মুঘল অস্ত্র

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আইন-ই-আকবরির অস্ত্রাগারের ছবি

মুঘল অস্ত্রশস্ত্রের বিবর্তন শুরু হয় মুঘল বাদশাহ বাবর, আকবর, আওরঙ্গজেব এবং শের-ই-মহীশূর (মহীশূরের বাঘ) টিপু সুলতানের আমলে। কয়েক শতাব্দী ধরে চলা মুঘল জয়রথ টেনে নিয়ে চলা মুঘল সেনাবাহিনী নানান ধরনের অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছে- যার মধ্যে তরবারি, তীর-ধনুক, ঘোড়া, হাতি, পৃথিবীর বৃহত্তর কামানগুলোর একাংশ, মাস্কেট বন্দুক (muskets) ও 'ফ্লিন্টলক ব্লান্ডারবাস' বন্দুক (flintlock blunderbusses) উল্লেখযোগ্য।

যুদ্ধের সরঞ্জামাদি[সম্পাদনা]

আক্রমণে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র[সম্পাদনা]

খাটো অস্ত্রসমূহ[সম্পাদনা]

মুঘল তরবারি- 'জুলফিকার'

বেশিরভাগ অশ্বারোহী সৈনিকগণ কাছাকাছি দূরত্বে যুদ্ধ করার জন্য মূলত খাটো অস্ত্রশস্ত্রের (kotah-yaraq) উপর নির্ভরশীল ছিল। এই খাটো অস্ত্রসমূহ মূলত ৫টি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল: ঢাল-তলোয়ার, গদা, যুদ্ধ-কুঠার, বল্লম এবং খঞ্জর। বেশি দূরত্বের আক্রমণের জন্য ব্যবহৃত হতো তীর-কামান, বন্দুক বা তিফাংক এবং পিস্তল। গোলন্দাজ (তোপখানা) বাহিনীতে ব্যবহৃত হতো ক্ষেপণাস্ত্র। স্বাভাবিকভাবেই কোনো ব্যক্তিই একা এসব অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে যেত না বরং একটি বিশাল সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অংশে এসকল অস্ত্রই কারো না কারো দ্বারা ব্যবহৃত হতো। যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র একজন মুঘল সেনা ব্যবহার করতো তার বর্ণনা পাওয়া যায় ফ্লিটজক্ল্যারেন্সের জবানিতে। ফ্লিটজক্ল্যারেন্স ছিলেন নিজামের সেনাবাহিনীর একজন ক্ষুদ্র প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা।

তিনি তার প্রতিরক্ষা সহচরকে বলেন:

“চমৎকার অশ্বসজ্জাবিশিষ্ট দুইটি অতীব দৃষ্টিনন্দন ঘোড়া আছে এই জমাদারের, যে কিনা নিজে সোনার লেস দেয়া সবুজ ইংলিশ ব্রড কাপড়ের (দ্বিগুণ চওড়া উন্নতমানের পশমি বস্ত্র) তৈরি পোশাকে শোভিত ছিল এবং তার পরনে আরও ছিল খুবই জাঁকালো কারুকার্যখচিত বেল্ট। মহিষের চামড়ায় তৈরি ও স্বর্ণমণ্ডিত গম্বুজের ন্যায় প্রতিরক্ষাংশযুক্ত একটি ঢাল ছিল তার পিঠে, তার হাতে অস্ত্রহিসেবে ছিল দুইটি তরবারি ও একটি খঞ্জর, ইংলিশ পিস্তল (রিভলভার) রাখার অস্ত্রবন্ধনী, এবং তার বন্দুকটি তার নফরের দ্বারা তার সামনে পরিবাহিত হচ্ছিল।”

তরবারি[সম্পাদনা]

তরবারি রাখার কোমরবন্ধনীসমূহগুলো সাধারণত ছিল চওড়া এবং খুব সুন্দরভাবে কারুকাজ করা। মুঘল যুগের প্রকৃত সৌন্দর্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ এর তরবারিগুলো। অশ্বারোহীরা কাঁধে ঝোলানো বেল্টের মাধ্যমে তরবারি বহন করতো। তবে বাকীরা তাদের তরবারি তিনটি ফিতেওয়ালা একটি কোমরবন্ধনীতে করেই বহন করতো।

বিভিন্ন রকমের ফলা (ব্লেড)

শাহ্‍জাদা দারা শেকোর তরবারি ও তরবারির খাপ (৮ নং), লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এন্ড আলবার্টস মিউজিয়ামে রাখা।

শমশের- এটি অনেকটা নিমচার (আরব, পারসিক ও তুর্কীদের পুরনো আমলের খাটো, বাঁকা একধারী তলোয়ারবিশেষ ) ন্যায় একটি বাঁকানো অস্ত্র। এর আকৃতি ও এটির হাতলের ক্ষুদ্রাকারই নির্দেশ করে এটি পুরোপুরিই কাটাকাটির উপযুক্ত একটি অস্ত্র। এটি তৈরি হতো স্টিল দিয়ে।

ধূপ- ধূপ একপ্রকার সোজা তরবারি। দক্ষিণাঞ্চল এর এই তরবারিকে মুঘলবাহিনীতে স্থান দেয়া হয়। এই তরবারিটি প্রায় চার ফুট লম্বা এবং বেশ চওড়া ফলার অধিকারী ছিল এবং এর হাতল এর দুইদিকে ছিল আনুভূমিক অতিরিক্ত অংশ যার জন্য এটিকে অনেকটা ক্রসের মতো দেখাতো। সার্বভৌমত্ব ও উচ্চমর্যাদার প্রতীক এই অস্ত্রটিকে নানান রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত করা হতো, যেখানে একজন মানুষ তার মনিবের সামনে মখমলে মোড়া এই তলোয়ারটিকে উঁচুতে তুলে ধরে রাখতো। এছাড়াও দরবারে আসীন ক্ষমতাশালী ব্যক্তির বালিশেও শোভা পেত এই তরবারিটি। এই ধরনের তরবারি সফল সৈনিক, মহান ও অভিজাত ব্যক্তি এবং দরবারের প্রিয়পাত্রদের জন্য উচ্চমর্যাদার বিষয় ছিল। এটিও স্টিল দিয়ে তৈরি ছিল।

