ধর্মীয় শিল্পকলা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
নবম শতাব্দীর হাজিয়া সোফিয়ার ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড ছবিবিশিষ্ট মোজাইক, যাতে মেরি ও শিশু যীশুর ছবি বিদ্যমান। আইকোনোক্লাস্টিক যুগ পরবর্তী সময়কার প্রথম দিককার মোজাইক। এটি আঁকা হয়েছে সোনালি পটের উপরে, যেটি ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিলt

ধর্মীয় শিল্পকলা বা পবিত্র শিল্পকলা হল এমন এক ধরনের শিল্পকলা, যেটি ধর্মীয় প্রেরণা ও উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে থাকে। এটি তৈরি করা হয় মানবমনের আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য। পবিত্র শিল্পকলা শিল্পীর ধর্মীয় ধ্যানধারণা, আত্মিক চিন্তা, পরিশুদ্ধির পথকে ভিত্তি করে তৈরি হয়ে থাকে।

খ্রিষ্টীয় শিল্পকলা[সম্পাদনা]

খ্রিষ্টীয় পবিত্র শিল্পকলা খ্রিষ্টীয় মূলনীতিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই ধরনের শিল্পকলায় খ্রিষ্টীয় চিন্তাচেতনা প্রতিফলিত হয়। এই শিল্পকলায় হরেক রকম বিশ্বাসের উপরে ভিত্তি করে শিল্পকর্ম নির্মিত হয়েছে। অধিকাংশ খ্রিষ্টীয় গোষ্ঠীই খ্রিষ্টীয় শিল্পকলা ব্যবহার করেছে বা সীমিত ব্যবহার করেলেও কিছু খ্রিষ্টীয় শিল্পকলার বিরুদ্ধে অভিযোগ বিদ্যমান। আইকোনোক্লাস্টিক যুগে খ্রিষ্টীয় শিল্পকলা একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বলে পরিগণিত হত।

অধিকাংশ খ্রিষ্টীয় শিল্পকর্মই সাংকেতিক অথবা এমন বিষয়কে ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে, যা শিল্পকর্মের প্রধান দর্শকদের নিকট অপরিচিত নয়। যীশুর ছবি এবং তার জীবনের বিভিন্ন অংশের কাহিনি ফুটে উঠেছে এসব চিত্রশিল্পে। এসব চিত্রশিল্পের যীশুর ছবি এবং ক্রুশ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

খ্রিষ্টীয় শিল্পকলায় ফুটে উঠেছে ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত বিভিন্ন কাহিনির ছবি। প্রোটেস্ট্যান্ট শিল্পকলায় রোমান ক্যাথলিক ও পূর্ব অর্থোডক্সীয় শিল্পকলা থেকে শিশু যীশুকে ধরে রাখা মেরির ছবি (যীশুর মা) এবং খ্রিষ্টীয় সাধুদের ছবি তুলনামূলকভাবে কম ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষদের সুবিধার জন্য শিল্পকর্মে এমন প্রতিমূর্তি ফুটে ওঠে, যাতে তার দ্বারা তা ধর্মীয় গ্রন্থের কোন দৃশ্যের প্রতিনিধিত্ব করে, খুব সহজেই তা বোঝা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ভেড়ার সাথে সেন্ট অ্যাগনেস, চাবির সাথে সেন্ট পিটার এবং শ্যামরকের সাথে চিত্রিত সেন্ট প্যাট্রিকের ছবি পবিত্র শিল্পকলার বৈশিষ্ট্য ও প্রতীকের বিষয়ে আলোকপাত করে থাকে।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

চতুর্থ শতাব্দীতে রোমের ভূগর্ভস্থ সমাধিক্ষেত্রের দেয়ালে ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড চিত্রকর্ম

