একটি পাত্রে মস্তিষ্ক

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
পাত্রে থাকা একটি মস্তিষ্ক যেটি মনে করছে যে এটি হাঁটছে

দর্শনশাস্ত্রে একটি পাত্রে মস্তিষ্ক বলতে একটি চিন্তন পরীক্ষণকে বোঝায় যেখানে জ্ঞান, বাস্তব, সত্য, মন, চেতনা এবং অর্থ সম্পর্কিত মানুষের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এটি রেনে দেকার্ত এর ইভিল ডিমন নামক চিন্তন পরীক্ষণটির এর একটি হালনাগাদকৃত সংস্করণ, যা গিলবার্ট হারম্যান এর দ্বারা আবিষ্কৃত হয়।[১] এই ব্যাপারটি অনেক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে দেখা যায়। এখানে একটি পাগল বিজ্ঞানীকে নিয়ে আসা হয়, তিনি একজন ব্যক্তির শরীর থেকে মস্তিষ্ককে বিচ্ছিন্ন করেন, একে একটি জীবন টিকিয়ে রাখতে পারে এরকম তরল সমৃদ্ধ পাত্রে (vat) মস্তিষ্কটিকে রাখলেন। এরপর মস্তিষ্কের নিউরনগুলোক তারের সাথে সংযুক্ত করে একটি সুপারকম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত করেন। সেই সুপারকম্পিউটারটি মস্তিষ্ককে বৈদ্যুতিক ইমপালস প্রদান করবে, আর এই ইলেক্ট্রনিক ইমপালস হবে ঠিক সেরকম যা সেই মস্তিষ্ক স্বাভাবিক অবস্থায় গ্রহণ করে থাকে।[২] এরকম গল্প অনুসারে, কম্পিউটারটি এরপর বাস্তবতার একটি সিমুলেশন তৈরি করবে (যেখানে মস্তিষ্কের নিজের আউটপুটের প্রতিক্রিয়াও অন্তর্ভুক্ত থাকবে)। এবং এই বিচ্ছিন্ন মস্তিষ্কটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক চেতনার অভিজ্ঞতা লাভ করবে, যেমনটা ব্যক্তি নিজের শরীরের মধ্যে থাকা অবস্থায় লাভ করত। এর জন্য এখন তার বাস্তব জগতের কোন ঘটনার সাথে সম্পর্কিত থাকতে হচ্ছে না।

ব্যবহার[সম্পাদনা]

একটি পাত্রে মস্তিষ্ক চিত্রায়নের সরলতম ব্যবহারটি দেখা যায় দার্শনিক সন্দেহবাদ[৩] এবং আত্মজ্ঞামবাদ এর যুক্তিতে। এটির সরল সংস্করণ হচ্ছে: যেহেতু পাত্রের মস্তিষ্কটি করোটিতে থাকলে যেরকম ইমপালস এর আদান প্রদান করত, এখানেও তাই করছে, আর যেহেতু এটাই পরিবেশের সাথে মিথস্ক্রিয়ার একমাত্র উপায়, সেহেতু এটি মস্তিষ্কের পক্ষে এটা কখনই জানা সম্ভব নয় যে এটি করোটিতে আছে নাকি পাত্রে। প্রথমে ব্যক্তি মনে করবেন, তিনি যা যা বিশ্বাস করেন সবই সত্য (যেমন তিনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, আইস-ক্রিম খাচ্ছেন)। পরক্ষণেই তিনি তার বিশ্বাস মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে কারণ এই যুক্তিটি বলছে যে একজন কিছুতেই জানতে পারছেন না যে তার মস্তিষ্ক তার করোটিতে আছে, নাকি কোন পাত্রে আছে। তাই তিনি যা যা বিশ্বাস করছেন তা আসলেই যে সত্য এটা প্রমাণ করার জন্য তার কাছে ভাল কোন ভিত্তি নেই। একটি সন্দেহবাদী যুক্তি তাই বলছে যে কেউই নিশ্চিতভাবে এটা জানতে পারবে না, যা জ্ঞানের সংজ্ঞা নিয়েই সমস্যা তৈরি করছে।

একটি পাত্রে মস্তিষ্ক হচ্ছে হিন্দু মায়া, প্লেটোর গুহার রূপক, ঝুয়াংঝির "ঝুয়াংঝি ড্রিমড হি ওয়াস এ বাটারফ্লাই" এবং রেনে দেকার্ত এর মেডিটেশনস অন ফার্স্ট ফিলোসফি গ্রন্থের ইভিল ডিমন নামক ধারণাগুলোর সমসাময়িক সংস্করণ।

