে আইনটি এই অঞ্চলে জমিদারী প্রথা বাতিল করে এবং সমস্ত ভূমি ফেডারেল সরকারে অধীনে চলে যায়। এটাকে সামন্ত শ্রেণীর পরিবর্তে রাজ্যে জনগণের গণতান্ত্রিক নীতি হিসেবে দেখা হত। ১৯৫৩ইং সনে ভারতের সংবিধানে অনুরূপ একটি আইন প্রবর্তন করা হয়। আধুুনিক পাকিস্তানে এটি আর সংশোধন হয়নি যার ফলে পাকিস্তানের রাজনীতি এবং সরকারে সামন্তপ্রথা একটা বিরাট প্রভাব বিস্তার করছে।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

ভারতবর্ষের মধ্য রাজ্যগুলোর সময়ে খাজনাকে বলা হত “রাজস্ব”। রাজার লোকজন আইনমতে তাঁর প্রজাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতেন। যারা নিয়মিত রাজস্ব দিতেন তাদেরকে উচ্ছেদ করা যেতো না। পরবর্তীতে মুঘল শাসনামলে হিন্দু রাজস্ব “জমা” নামে পরিবর্তিত হয়। মূলত রাজস্ব এবং জমা এর চেতনা একই ছিল। কৃষকগণ যতক্ষণ শাসকদের রাজস্ব দিতেন প্রচলিত নিয়মে ততক্ষণ সম্মানিত ভূমিতে তাদের সার্বভৌম অধিকার থাকত। সামন্ত আভিজাত্য তৈরীকারী সাম্রাজ্যের আধিকারিক জমিদারগণকে এর রাজস্ব প্রদান করা হত। মুঘল আমলে বিশেষতঃ সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মনসবদারি প্রথা, সামরিক আভিজাত্য অভিজাত জমিদারী ব্যবস্থায় পরিবর্তিত হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদারগণ ভূমি আভিজাত্যদের সমতুল্য হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। ১৭৯৩ইং সনে জমিদারগণ শুধু সার্বভৌম রাজ্যের প্রতিনিধি নয় তারা ভূমির সার্বভৌম মালিক হয়ে উঠেন।[১][২]

বিলোপ[সম্পাদনা]

এই আইনটি ১৫২ টি ধারা ৫টি অংশ এবং ১৯টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এই আইনটি প্রবর্তনের ফলে সরকার ও জনগণের মধ্যে কোন মধ্যবর্তী সুদ ছিল না, সরকার হয়েছিল একমাত্র প্রভূ এবং জনগণ সামন্ত প্রভাব থেকে মুক্তি পেয়েছিল। জমিদার পরিবার গুলো আদালতে কয়েকটি মামলার পর জমির মালিকানা হস্তান্তরে তাদের ক্ষতির জন্য তাদেরকে কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল। জমিদারদের শাসন ক্ষমতা ভূমি প্রশাসন বোর্ডের সরকারী কর্মকর্তা যেমন-সহকারী কমিশনার, কালেক্টর এবং ডেপুটি কমিশনার এদের হাতে ন্যাস্ত হয়। কালেক্টর বা জেলা প্রশাসককে একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), একজন উপ-রাজস্ব কালেক্টর এবং কিছু সংখ্যক সরকারী কর্মচারী সহযোগিতা করে থাকেন।

ঢাকার নবাব পরিবার, পৃথিমপাশা পরিবার, দিঘাপতিয়ার রাজ পরিবার, পুটিয়ার রাজ পরিবার, সিংরা নাটোর পরিবার আইনত বিলুপ্ত হয়েছিল এবং তারা তাদের শতাব্দী জুড়ে যে দায়িত্ব, অধিকার, উপাধি পেয়েছিল তা বিলুপ্ত হল। তবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে আইনটি প্রয়োগ না হওয়ায় এখনও সেখানে ত্রিদেব রায় এবং দেবাশিষ রায় রাজা উপাধি ধারণ করে আছেন যেখানে তাদের পূর্ব পুরুষগণ সে অধিকার হারিয়েছিল।

১৯৫০[সম্পাদনা]

১৯৫৫ইং সনের ১৪ অক্টোবর তদানীন্তন ভারত সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ রাজ্য পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশের সাথে একত্রিত হয়েছিল এবং নতুন দেশকে এক বছরের মধ্যে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল যদিও কিছু কিছু সীমান্তবর্তী অঞ্চল পৃথক ইউনিট হিসেবে পরিচালিত হতে থাকে। একই সময়ে ১৯৪৮-১৯৫০ইং সনের দিকে অবশিষ্ট রাজ্য/প্রদেশগুলো ভারতের অর্ন্তভূক্ত হয় এবং তখন ভারতেও জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয়। জমিদার রাজপুতদের ক্ষেত্রে তাদের রাজ্যগুলো সরকারকে আত্মসমর্পণের পরিবর্তে তাদের রাজস্ব এবং সামরিক বাহিনীর সাথে পূর্ববর্তী শাসক রাজাদের বংশগত শৈলী, উপাধি, পদ এবং সম্মানের কিছু বিশেষ অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল একই সাথে তাদের নিজের ও পরিবারের জীবন যাত্রার ব্যয় ভারের জন্য “প্রাইভি পার্স” দেওয়া হয়েছিল। তবে এ আইনটিও ১৯৫৬ইং সনে বিলুপ্ত করা হয়।[৩]

১৯৭০[সম্পাদনা]

১৯৭১ইং সনের পূর্ববর্তী শাসক পরিবারগুলোর উপভোগ করার ধরন এবং উপাধি সমূহকে ১৯৭২ইং সনের জানুয়ারীতে পাকিস্তান সরকার “সরকারীভাবে স্বীকৃতি দান” বন্ধ করে দেন। কাকতালীয়ভাবে ঐ বছরটি পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) স্বাধীনতার বছর ছিল। পাকিস্তানে অবশ্য পূর্বের শাসক পরিবারগুলো বেশির ভাগই উল্লেখযোগ্য হারে প্রভাব বিস্তার এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করতে থাকে।[৪] ভারতে এক বছরের দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধের পর এক সংশোধনী বলে ১৯৭১ইং সনের শেষের দিকে সংবিধানের গ্যারান্টিযুক্ত প্রাইভি পার্সগুলো বাতিল করা হয় এবং সাংবিধানিক ভাবেই রাজ পরিবারের আদেশকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০১-২০ 
  2. "খাজনা - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০১-২০ 
  3. "A brief history of Princely India"www.royalark.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০১-২০ 
  4. "Brief History of the Ruling families of Pakistan"www.royalark.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০১-২০ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]