  • খান্দাঃ খান্দা একপ্রকার সোজা তরবারি। এটি প্রায় ধূপের ন্যায় দেখতে।
  • সিরোহিঃ এটিও একপ্রকার নিমচাসদৃশ তরবারি। ভারতীয় এই তলোয়ারের ধারাল ফলা দিয়ে কারো মাথায় উল্লম্বভাবে আঘাত করা হলে তা শরীরকে কোমর পর্যন্ত ফালি করে দিতো এবং শরীরে আঘাত করা হলে তা শরীরকে দ্বিখন্ডিত করে দিতে সক্ষম ছিল। এই তরবারির ফলা অনেকটা দামেস্কে ব্যবহৃত ফলার ন্যায় আকৃতির এবং কিছুটা বাঁকানো, সাধারণ তরবারির চেয়ে এটি ছিল হালকা এবং অপেক্ষাকৃত সরু। দামেস্কের ইস্পাত দিয়ে সিরোহী নামক স্থানে এই তরবারিটি তৈরি হতো।
  • পাটাঃ পাটা একপ্রকার সরু ফলাযুক্ত, সোজা তরবারি। এর হাতলের ভেতরে রাখা ক্রসবারের মাধ্যমে এটি ধরতে হতো এবং এর বাহিরের আবরণ ধাতব দস্তানার ন্যায় সুরক্ষা দিতো। এটিও ইস্পাতের তৈরি। মুহররম শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের এখন এ তলোয়ার ঘোরাতে দেখা যায়।
  • গুপ্তিঃ গুপ্তি একপ্রকার সোজা তরবারি যা হাঁটতে সহায়ক লাঠির আবরণের ন্যায় খাপে পুরে রাখা হতো। এটি ছিল তিন ফুট লম্বা এবং এই তরবারির হাতল ও মাথা সুফিদের ব্যবহৃত অস্ত্র ‘ফকিরস ক্রাচ’ এর সাথে মিলসম্পন্ন ছিল। পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের শক্তিমন্ত বিনম্রতার প্রতীক হিসেবে স্টিলনির্মিত এই অস্ত্রটি ব্যবহৃত হতো।
মুঘল ঢালসমূহ[সম্পাদনা]
রয়্যাল অন্টারিও মিউজিয়ামে রাখা ইস্পাত, সোনা, সিল্ক . চামড়ার তৈরি সপ্তদশ শতকে প্রস্তুতকৃত মুঘল ঢাল যা উত্তর ভারতে ব্যবহৃত হতো।- DSC04543

একজন তলোয়ারবাজের সরঞ্জামাদির অবিচ্ছেদ্য অংশ তরবারি ও এর সঙ্গী ঢাল। যুদ্ধের সময় বাম হাতে ধরা ঢাল এর এই ব্যবহার শেষ হলে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো। সাধারণত ঢালগুলো চামড়া কিংবা ইস্পাতের তৈরি এবং এর ব্যাস ছিল ১৭-২৪ ইঞ্চির (৪৩০-৬১০ মিলিমিটার) মধ্যে। ইস্পাতের তৈরি ঢালগুলো খুবই জমকালো কারুকার্যপূর্ণ ছিল এবং এই কাজগুলো ছিল সোনা দিয়ে করা। অপরপক্ষে চামড়ার তৈরি ঢালগুলোয় স্বর্ণ ও রৌপ্যমণ্ডিত উঁচু অংশ, অর্ধচন্দ্র অথবা তারকা আকৃতির উঁচু অংশ বসানো থাকতো।কিছু কছু ঢাল সাম্বার হরিণ, মহিষ, নিলগাই, হাতি অথবা গণ্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি হতো যার মধ্যে গণ্ডারের চামড়ানির্মিত ঢালই বেশি মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত ছিল। ব্রাহ্মণ সেনারা নানান রঙ করা ৪০-৫০ পরত চওড়া সিল্কের তৈরি ঢাল ব্যবহার করতো।

ঢালের নানান প্রকারভেদঃ

  • চিরওয়াহ এবং তিলওয়াহ- এই ঢালগুলো সেসব তলোয়ারবাজ (শমশেরবাজ) অথবা যোদ্ধাবাহিনীর দ্বারা ব্যবহৃত হতো যারা মুঘল সম্রাট আকবরের (১৫৪২-১৬০৫) যুদ্ধযাত্রার সময় তার সঙ্গী হতো।
  • তরবারিযুদ্ধে ব্যবহৃত ঢাল

ছোট গোলাকৃতির এর ঢালগুলি কঞ্চি অথবা বাঁশের তৈরি। এর আকৃতি অনেকটা মসুরডাল এর হওয়ায় এটিকে ডাল হিসেবে ডাকা হতো এটিকে ডাল হিসেবে ডাকা হতো। এছাড়াও মারু বা সিংগৌটা নামক অদ্ভুতুড়ে ঢালগুলো তৈরি হতো কৃষ্ণসার হরিণের শিং ও ইস্পাত সহযোগে। হরিণের শিং মোড়া হতো ইস্পাতে এবং শিংদুটো মিলিত হতো এর ভোঁতা প্রান্তভাগে। সাইন্তি একপ্রকার ঢাল যা অসিযুদ্ধে প্রতিপক্ষের আঘাত ঠেকাতে ব্যবহৃত হতো।

আনুষ্ঠানিক গদা[সম্পাদনা]

চোব নামক আনুষ্ঠানিক গদা।
  • গুর্জঃ এটি একপ্রকার খাটো হাতলের গদা যার শেষে তিনটি বড় গোলাকৃতি বল রয়েছে এবং এই অস্ত্রটি সাধারণত বেশ গণ্যমান্য পদমর্যাদার মুঘলযোদ্ধার অস্ত্রাগারের অংশ ছিল।
  • শ্বাসবুরঃ এরই আরেকটি প্রকরণ হলো- শ্বাসবুর তথা ফুসফুসভেদী (ফুসফুস ছিন্নকারী)। এটির অনেকটা গুর্জেরই মতো গোলাকার মাথা ছিল। এছাড়াও এসদৃশ আরো কিছু গদা হচ্ছে- ধারা, গারগাজ এবং খান্ডলি ফাঁসি।
  • ধারাঃ কোলহাপুর থেকে আগত ধারা নামক গদাটির ছয়টি ফলাযুক্ত মাথা এবং অস্টভুজাকৃতির ইস্পাতের সরু-হাতল ছিল। এটি লম্বায় ছিল দু ফুট (০.৬১ মিটার)।
  • গারগাজঃ এটি ছিল ৮ অথবা ৭টি ফলাযুক্ত মাথাবিশিষ্ট এবং এর হাতলের চারিপাশ ঘেরা ছিল ঝুড়ির মতোন অংশে (basket hilt) যা জাতকে সুরক্ষা দিতো। এটি দৈর্ঘ্যে ২.৪-২.১০ ইঞ্চি (৬১-৫৩ মিলিমিটার) ছিল।
  • খুন্ডলি ফাঁসিঃ এটি এটি এক ইঞ্চি (২৫ মিলিমিটার) লম্বা ছিল এবং এর হাতলের মাথা ছিল ফাঁকা ধাতবকারুকাজসম্পন্ন।
  • কস্তনীঃ এটি এমন একপ্রকার অস্ত্র যা পুস্ত-খার (পিঠ খামচে আহতকারো অস্ত্র) এর ন্যায় গদা শ্রেণীভুক্ত। হাতের আকৃতিতে বানানো এই অস্ত্রটি ইস্পাতের তৈরি।
  • খার-ই-মাছই বা ‘মাছের মেরুদন্ডীয় কাঁটাঃ এই গদার সোজা মাথার দুপাশ থেকে ইস্পাতনির্মিত কণ্টকের ন্যায় ধারালো অংশ বেরিয়ে থাকতো।
  • গুজবাগঃ গুজবাগ নামক অস্ত্রটি ছিল হাতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রশিক্ষণ দেবার কাজে ব্যবহৃত এক প্রকার অস্ত্র (অঙ্কুশ)।
যুদ্ধ-কুঠার[সম্পাদনা]
১) লাঠির ভেতরে লুকিয়ে রাখা ছোরা (Dagger Crutch বা fakir's crutch) বা ভিক্ষুকের ক্রাচ তথা লাঠি, ২) তাবার (যুদ্ধকুঠার), ৩) অষ্টফলাযুক্ত ঢেউ খেলানো গদা, ৪) তাবার নামক যুদ্ধকুঠার, ৫) জাঘনাল (যুদ্ধকুঠার), ৬) লাঠির ন্যায় তরবারি (মুঘল আমলের)
  • সূঁচাল মাথা এবং দুইধারবিশিষ্ট ফলাওয়ালা কুঠারের নাম ছিল 'জাঘনল' তথা কাকের চঞ্চু।
  • দ্বিমাথাযুক্ত কুঠার যার হাতলের একপাশে চওড়া ফলাবিশিষ্ট এবং অন্যপাশে তীক্ষ্ণ ফলাবিশিষ্ট ব্লেড থাকলে তাকে তাবার জাঘনল বলা হতো।
  • লম্বা হাতলযুক্ত 'তারানগালাহ' নামক আরও একপ্রকারের কুঠারও ব্যবহৃত হতো। তাবারের হাতল ছিল সাধারণ ১৭-২৩ ইঞ্চি (৪৩০-৫৮০ মিলিমিটার) লম্বা এবং এর মাথা ছিল একদিকে ৫-৬ ইঞ্চি (১৩০-১৫০ মিলিমিটার) ও অন্যদিকে ৩-৫ ইঞ্চি (৭৬-১২৭ মিলিমিটার) দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট। কিছু কিছু কুঠারের মাথা ছিল অর্ধচন্দ্রাকৃতির এবং তার হাতলের একটি অংশ ছোরা লুকিয়ে রাখার জন্য ফাঁপা রাখা হতো।
  • ‘বাসোলাহ’ নামক কুঠারটি ছিল অনেকটা বাটালির ন্যায় দেখতে এবং প্রচুর কারুকার্যপূর্ণ রূপোর কুঠারগুলো সভাসদবৃন্দ দরবারে প্রদর্শনার্থে বহন করতেন।
বর্শা[সম্পাদনা]
মুঘল আমলের রাইফেল, বর্শা এবং হাতলযুক্ত বাঁকা ফলকওয়ালা ভারী তলোয়ার যা অশ্বারোহীদের দ্বারা ব্যবহৃত হতো।

