ওয়াল্টার আলভারেজ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ওয়াল্টার আলভারেজ

ওয়াল্টার আলভারেজ (জন্ম: অক্টোবর ৩, ১৯৪০) বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ভূতত্ব ও গ্রহ-সম্পর্কিত বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। এক বিশালাকার উল্কার সংগে পৃথিবীর সংঘর্ষের কারণে ডাইনোসরেরা অকস্মাৎ বিলুপ্ত হয় - ওয়াল্টার আলভারেজ এই বহুল প্রচারিত তত্বের এক জনক। অন্য জন তার বাবা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিদ লুই আলভারেজ। দুজনে মিলিতভাবে এই তত্বের আবিষ্কার করেন।

জীবনী[সম্পাদনা]

ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে ওয়াল্টারের জন্ম। এঁদের বংশে বহু বিখ্যাত লোকের নাম আছে। আগেই বলেছি বাবা ছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিদ। ঠাকুর্দা ওয়াল্টার আলভারেজ ছিলেন বিখ্যাত ডাক্তার। ঠাকুর্দার বাবা লুই আলভারেজ ছিলেন স্পেনীয় বংশোদ্ভূত এবং তিনিও ছিলেন ডাক্তার। হাওয়াইতে প্র্যাক্টিস করতেন এবং সেখানে থাকতে ম্যাকুলার কুষ্ঠ রোগ শনাক্ত করার একটা নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এই ডাক্তার লুই আলভারেজের এক বোন মাবেল আলভারেজও ছিলেন বিখ্যাত। তিনি ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। অয়েল পেন্টিংএ তার নাম ছিল খুব।[১]

আমাদের আলোচ্য ওয়াল্টার আলভারেজ ১৯৬২ সালে মিনেসোটার কার্লটন কলেজ থেকে ভূবিদ্যায় বিএ পাশ করে ১৯৬৭ সালে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে ভূবিদ্যায় ডক্টরেট করেন। এরপর আমেরিকান ওভারসীজ পেট্রোলিয়াম লিমিটেড নামের একটা কোম্পানীতে চাকরি নিয়ে নেদারল্যান্ডসে চলে আসেন। এই চাকরিসূত্রে তাকে লিবিয়ায় আসতে হয়, এবং লিবিয়াতে কর্নেল গদ্দাফি যখন অভ্যুত্থান করছেন, তখন ওয়াল্টার লিবিয়ায়। এই পেট্রোলিয়াম কোম্পানীতে কাজ করতে করতে ওয়াল্টারের পুরাতাত্ত্বিক ভূবিদ্যার প্রতি আকর্ষণ জন্মায় এবং তিনি পেট্রোলিয়াম কোম্পানীর চাকরি ছেড়ে কিছুদিনের জন্য ইটালিতে চলে আসেন। ইটালির রোমের কাছেই আগ্নেয়গিরির অস্তিত্ব। ওয়াল্টার আগ্নেয়গিরি নিয়ে পড়াশুনো শুরু করেন এবং রোমান সভ্যতার আদিকালে এই আগ্নেয়গিরিগুলোর সেই সভ্যতার ওপর কি প্রভাব ছিল, সে বিষয়ে গবেষণা করেন।

কিছুদিন পরে ওয়াল্টার কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির লামন্ট-ডোহার্টিতে ভূবিদ্যা-সম্পর্কিত অবজারভেটরীতে যোগ দেন এবং ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চলের টেকটোনিক প্লেট নিয়ে গবেষণা করেন। ঠিক ঐ সময়ের কিছু আগে টেক্টোনিক প্লেট এবং ভূমিকম্পের সংগে তার সম্পর্ক নিয়ে বিখ্যাত টেক্টোনিক তত্ব আবিষ্কৃত হয়েছিল। টেক্টোনিক প্যালিওম্যাগনেটিজমের ওপর ওয়াল্টারের গবেষণা কিছুদিনের মধ্যে এক নতুন তত্বের সন্ধান দিল। ওয়াল্টার ও তার সহকর্মীরা ভূমধ্য সাগরের গভীর চুনা পাথরের স্তরের মধ্যে পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্রের দিক পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। শুধু তাই নয়, Foramina biostratigraphy নামক এক টেকনিক প্রয়োগ করে তারা সেই দিক পরিবর্তনের আনুমানিক সময়কালও নির্ধারণ করেন। এই দিক পরিবর্তন প্রায় একশ মিলিয়ন বছরেরও বেশি সময় ধরে হরেছিল।  এই একশ মিলিয়ন বছরে যতগুলি ভূ-চুম্বক ক্ষেত্রের দিক পরিবর্তন হয়েছিল, ওয়াল্টারের গ্রুপ সবগুলির কাল সঠিক ভাবে নির্ধারণ করেন।[১][২]

সংঘর্ষ তত্ত্ব[সম্পাদনা]

