বহুব্রীহি সমাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

যে সমাসে সমস্যমান পদগুলোর কোনোটির অর্থ না বুঝিয়ে, অন্য কোনো পদকে বোঝায়, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে।[১] যেমন: বহু ব্রীহি (ধান) আছে যার= বহুব্রীহি। এখানের 'বহু' কিংবা 'ধান' কোনোটিরই অর্থের প্রাধান্য নেই, যার বহু ধান আছে এমন লোককে বোঝাচ্ছে।

বহুব্রীহি সমাসে সাধারণত যার, যাতে ইত্যাদি শব্দ ব্যাসবাক্যরূপে ব্যবহৃত হয়।

প্রকারভেদ[সম্পাদনা]

বহুব্রীহি সমাস আট প্রকার।[১] যথা:

১. সমানাধিকরণ বহুব্রীহি[সম্পাদনা]

পূর্বপদ বিশেষণ আর পরপদ বিশেষ্য হলে সমানাধিকরণ বহুব্রীহি হয়। যেমন: হত হয়েছে শ্রী যার= হতশ্রী, খোশ মেজাজ যার= খোশমেজাজ। এরূপ- হৃতসর্বস্ব, উচ্চশির, পীতাম্বর, নীলকণ্ঠ, জবরদস্তি, সুশীল, সুশ্রী, বদবখ্ত, কমবখ্ত ইত্যাদি।

২. ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি[সম্পাদনা]

বহুব্রীহি সমাসের পূর্বপদ এবং পরপদ কোনোটিই যদি বিশেষণ না হয়, তবে তাকে ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি বলে। যেমন: আশীতে (দাঁতে) বিষ যার= আশীবিষ, কথা সর্বস্ব যার= কথাসর্বস্ব।

পরপদ কৃদন্ত বিশেষণ হলেও ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস হয়। যেমন: দুই কান কাটা যার= দু কানকাটা, বোঁটা খসেছে যার= বোঁটাখসা। অনুরূপভাবে- ছা-পোষা, পা-চাটা, পাতা-চাটা, পাতাছেঁড়া, ধামাধরা ইত্যাদি।

৩. ব্যাতিহার বহুব্রীহি[সম্পাদনা]

ক্রিয়ার পারস্পরিক অর্থে ব্যতিহার বহুব্রীহি হয়। এ সমাসে পূর্বপদে 'আ' এবং পরপদে 'ই' যুক্ত হয়। যেমন: হাতে হাতে যে যুদ্ধ= হাতাহাতি, কানে কানে যে কথা= কানাকানি। এরূপ- চুলাচুলি, কাড়াকাড়ি, গালাগালি, দেখাদেখি, কোলাকুলি, লাঠালাঠি, হাসাহাসি, গুঁতাগুঁতি, ঘুষাঘুষি ইত্যাদি।

৪. নঞ্ বহুব্রীহি[সম্পাদনা]

বিশেষ্য পূর্বপদের আগে নঞ্ (না অর্থবোধক) অব্যয় যোগ করে বহুব্রীহি সমাস করা হলে তাকে নঞ্ বহুব্রীহি বলে। নঞ্ বহুব্রীহি সমাসে সাধিত পদটি বিশেষণ হয়। যেমন: ন (নাই) জ্ঞান যার= অজ্ঞান, বে (নাই) হেড যার= বেহেড, না (নাই) চারা (উপায়) যার= নাচার, নি (নাই) ভুল যার= নির্ভুল, না (নয়) জানা যা= নাজানা, অজানা ইত্যাদি। এরূপ- নাহক, নিরুপায়, নির্ঝঞ্ঝাট, অবুঝ, অকেজো, বে-পরোয়া, বেঁহুশ, অনন্ত, বেতার ইত্যাদি।

৫. মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি[সম্পাদনা]

বহুব্রীহি সমাসের ব্যাখ্যার জন্য ব্যবহৃত বাক্যাংশের কোনো অংশ যদি সমস্তপদে লোপ পায়, তবে তাকে মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি বলে। যেমন: বিড়ালের চোখের ন্যায় চোখ যে নারীর= বিড়ালচোখী, হাতে খড়ি দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে= হাতেখড়ি। এরূপ- গায়ে হলুদ, মেনিমুখো,সোনাক্ষি= সোনার ন্যায়মূল্যপূর্ন অক্ষি যার, জন্মাষ্টমী= জন্ম হয়েছে অষ্টমীর দিনে যার, রুদ্রাক্ষী= রুদ্র রূপ হইতে অক্ষি যার ইত্যাদি।

৬. প্রত্যয়ান্ত বহুব্রীহি[সম্পাদনা]

যে বহুব্রীহি সমাসের সমস্তপদে আ, এ, ও ইত্যাদি প্রত্যয় যুক্ত হয় তাকে প্রত্যয়ান্ত বহুব্রীহি বলা হয়। যেমন: এক দিকে চোখ (দৃষ্টি) যার= একচোখা (চোখ+আ), ঘরের দিকে মুখ যার= ঘরমুখো (মুখ+ও), নিঃ (নেই) খরচ যার= নি-খরচে (খরচ+এ), তিন (তে) ভাগ যার= তেভাগা (আন্দোলনবিশেষ; ভাগ+আ)। এরূপ- দোটানা, দোমনা, একগুঁয়ে, অকেজো, একঘরে, দোনলা, দোতলা, ঊনপাঁজুরে ইত্যাদি।

