বিদ্যার্ঘ (ভাস্কর্য)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিদ্যার্ঘ
বিদ্যার্ঘ
শিল্পীশাওন সগীর সাগর[১]
অবস্থানরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হল গেট[২]

মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত বিদ্যার্ঘ ভাস্কর্যটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনে অবস্থিত।

পরিচিতি[সম্পাদনা]

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা ছিল বলিষ্ঠ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক বাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করার যে প্রয়াস চালিয়েছিল, তাতে আক্রান্ত হয়েছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বড় অংশ ঘাঁটি গেড়ে বসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসময় যে সমস্ত বীরপুরুষ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে দেশ স্বাধীনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আমাদের কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক হবিবুর রহমান অন্যতম। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ১৫ এপ্রিল ব্রিগেডিয়ার আসলাম ও কর্নেল তাজ এর নেতৃত্বে তার বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার সর্বোচ্চ ত্যাগের সম্মানে তার নামানুসারে একটি হলের নাম করণ করে। এরপর তিনিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসকল বুদ্ধিজীবী স্বাধীনতার যুদ্ধে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে গেছেন তাদের স্মৃতিকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে রক্ষিত করে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হবিবুর রহমান হলে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন। এই ভাস্কর্যটির নাম ‘বিদ্যার্ঘ’।

অবস্থান[সম্পাদনা]

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিুবর রহমান হল গেট থেকে প্রায় ২০ ফিট সামনে ভাস্কর্যটির নির্মাণ স্থান। এটি নির্মাণ করতে প্রায় ৩ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে। মহান ২৬ মার্চ, ২০১১ ভাস্কর্যটি উন্মোচন করা হয়। ভাস্কর্যটির স্থপতি হলেন শাওন সগীর সাগর।

ভাস্কর্যের বিবরণ[সম্পাদনা]

ভাস্কর্জের গায়ে পোড়া মাটি দিয়ে তৈরি ষড়ভুজের অংশবিশেষ

সমগ্র ভাস্কর্যটি মূলত একটি ষষ্ঠভূজের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ভাস্কর্যটিতে রয়েছে প্রায় ৫ ফিট লম্বা আকৃতির দু’জন মুক্তিযোদ্ধা। যাদের একজনের হাতে একটি বন্দুক আর অন্য জনের হাতে রয়েছে কলম। ভাস্কর্যটিতে বন্দুকের চেয়ে কলমের উচ্চতা উপরে দেখানো হয়েছে। দেশের স্বাধীনতার জন্য একজন বন্দুক হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছেন আর অন্যজন যিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন কিন্তু অস্ত্র দিয়ে নয়। তিনি যুদ্ধ করেছেন কলমের মাধ্যমে এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এখনও যুদ্ধে করে যাচ্ছেন। তাই কলমসৈনিক বা বুদ্ধিজীবিদের অবস্থান একজন অস্ত্রধারী যোদ্ধার চেয়ে অনেক উপরে। যা শিল্পী তার ভাস্কর্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এই দু’জন যোদ্ধার নিচে রয়েছে শহীদ হবিবুর রহমানের আবক্ষ ভাস্কর্য। আবক্ষ ভাস্কর্যটি সাদা রংয়ের। দেখে মনে হয় এটি বর্তমান প্রজন্মের জন্য আলো ছড়াচ্ছে। এগুলো মূলত দাঁড়িয়ে আছে একটি ষষ্ঠ ভূজের উপর। কালো রংয়ের এই ষষ্ঠভুজটি দ্বারা বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ৬ টি বিষয়কে বুঝানো হয়েছে। প্রথম ভূজটি বাঙালী জাতিকে আন্দোলনের জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এখানে গ্রাম এবং শহরের মানুষদের কথা বলা হয়েছে যারা সবাই এক হয়ে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছে। এরপর দ্বিতীয় ভূজটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। মাতৃভাষার দাবীতে বাংলা মায়ের সন্তানদের বুকের তাজা রক্ত দেওয়ার কথা জানাচ্ছে এটি। তাদের স্মরনে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে সর্বস্তরের বাঙ্গালীসহ বিশ্ববাসী।

এরপর তৃতীয় ভূজটিতে স্থান পেয়েছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাংলার পবিত্র মাটি যখন পাকিস্তানি বাহিনী দিয়ে আক্রান্ত হল তখন বাংলা মায়ের দামাল সন্তানেরা কীভাবে তাদের এই বাংলার মাটি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল তারই চিত্র ফুটে উঠেছে এখানে। এরপর চতুর্থ ভূজটিতে স্থান পেয়েছে ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড। যে দিনে বাংলাদেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। যেই দিনটিকে আজ আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস হিসেবে পালন করি। এরপর পঞ্চম ভূজটিতে স্থান পেয়েছে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের চিত্র। দেশ স্বাধীন করার জন্য যে সমস্ত বীর পুরুষ বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে তাদের সম্মানে নির্মিত হয়েছে দেশে অসংখ্য শহীদ মিনার এবং স্মৃতিসৌধ। যেখাসে স্বাধীন বাংলার মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করছে। আর শেষ ভূজটিতে স্থান পেয়েছে বাংলার একটি ইতিহাস গ্রন্থ।

এই ইতিহাস গ্রন্থের পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে শ্রদ্ধাভাজন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক হবিবুর রহমানের নাম এবং ভাস্কর্যটির নাম ‘বিদ্যার্ঘ’। বইটির উপরে একটি সূয় রয়েছে যা বাঙালী জাতিকে আজও আলো এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করবার শক্তি দিয়ে যাচ্ছে। এই ৬ষ্ঠ ভূজ পোড়া মাটির দ্বারা তৈরী। ষষ্ঠভূজটিকে আবার একটি গোলাকার বেষ্টনী দ্বারা আবদ্ধ করা হয়েছে। গোলাকার বেষ্টনীটির এক পার্শ্বে রয়েছে ষষ্ঠভূজটি আর অপর পার্শ্বে রয়েছে একটি প্রাচীর। গোলাকার বেষ্টনীটি লাল রং দ্বারা সজ্জিত। লাল রংয়ের মাঝে আবারা কিছু কিছু জায়গায় সুবজ রংয়ের জীবন্ত ঘাস দেওয়া হয়েছে। লাল রংটি শহীদ হবিবুর রহমান হলকে নির্দেশ করছে (হলের কক্ষগুলোর বাইরের দিকের রং লাল) এবং লাল ও সবুজ রং একত্রে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে নির্দেশ করছে। এর বাইরের দেওয়ালটি মূলত লোহার বাকানো শিকল দ্বারা তৈরী করা হয়েছে। লোহার শিকলগুলো একটির সাথে আরেকটি এমনভাবে লাগানো যেন অনেকগুলো মানুষ একজন আরেকজনের হাত ধরে দাড়িয়ে আছে। এ মানুষগুলো এ দেশের নতুন প্রজন্ম। যারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পাহাড়া দিচ্ছে ও শ্রদ্ধা নিবেদন করছে এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে সম্মানের সাথে ঘিরে রেখেছে।

গুরুত্ব[সম্পাদনা]

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এটিই প্রথম নির্মিত ভাস্কর্য। দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন মূলত তাদের স্মৃতিকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্যই এই ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের চেতনাগত দিকও তুলে ধরা হয়েছে যা থেকে আজকের প্রজন্ম শিখবে।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে রাবিতে 'বিদ্যার্ঘ' ভাস্কর্যের উদ্বোধন"cutimes24.com। ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুন ২০১৫ 
  2. "মুক্তিযুদ্ধের অমর গাথা"dailyjanakantha.com [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]