এই ধরনের অস্ত্রের নানান ধরনের প্রকরণ ছিল। অশ্বারোহী সেনারা সাধারণত ঘোড়সওয়ারদের বিশেষ শর ব্যবহার করতো এবং পদাতিক সেনা ও সম্রাটের দরবার ঘিরে থাকা রক্ষীরা অন্য ধরনের বর্শা ব্যবহার করতো। এছাড়াও জ্যাভেলিন বা খাটো বর্শা, যা ছুঁড়ে মারা যেতো, তারও ব্যবহার থাকার প্রমাণ মিলেছে, বিশেষত মারাঠাদের মধ্যে।

  • নেজাহ্ঃ নেজাহ্ ছোট ইস্পাতনির্মিত মাথা ও লম্বা বাঁশের তৈরি হাতলযুক্ত একপ্রকার অশ্বারোহী সেনার বর্শা যা কিনা নেজাহ্-বাজান (বর্শা-নিক্ষেপক) এ করে বহন করা হতো। মারাঠা অস্ত্রশস্ত্রের ভাণ্ডারেই এই অস্ত্রটি বেশি দেখা যেতো এবং বলা হয় কোনো শত্রুপক্ষের অশ্বসেনাবাহিনীই এগুলোর মুখোমুখি হলে টিকে থাকতে সক্ষম ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রায় ২০,০০০-৩০,০০০ বর্শা শত্রুসেনার উদ্দেশ্যে তৈরি রাখা হতো এবং এগুলোকে এমন আঁটসাঁটভাবে প্রস্তুত রাখা হতো যেন শরবিদ্ধ মানুষের সারির মাঝে কোনো স্থান ফাঁকা (যেখানে বর্শা পৌঁছয়নি) না থাকে। যদি অশ্বারোহী সেনারা এই সকল বর্শা-নিক্ষেপকের ওপর দিয়ে একে অতিক্রম করার চেষ্টা করতো তাহলে এগুলোয় থাকা বর্শার ফলা ও আগুয়ান সেনাদের মাঝে সংঘর্ষ ঘটিত হয়ে সেনারা অশ্বচ্যুত হয়ে যেতো। অশ্বসেনা আক্রমণের সময় যদি নেজাহ্ এর সহিত শত্রুসেনার অস্ত্রের সংঘর্ষ হতো তাহলে তার পরিণামস্বরূপ এতো বেশি জোরে শদব হতো যে প্রতিপক্ষের ঘোড়াগুলো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উল্টো ঘুরে গিয়ে প্রচণ্ড বেগে দৌড়ে পালাতো। সাধারণত অশ্বারোহী একজন মানুষ তার মাথার ওপরে তুলে হাতের বাহুর সাথে সমান্তরালে বর্শা ধরতেন। বাঁশ ও ইস্পাত সহযোগে অস্ত্রটি তৈরি হতো।
  • বার্ছাহ্ঃ বার্ছাহ্‍ও একপ্রকার মুঘল অস্ত্র যা কিনা মারাঠাদের দ্বারাও ব্যবহৃত হতো। লৌহ বা ইস্পাতনির্মিত মাথা ও হাতলযুক্ত এই ভারী বর্শাটি পদাতিক সৈন্যদের দ্বারাই ব্যবহৃত হতো, কেননা, ঘোড়সওয়ারদের ব্যবহারের জন্য এটি বেশ ভারী ছিল।
  • সাঙঃ সাঙ ছিল পুরোপুরি লৌহনির্মিত বর্শা যা সাধারণত বার্ছাহ্ এর চেয়ে খাটো হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা ৭.১১ ফুট (২.১৭ মিটার) পর্যন্তও লম্বা হতো এবং এই লম্বা বর্শাগুলোর মাথার দৈর্ঘ্য ছিল ২.৬ ফুট (০.৭৯ মিটার)। অস্ত্রটির ছিল লম্বা, সরু তিন থেকে চারটি মাথা, ইস্পাতের হাতল এবং এর হাত দিয়ে ধরবার অংশটি ছিল মখমলমোড়া।
  • সাইন্থিঃ এর হাতল ছিল সাঙ এর চেয়ে খাটো আকৃতির।
  • সেলারাহ্ঃ সাইন্থির চেয়ে চেয়ে লম্বা কিন্তু সাঙ এর চেয়ে খাটো মাথা ও হাতলবিশিষ্ট এই বর্শা।
  • বল্লমঃ এই বর্শা তথা শরগুলো ক্রমশ বেঁকে তীক্ষ্ণ হওয়া মাথা ও কাষ্ঠনির্মিত হাতলযুক্ত এবং এগুলো লম্বায় ছিল ৫.১১ ফুট (১.৫৬ মিটার), যার মধ্যে ১৮ ইঞ্চি (৪৬০ মিলিমিটার) ছিলো এর ফলার দৈর্ঘ্য। পদাতিক সৈন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত বল্লম ছিল চওড়া মাথাযুক্ত এক খাটো আকারের বর্শা।
  • পান্ডি-বল্লমঃ শূকর শিকারে ব্যবহৃত এই বর্শাটি অনেকটা Aspidistra elatior গাছের পাতার ন্যায় দেখতে ফলা এবং বাঁশের হাতলে তৈরি ছিল। বর্শাটির সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছিল ৮.৩ ফুট (২.৫ মিটার) যার মধ্যে ফলার দৈর্ঘ্য ছিল ২.৩ ফুট (০.৭০ মিটার)।
  • পাঞ্জমুখঃ পাঁচটি মাথাবিশিষ্ট এই বর্শাটি গুজরাটের লোকেরা ব্যবহার করতো।
  • লাঙ্গেঃ এই একপ্রকার মুঘল শর যা চারটি চারকোনে থাকা মাথা ও একটি ফাঁপা হাতলযুক্ত ছিল।
  • গার্হিয়াঃ এটি ছিল সম্ভবত দীর্ঘ শূলাকৃতির বল্লম, জাভেলিন কিংবা বর্শাশ্রেণীর অস্ত্র।
  • আলমঃ এটি একপ্রকার বর্শা (সুচারুরূপে নিখুঁত বা চমৎকার)।
  • কন্টঃ এক প্রকারের বর্শা।
  • গান্দাসাঃ এটি বড়শির ন্যায় বাঁকানো বর্শা কিংবা প্রান্তভাগে ফলাযুক্ত কুঠার যার ইস্পাতের ফলা লম্বাকৃতির দণ্ডের অগ্রভাগে লাগাবো থাকতো। গ্রামের চৌকিদার বা গ্রাম্য রক্ষীর দ্বারা এটি ব্যবহৃত হতো।
খঞ্জর এবং ছুরি[সম্পাদনা]

