মুগীরা ইবনে শুবা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

মুগীরা ইবনে শুবা (মৃত্যু- ৫০ হিজরি) মুহাম্মদের একজন বিশিষ্ট সাহাবা ছিলেন। ফাতিমার বাড়িতে আক্রমণের ক্ষেত্রে তার একটি বড় ভুমিকা ছিল। উমর ইবনে খাত্তাবের আদেশে মুগীরা বাহরাইন, বসরা এবং কুফার গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে আমীরে মুয়াবীয়ার শাসনকালে তিনি কুফার গভর্নর পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। মসজিদে আল-কুফায় মুগীরা আলী ইবনে আবু তালিব এবং তার শিয়াদের অভিশাপ দিয়েছিলেন। উমর ইবনে খাত্তাবের হত্যাকারী আবু ল'লু' ছিলেন মুগীরার একজন দাস।

নাম ও বংশ পরিচয়[সম্পাদনা]

মুগীরা ইবনে শুবা বিন আবু আমীর বিন মাসুদ ছিলেন সাকিফ উপজাতির এক সদস্য। আবু ইসা অথবা আবু আব্দুল্লাহ্ মুগীরার উপনাম ছিল। তিনি ৬১২ অথবা ৬১৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং কুফায় ৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। আল-মুগীরা একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি হিসেবে বর্ণিত। [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৩ জুন ২০২০ তারিখে

ইসলাম গ্রহণ[সম্পাদনা]

হিজরী পঞ্চম সনে ৬২৬ খৃস্টাব্দে আল-মুগীরা ইসলাম গ্রহণ করেন, হুদাইবিয়ার সন্ধি এবংং রিদওয়ানের চুক্তিতে তিনি উপস্থিত ছিলেন। নবম হিজরী ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে যখন পুরো সাকিফ উপজাতি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, তখন রাসুলুল্লাহ্ (সা.) মুগীরা এবং আবু সুফিয়ানকে আল-লূতকে ভাংতে তায়েফে গমণে আদেশ দেন। [২] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৩ জুন ২০২০ তারিখে

মুহাম্মদের ইন্তিকালের পরে[সম্পাদনা]

আল-সাইখ আল-মুফিদের মতে মুগীরা আলী ইবনে আবু তালিব এবং তার শিয়াদের প্রথম খলিফা আবু বকরের প্রতি জোড় করে আনুগত্য স্বীকার করানোর উদ্দেশ্যে ফাতিমার ঘরে আক্রমণ করতে এক বড় ভুমিকা রাখেন৷ " আল-ইজতিহাদ " মোতাবেক ইমাম আল-হাসান (আ.) মুগীরাকে নিন্দা করেছিলেন এই বলে " তুমি ফাতিমাকে এত জোড়ে আঘাত করেছিলে যে তিনি আহত হয়ে পড়েন এবং পরিণতিতে গর্ভস্রাব হয় ( মহসিন বিন আলী ) এর। " [৩] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৩ জুন ২০২০ তারিখে

রাশিদুন খিলাফতের আমলে[সম্পাদনা]

আবু বকরের যুগে[সম্পাদনা]

মুহাম্মদের মৃত্যুর পর প্রথম দুই খলিফার যুগে অধিকাংশ যুদ্ধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আবু বকরের নির্দেশে সর্বপ্রথম তিনি ‘বাহীরা’ অভিযানে যান। ইয়ামামার ধর্মত্যাগীদের নির্মূল করার ব্যাপারেও তিনি অংশগ্রহণ করেন।

ইয়ামামার যুদ্ধে ভণ্ড নবীদের বিদ্রোহ দমনের পর তিনি ইরাক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। ‘

পারস্য অভিযান[সম্পাদনা]

