বৃহস্পতি গ্রহের প্রাকৃতিক উপগ্রহ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(বৃহস্পতির প্রাকৃতিক উপগ্রহসমূহ থেকে পুনর্নির্দেশিত)
বৃহস্পতি ও তার চারটি বৃহত্তম প্রাকৃতিক উপগ্রহের একটি মন্তাজ (দূরত্ব ও আকার স্কেল অনুযায়ী নয়)

বৃহস্পতি গ্রহের ৯৫টি প্রাকৃতিক উপগ্রহ রয়েছে বলে জানা গিয়েছে।[১][২][৩] অর্থাৎ, শনির বলয়স্থিত উপগ্রহিকাগুলিকে বাদ দিলে সৌরজগতের গ্রহগুলির মধ্যে বৃহস্পতিরই সর্বাধিক সংখ্যক যুক্তিসঙ্গতভাবে স্থায়ী কক্ষপথযুক্ত জ্ঞাত প্রাকৃতিক উপগ্রহ রয়েছে।[৪] এগুলির মধ্যে বৃহত্তম চারটি উপগ্রহ গ্যালিলিয়ান চাঁদ নামে পরিচিত। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলিসাইমন মরিয়াস পৃথক পৃথক ভাবে এগুলি আবিষ্কার করেন। এই উপগ্রহগুলিই আবিষ্কৃত প্রথম মহাজাগতিক বস্তু, যেগুলি পৃথিবী বা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে না। ১৯শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে অনেকগুলি ক্ষুদ্রতর বার্হস্পত্য চাঁদ আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির নামকরণ করা হয়েছে রোমান দেবতা জুপিটার অথবা তার গ্রিক রূপ জিউসের প্রেমিক-প্রেমিকা বা কন্যাদের নামানুসারে। বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণরত বৃহত্তম ও সর্বাপেক্ষা অধিক ভরযুক্ত বস্তুগুলি হল এই গ্যালিলিয়ান চাঁদ চারটি। অন্যান্য জ্ঞাত ৭৫টি চাঁদ ও বলয়গুলির একত্রিত ভর এই গ্রহটিকে প্রদক্ষিণরত বস্তুগুলির সামগ্রিক ভরের ০.০০৩% মাত্র।

বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে গ্যালিলিয়ান চাঁদগুলির কক্ষপথ ও গতি, জুনো মহাকাশযানে স্থাপিত জুনোক্যাম কর্তৃক গৃহীত।

বৃহস্পতির প্রাকৃতিক উপগ্রহগুলির মধ্যে আটটি নিয়মিত প্রাকৃতিক উপগ্রহ। এগুলি অনুগামী গতিতে প্রায় বৃত্তাকার কক্ষে বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করছে। এই উপগ্রহগুলির কক্ষপথ বৃহস্পতির নিরক্ষীয় তলের সঙ্গে নতি খুব বেশি নয়। গ্রহীয় ভরের কারণে গ্যালিলিয়ান চাঁদগুলির আকার প্রায় গোলকাকার। তাই এগুলি যদি সরাসরি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করত, তাহলে এগুলিকে অন্ততপক্ষে বামন গ্রহ হিসাবে বিবেচনা করা হত। অপর চারটি নিয়মিত উপগ্রহ তুলনামূলকভাবে আকারে অনেক ছোটো এবং বৃহস্পতির অপেক্ষাকৃত নিকটে অবস্থিত। এগুলিই সেই ধূলির উৎস যা দ্বারা বৃহস্পতির বলয়গুলি গঠিত হয়েছে। বৃহস্পতির অবশিষ্ট উপগ্রহগুলি অনিয়মিত। এগুলির অনুগামী ও বিপরীতগামী কক্ষপথগুলি বৃহস্পতির থেকে অপেক্ষাকৃত দূরে অবস্থিত এবং বৃহস্পতির নিরক্ষীয় তলের সঙ্গে এগুলির নতি ও উৎকেন্দ্রিকতা অনেক বেশি। সম্ভবত বৃহস্পতির আকর্ষণে সৌর কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে এগুলি বৃহস্পতির উপগ্রহে পরিণত হয়েছে। এই অনিয়মিত উপগ্রহগুলির মধ্যে সাতাশটির এখনও আনুষ্ঠানিক নামকরণ করা হয়নি।

বৈশিষ্ট্য[সম্পাদনা]