বর্তমান দুনিয়ায় টিকে থাকা সবচেয়ে প্রাচীন খ্রিষ্টীয় শিল্পকলা খ্রিষ্টধর্মের শুরুর দিককার সময়ের। দুনিয়ায় টিকে থাকা সবচেয়ে প্রাচীন খ্রিষ্টীয় শিল্পকলাটি হল ইসরায়েলের তেল মেগিদ্দোতে, যেটি প্রায় ৭০ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। সবচেয়ে প্রাচীন খ্রিষ্টীয় প্রস্তরে খোদিত মূর্তিটি দ্বিতীয় শতাব্দীর একটি প্রস্তর শবাধার নির্মিত হয়েছিল। কন্সটাইন খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করার পূর্বে খ্রিষ্টীয় শিল্পকলা প্রভাবিত হয়েছিল রোমান শিল্পকলার মূর্তিশিল্প কর্তৃক। বর্তমান যুগে টিকে থাকা প্রথম দিককার অধিকাংশ খ্রিষ্ট ধর্মীয় ভবন রোমান অভিজাত শ্রেণীর ভবনের কাঠামো অনুসরণ করে গড়ে উঠেছিল। এসব ভবনের শিল্পকলায় রোমান শিল্পকলার প্রভাব থাকত। এছাড়া, এসব ভবনে ব্যবহৃত হত মোজাইক।

বাইজেন্টাইন শাসনামলে খ্রিষ্টীয় শিল্পকলার উন্নতি ঘটে। নান্দনিক বিমূর্ত এই শিল্পকলা হেলেনীয় শিল্পকলার স্থান দখল করে। নতুন ধরনের এই শিল্পকলা ধর্মের দিক্র অধিক গুরুত্ব দিত। চিত্রে উপস্থিত বস্তু এবং ব্যক্তি থেকে চিত্রে ধর্মীয় কাহিনিকে ফুটিয়ে তোলার অধিক প্রচেষ্টা করা হত। বাস্তব দৃশ্য ও সুষমতা, আলো ও রংয়ের ব্যবহার থেকে জ্যামিতিক সহজবোধ্যতা, বিপরীত চিত্রানুপাত, ব্যক্তি ও ঘটনার প্রমিত উপস্থিতির দিকে নজর দেওয়া হত এখানে। "খোদিত চিত্র", দ্বিতীয় আদেশ বিষয় বিতর্ক এবং বাইজেন্টাইন আইকনোক্লাজমের সংকটের দরুন তা প্রাচ্য অর্থোডক্সীয় শিল্পকলার নিকট জায়গস হারায়।

ম্যাডোনা একটি উদাহরণ। এটি সান্দ্রো বত্তিসেল্লি ১৪৭০ সালে এঁকেছিলেন। রেনেসাঁ সময়কালেত এই ছবি ফ্লোরেন্সে ক্যাথলিক গির্জার অনুমোদন পেয়েছিল (ইসাবেলা স্টুয়ার্ট গার্ডনার জাদুঘর, বোস্টন