এগুলো ছিলো নানান আকৃতি ও প্রকারের, যার প্রত্যেকটিই পৃথক পৃথক নামে অভিহিত ছিল।

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্যবহৃত মুঘল সাম্রাজ্যের ছোরা, যার রয়েছে পানির ন্যায় অবয়বযুক্ত ইস্পাতের ফলা এবং নেফ্রাইটের হাতল। হাতলে সোনা, চুনি এবং পান্নাখচিত কারুকার্য রয়েছে। অবস্থান: ফ্রিয়ার গ্যালারি অফ আর্ট- DSC05186
  • কাটারা তথা কাটারিঃ এটি হালকা ওজনবিশিষ্ট আক্রমণে ব্যবহার্য ছোরা যা কিনা অনেকটা ফরাসী poignard (ছোট সরু আকৃতির ছোরাবিশেষ) এর সমতুল্য এবং ভারতে কিছুটা বিচিত্রও বটে। এর হাতলের দুইটি অংশ হাত এবং বাহুর কিঞ্চিৎ অংশকে সুরক্ষা দেবার জন্য বাহু বরাবর দুই পাশে প্রসারিত। এই অস্ত্রটির মোটা ফলা এবং দ্বিমুখী ধারালো কাটার অংশ রয়েছে যা হাতল অংশে প্রস্থে ৩ ইঞ্চি (৭৬ মিলিমিটার) এবং ফলাযুক্ত দৃঢ় অংশে ১ ইঞ্চি (২৫ মিলিমিটার)। এর ফলাটিকে বাঁকানো যেতো না এবং এটি এতটাই শক্ত ছিলো যে ধাতবনির্মিত শক্ত বর্ম ব্যতীত অন্য কোনো কিছুই এটিকে আটকাতে পারতো না। একটি কাটারার পুরো দৈর্ঘ্য ২২ ইঞ্চি (৫৬০ মিলিমিটার) পর্যন্ত হতে পারে যার অর্ধাংশ জুড়েই এর ফলার উপস্থিতি। ফলার ডানদিকে হাতলটির সাথে একটি ক্রসবার যুক্ত ছিল যার মাধ্যমে অস্ত্রটিকে এমনভাবে ধরা যেতো যাতে এটিকে শুধুমাত্র সম্মুখভাগে আঘাত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়।

এই অস্ত্রগুলির কিছু কিছু ছিল হালকা বাঁকানো আবার কিছু ছিলো কাঁটাচামচের ন্যায় ভাগ করা অংশযুক্ত কিংবা দুইটি ফলাযুক্ত। ফলাগুলি হতো নানান রকমের যার দৈর্ঘ্য ৯-১৭.৫ ইঞ্চির (২৩০-৪৪০ মিলিমিটার) এর মধ্যে হতো।

  • জমাধারঃ এগুলির কাটারার ন্যায় একই হাতল থাকলেও এদের ফলাগুলো ছিল চওড়া ও সোজা, যেখানে কাটারার ফলা সোজা বা বাঁকানো উভয় রকমই হতো। জমাধার কাটারির সোজা ফলা এবং তরবারি কিংবা সাধারণ চাকুর ন্যায় হাতল ছিল।
  • খঞ্জরঃ এটিও পয়েগনার্ডের ন্যায় ছোরাবিশেষ যার হাতল ছিল তরবারির ন্যায় এবং এর ফলাগুলো ছিলো দ্বি-বাঁকযুক্ত। অস্ত্রটি ছিল ১২ ইঞ্চি (৩০০ মিলিমিটার) লম্বা। অস্ত্রটির উদ্ভব হয় তুর্কিদের কাছে, তারা এটিকে উঁচু করে তুলে ধরে কিংবা তাদের ডানপাশে বহন করতো। তবে মাঝে মাঝে পারস্যদেশীয় লোকজন ও ভারতীয়রাও এটি পরিধান করতো এবং ভারতীয়রা বাঁ পাশে এটিকে বহন করতো। এগুলো ছিলো চার প্রকারের্: জামহাক, ঝাম্বওয়াহ্, বাঙ্ক এবং নরসিং মথ। এগুলোর প্রতিটিই প্রায় খঞ্জরের ন্যায় দেখতে ছিল যদিও কিছু খোটখাটো ব্যতিক্রম পাওয়া যেতো। প্রধানত তুর্কিরা ব্যবহার করতো, কখনো কখনো পারস্যদেশীয় ও ভারতীয়রাও।
  • বিছুয়া এবং খাপওয়াহ্ঃ বিছুয়া অর্থ বিচ্ছু, এই ধরনের ছুরিগুলোর বেশ ঢেউয়ের ন্যায় বাঁকা ফলা ছিল, অপরপক্ষে, খাপওয়াহ্ ছিলো একধরনের ছোরা। এটি দেখতে মারাঠাদের ব্যবহৃত জাম্বওয়াহান্দ এর ন্যায় প্রায় একইরকম ছিল।
  • পেশকাজঃ এটি একপ্রকার চোখা পারস্যের ছোরা যার ফলার ধারালো অংশটি বাঁকানো কিন্তু অন্যপার্শ্ব সোজা (straight back) এবং কোনোপ্রকার আচ্ছাদনবিহীন সোজা হাতলযুক্ত। তবে কখনো কখনো এর ফলা বাঁকানো কিংবা দুবার বাঁকানো থাকতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাতলে সুরক্ষা আচ্ছাদনও থাকতো।
  • কারুদঃ কারুদের আগমন আফগানদের হাত ধরে- এটি অনেকটা কসাইয়ের ছুরির ন্যায় দেখতে এবং এটি খাপে পুরে রাখা হতো। কারুদের সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছিল ২.৬ ফুট (০.৭৯ মিটার), যার মধ্যে এর ফলার দৈর্ঘ্যই ছিল ২ ফুট (০.৬১ মিটার)। ‘গুপ্তি-কারুদ’ নামক ছুরিটি লাঠিতে পুরে লুকিয়ে রাখা হতো এবং কামচি-কারুদ ছিলো চাবুকাকৃতির স্থিতিস্থাপক ছুরি। চাকু বাঁকিয়ে লুকিয়ে রাখা যায় এমন ছুরিবিশেষ (clasp knife) ছিল পাঞ্জাবিদের দ্বারা যুদ্ধে ব্যবহৃত একপ্রকার অস্ত্র।
  • সাইলাবাহ্-ই-ক্বালমাকিঃ কাশঘরের মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত ছুরিবিশেষ। এটি তরবারির ন্যায় লম্বা এবং শের-মাহি নামক (lion-fish) মাছের হাড় দিয়ে তৈরি হাতল বিশিষ্ট এই ধারালো অস্ত্রটি ‘আসোব’ তথা কাঁধ থেকে ঝোলানো বেল্টে ঝুলিয়ে বহন করা হতো। এই যুদ্ধ-ছুরিটি কাশঘরের লোকেরা ব্যবহার করতো।