উপগ্রহগুলির প্রাকৃতিক ও কাক্ষিক বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষিত হয়। চারটি গ্যালিলিয়ান চাঁদের ব্যাস সার্বিকভাবে ৩,১০০ কিলোমিটার (১,৯০০ মা)। এগুলির মধ্যে বৃহত্তম উপগ্রহ গ্যানিমিড সূর্য ও সাতটি গ্রহের পরই সৌরজগতের নবম বৃহত্তম বস্তু। এই উপগ্রহটির বুধের থেকেও আকারে বড়ো। অন্যান্য সকল বার্হস্পত্য উপগ্রহের ব্যাস ২৫০ কিলোমিটার (১৬০ মা) বা তারও কম। অধিকাংশেরই ব্যাস ৫ কিলোমিটার (৩.১ মা)-এর সামান্য বেশি।[note ১] এগুলির কক্ষপথের আকৃতিও বিভিন্ন প্রকারের। কোনওটি প্রায় নিখুঁত বৃত্তাকার, আবার কোনও কোনওটি উচ্চমাত্রায় উৎকেন্দ্রিকনতিযুক্ত। অনেকগুলি উপগ্রহ বৃহস্পতির ঘূর্ণনের বিপরীত গতিতে আবর্তিত হচ্ছে (বিপরীতগামী গতি)। এগুলির কক্ষীয় পর্যায়কালও বিভিন্ন। কোনও উপগ্রহ সাত ঘণ্টায় আবর্তন করে (বৃহস্পতির নিজের অক্ষের চারিদিকে একবার আবর্তনেরও কম সময়ে), আবার কোনও কোনও উপগ্রহ তার থেকে তিন হাজার গুণ বেশি সময় নিয়ে আবর্তন করে (প্রায় তিন পার্থিব বছরের সমান)।

উদ্ভব ও বিবর্তন[সম্পাদনা]

বার্হস্পত্য চাঁদগুলির আপেক্ষিক ভর। ইউরোপা অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর উপগ্রহগুলি এই স্কেলে দৃশ্যমান নয়, কেবলমাত্র ১০০× বিবর্ধনে সম্মিলিতভাবে দৃশ্যমান।

বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন, বৃহস্পতির নিয়মিত উপগ্রহগুলির উদ্ভব ঘটেছিল একটি গ্রহপ্রদক্ষিণকারী চাকতি থেকে। প্রাক্‌গ্রহ চাকতির অনুরূপ এই চাকতিটি ছিল ঘনায়মান গ্যাস ও কঠিন বর্জ্যের একটি বলয়।[৫][৬] সম্ভবত বৃহস্পতির ইতিহাসের আদি পর্বে একাধিক গ্যালিলীয়-ভরযুক্ত উপগ্রহের অবশেষ ছিল এই গ্যাস ও বর্জ্যের উৎস। [৫][৭]

সিম্যুলেশনের বিষয়টি দেখে অনুমান করা হয় যে, চাকতিটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে আপেক্ষিকভাবে উচ্চ ভরযুক্ত ছিল। কালক্রমে বৃহস্পতির ভরের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ (একাধিক ক্ষেত্রে দশ-শতাংশ) পাশ দিয়ে যাওয়া সৌর নীহারিকা থেকে বন্দি হয়ে পড়ে। যদিও বৃহস্পতির প্রাক্‌-চাকতি ভরের মাত্র ২ শতাংশই বিদ্যমান উপগ্রহগুলিকে ব্যাখ্যা করার পক্ষে যথেষ্ট।[৫] বৃহস্পতির আদি ইতিহাসে সম্ভবত একাধিক প্রজন্মের গ্যালিলীয়-ভরযুক্ত উপগ্রহের অস্তিত্ব ছিল। চাকতি থেকে টেনে নেওয়ার জন্য প্রত্যেক প্রজন্মের উপগ্রহগুলি হয়তো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বৃহস্পতির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। সেই সঙ্গে সৌর নীহারিকা থেকে বন্দি করা নতুন বর্জ্য থেকে নতুন উপগ্রহের সৃষ্টি হয়।[৫] বর্তমান (সম্ভবত পঞ্চম) প্রজন্মের উপগ্রহগুলি সৃষ্টির সময় চাকতিটি এতটাই ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল যে উপগ্রহগুলির কক্ষপথে সেটি আর বড়ো অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারেনি।[৭] বর্তমান গ্যালিলীয় উপগ্রহগুলি তখনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল, বৃহস্পতিতে বিলীন হওয়ার পথে ছিল এবং পরস্পরের মধ্যে একটি কাক্ষিক অনুরণনের দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। এই কাক্ষিক অনুরণন আইয়ো, ইউরোপাগ্যানিমিডের ক্ষেত্রে এখনও বিদ্যমান। গ্যানিমিডের অধিকতর ভরের অর্থ এটি ইউরোপা ও আইয়ো অপেক্ষা দ্রুত হারে বৃহস্পতিতে বিলীন হচ্ছে।[৫]