রেনেসাঁয় ধর্মনিরপেক্ষ চিত্রকলার প্রসার ঘটলেও খ্রিষ্টধর্ম সংস্কার আন্দোলন সংঘটিত হবার আগ পর্যন্ত গির্জা, পাদ্রি এবং সাধারণ লোকদের জন্য প্রচুর খ্রিষ্টধর্মীয় শিল্পকলা তৈরি হয়েছিল। এই সময়ে মাইকেল অ্যাঞ্জেলো সিস্তিন চ্যাপেলে ছবি আঁকেন এবং পিয়েতা নামে তার এক ভাস্কর্য তৈরি করেন। গিয়ানলোরেঞ্জো বার্নিনি সেন্ট পিটারস ব্যাসিলিকায় বৃহৎ স্তম্ভ তৈরির সাথে যুক্ত ছিলেন। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি লাস্ট সাপার অঙ্কন করেছিলেন। সংস্কার আন্দোলন খ্রিষ্টধর্মীয় শিল্পকলার উপরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। এসময়ে চিত্র তৈরি অনেক কমে যায় এবং বিদ্যমান কলার ধ্বংস সাধিত হয়।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নিরপেক্ষ বৈশ্বিক চিত্রকলা পশ্চিম ইউরোপে ঊনবিংশ শতাব্দীতে যাত্রা শুরু করে। এই ধারার চিত্রশিল্পীদের মাঝে মাঝে খ্রিষ্ট ধর্মীয় শিল্পকলা ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে (বাগেরোঁ, মানেইঁ)। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চিত্রকলা তৈরির ঘটনা জর্জেস রৌওল্ট বা স্ট্যানলি স্পেন্সার ছাড়া কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় নি। এরিক গিল, মার্ক চাগাল, হেনরি ম্যাটিসে, জ্যাকব এপস্টেইন, এলিজাবেথ ফ্রিঙ্ক এবং গ্রাহাম সাদারল্যান্ডের মত আধুনিক যুগের চিত্রকররা গির্জার জন্য বিখ্যাত চিত্রকর্ম তৈরির সাথে যুক্ত ছিলেন।[১] খ্রিষ্টীয় মতবাদের সামাজিক ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য ফ্রিতজ ফজ উহদে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে যীশুকে চিত্রিত করে পবিত্র শিল্পকলাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন।

ছাপাখানার আবিষ্কারের পর একই শিল্পকলার প্রতিকৃতি বিক্রি জনপ্রিয় খ্রিষ্টীয় রীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মিহালি মুঙ্কাস্কি এই ধারার চিত্রকর ছিলেন। কালার লিথোগ্রাফির আবিষ্কার প্রার্থনা কার্ডের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। আধুনিক যুগে চিত্রকর থমাস ব্ল্যাকশিয়ার এবং থমাদ কিনকাদের প্রতিষ্ঠানের হয়ে খ্রিষ্ট ধর্মীয় শিল্পকলা বাজারজাতকরণের সাথে যুক্ত এবং এখন "কিচ" নামে এক নতুন শিল্পকলার প্রভাব বিদ্যমান।[২]

বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ও একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আবারো খ্রিষ্টধর্মীয় বিশ্বাস, যীশু, ঈশ্বর, গির্জা, বাইবেল এবং অন্যন্য ঐতিহ্যগত খ্রিষ্টীয় বিষয়কে ভিত্তি করে চিত্রকর্ম তৈরি করেন। এই শিল্পকলায় ধর্মনিরপেক্ষ শিল্পকলার প্রতি সম্মান রেখে তৈরি হয়েছে। পবিত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ শিল্পকলায় মাকোতো ফুজিমুরার প্রভাব দেখা যায়। এই যুগে পবিত্র শিল্পকলার উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন ল্যারি ডি. আলেকজান্ডার, গ্যারি পি. বার্গেল, কার্লোস কাজারেস, ব্রুস হারম্যান, দেবোরাহ সকোলভ এবং জন অগাস্ট সোয়ানসন।[৩]

বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলা[সম্পাদনা]

গৌতম বুদ্ধ ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেই বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলা যাত্রা শুরু করে। এরপর বৌদ্ধধর্ম প্রচারের সাথে সাথে এটি গোটা এশিয়া ও পরবর্তীতে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

শ্রীলঙ্কায় বুদ্ধমূর্তি

নতুন নতুন দেশে বৌদ্ধধর্ম ছড়ানোর সাথে সাথে সে দেশের বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলার আগমন এবং বিকাশ ঘটে। মধ্য এশীয় এবং পূর্ব এশীয় বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলার মাধ্যমে এশিয়ার উত্তরে বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলার বিকাশ ঘটে।

এছাড়া, পূর্ব এশীয় এবং দক্ষিণপূর্ব এশীয় বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলার দ্বারা বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলার দক্ষিণ এশীয় অংশের বিকাশ ঘটে।