ওয়াল্টার আলভারেজ ও তার বাবা পদার্থবিদ লুই আলভারেজ বিশেষ করে এই সংঘর্ষ তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত। তারা এবং তাদের দুই সহকর্মী ফ্রাংক আসারো ও হেলেন মিশেল লক্ষ্য করেন যে, যে সময়টাতে ক্রিটেসিয়াস যুগ শেষ হয়ে প্যালিওজিন যুগ শুরু হচ্ছে সেই সময়কার মৃত্তিকাস্তরে ইরিডিয়াম ধাতুটির মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি।  সাধারণতঃ পৃথিবীতে ইরিডিয়াম একটি বিরল ধাতু, কিন্ত উল্কাতে ইরিডিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে। সুতরাং তারা অনুমান করলেন, এই মৃত্তিকাস্তরটি পৃথিবীর সংগে এক বিশালাকার উল্কার সংঘর্ষে তৈরী হয়েছে এবং খুব সম্ভবতঃ এই সংঘর্ষের কারণে ক্রিটেসিয়াস-প্যালিওজিনিক যুগের বৃহৎ প্রাণীকুল যেমন ডাইনোসরেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পৃথিবীতে অনেক যায়গায় এখন ইরিডিয়াম মোটামুটি একটু বেশি মাত্রায় পাওয়া যায়। উপরন্তু দক্ষিণ আমেরিকায় Chicxutub নামক জায়গায় এক বিশাল ক্রেটারের আছে। আলভারেজদের মতে, ঐ ক্রেটারটি এই ভয়ংকর সংঘর্ষের প্রমাণ। ফলতঃ আজকের সমস্ত বিজ্ঞানীই এই সংঘর্ষ তত্ত্ব মেনে নিয়েছেন। তারা মনে করেন, ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর সংগে এই বিশালাকার উল্কার সংঘর্ষ হয়েছিল। সেই সংঘর্ষের ফলে যে ধূলিকণা উড়েছিল, তা পৃথিবীকে সম্পূর্ণ অন্ধকার করে রেখেছিল শত শত বছর।  ফলে, প্রায় ৭৫ শতাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদ বিনাশপ্রাপ্ত হয়েছিল, যাদের মধ্যে non-avian ডাইনোসর ছিল অন্যতম।[৩] এর পর ওয়াল্টার আলভারেজ টি রেক্স ও বিনাশের ক্রেটার নামে একটি বই লেখেন। ক্রেটাসিয়াস - প্যালিওজিনিক যুগের এই ভয়ংকর সংঘর্ষের সম্পূর্ণ বিবরণ এই বইটিতে আছে।[৪]

সংঘর্ষ তত্ত্ব ছাড়া অন্য যে যে বিষয়ের ওপর ওয়াল্টার আলভারেজের অবদান আছে, সেগুলি হল - ভূমধ্য সাগরীয় টেক্টোনিক্স, রমান যুগের ভূবিদ্যা, পুরাতত্ত্ব, এবং তাদের সংগে ম্যাগনেটো স্ট্র্যাটিগ্রাফির সম্পর্ক।

বৃহৎ ইতিহাস[সম্পাদনা]

২০০৬ সালে ওয়াল্টার আলভারেজ বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে এক নতুন কোর্স শুরু করেন। কোর্সটির নাম - ‘বৃহৎ ইতিহাস, মহাবিশ্ব, পৃথ্বী, জীবন ও মানবতা’। ওয়াল্টারের মতে, তিনি এই কোর্সের মাধ্যমে মানবতা, পৃথ্বী, জীবন ও মহাবিশ্বের মধ্যে একটা সংযোগ সূত্র খুঁজতে চেয়েছেন এবং এই কোর্স অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে বুঝতে সাহায্য করে। ওয়াল্টারের এই কোর্সটিতে যে কেউ যোগ দিতে পারেন  এবং এতে ‘মেজর’ (বিষয় বস্তুর গুরুত্ব ও গভীরতায় এটা আমাদের কোন বিষয়ে অনার্স করার সমান) করা যায়।

ওয়াল্টার আলভারেজ আন্তর্জাতিক বৃহৎ ইতিহাস অ্যাসোসিয়েশনের (International Big History Association বা IBHA) একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ২০১০ সালে ওয়াল্টার ইটালির Coldgioco ভূবিদ্যা-সম্পর্কিত অবজারভেটরীতে ‘বৃহৎ ইতিহাসবিদ’-দের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত করেন।  এই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক বৃহৎ ইতিহাস অ্যাসোসিয়েশনের (International Big History Association বা IBHA) প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠার পরে অ্য্যাসোসিয়েশন বৃহৎ ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াল্টার আলভারেজের ধারণাকে অ্য্যাসোসিয়েশনের সংজ্ঞা রূপে গ্রহণ করে। ২০১১ সালে এই সংস্থাটি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ৫০১ (গ) ৩ ধারার অন্তর্গত একটি লাভ-নিরপেক্ষ সংস্থায় পরিণত হয়। ওয়াল্টার আলভারেজ দীর্ঘদিন এর পরামর্শদাতা বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। অবশেষে ২০১৪ সালের ৭ই আগস্ট যখন ক্যালিফোর্নিয়ার ডোমিনিকান ইউনিভার্সিটিতে IHBA-এর কনফারেন্স হয়েছিল, তখন তিনি এই পদ থেকে সরে দাঁড়ান।