একটি পাত্রে মস্তিষ্ক চিত্রায়নটি ভারচুয়াল বাস্তবতার তৈরি সিমুলেশন এবং এটি ব্যবহার করা ব্যক্তির বাস্তব সম্পর্কে অজ্ঞ থাকবার অবস্থার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এক্ষেত্রে এই চিত্রায়নকে কেবল মাত্র সন্দেহবাদী যুক্তির উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হয়নি, বরং ভিনসেন্ট কনিৎজার ফারদার ফ্যাক্টস (further facts) কে প্রকাশ করতেও এই ধারণাটিকে ব্যবহার করেছেন। ফারদার ফ্যাক্ট বলতে সেই বাস্তবতাকে বোঝায় যা পদার্থবিজ্ঞানের জগতের যৌক্তিকতাকে অনুসরণ করে না বা অনেক সময় আমাদের নিজস্ব শারীরিক অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে এটি কাজ করে। যেমন কোয়ালিয়া (কোন নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করা কিরকম?), ইনডেক্সিকালিটি (এটা কোন সময় এবং আমি কে?), এবং ব্যক্তিগত পরিচয় নিয়ে এটি কাজ করতে পারে।[৪] উদাহরণ হিসেবে, বাস্তব জগতের কোন ব্যক্তি একটি পর্দায় সিমুলেশনকৃত জগতকে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, কিন্তু তিনি এটি পর্যবেক্ষণ করবেন সিমুলেশনে থাকা সিমুলেশনকৃত এজেন্টের পরিপ্রেক্ষিত থেকেই। এই পর্যবেক্ষণ করা ব্যক্তি জানেন যে, সিমুলেশনে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের কোডগুলো ছাড়াও অতিরিক্ত কোড দেয়া রয়েছে যা নির্ধারণ করে দেয় যে পর্দায় ঠিক কোন রংগুলোতে সিমুলেশনটি প্রদর্শিত হবে, অর্থাৎ এই অতিরিক্ত কোডগুলো সিমুলেশনকে বাস্তব এর ঊর্ধ্বেও ভিন্ন মাত্রা দান করে, যেখানে সিমুলেশনের ভেতরের এজেন্টটির পরিপ্রেক্ষিত ফুটে ওঠে, ঠিক যে লোকটির পরিচয়কে সিমুলেশনে আসা ব্যক্তিটি ব্যবহার করছেন। (এই প্রশ্নগুলো ইনভার্টেড স্পেকট্রাম চিত্রায়ন, এবং ব্যক্তিগত পরিচয় এর সাথে ফারদার ফ্যাক্টস এর উপস্থিতি আছে কিনা এই প্রশ্নটির সাথে সম্পর্কিত।) অর্থাৎ, ব্যক্তি এই উপসংহারে আসতে পারেন যে, সিমুলেশনের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো বা বাস্তব জগতের ঘটনাগুলো (যেগুলো পদার্থবিজ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণকরা কোডগুলো দ্বারাই পুরোপুরিভাবে নির্ধারিত হয়) সিমুলেশনে ব্যক্তির নিজের অভিজ্ঞতাকে সম্পূর্ণরূপে নির্ধারণ করতে পারে না। কিন্তু তারপর কনিৎজার বলেন, একজন কল্পনা করতেই পারেন যে তিনি ভারচুয়াল রিয়ালিটি সিমুলেশনে এত গভীরভাবে ঢুকে গেছেন যে তিনি এটাই ভুলে গেছেন যে তিনি একটা সিমুলেশনে রয়েছেন। এই ব্যক্তি তখনও একই উপসংহারে পৌঁছতে পারেন, তা হল আমাদের নিজেদের জীবন নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত ও বিশ্বাসগুলো হয়তো প্রশ্নাতীত নয়।

দার্শনিক বিতর্ক[সম্পাদনা]

শরীর থেকে বিচ্ছন্ন মস্তিষ্কটিকে (একটি পাত্রে মস্তিষ্ক) একটি সাহায্যকারী চিন্তন পরীক্ষণ হিসেবে দেখা যায়। এই চিন্তন পরীক্ষণটি সম্ভাবনাকে ঘিরে অনেক দার্শনিক বিতর্ক রয়েছে। যদি এই বিতর্কগুলো থেকে উপসংহারে আসা যায় যে, এই চিন্তন পরীক্ষণটি অসম্ভব, তাহলে হয়তো বলা যায় যে এই চিন্তন পরীক্ষণ থেকে আমরা জ্ঞান, সত্য, চেতনা, প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি বিষয়ে এই পরীক্ষাটির দ্বারা আর কিছুই জানতে পারিনি।

জীববিজ্ঞান থেকে যুক্তি[সম্পাদনা]