ভারতে হিন্দুধর্মীয় শিল্পকলার উন্নতির প্রভাবে দশম শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলার বিকাশ ঘটে। এরপর ইসলামের আগমন ঘটলে বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।

তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলার উদাহরণ:থাঙ্কা চিত্রকর্মে বজ্রভৈরবের প্রতিমূর্তি, আনুমানিক ১৭৪০ সালে নির্মিত

তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলা[সম্পাদনা]

অধিকাংশ তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলা বজ্রায়ন এবং বৌদ্ধধর্মীয় তন্ত্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলায় মূলত বুদ্ধত্বলাভ এবং বোধিসত্ত্বর প্রভাব বেশি দেখা যায়। বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলা তৈরিকে ধ্যানের তুল্য মনে করা হয় এবং বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলা বস্তু তৈরি ধ্যানের সহায়ক বলে মনে করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, বালি মণ্ডল তৈরির আগে ও পরে প্রার্থনা করা হয়। এই চিত্রকর্মকে একজন ব্যক্তির মনকে পরিশুদ্ধ করে বলে বিশ্বাস করা হয়। এই বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলাটি মূলত বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের হাত্র সম্পাদিত হয়, শিল্পীরা খুব কম বালি মণ্ডল তৈরি করেছেন। অন্যান্য তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলায় ধাতুনির্মিত শাস্ত্রীয় বস্তু যেমন বজ্র এবং কিলা দেখা যায়।

ভারতীয় বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলা[সম্পাদনা]

ভারতের দুইটি স্থান যে কোন স্থান থেকে বৌদ্ধধর্মীয় গুহা চিত্রকর্মের গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম, যার যাত্রা শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে। তন্মধ্যে একটি হল ভারতের অজন্তা গুহা। ১৮১৭ সালে আবিষ্কারের আগে এটির কথা ভুলে গিয়েছিল মানুষ। অপরটি হল চীনের কানসু প্রদেশের দুনহুয়াংয়ের মোগাও গুহা। মোগাও গুহা সিল্ক রোড থেকে খুব বেশি দূরে অবস্থিত নয়। অজন্তা গুহায় শান্ত ধ্যানরত বুদ্ধের ছবি থেকে বাস্তব জীবনের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধের ছবি অঙ্কিত হয়েছে, যাতে প্রায়শই বড় স্তন ও সরু কটিবিশিষ্ট সম্মোহনী নারীর ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যা ভারতীয় চিত্রকলা থেকে ভারতীয় ভাস্কর্যে বেশি দেখা যায়।[৪]

ইসলামি শিল্পকলা[সম্পাদনা]

ইসলামি পবিত্র শিল্পকলার একটি উদাহরণ: তিউনিসিয়ার কাইরুয়ান জামে মসজিদে (উকবা মসজিদ নামেও পরিচিত) মিহরাবের ঊর্ধ্বাংশ নবম শতাব্দীর দীপ্যমান টাইলস ও উদ্ভিদের সমাবেশের ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে

শরিয়ত অনুসারে, প্রাণীর চিত্রাঙ্কন নিষিদ্ধ। সেজন্য উদ্ভিদের সমাবেশ বিশিষ্ট চিত্রকর্মের পাশাপাশি আরবি বর্ণমালার ব্যবহার ইসলামি শিল্পকলায় দেখা যায়। পরবর্তীকালে ইসলামি শিল্পকলায় চারুলিপির ব্যবহার দেখা যায়, যা জ্যামিতিক প্যাটার্ন আরবেস্ককে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। চারুলিপিতে ফুটে উঠত ধর্মীয় বাণী। ইসলামি শিল্পকলার ব্যবহার ধর্মীয় স্থাপনা, কার্পেট এবং হাত দিয়ে লেখা কাগজপত্রে দেখা গিয়েছে।[৫] ইসলামি শিল্পকলাউ ভারসাম্যযুক্ত বিশ্বের ছবি ফুটে উঠেছে। এই ধরনের শিল্পকলায় বস্তুর থেকে ধর্মীয় বাণী ছড়ানো অধিক গুরুত্ব পেয়েছে।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে মূর্তি ভাঙার ইতিহাস থাকলেও আধুনিক সুন্নি চিন্তাধারা এটি থেকে আলাদা। পারস্যের ক্ষুদ্র চিত্র, মধ্যযুগে মুহাম্মাদ এবং ফেরেশতাদের চিত্রায়ন এর উদাহরণ। শিয়া চিন্তাধারা মানব ছবি চিত্রায়নের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম বিরোধী। নবির বাণী এবং তার চিত্রায়নকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়ে থাকে।