বুয়াইব’ বিজয়ের পর মুসলিম বাহিনী কাদেসিয়ার দিকে অগ্রসর হলে পারস্য সেনাপতি বীর রুস্তম মুসলমানদের আলোচনার প্রস্তাব করেন। মুসলমান বাহিনী আলোচনার প্রস্তাবে রাজি হয় এবং সর্বশেষ আলোচনার জন্য যান মুগীরা ইবনে শুবা । মুগীরা রুস্তমের সঙ্গে অনেক সময় ধরে আলোচনা করে করে মীমাংসা-সিদ্ধান্ত না করতে পারলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পরে ।[১]

নাহাওয়ান্দের যুদ্ধ[সম্পাদনা]

১৯ হিজরী অর্থাৎ ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে কাওমাস ও ইসপাহানবাসীরা শাহানশাহ ইয়াজদগিরদ এর সাথে যোগাযোগ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ৬০ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী গড়ে তোলে।

আম্মার ইবনে ইয়াসির খলিফা উমরকে বিষয়টি জরুরী ভিত্তিতে অবহিত করেন। উমর বসরা ও কুফার শাসনকর্তাকে নিজ বাহিনী নিয়ে নাহাওয়ান্দের দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন । এবং তিনি নুমান ইবন মুকরিনকে সেনাপতি নিয়োগ দেন । এবং উমর ঘোষণা দেন, নুমান ইবনে মুকাররিন নিহত হলে সেনাপতি হবে হুজাইফা ইবনে ইয়ামান,এ নিহত হলে সেনাপতি হবে জারির ইবনে আব্দুল্লাহ আল বাজালী,এ নিহত হলে সেনাপতি হবে মুগীরা ইবনে শুবা[১]

মুসলিম সৈন্যরা নাহাওয়ান্দের নিকটে শিবির স্থাপন করলে পারস্য বাহিনী আবারো আলোচনার প্রস্তাব দেন । কিন্তু এবার মুগীরা ইবনে শুবা আলোচনার জন্য গেলে প্রথম বারের থেকে অধিক বাকবিতণ্ডা হয় এবং দুই দলই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে ।

মুসলিম বাহিনীর বাম ভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত করা হল মুগীরা ইবনে শুবাকে। নাহাওয়ান্দের এই যুদ্ধে নুমান ইবনে মুকাররিন মৃত্যুবরণ করেন এবং পারস্য বাহিনী পরাজয় বরণ করে।[২]

হামদান অভিযান[সম্পাদনা]

নাহাওয়ান্দের পর বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন বাহিনী পাঠিয়ে ব্যাপক অভিযান চালানো হয়। হামদান অভিযানের সার্বিক দায়িত্ব মুগীরার ওপর অর্পিত হয়। তিনি সাফল্যের সাথে তিনি হামদানবাসীদের পরাজিত করে তাদেরকে সন্ধি করতে বাধ্য করেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধেও তিনি যোগ দেন। এ যুদ্ধে তিনি চোখে মারাত্মক আঘাত পান।[৩][৪]

উমরের যুগে[সম্পাদনা]

বসরা শহর পত্তনের পর খলিফা উমর তাকে সেখানকার শাসক হিসেবে নিয়োগ করেন। তিনি বসরার ওয়ালী থাকাকালীন অনেক নিয়ম-পদ্ধতি চালু করেন। সৈনিকদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি দেওয়ার জন্য সর্বপ্রথম বসরায় একটি পৃথক দফতর প্রতিষ্ঠা করেন ।[৩] কিছুদিন পর তার চরিত্রের দোষারোপের কারণে খলিফা উমার তাকে বসরার শাসক পদ থেকে বরখাস্ত করেন। তদন্তের পরে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন।[৫]

এ ঘটনার পর খলিফা উমার কুফার শাসক আম্মার ইবন ইয়াসিরের স্থলে মুগীরা ইবনে শুবাকে নিয়োগ দেন। উমারের খিলাফতের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন।

উসমানের আমলে[সম্পাদনা]