ক্ষেপণাস্ত্রসমূহ[সম্পাদনা]

তীর-ধনুক, ম্যাচলক বন্দুক, পিস্তল এবং কামানসহ চার ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের অস্তিত্ব ছিল। অশ্বারোহী সৈন্যদের কাছে প্রধানত ধনুক থাকতো কেননা মুঘল অশ্বারোহী সেনারা তাদের ধনুর্বিদ্যার জন্য সর্বজনবিদিত ছিল। কথিত কিংবদন্তি আছে যে, তীর ও ধনুক সরাসরি জান্নাত থেকে ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল (আ.) এর মাধ্যমে আনিত হয় এবং তিনি সেটি হযরত আদম (আ.) কে দেন। ব্যক্তিগত অস্ত্রগুলো পদমর্যাদার বলে ছিলো এরূপে নিম্ন থেকে উচ্চস্তরে বিভক্ত ছিল: ছোরা, তরবারি, বর্শা এবং সর্বোচ্চ মর্যাদার অস্ত্র তীর-ধনুকবিশিষ্ট সেনা।

যদিও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার তখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, তীর-ধনুকের ব্যবহার এর চমৎকার নির্মাণ কাঠামো ও সহজে ব্যবহার্যতার দরুণ অস্টাদশ শতাব্দী জুড়ে বিরাজ করেছিল। ১৮৫৭ সালে ভারতীয় বিপ্লবের (সিপাহী বিদ্রোহ) সময় বিপ্লবীরা বেশমাত্রায় তীর-ধনুকের ব্যবহার করেছিল।

ম্যাচলক- এটি একপ্রকার ভারী এবং নিঃসন্দেহে কার্যকরী সমরাস্ত্র যা পদাতিক সৈন্যের জন্য বরাদ্দ ছিল যেখানে পিস্তলের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।

মুঘল গোলন্দাজ যুদ্ধাঙ্গনবাহিনী- যদিও এর খরচাপাতির অঙ্কটা অনেক বেশি ছিল তবুও শত্রুপক্ষের লড়াকু যুদ্ধহাতির বিরুদ্ধে এটি অত্যন্ত কার্যকরী ছিল এবং এটির ব্যবহার অনেকগুলি দোদুল্যমান বিজয়কে নিশ্চিত করেছিল। বাবুরের গোলন্দাজবাহিনী ষোড়শ শতাব্দীতে ইব্রাহীম লোদীর সেনাবাহিনীকে পরাভূত করার পর থেকে পরবর্তী মুঘল সম্রাটগণ যুদ্ধাঙ্গনে গোলন্দাজবাহিনীর ব্যবহারকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানসূচক রণাস্ত্র হিসেবে দেখতে শুরু করেন।

তীর-ধনুক[সম্পাদনা]
তীর-ধনুক ও হুক্কা-পাইপ হাতে ধরা অবস্থায় মুহম্মদ শাহ্‍ এর দণ্ডায়মান চিত্র।

নিজস্ব অস্ত্রচালনায় পারদর্শী হিসেবে সুবিদিত মুঘল অশ্বসেনারা তীর-ধনুকে সজ্জিতাবস্থায় বন্দুকধারী সৈন্যদের চেয়ে নিক্ষেপক অস্ত্রছোঁড়ায় প্রায় তিনগুণ দ্রুত ছিলেন।

আদর্শ মুঘল তীর-কামান (ধনুক) ছিল প্রায় ৪ ফুট (১.২ মিটার) লম্বা এবং দ্বিবাঁকযুক্ত আকৃতির, যার হাতে ধরার স্থল ছিল মখমলে মোড়া। প্রাণীর শিং, কাঠ, বাঁশ, হাতির দাঁত এবং কখনো কখনো ইস্পাত দিয়েও এটি তৈরি করা হতো।

কয়েক ছড়া মোটা তার দিয়ে টানা হতো মুঘল ধনুকের অবতল পার্শ্ব (টানাবস্থায় উত্তল) যেন তা স্থিতিস্থাপকতা ও বলের যোগান দেয়। তীরের পেটের অংশটি ছিলো সুন্দরভাবে ঘন কালো রঙে পালিশ করা মহিষ কিংবা জংলি ছাগলের শিং দিয়ে তৈরি। এর সাথে শক্ত কাঠের পাতলা পাতের ন্যায় অংশ আঠা দিয়ে লাগানো থাকতো। ধনুকের অগ্র ও পশ্চাত্‍ শীর্ষে চল অনুসারে সাপের মাথার আকৃতি দেয়া হতো, শিং এর তৈরি অংশটিতে কোনো কারুকার্য করা হতো না এবং কাঠের তৈরি পিঠের অংশ সোনায় মোড়ানো পাখি, ফুল-ফল, লতাপাতা ইত্যাদির চিত্রবিচিত্র বক্ররেখা-বিজাড়িত অলংকরণে শোভিত ছিল। পর্যটকদের বহনকৃত ভারতীয় ধনুক প্রদর্শনী কিংবা বিনোদনকার্যে ব্যবহৃত হতো। এই ধরনের ধনুকগুলো মহিষের শিং দিয়ে তৈরি হতো, দুইটি একই রকমভাবে বাঁকা শিং বাঁকিয়ে এটি তৈরি করা হতো যার প্রতিটির বাইরের দিকের প্রান্তভাগে কাঠের তৈরি সূক্ষ অগ্রভাগ ছিল জ্যা পরাবার কাজে ব্যবহারের জন্য। শিং দুটির অপর প্রান্তভাগের অংশদুটি একসাথে এনে শক্ত কাঠের টুকরোর সাথে কষে বেঁধে ফেলা হতো। এই কাঠের টুকরোটি ধনুকের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতো এবং এটিকে বাম হাত দিয়ে ধরা হতো। ধনুক তৈরির পর এগুলোকে মাপমতো প্রাণীজ তন্তুওতে মোড়ানো হতো এবং তার ওপর মিহি দড়ি মুড়ে পাতলা আবরণ দেয়া হতো অন্তিম কার্য হিসেবে রঙ ও বার্নিশের চূড়ান্ত প্রলেপ দেয়ার পূর্বে। ধনুর্গুণ বা জ্যাগুলো কখনো কখনো সাদা সিল্কের শক্তিশালী সুতো দিয়ে তৈরি হতো যা পরষ্পর পেঁচিয়ে ১.২৫ সেন্টিমিটার (০.৪৯ ইঞ্চি) ব্যাসার্ধের সিলিন্ডারের ন্যায় আকৃতি তৈরি করতো। একই বস্তু দ্বারা মধ্যিখানে তিন থেকে চার ইঞ্চি পেঁচানো হতো এবং এই মধ্যভাগেই রক্তাভ লাল কিংবা অন্যরঙের বড় বড় ফাঁসযুক্ত বস্তু জটিল গিঁটের মাধ্যমে যুক্ত থাকতো। এই জাঁকালো ফাঁসগুলো তখন সাদা সিল্কের বিপরীতে লক্ষণীয় রঙবৈচিত্র্য প্রকাশ করতো।