ছবি উপস্থাপন[সম্পাদনা]

শরিয়তে জীবত প্রাণীর ছবি বা প্রতিমূর্তি নির্মাণকে অনুৎসাহিত করা হয়েছে এবং এটাকে শিরক বলে অভিহিত করা হয়েছে। এর জন্য, ইসলামি শরিয়ত অনুসারে জীবিত প্রাণীর ছবি, মূর্তি এবং এর নির্মাতারা সমালোচিত হয়ে থাকে

হাদিস অনুসারে জীবিত প্রাণীর ছবি ও মূর্তি নির্মাতাদের তাদের সৃষ্টির অভ্যন্তরে "জীবন" দেবার কথা বলে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে তাদেরকে শেষ বিচারের দিনে শাস্তি প্রদান করা হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে। হাদিসের এই ঘটনাটিকে জীবিত প্রাণীর ছবি ও মূর্তি নির্মাণের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ঘোষণা বলে ধরা হয়ে থাকে।

আরদাবিল কারপেট, সম্ভবত, টিকে থাকা পারস্যদেশীয় কার্পেটগুলোর মাঝে সবচেয়ে সুন্দর, তাবরিজ, ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ

কুরআনে জীবিত প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণ সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে কম বর্ণনা করা হয়েছে, এবং সেখানে আরবি শব্দ "মুসওয়ির" ব্যবহৃত হয়েছে (বাংলা অর্থ: "আকৃতিদানকারী") এবং শব্দটিকে আল্লাহর গুণবাচক নাম বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই ধর্মীয় বাণীকে মাথায় রেখে ইসলামি শিল্পকলায় চিত্রকর্ম নির্মিত হয়ে থাকে এবং কখনো কখনো চিত্রকর্ম ধ্বংস করা হয়ে থাকে। বাইজেন্টীয় আমলের খ্রিষ্টধর্মে মূর্তিপূজা বিরোধিতা এবং ইহুদীয় আইনে জীবিত ব্যক্তির প্রতিকৃতি নির্মাণ বিরোধিতার বিষয়টি ইসলামি শরিয়তেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অলঙ্কার হিসেবে জীবিত প্রাণীর প্রতিকৃতি ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে এবং এটি তুলনামূলকভাবে কম বিতর্কের সম্মুখীন হয়ে থাকে।[৬] ইসলামি শিল্পকর্মের অন্য ধারায় মানুষ ও প্রাণীর সাধারণ ভঙ্গির চিত্র দেখা যায়, যা চিত্রসংক্রান্ত নকশায় নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে।

আরবেস্ক[সম্পাদনা]

আরবেস্ক হল এমন একধরনের ছাঁচ, যেখানে বৃক্ষের লতাপাতার সমাবেশ বা সরলরেখার প্যাটার্ন দেখা যায়। এটির বিকাশ ঘটেছে নবম শতাব্দীর দিকে। এরপর, রেনেসাঁ যুগে ইউরোপে এর বিকাশ ঘটেছে। পশ্চিমা আরবেস্ক ইসলামি আরবেস্ক এবং রোমান শিল্পকলাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।

চারুলিপি[সম্পাদনা]

