বঙাল খেদা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বঙাল খেদা উত্তর-পূর্বের বাঙালিদের প্রতি অসমীয়া জাতির বিদ্ধেষ মূলক একটি সংগঠিত প্রচারাভিযানের কথা উল্লেখ করে, যা আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে এবং ১৯৮০-এর দশকে মেঘালয় ও ত্রিপুরাতে ছড়িয়ে পড়ে।[১] ১৯৬০ সালে এই আন্দোলনের নামে আসামে বাঙালি বিদ্ধেষ তীব্র হয়। এই সময় প্রায় ৫০,০০০ বাঙালি আসাম রাজ্য থেকে বিতারিত হয় অসমীয়াদের দ্বারা, এবং পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়। আসামে সাহসি কিশোর সিরিজের হিন্দু বাঙালি চরিত্র বাসু ভাস্করের জন্মদাতা রবিন দে আসাম থেকে কলকাতায় পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়।[২] ১৯৫৯ সালে সুকোমাল পুরাকায়স্থ, যিনি ১৯৬১ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় শহীদ হন, তাকে ডিব্রুগড়ায় ব্যবসা বন্ধ করে বরাক উপত্যকায় পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়।[৩]

পটভূমি[সম্পাদনা]

অসমীয়া কিশোর সাহিত্যের একজন জাতিগত বাঙালি হিন্দু লেখক রবিন দে, অসম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।

১৯৪৮ সালের ১ লা মে আসামের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়া অসমীয়াবাঙালি হিন্দুদের মধ্যে একটি জাতিগত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।[৪] গুয়াহাটিতে বাংলা-মালিকানাধীন দোকানগুলি লুট করা হয়েছিল অসমীয়াদের দ্বারা।[৫] ১৯৫৬ সালে, পূর্ববাংলার অবিভক্ত গোলপাড়া জেলার ব্যাপক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়, যখন রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন জেলার সাথে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য জেলা পরিদর্শন করে। [৫] প্রায় ২৫০ বাংলা ভাষা মাধ্যমের মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে রাতের অন্ধকারে আসামি ভাষার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়।[৬]

১৯৪৬–১৯৫১ সালে আসামে আগত শরণার্থী[৭]
উৎপত্তি বর্ষ সংখ্যা
পূর্ব বাংলা ১৯৪৬ ৮,৫৯৩
পূর্ব বাংলা ১৯৪৭ ৪২,৩৪৬
পূর্ব বাংলা ১৯৪৮ ৪১,৭৪০
পূর্ব বাংলা ১৯৪৯ ৩৩,১৩৮
পূর্ব বাংলা ১৯৫০ ১,৪৪,৫১২
পূর্ব বাংলা ১৯৫০ (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) ৩,৪৭৯
পশ্চিম পাকিস্তান - ৬৪৭
মোট ২,৭৪,৪৫৫

আক্রমণ[সম্পাদনা]

১৯৬০ সালের জুন মাসে বাঙালি হিন্দুদের উপর হামলা শুরু হয়। এটি প্রথম গুয়াহাটির কটন কলেজে শুরু করে এবং তারপর রাজ্যের সমস্ত স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। [৮] ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাঙালি জনগোষ্ঠীকে আক্রমণ করে। [৫] কামরূপ জেলার গোরেশ্বরের ২৫ টি গ্রামে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা ঘটে। বিচারপতি গোপাল মেহেরপুরে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। রিপোর্ট অনুযায়ী ৯ জন বাঙালি শহীদ হন এবং একশ'র বেশি আহত হন। মহিলাদের উপর আক্রমণের অন্তত একটি ঘটনা ছিল। বাঙালিদের ৪,০১৯ টি কুটির এবং ৫৮ টি ঘর ভাংচুর ও ধ্বংস করা হয়। গুয়াহাটি জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, যিনি একজন বাঙালি ছিলেন, এর জন্য তার বাড়িতে প্রায় ১০০ জন আক্রমনকারী ভিড় করে এবং তাকে ছুরি দিয়ে ঘাত করে। [৯] পুলিশের উপপরিদর্শক, বাঙালি হওয়ায় তাকেও লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল। [৯] গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়, ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজ এবং আসাম মেডিক্যাল কলেজের বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীদের জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হয়।[১০] ডিব্রুগড়া এলাকায় বাঙালি হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালানো হয়। বাঙালি হিন্দু বাড়িগুলি লুটপাট করা হয়, পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং অধিবাসীদেরকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়।[৮] ২০১৯ সালের ৩১শে আগষ্ট ১৩ লাখের বেশি বাঙালীর নাম N. R. C.-এর চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ১৯৭১ ইংরেজি সালকে ভিত্তি করে। এমতাবস্থায় আসামসহ সারা ভারতে বাঙালী জাতি আজ উদ্বেগের মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছে।[১১]