বিজ্ঞানীরা আরও মনে করেন যে, বহিঃস্থ অনিয়মিত উপগ্রহগুলির উৎস হল বৃহস্পতির অভিকর্ষজ টানে আটকে পড়া গ্রহাণুগুলি। প্রাক্‌চান্দ্র চাকতিটি তখনও এতটাই বড়ো ছিল যে সেগুলির ভরবেগের অনেকটাই আত্মীভূত করে এবং সেইভাবেই এগুলি বৃহস্পতির কক্ষপথে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। মনে করা হয় যে, অনেকগুলি উপগ্রহ এই অভিকর্ষজ টানে আবদ্ধ হওয়া প্রক্রিয়ায় যান্ত্রিক চাপে অথবা পড়ে অন্যান্য ক্ষুদ্রাকার বস্তুর সঙ্গে সংঘাতের ফলে ভেঙে পড়ে। আজ আমরা যে উপগ্রহগুলিকে দেখি, সেগুলি এরই ফলে সৃষ্ট।[৮]

আবিষ্কার[সম্পাদনা]

গ্যালিলীয় উপগ্রহসমূহ। বাঁদিক থেকে ডানদিকে বৃহস্পতির থেকে ক্রমবর্ধমান দূরত্বের ক্রমে: আইয়ো, ইউরোপা, গ্যানিমিডক্যালিস্টো

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

পাদটীকা[সম্পাদনা]

  1. তুলনামূলকভাবে দেখলে, ২৫০ কিলোমিটার ব্যাসবিশিষ্ট একটি গোলকের আয়তন সেনেগালের সমান এবং বেলারুস, সিরিয়াউরুগুয়ের আয়তনের সঙ্গে তুলনীয়। ৫ কিলোমিটার ব্যাসবিশিষ্ট একটি গোলকের আয়তন গার্নসির আয়তনের প্রায় সমান এবং সান মারিনোর আয়তনের তুলনায় সামান্য বেশি। (তবে দ্রষ্টব্য বিষয় হল এই যে, এই উপগ্রহগুলি গোলকাকার নয়।)

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Sheppard, Scott S.। "The Jupiter Satellite and Moon Page"Carnegie Institution, Department of Terrestrial Magnetism। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুলাই ২০১৮ 
  2. Resnick, Brian। "The Jupiter Satellite and Moon Page"Vox। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুলাই ২০১৮ 
  3. Science, Carnegie (১৬ জুলাই ২০১৮)। "A dozen new moons of Jupiter discovered, including one "oddball""Carnegie Institution for Science (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুলাই ২০১৮ 
  4. "12 New Moons Found Orbiting Jupiter"। ১৭ জুলাই ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুলাই ২০১৮ 
  5. Canup, Robert M.; Ward, William R. (২০০৯)। "Origin of Europa and the Galilean Satellites"। Europa। University of Arizona Press (in press)। arXiv:0812.4995অবাধে প্রবেশযোগ্যবিবকোড:2009euro.book...59C 
  6. Alibert, Y.; Mousis, O.; Benz, W. (২০০৫)। "Modeling the Jovian subnebula I. Thermodynamic conditions and migration of proto-satellites"। Astronomy & Astrophysics439 (3): 1205–13। arXiv:astro-ph/0505367অবাধে প্রবেশযোগ্যডিওআই:10.1051/0004-6361:20052841বিবকোড:2005A&A...439.1205A 
  7. Chown, Marcus (৭ মার্চ ২০০৯)। "Cannibalistic Jupiter ate its early moons"New Scientist। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মার্চ ২০০৯ 
  8. Jewitt, David; Haghighipour, Nader (২০০৭)। "Irregular Satellites of the Planets: Products of Capture in the Early Solar System" (পিডিএফ)Annual Review of Astronomy and Astrophysics45 (1): 261–95। arXiv:astro-ph/0703059অবাধে প্রবেশযোগ্যডিওআই:10.1146/annurev.astro.44.051905.092459বিবকোড:2007ARA&A..45..261J। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

টেমপ্লেট:সৌরজগতের প্রাকৃতিক উপগ্রহসমূহ (সংক্ষিপ্ত)