৭. অলুক বহুব্রীহি[সম্পাদনা]

যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্ব বা পরপদের কোনো পরিবর্তন হয় না, তাকে অলোপ বহুব্রীহি বলে। অলোপ বহুব্রীহি সমাসে সমস্ত পদটি বিশেষণ হয়। যেমন: মাথায় পাগড়ি যার= মাথায়পাগড়ি, গলায় গামছা যার= গলায়গামছা (লোকটি)। এরূপ- হাতে-ছড়ি, কানে-কলম, গায়ে-পড়া, হাতে-বেড়ি, মাথায়-ছাতা, মুখে-ভাত, কানে-খাটো ইত্যাদি।

৮. সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি[সম্পাদনা]

পূর্বপদ সংখ্যাবাচক এবং পরপদ বিশেষ্য হলে এবং সমস্তপদটি বিশেষণ বোঝালে তাকে সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি বলা হয়। এ সমাসে সমস্তপদে 'আ', 'ই' না 'ঈ' যুক্ত হয়। যেমন: দশ গজ পরিমাণ যার= দশগজি, চৌ (চার) চাল যে ঘরের= চৌচালা। এরূপ- চারহাতি, তেপায়া ইত্যাদি।

কিন্তু, সে (তিন) তার (যে যন্ত্রের)= সেতার (বিশেষ্য)।

বহুব্রীহি সমাসের নিয়ম[সম্পাদনা]

বহুব্রীহি সমাসে সাধারণত যার, যাতে ইত্যাদি শব্দ ব্যাস বাক্যরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন: আয়ত লোচন যার= আয়তলোচনা (স্ত্রী), মহান আত্মা যার= মহাত্মা, স্বচ্ছ সলিল যার= স্বচ্ছসলিলা, নীল বসন যার= নীলবসনা, স্থির প্রতিজ্ঞা যার= স্থিরপ্রতিজ্ঞ, ধীরবুদ্ধি যার= ধীরবুদ্ধি।

'সহ' কিংবা 'সহিত' শব্দের সঙ্গে অন্য পদের বহুব্রীহি সমাস হলে 'সহ' ও 'সহিত' এর স্থলে 'স' হয়। যেমন: বান্ধবসহ বর্তমান= সবান্ধব, সহ উদর যার= সহোদর> সোদর। এরূপ- সজল, সফল, সদর্প, সলজ্জ, সকল্যাণ ইত্যাদি।

বহুব্রীহি সমাসে পরপদে মাতৃ, পত্নী, পুত্র, স্ত্রী ইত্যাদি শব্দ থাকলে এ শব্দগুলোর সাথে 'ক' যুক্ত হয়। যেমন: নদী মাতা (মাতৃ) যার= নদীমাতৃক, বি (বিগত) হয়েছে পত্নী যার= বিপত্নীক। এরূপ- সস্ত্রীক, অপুত্রক ইত্যাদি।

বহুব্রীহি সমাসে সমস্ত পদে 'অক্ষি' শব্দের স্থলে 'অক্ষ' এবং 'নাভি' শব্দের স্থলে 'নাভ' হয়। যেমন: কমলের ন্যায় অক্ষি যার= কমলাক্ষ, পদ্ম নাভিতে যার= পদ্মনাভ। এরূপ- ঊর্ণনাভ।

বহুব্রীহি সমাসে পরপদে 'জায়া' শব্দ স্থানে 'জানি' হয় এবং পূর্বপদের কিছু পরিবর্তন হয়। যেমন: যুবতী জায়া যার= যুবজানি ('যুবতী' স্থলে 'যুব' এবং 'জায়া' স্থলে 'জানি' হয়েছে)।

বহুব্রীহি সমাসে পরপদে 'চূড়া' শব্দ সমস্ত পদে 'চূড়' এবং 'কর্ম' শব্দ সমস্ত পদে 'কর্মা' হয়। যেমন: চন্দ্র চূড়া যার= চন্দ্রচূড়, বিচিত্র কর্ম যার= বিচিত্রকর্মা।

বহুব্রীহি সমাসে 'সমান' শব্দের স্থানে 'স' এবং 'সহ' হয়। যেমন: সমান কর্মী যে= সহকর্মী, সমান বর্ণ যার= সমবর্ণ, সমান উদর যার= সহোদর।

বহুব্রীহি সমাসে পরপদে 'গন্ধ' শব্দ স্থানে 'গন্ধি' বা 'গন্ধা' হয়। যেমন: সুগন্ধ যার= সুগন্ধি, পদ্মের ন্যায় গন্ধ যার= পদ্মগন্ধি, মৎস্যের ন্যায় গন্ধ যার= মৎস্যগন্ধা।

নিপাতনে সিদ্ধ বহুব্রীহি[সম্পাদনা]

এই ধরনের বহুব্রীহি সমাস কোনো নিয়মের অধীনে নয়। যেমন: দু দিকে অপ যার= দ্বীপ, অন্তর্গত অপ যার= অন্তরীপ, নরাকারের পশু যে= নরপশু, জীবিত থেকেও যে মৃত= জীবন্মৃত, পণ্ডিত হয়েও যে মূর্খ= পণ্ডিতমূর্খ ইত্যাদি।

আরো দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, নবম-দশম শ্রেণি, শিক্ষাবর্ষ ২০১৬, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, বাংলাদেশ