স্থানান্তর[সম্পাদনা]

হাজার হাজার বাঙালি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে বিতাড়িত হয় এবং পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গে স্থানান্তরিত হয়। এক অনুমান অনুযায়ী ৫,০০,০০০ বাঙালি অসম থেকে বাস্তুচ্যুত হয়।[১২] পশ্চিম বঙ্গে হাজারো শরণার্থী পর্যায় আসে। প্রায় ৪,০০০ শরণার্থীর প্রথম ব্যাচটি ১৯৬০ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ জুলাই এবং ১১ জুলাইয়ের মধ্যে এসে পৌঁছায়। ৪৪৭ এর পরবর্তী ব্যাচের ১২ থেকে ২০ জুলাই এর মধ্যে আগমন ঘটে। বাকি বাঙালি শরণার্থীর ৩১ জুলাই পরে এসেছিল। জুলাই-সেপ্টেম্বরের সময়, প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়।

আসাম থেকে সংগৃহীত শরণার্থী সংখ্যা
জলপাইগুড়ি জেলা, পশ্চিমবঙ্গে[১৩]
তারিখ সংগৃহীত শরণার্থী সংখ্যা
১৬ জুলাই ১৯৬০ ৯,৩৬৫
১ আগস্ট ১৯৬০ ৮,৯৭৫
২১ আগস্ট ১৯৬০ ১০,০৪৩
২৫ আগস্ট ১৯৬০ ৫০,০০০

প্রতিবাদ[সম্পাদনা]

১৯৬২ সালে বঙাল খেদা বা বাঙালি খেদা আন্দোলনের প্রতিবাদে বাঙালি পল্লি কবি নিবারান পণ্ডিত সেই দিনগুলির কথা নামে কাব্যের একটি সংগ্রহ রচনা করেন।

ভবিষ্যৎ ফল[সম্পাদনা]

১৯৭২-৭৩ ভাষা দাঙ্গা[সম্পাদনা]

১৯৭২ সালে আসামে বড় বড় জাতিগত দাঙ্গা সংঘটিত হয়, যেখানে লক্ষ্য ছিল বেশিরভাগই বাঙালি।[১৪] প্রায় ১৪,০০০ বাঙালি পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্য রাজ্য গুলিতে পালিয়ে যায়।

১৯৭৯-৮০ আক্রমণ[সম্পাদনা]