চারুলিপি ইসলামি শিল্পকলার অপরিহার্য অঙ্গ। আরবি ভাষায় নাযিল হয়েছে কুরআন এবং আরবি ভাষার হরফ চারুলিপির খুব উপযোগী বলে গণ্য করা হয়। শুধুমাত্র নান্দনিকতার জন্য চারুলিপি তৈরি করা হয়, চারুলিপি পবিত্র গ্রন্থের বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যও চারুলিপি তৈরি হয়ে থাকে। অধিকাংশ ইসলামি চারুলিপিতেই ধর্মীয় বাণী লেখা থাকলেও সব মুসলমান তা পড়তে পারে না। চারুলিপি পড়ার সময় কারো মনে রাখা উচিত যে, চারুলিপি ধর্মীয় বাণীকে দৃষ্টিনন্দনভাবে উপস্থাপনের জন্য তৈরি করা হয়ে থাকে।[৭] পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে আরবি চারুলিপির প্রাথমিক ও সরল ধারা তৈরি হয়েছিল। ইসলাম আগমনের পর সপ্তম শতাব্দীতে আরবি বর্ণমালার দ্রুত বিকাশ ঘটে এবং আরবি চারুলিপিরও সুদৃশ্য রূপ লাভ করে। ইসলামি চারুলিপির দুইটি প্রধান ভাগে বিভক্ত। একটি হল শুষ্ক শৈলী, যা সচরাচর কুফিক লিপি নামে পরিচিত। ইসলামি চারুলিপির অন্য ধারাটি হল লঘুগামী টানালেখা শৈলী, যার অন্তর্ভুক্ত হল নাসখ লিপি, সুলুস লিপি, নাস্তালিক লিপি ইত্যাদি।[৮]

জ্যামিতি[সম্পাদনা]

জ্যামিতিক কারুকাজ ইসলামি শিল্পকলার তিনয়ি ধারার মাঝে অন্যতম, যেখানে কোন জীবের ছবি উপস্থাপন জরা হয় না। জীবের ছবিহীন চিত্রকলায় এর উপস্থিতি বা জীবের ছবিবিশিষ্ট চিত্রকলা থেকে এর বিচ্ছিন্নতা, এসবের দরুন এটি ইসলামি শিল্পকলার অঙ্গতে পরিণত হয়েছে। মূলত, প্রাণীর ছবি না থাকার দরুন এটি ইসলামি শিল্পকলার অন্যতম প্রধান অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। ইসলামি জ্যামিতিক কারুকাজ শুধু ইসলামি স্থাপাত্যকে মনোহর রূপ প্রদানে ব্যবহৃত হয় না, এটি বিভিন্ন ধরনের বস্তুকে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলার কাজেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।[৯]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Beth Williamson, Christian Art: A Very Short Introduction, Oxford University Press (2004), page 110.
  2. Cynthia A. Freeland, But Is It Art?: An Introduction to Art Theory, Oxford University Press (2001), page 95
  3. Buenconsejo, Clara (২১ মে ২০১৫)। "Contemporary Religious Art"। Mozaico। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জুন ২০১৫ 
  4. "History Of Buddhism"। Historyworld.net। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৯-০৬ 
  5. "Islamic Art - Islamic Art of Calligraphy and Arabesque"। ২০০৪-০২-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০২-১১ 
  6. "Figural Representation in Islamic Art | Thematic Essay | Heilbrunn Timeline of Art History"। Metropolitan Museum of Art। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৯-০৬ 
  7. "Calligraphy in Islamic Art | Thematic Essay | Heilbrunn Timeline of Art History"। Metropolitan Museum of Art। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৯-০৬ 
  8. "Art of Arabic Calligraphy"। Sakkal। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৯-০৬ 
  9. "Geometric Patterns in Islamic Art | Thematic Essay | Heilbrunn Timeline of Art History | The Metropolitan Museum of Art"। Metmuseum.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৯-০৬ 

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]