ধনুকের জ্যা যেখানে লাগানো হতো সেই অংশটি মূল্যবান রত্নপাথরখচিত বড় রিং আকৃতির হতো এবং এই মূল্যবান রত্নটি পদমর্যাদার পদাধিকারবল অনুসারে নানাবিধ হতো যেমন: স্ফটিক, জেডপাথর, হাতির দাঁত, শিং, মাছের কাঁটা/হাড়, সোনা কিংবা লৌহ।

বিশেষায়িত ধনুক[সম্পাদনা]
  • চার্খঃ এটি একপ্রকার আড়ধনুক যা চার্খ গোত্রীয় মানুষেরা ব্যবহার করতো।
  • তক্ষ কামানঃ এটি একপ্রকার ছোট ধনুক।
  • কামান-ই-গুরোহাহ্ঃ এটি আধুনিক গুলতির ন্যায় ছোট ছোট গুলি ছোঁড়ার ধনুক যা ছোট ছেলেরা পরিণতপ্রায় ফসলের থেকে পাখি তাড়াতে ব্যবহার করতো।
  • গোভানঃ এগুলোও গুলতির ন্যায় যেগুলো বানদাহ্ এর নেতৃত্বে শিখদের ১৭১০ সালে করা আক্রমণ থেকে জালালাবাদ শহরের প্রতিরক্ষাকল্পে গ্রামবাসী সমবেত হবার সময় সাথে এনেছিল।
  • কামথাহ্ঃ মধ্যভারতের ভীল জনগোষ্ঠীর দ্বারা ব্যবহৃত লম্বা ধনুকবিশেষ। এরা ধনুকটিকে তাদের পা দিয়ে ধরে ধনুর্গুণ (চিল্লাহ্) হাত দিয়ে টেনে ধরে এবং এতটাই শক্তি দিয়ে তীর ছুঁড়তে পারে যে তা হাতির চামড়া পর্যন্ত ভেদ করে যেতে পারে। ভীলদের প্রধান অস্ত্র ছিল কাম্পতি তথা বাঁশের ধনুক, যার জ্যা ছিল বাঁশের স্থিতিস্থাপক ছালের তৈরি পাতলা অংশ। ৬০টি কাঁটাযুক্ত তীর যা তূণীর ভেতর একগজ লম্বা, এবং যেগুলি মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত হতো সেগুলোয় হাতলের সাথে চোখা মাথাযুক্ত ছিল যেটি মাছের গায়ে আঘাত করতো। তীরের মাথা এবং হাতল লম্বা সূত্রের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকতো যেন পানির পৃষ্ঠদেশে হাতলটি ভেসে থাকে।
  • নওয়াকঃ এটি একপ্রকার চোঙবিশেষ যার মধ্য দিয়ে তীর ছোঁড়া হতো, নওয়াক পাখি মারার কাজে ব্যবহার করা হতো। এটি হয় একটি আড়ধনুকের ন্যায় কিংবা কিছুটা সাধারণ ধনুকের অংশবিশেষের ন্যায় দেখতে। এটি মালয়দের তৈরি ফুঁ দিয়ে বিষাক্ত তীর ছোড়ার ফুঁ-চোঙ নয়। এটির চোঙের বিভিন্ন নমুনা থেকে এর দৈর্ঘ্য পাওয়া গেছে ৬.৬-৭.৬ ফুট (২-২.৩ মিটার) এবং এতে তারা একফুট লম্বা তীর ব্যবহার করতো।
  • তুফাক-ই-দাহানঃ এটি একপ্রকার ফুঁ-চোঙ যা ফাঁপা চোঙাকৃতির অংশ দিয়ে দম তথা বাতাসের জোরে কাদামাটির ছোট বল ছুঁড়তে ব্যবহৃত হতো।

তীরগুলো ছিল দুই প্রকৃতির: সাধারণকার্যে ব্যবহার্যগুলি তৈরির নিমিত্তে নলখাগড়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং যেগুলো বাঘের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতো সেগুলি ছিলো কাঠের হাতলবিশিষ্ট। নলখাগড়াভিত্তিক তীরগুলির মাথা রজনের মাধ্যমে হাতলে লাগানো থাকতো এবং কাঠের হাতলযুক্ত তীরের ক্ষেত্রে হাতলে ছিদ্র করে লোহিত-তপ্ত তীরের মাথা সেখানে বলপূর্বক ঢুকিয়ে দেয়া হতো। ভারতীয় জাদুঘরের কিছু কিছু তীর. (ব্যাখ্যা প্রয়োজন কোনগুলির) ২.৪ ফুট (০.৭৩ মিটার) লম্বা, একটি উদাহরণস্বরূপ, ১৮৫৭ সালে লখনৌতে পাওয়া একটি তীর, ছয় ফুট (১.৮ মিটার) পর্যন্ত লম্বা ছিল এবং এর জন্য স্বাভাবিক গড়পড়তা ধনুকের চেয়ে বড় আকৃতির ধনুক প্রয়োজন ছিল। তীরে যে পালকগুলি ব্যবহার করা হতো তা প্রায়শই কালো সাদার মিশেলে হতো (আবলাক), যেখানে তীরের মাথা বা ফলা হতো সাধারণত ইস্পাতের যদিও ভীলরা হাড়নির্মিত তীরের মাথা ব্যবহার করতো।

ম্যাচলক বন্দুক[সম্পাদনা]
বৃহৎ আকৃতির ম্যাচলক বন্দুক নিয়ে মুঘল সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা

তুংফাং হিসেবে পরিচিত ম্যাচলক বন্দুকটির আদি অবস্থা থেকে তার প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেন মুঘল সম্রাট আকবর। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এটিকে তীর ধনুকের চেয়ে কম গুরুত্বের চোখে দেখা হতো। ম্যাচলক বন্দুক সাধারণত পদাতিক সেনার এখতিয়ারাধীনই রাখা হতো, যারা কিনা মুঘল সেনাপতিদের তথ্যানুসারে ঘোড়সওয়ার সেনাদের তুলনায় নিম্নস্তরভুক্ত সৈন্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগের পূর্বে যতদিন না ফরাসী এবং ইংরেজ সেনারা পদাতিক সেনাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং শৃঙ্খলাচর্চা উন্নতির পদক্ষেপ নিলে সেটিকে পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করে ভারতেও এর চল শুরু হয়। সম্রাট আকবরের ম্যাচলক বন্দুকগুলোর দুটি ব্যারেলের দৈর্ঘ্য ছিল দু দুরকম: ৬৬ ইঞ্চি (১,৭০০ মিলিমিটার) এবং ৪১ ইঞ্চি (১,০০০ মিলিমিটার)। গোটানো ইস্পাতের পাত দুইপ্রান্ত ঝালাইয়ের মাধ্যমে একত্রিত করে এগুলোকে তৈরি করা হতো। সম্ভবত এরও আগে দাক্ষিণাত্য মালভূমিতে ফরাসি ও ইংরেজদের সংসর্গে আসার জন্য ফ্লিন্ট-লক অস্ত্র ব্যবহারের সূচনা হয়েছিল।

ম্যাচলকের ব্যারেলগুলোর ধাতব শরীর আরো বিশদ স্বর্ণ ও রৌপ্যের কারুকাজপূর্ণ ছিল, যে অংশটি শরীরে ভর দিয়ে রেখে তা চালাতে হতো (অস্ত্রের হাতল কিংবা ভিত্তি) সেখানে ধাতব নকশা খচিত ছিল কিংবা বার্ণিশ, রঙ কিংবা বিভিন্ন জিনিসের টুকরো দিয়ে তা সাজানো হতো। কখনো কখনো অস্ত্রটির ভিত্তিতে সোনার স্ফীত অংশ খচিত বা শোভিত থাকতো কিংবা পেছনভাগে হাতির দাঁত অথবা আবলুস কাঠের ঢাকনির ন্যায় আবরণ লাগানো থাকতো। ব্যারেল সাধারণত হাতলের সাথে ধাতব চওড়া বন্ধনী কিংবা ইস্পাত, পিতল, রূপা অথবা স্বর্ণের তারের মাধ্যমে যুক্ত থাকতো। চওড়া বন্ধনীগুলো অনেকসময় হতো ছিদ্রযুক্ত কিংবা কখনোবা তাতে খোদাইয়ের কাজ করা থাকতো। ভিত্তি কিংবা হাতলগুলো হতো দুই ধরনের: প্রথমত, সরু, কিঞ্চিত বাঁকা এবং সকল অংশেই সমান প্রস্থযুক্ত এবং দ্বিতীয়ত, নিখুঁতভাবে অনেকটা বাঁকানো এবং হাতে ধরার স্থানে সরু, তবে পশ্চাত্‍ভাগে কিছুটা চওড়া। ব্যবহার ব্যতিরেকে ম্যাচলকগুলোকে রক্তলাল কিংবা সবুজরঙা খোলসে ভরে বহন করা হতো।

পুরো সরঞ্জামাদির সেটটিতে থাকতো একটি পাউডার ধারক, গুলি রাখার থলে, যুদ্ধশিঙা (সিঙ্গরা), পোড়াবার দড়ি, চকমকি পাথর এবং ইস্পাত যেখানে সবমিলিয়ে সম্পূর্ণ জিনিসটি প্রায়শই একটি মখমলের বেল্টে রাখা হতো যাতে করা থাকতো সোনার সূচিকর্ম। যেসব আধারে করে পাউডার এবং মাস্কেট বলসমূহ (একপ্রকারের গুলি) বহন করা হতো সেগুলো ছিল বেশ ভারী এবং তাই বহনের পক্ষে বেশ কস্টকর, এবং যেহেতু মুঘলসেনারা কখনোই কার্তুজ ব্যবহার করেনি তাদের অস্ত্র লোড করতে অপেক্ষাকৃত দেরী হতো। কোনো কোনো সৈন্য একাই প্রায় বিশ গজেরও বেশি আগুন ধরাবার ফিতে বা দড়ি বহন করতো যা কিনা দেখতে অনেকটা প্যাঁচানো সুতোর বলের মতো ছিল।

বিশেষায়িত বন্দুকসমূহ[সম্পাদনা]
  • ক্যাইলেটকঃ এক অদ্ভুত ও অত্যন্ত লম্বা এবং ভারী ম্যাচলক বন্দুক। এই বন্দুকটিকে প্রায়ই হাতের বাহুর নিচে পরিবহন করা হতো।
  • জাযাইল বা জাযাইরঃ এগুলো ছিল দুর্গদেয়ালে ব্যবহৃত বন্দুক কিংবা কাঠামোর সাহায্যে বিভিন্নদিকে ঘুরিয়ে ব্যবহার করা যায় এমন তোপ যেগুলো কিনা যুদ্ধসেনাদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলন্দাজবাহিনীর দ্বারা ব্যবহৃত কামানের মাঝামাঝি অস্ত্রবিশেষ এবং এতে এ দুই ধরনের অস্ত্রেরই বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ বিদ্যমান ছিল। জাযাইলের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৭-৮ ফুট (২.১-২.৪ মিটার)। বিভিন্ন ক্যালিবারের (বন্দুকের ব্যারেলের ছিদ্রের ব্যাস) ম্যাচলকগুলো ভারতের স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা দেয়ালে ব্যবহার্য যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো, এগুলো সহজেই ঘুরানো বা নাড়ানো যায় এমন কব্জার ওপর বসানো থাকতো এবং এগুলো থেকে প্রায় এক পাউন্ডেরও (০.৪৫ কেজি) কম ওজনের গোলা ছোঁড়া হতো। যুদ্ধ ময়দানে কখনো কখনো এগুলোকে উটের পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। দুই বা ততোধিক আউন্স ওজনধারী হতো ভারতীয় জাযাইলের গোলাগুলি।

জিনযাল বা ভারী ম্যাচলক আগ্নেয়াস্ত্রগুলি সাধারণত দুর্গ প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহৃত হতো। এগুলো এক থেকে তিন আউন্স ওজনের গোলা বহনে সক্ষম ছিল। এগুলোর ব্যারেল বা নলগুলো ছিল বৃহদাকার, মধ্যবর্তী কালক্ষেপন ব্যতীত একেবারে ব্যবহার করার পক্ষে বেশ ভারী। অনেকগুলিরই লোহার তৈরি প্রায় এক ফুট লম্বা দাঁড়ার ন্যায় অংশ ছিল, যা সরু মুখনলের অদূরে ক্ষুদ্র পিভটের ওপর যুক্ত ছিল। দেয়াল, ঝোপ কিংবা মাটি যেখানেই রাখা হোক না কেনো এটি ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করতো। মাটিনির্মিত দুর্গ বিশেষত বুন্দেলখন্ডে, অবরুদ্ধ সেনারা অসাধারণ করদক্ষতার সাথে কাজ করেছিল, এমনকি বেশ অনেক দূরত্বও তারা প্রায় নির্ভুলভাবে মাথায় কিংবা হৃদপিণ্ডের নিকটে নিশানাবিদ্ধ করেছিল যা প্রায় লক্ষ্যচ্যুত হয়নি বললেই চলে। ভারতীয়দের ব্যবহৃত সকল আগ্নেয়াস্ত্রের ছোট বেলনাকৃতির প্রকোষ্ঠ ছিল এবং সেগুলোর ছিদ্র হতো ছোট, বল আকৃতির গুলিগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভরবেগপ্রাপ্ত হতো।