আসাম বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে বাঙালি সম্প্রদায়কে আক্রমণ করা হয়েছিল। দুলিয়াজানে অয়েল ইন্ডিয়ার সদর দফতরের একটি জন বাঙালি টেকনিক্যাল অফিসার রবি মিত্রের উপর রক্তক্ষয়ী হামলায় বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক দেখা দেয়। ১৯৮৩ সালে, বিদেশি বিতারণ আন্দোলনের নামে আবারও বাঙালিদের উপর আক্রমণ করা হয়। ধমাইজি জেলায়, শালাপাথের অসমীয়া ছাত্রদের দ্বারা পূর্ব নোটিশ ছাড়াই বাঙালিদের ঘর ভাঙচুর করা হয়।[১৫] বাঙালিদের প্রতি অসমীয়া জনগণের ঘৃণার পথ অনুসরণ করে, আদিবাসীরা মেঘালয়তে বাঙালি হিন্দুদের উপর হামলা চালাতে শুরু করে, এবং তাদের চাকরি ও ব্যবসার আধিপত্য রোধ করে। আক্রমণগুলি বেশিরভাগই শিলংতে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৮০ সালে, এক জন বাঙালি হিন্দু বিধায়ক নিহত হন এবং হিন্দু এলাকাগুলি বারংবার নিয়মিত আক্রমণের মধ্য পরে। বেশিরভাগ বাঙালি হিন্দুর উৎসব দুর্গা পূজার আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হামলা হয়েছিল। ১৯৮০ সাল থেকে আনুমানিক ২৫,০০০ থেকে ৩৫,০০০ বাঙালি হিন্দু মেঘালয় ত্যাগ করে এবং পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য অংশে বসতি স্থাপন করে।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Karmakar, Rahul (২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭)। "That Rohingya feeling: NE no stranger to xenophobia, genocides, say experts"Hindustan Times। HT Media। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ 
  2. Ray, Biswajit (২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)। "বাংলার বাইরে বাংলার খোঁজে কয়েক দিন"Anandabazar Patrika (Bengali ভাষায়)। Kolkata: ABP Group। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ 
  3. "'তোমরা ছিলে তাই লেখার সাহস পাই'"Ei Samay (Bengali ভাষায়)। Kolkata: Bennett Coleman। ১৯ মে ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ 
  4. Nag, Sajal (২০১৫)। Nehru and the North East (পিডিএফ)। পৃষ্ঠা 12। আইএসবিএন 978-93-83650-81-1। ১৬ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ অক্টোবর ২০১৭ 
  5. Internal Displacement in South Asia: The Relevance of the UN's Guiding Principles। Sage। ২০০৫। পৃষ্ঠা 150–151। আইএসবিএন 0761933131 
  6. Bhattacharya, Nitish (২৫ জুলাই ২০১৫)। "অসম বাংলাভাষীরও, বুঝতে হবে শাসকদের"Anandabazar Patrika (Bengali ভাষায়)। Kolkata: ABP Group। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ 
  7. India, Census of (১৯৫১)। "Annual Arrival of Refugees in Assam in 1946–1951"। Census of India। XII, Part I (I-A): 353 – web.archive.org-এর মাধ্যমে। 
  8. Datta, Rathin। "A Taste of British Judiciary & infamous 'Bongal Kheda'"TripuraINFOWAY.com। Tripura Infoway News। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ 
  9. Chakravarti, K.C. (৩০ জুলাই ১৯৬০)। "Bongal Kheda Again" (পিডিএফ)The Economic Weekly। Mumbai: Sameeksha Trust: 1193–95। আইএসএসএন 0012-9976। সংগ্রহের তারিখ ৫ মার্চ ২০১৪ 
  10. Chowdhury, Anwar (১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। "যে আগুন ছড়িয়ে গেল..."Daily Ittefaq (Bengali ভাষায়)। Dhaka। ১৬ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জুন ২০১৭ 
  11. "Over 12 lakh hindu left out from NRC"www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৫-১০ 
  12. Bhaumik, Subir (২০০৮)। Samir Kumar Das, সম্পাদক। Blisters on their Feet (পিডিএফ)। Sage। পৃষ্ঠা 303। আইএসবিএন 978-81-7829-819-1। ৫ মার্চ ২০১৪ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ মার্চ ২০১৪ 
  13. Roy, Jagabandhu (জানুয়ারি ২০১৭)। "Demographic Change in North Bengal in 19th and 20th century" (পিডিএফ)North Asian International Research Journal of Social Science & Humanities। Pulwama: North Asian International Research Journal Consortium। 3 (1): 11। আইএসএসএন 2454-9827। সংগ্রহের তারিখ ১৫ অক্টোবর ২০১৭ 
  14. Sekhawat, Vibhuti Singh (২০০৭)। Assam: From Accord to ULFA। Anamika Publishers। পৃষ্ঠা 88। আইএসবিএন 9788179751695। সংগ্রহের তারিখ ৬ মার্চ ২০১৪ 
  15. 'Bearing Witness': The Impact of Conflict on Women in Nagaland and Assam। Centre for North East Studies and Policy Research। ২০১১। পৃষ্ঠা 42। 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]