খলিফা উসমান তাকে পুনরায় উক্ত পদ থেকে বরখাস্ত করেন।[৬] তবে খলিফা উসমানকে মুগীরা ইবনে শুবা সবসময় সৎ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন। এমনকি উসমান গৃহবন্ধি অবস্থায় থাকাকালীন সময় যুদ্ধ ঘোষণা অথবা গোপনে মক্কায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন।[৭]

আলীর যুগে[সম্পাদনা]

মুমুগীরা আলী ইবনে আবু তালিবের একজন শত্রু হিসেবে পরিচিত। মুগীরা আলী ইবনে আবু তালিবকে অভিশাপও দিয়েছিলেন। মুয়াবিয়া দ্বারা কুফার গভর্নর নিযুক্ত হবার পর তিনি মসজিদে আল-কুফাতে আলী এবং অনুসারীদের অভিসম্পাত দিতেন।

একদা তিনি আলী ইবনে আবু তালিবের  এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী সা'সা বিন সাওহান সম্পর্কে তার এক খুতবায় বলেন, " উসমান সম্পর্কে মিথ্যা অভিযোগদাতা, আলীর গুণাবলি নিয়ে বানোয়াট তথ্যদাতা। আমি তার গুণাবলি সম্বন্ধে তোমাদের থেকে বেশি অবগত। কিন্তু ক্ষমতা এখন মুয়াবিয়ার হাতে, যেই উসমান সম্পর্কে মন্দ কথা বলবে, তাঁকেই শাস্তি দেওয়া হবে। "

হাদিস বর্ণনা[সম্পাদনা]

হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থে তার বর্ণিত ১৩৩ টি হাদীস পাওয়া যায়। এরমধ্যে ৯টি বুখারী ও মুসলিম শরীফ উভয়ই (মুত্তাফাকুন আলাইহি) বর্ণনা করেছেন। এবং একটি বুখারী ও দুটি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন।

বহু সাহাবী ও তাবেয়ী তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

তার তিন পুত্র -

অন্যান্যের মধ্যে -

রাজনৈতিক বিচক্ষণতা[সম্পাদনা]

মুগীরা ইবনে শুবা একজন বিজ্ঞ কূটনীতিক ও রাজনৈতিক পরামর্শদাতা ছিলেন । তাকে আরবের প্রসিদ্ধ কূটনীতিকদের মধ্যে গণ্য করা হয়। ইমাম শাবী বলেন, আরবের বিজ্ঞ কূটনীতিক ব্যক্তি চারজন –

তার অনেক বিখ্যাত কূটনীতিক ইতিহাস রয়েছে । খলিফা উমরের সময়ে তার নামে অর্থ চুরির মামলা দায়ের করে বসরার শাসক থেকে বরখাস্ত করা হলে । তিনি অতি বিচক্ষনতার সাথে নিজেকে প্রমাণাদি নিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষন হন।[১০]

সাহাবী নুমান ইবনে মুকাররিন মুগীরাকে বলেছেন, "তুমি বুদ্ধিমত্তা, পরামর্শদান ও সঠিক মতামতের অধিকারী ব্যক্তি"[১১]

মৃত্যু[সম্পাদনা]

মুগীরা ইবনে শুবা ৫০ হিজরিতে কুফায় প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।[১২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. (হায়াতুস সাহাবা-১/২২০, ২২২-২৩, ৩/৬৮৭-৯২) 
  2. (তারীখুল উম্মাহ আল-ইসলামিয়্যাহ-১/২০৯) 
  3. (আল-ইসাবা-৩/৪৫৩) 
  4. (উসুদুল গাবা-৪/৪০১) 
  5. (উসুদুল গাবা-৪/৪০৬) 
  6. (উসুদুল গাবা – ৪/৪০৭) 
  7. (হায়াতুস সাহাবা-২/৩৯৬) 
  8. (উসুদুল গাবা-৪/৪০৭) 
  9. আল ইসাবা ৩/৪৫৩ 
  10. (আল-ইসাবা ৩/৪৫৩) 
  11. (হায়াতুস সাহাবা – ১/৫১২) 
  12. (বইঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা – দ্বিতীয় খন্ড)