ঘোর-দাহান এক ধরনের জাযাইলের প্রকরণ। এই নাম এর নলের উল্টানো কিংবা চওড়াকৃত মুখকেই নির্দেশ করে।

পিস্তল[সম্পাদনা]

পিস্তলগুলিকে ‘তামানচাহ্’ নামে ডাকা হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে পিস্তল ভারতে ব্যবহৃত হতো, কিছুক্ষেত্রে যে কোনো মূল্যে এর ব্যবহারই প্রচলিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৭২০ সালের অক্টোবর মাসে হুসেইন আলি খানের আত্মীয়- এক তরুণ সৈয়দ, তাঁরই হত্যার উদ্দেশ্যে প্রেরিত এক গুপ্তঘাতককে পিস্তলের এক গুলিতে হত্যা করেন। পিস্তল উচ্চপদস্থ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, খুব কম সংখ্যক সৈন্যেরই ইউরোপীয় পিস্তল এবং তাবানচাহ্ ব্যবহারের সুযোগ ছিল।

  • শেরবাচাহ্ঃ এই ছোট বন্দুক তথা ব্লান্ডারবাস বন্দুকের আগমন ঘটে পিস্তলের পর। সম্ভবত নাদির শাহ্ এর সৈন্যবাহিনী (১৭৩৮) কিংবা আহমাদ শাহ্ আবদালী এর সেনাবাহিনীর (১৭৪৮-১৭৬১) হাত ধরে ভারতবর্ষে এর আগমন ঘটে। অষ্টাদশ শতকের শেষের এক-চতুর্থাংশে লখনৌ এর কার্যে এক দল পারসিক ঘোড়া নিয়োজিত ছিল যেগুলোকে একত্রে ডাকা হতো- ‘শেরবাচাহ্’ নামে। সম্ভবত তারা এই যুদ্ধাস্ত্র থেকেই এই নাম দিয়েছিল, যা দিয়ে তাদের অস্ত্রসজ্জিত করা হতো। কিংবা এই নামের পেছনে তাদের সম্ভাব্য হিংস্রতা এবং শত্রুপক্ষের রক্তের জন্য তাদের রক্তপিপাসু মনোভাবও দায়ী হতে পারে।

গোলন্দাজবাহিনী[সম্পাদনা]

রত্নাম্ভর দুর্গ আক্রমণের সময় বলদ কর্তৃক পাহাড়ের ওপরে টেনে তোলা হচ্ছে অবরোধ বন্দুক। Fort[১]

মুঘল সৈন্যবাহিনী বেশ বড় পরিসরের গান পাউডার বা বারুদভিত্তিক অস্ত্র ব্যবহার করতো যেগুলো ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়ে বড় ছিল। এর মধ্যে রকেট ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে চলমান বন্দুক এমনকি চৌদ্দ ফুটেরও (৪.৩ মিটার) বেশি লম্বা সুবিশাল কামানও ছিল যা কিনা একদা "বিশ্বের সর্বাধিক বিশালকায় অস্ত্র"[২] হিসেবে বিবেচিত ছিল। এই ধরনের অস্ত্রসস্ত্রসমূহ ভারী এবং হালকা গোলন্দাজবাহিনী আকারে বিভক্ত ছিল।[৩]

যুদ্ধময়দানে ব্যবহৃত চলমান গোলন্দাজবাহিনীকে কিছু কিছু ইতিহাসবিদ মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় সামরিক শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং এসকল সেনাদলকে তাদের অধিকাংশ প্রতিপক্ষের তুলনায় অনন্যভাবে আলাদা হিসেবে গণ্য করেছেন। এছাড়াও এটি ছিল সম্রাটের পদমর্যাদার প্রতীক, তাই সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ যাত্রাগুলোতে গোলন্দাজবাহিনীর একাংশ সর্বদা মুঘল সম্রাটের সঙ্গে সঙ্গে চলতো।[৪] প্রতিপক্ষের হাতিসমূহ যেগুলো কিনা ভারতীয় উপমহাদেশের যুদ্ধগুলোতে অত্যধিক পরিমাণে দেখা যেতো, সেগুলোর মোকাবেলায় মুঘলরা মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে গোলন্দাজ সেনাদের ব্যবহার করতো। তবে যদিও কামানের নিশানাভেদ আরো নিখুঁত করার উদ্দেশ্যে সম্রাট আকবর নিজেই ব্যক্তিগতভাবে তার কামানবাহী রথসমূহের নকশা করেন, তবুও মুঘল গোলন্দাজবাহিনীর ছোঁড়া গোলাসমূহ সবচেয়ে কার্যকরী ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের হাতিগুলোকে ভয় দেখাতেই। প্রতিপক্ষ সৈন্যদলে এভাবে সৃষ্টি হওয়া বিশৃঙ্খলাই মুঘল সেনাবাহিনীকে তাদের শত্রুর ওপর বিজয় হাসিলে ভূমিকা রাখতো। প্রাণীজ-উত্‍স থেকে তৈরি কব্জাসমৃদ্ধ ঘুরানো-বাঁকানোয় সক্ষম তোপগুলো মুঘল যুদ্ধবিগ্রহের একটি বৈশিষ্ট্যে পরিণত হতেছিল যার ভিত্তি ছিল ৬.৭ ফুটেরও (২ মিটার) বেশি লম্বা দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট, যা থেকে ছোঁড়া গোলার ব্যাস ৩.৮-৪.৭ ইঞ্চি (৯৯-১১৯ মিলিমিটার)।[৫]

চিত্রশালা[সম্পাদনা]

টীকা[সম্পাদনা]

এই নিবন্ধটি William Irvine এর লেখা 'The army of the Indian Moghuls: its organization and administration' শীর্ষক রচনা থেকে লেখা হয়েছে। এটি ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয় এবং বর্তমানে এটি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের নিকট উন্মুক্তকৃত।

  1. Unknown (১৫৯০–৯৫)। "Bullocks dragging siege-guns up hill during Akbar's attack on Ranthambhor Fort"the Akbarnama। ১৯ মে ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মার্চ ২০১৮ 
  2. Irvine (1903): The army of the Indian Moghuls, 113–159.
  3. Gommans JJL. (2002). Mughal Warfare: Indian Frontiers and Highroads to Empire 1500–1700. Routledge.
  4. a b c Rothermund, Dietmar (2014). "Akbar 'Der Große'" [Akbar 'The Great']. Damals (in German). Vol. 46 no. 1. pp. 24–29.
  5. Richards 1995, p. 288.

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

Richards, J.F. (1995). The Mughal Empire. ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস. ISBN 9780521566032.