ক্রোনোজুম[সম্পাদনা]

পৃথিবীর বয়স অনেক - প্রাগৈতিহাসিক কালও বিশাল। যাঁরা এই প্রাগৈতিহাসিক কাল ও তখনকার নানা ঘটনাবলী আলোচনা করেন, তাদের কাছে একটা বড় সমস্যা হল এই সব ঘটনাবলীকে সুসংহতভাবে একটা সময়কালের মধ্যে রাখা। ওয়াল্টার আলভারেজের সাম্প্রতিকতম অবদান এইখানে। তিনি মাইক্রোসফট রিসার্চের সংগে সহযোগিতায় ক্রোমোজুম নামে এমন একটা সফটওয়্যার বানিয়েছেন যার সাহায্যে এই বিশাল সময়কালকে সুসংহতভাবে কম্প্যুটার গ্রাফিক্সের মাধ্যমে একটি সময়কালের মধ্যে ধরা যায়। সব চাইতে বড় কথা, এই সফটওয়্যারটি অবাণিজ্যিক অর্থাৎ যে কেউ এটিকে ডাউনলোড করে নিজের রিসার্চে এটা ব্যবহার করতে পারেন।  এর ফলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের ঘটানাবলী বোঝা এবং অনেকগুলো বিভিন্ন সময়ের তথ্যকে জানা সহজ হয়েছে। বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ৯৭তম বার্ষিক ফ্যাকাল্টি রিসার্চ লেকচারে প্রথম এই সফটওয়্যারের প্রয়োগ দেখান হয়।[৫]

পুরস্কার ও সম্মান[সম্পাদনা]

ওয়াল্টার আলভারেজ সারা জীবনে অসংখ্য সম্মানে সম্মানিত এবং অসংখ্য পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। তিনি ১৯৮৩ সালে আমেরিকান আকাদেমি অফ আর্টস ও সায়েন্সের ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে তিনি ন্যাশনাল আকাদেমি অফ সায়েন্সের সদস্য নির্বাচিত হন।[৬] ২০০৬ সালে পান নেভাদা মেডেল, ২০০৮  সালে Vetiesen পুরস্কার। ২০০৫ সালে পান আমেরিকার জিওলজিক্যাল সোসাইটির Penrose মেডেল। ইটালির সিয়েনা ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৫ সালে তাকে ভূবিদ্যায় সাম্মানিক ডক্টরেট দেওয়া হয়।  

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Walter Alvarez"। Department of Earth and Planatery Science at UCB। সংগ্রহের তারিখ ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ 
  2. Alvarez, Walter। "The historical record in the Scaglia limestone at Gubbio: magnetic reversals and the Cretaceous-Tertiary mass extinction" (পিডিএফ)। Sedimentology। ২২ জুলাই ২০১৪ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ 
  3. Schulte, Peter; Alegret, Laia; Arenillas, Ignacio; Arz, Jose A.; Barton, Penny J.; Bown, Paul R.; Bralower, Timothy J.; Christeson, Gail L.; Claeys, Philippe; Cockell, Charles S.; Collins, Gareth S.; Deutsch, Alexander; Goldin, Tamara J.; Goto, Kazuhisa; Grajales-Nishimura, José M.; Grieve, Richard A. F.; Gulick, Sean P. S.; Johnson, Kirk R.; Kiessling, Wolfgang; Koeberl, Christian; Kring, David A.; MacLeod, Kenneth G.; Matsui, Takafumi; Melosh, Jay; Montanari, Alessandro; Morgan, Joanna V.; Neal, Clive R.; Nichols, Douglas J.; Norris, Richard D.; Pierazzo, Elisabetta; Ravizza, Greg; Rebolledo-Vieyra, Mario; Reimold, Wolf Uwe; Robin, Eric; Salge, Tobias; Speijer, Robert P.; Sweet, Arthur R.; Urrutia-Fucugauchi, Jaime; Vajda, Vivi; Whalen, Michael T.; Willumsen, Pi S. (৫ মার্চ ২০১০)। "The Chicxulub Asteroid Impact and Mass Extinction at the Cretaceous- Paleogene Boundary"Science327 (5970): 1214–1218। ডিওআই:10.1126/science.1177265পিএমআইডি 20203042বিবকোড:2010Sci...327.1214S। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৩-০৮ 
  4. People and Discoveries: Alvarez finds evidence of dinosaur-killing asteroid, 1980, PBS website, accessed April 17, 2011
  5. "ChronoZoom debuts at UC Berkeley Faculty Research Lecture Series"University of California Berkeley Library। The Regents of the University of California। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মে ২০১৪ 
  6. "Book of Members, 1780-2010: Chapter A" (পিডিএফ)। American Academy of Arts and Sciences। সংগ্রহের তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০১১