একটি পাত্রে মস্তিষ্ক চিন্তন পরীক্ষণ এর যুক্তির বিরুদ্ধে একটি যুক্তি হচ্ছে পাত্রে রাখা মস্তিষ্ক কখনই জীববিজ্ঞানগতভাবে শরীরে থাকা মস্তিষ্কের সমতুল্য হতে পারে না। যেহেতু একটি পাত্রে মস্তিষ্ক এ মস্তিষ্ক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, কাজেই এখান থেকে বলা যায় যে, এটি হয়তো করোটিতে থাকা মস্তিষ্কের মত হবে না। অর্থাৎ পাত্রের মস্তিষ্কে শরীরের সাথে মস্তিষ্কের যে সংযোগ ছিল সেটার অভাব হবে, যার ফলে পাত্রের মস্তিষ্ক কখনই নিউরোএনাটমি বা স্নায়ু-অঙ্গসংস্থান এর দিক থেকে বা নিউরোফিজিওলজি বা স্নায়ু-শারীরবিদ্যা এর দিক থেকে শরীরে থাকা মস্তিষ্কের সমতুল্য হতে পারে না।[৫][৬] যদি তাই হয়, তাহলে আমরা বলতে পারব না যে, পাত্রের মস্তিষ্কের দ্বারা আমরা শরীরের মস্তিষ্কের মত একই অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারব না, যেহেতু মস্তিষ্কগুলো ও তাদের কার্যকারিতা ভিন্ন। এই যুক্তির বিপক্ষে আবার আরেকটি যুক্তি দাঁড়া করানো যায়। যদি একটি অনুকল্পিত যন্ত্র তৈরি করা যায় যার দ্বারা শরীরে থাকা মস্তিষ্কের সকল বৈশিষ্ট্য ও কার্যকারিতা হুবহু নকল করা যায় তাহলে এই চিন্তন পরীক্ষণটি সফল হবে।

বহিস্থিতবাদ থেকে যুক্তি[সম্পাদনা]

একটি পাত্রে মস্তিষ্ক চিন্তন পরীক্ষণ এর বিরুদ্ধে একটি দ্বিতীয় যুক্তি আছে যা মস্তিষ্ক থেকে আসা উদ্দীপনা নিয়ে যুক্তি দ্য। এটাকে প্রায়ই এক্সটার্নালিজম বা আল্ট্রা-এক্সটার্নালিজম এর সাথে সম্পর্কিত করা হয়।[৭] একটি পাত্রে মস্তিষ্ক এর ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক একটি যন্ত্র থেকে উদ্দীপনা গ্রহণ করে। একটি শরীরস্থ মস্তিষ্ক বরং এই উদ্দীপনা লাভ করে তার শরীরের থাকা বিভিন্ন উদ্দীপনাগ্রাহক এর দ্বারা (যেমন স্পর্শ, স্বাদ, গন্ধ ইত্যাদির দ্বারা), যেগুলো বহিঃস্থ পরিবেশ থেকে উদ্দীপনা গ্রহণ করে। এই যুক্তিটি প্রায়ই আমাদেরকে এই উপসংহারে নিয়ে যায় যে, একটি পাত্রে মস্তিষ্ক যে বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করছে, এবং আমাদের শরীরস্থ মস্তিষ্ক যে বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করছে তা ভিন্ন। এই বিতর্কটি নিয়ে উরিয়ান ক্রিয়েগেল,[৮] কলিন ম্যাকগিন,[৯] এবং রবার্ট রুপার্ট[১০] কাজ করেছেন, কিন্তু এখনও এটির সমাধান আসে নি। মনোদর্শনের অনেক ক্ষেত্রেই এটির আলোচনা হয় যেমন প্রতিনিধিত্ব, চেতনা, সন্তোষ, সজ্ঞান, শরীরস্থ সজ্ঞান ইত্যাদির আলোচনায়।[১১]

কল্পকাহিনীতে[সম্পাদনা]

১৯৬২ সালের চলচ্চিত্র দ্য ব্রেইন দ্যাট উডন্ট ডাই এর পোস্টার

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Harman, Gilbert 1973: Thought, Princeton/NJ, p.5.
  2. Putnam, Hilary"Brains in a Vat" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ ২১ এপ্রিল ২০১৫ 
  3. Klein, Peter (২ জুন ২০১৫)। "Skepticism"Stanford Encyclopedia of Philosophy। সংগ্রহের তারিখ ৭ জানুয়ারি ২০১৭ 
  4. Conitzer, Vincent (২০১৮)। "A Puzzle about Further Facts"। ErkenntnisarXiv:1802.01161অবাধে প্রবেশযোগ্যডিওআই:10.1007/s10670-018-9979-6 
  5. Heylighen, Francis (২০১২)। "A Brain in a Vat Cannot Break Out: Why the Singularity Must be Extended, Embedded, and Embodied"Journal of Consciousness Studies19 (1–2): 126–142। 
  6. Thompson, Evan; Cosmelli, Diego (Spring ২০১১)। "Brain in a Vat or Body in a World? Brainbound versus Enactive Views of Experience"Philosophical Topics39 (1): 163–180। ডিওআই:10.5840/philtopics201139119 
  7. Kirk, Robert (১৯৯৭)। "Consciousness, Information and External Relations"। Communication and Cognition30 (3–4)। 
  8. Kriegel, Uriah (২০১৪)। Current Controversies in Philosophy of Mind। Routledge। পৃষ্ঠা 180–95। 
  9. McGinn, Colin (১৯৮৮)। "Consciousness and Content"। Proceedings of the British Academy76: 219–39। 
  10. Rupert, Robert (২০১৪)। The Sufficiency of Objective RepresentationCurrent Controversies in Philosophy of Mind। Routledge। পৃষ্ঠা 180–95। 
  11. Shapiro, Lawrence (২০১৪)। When Is Cognition EmbodiedCurrent Controversies in Philosophy of Mind। Routledge। পৃষ্ঠা 73–90। 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]